আজকের পত্রিকা: সরকার বলছে, গরিবমুখী বাজেট হয়েছে। আপনার বক্তব্য কী?
আনু মুহাম্মদ: এবারের বাজেট গণমুখী নয়, সরকারমুখী হয়েছে নিঃসন্দেহে। সরকারের তো একটা উন্নয়ন মডেল আছে। তার একটা প্রতিফলন আছে এই বাজেটে। সেই উন্নয়ন মডেলের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অতি ব্যয়ে মেগা প্রকল্প করা। মেগা প্রকল্প করার জন্য অনেক স্বচ্ছতা থাকতে হয়। এসব মেগা প্রকল্প দিয়ে কী হবে, তার ফলাফল কী হবে—এ নিয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এসব বিষয় নিয়ে জনগণকে জানাতে হয়, তাদের মতামত থাকতে হয়। এগুলোর মধ্য দিয়ে যথাযথ অভিজ্ঞতা নিয়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন মডেলের নামে যেসব মেগা প্রকল্প হচ্ছে, সেগুলো অনেক ব্যয়বহুল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে এসব প্রকল্পে। এরপর এসবের সামাজিক, আর্থিক, পরিবেশগত কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে কোনো ধরনের সমীক্ষার প্রচার জনগণের মধ্যে করা হয়নি। মানুষের কোনো ধরনের ক্ষতি হলে, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। সেই সবের ধারাবাহিকতা এ বাজেটের মধ্যে আছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাছ-বিচারহীনভাবে দেশি ও বিদেশি ঋণ গ্রহণ করার প্রবণতা। সরকারও ঋণ নিচ্ছে আবার প্রাইভেট সেক্টরকে ঋণ করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। সেসব আবার সরকারের দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ করা হচ্ছে। ঋণগ্রস্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? প্রথমত, বেশি ব্যয়ে মেগা প্রকল্প করা হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, বিপুল পরিমাণ সম্পদ বা ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই দুটি কারণে দেশের মধ্যে টাকার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আর সরকার ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণ করছে।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই যে সম্পদ পাচার হচ্ছে, মেগা প্রকল্প হচ্ছে এবং ঋণ করতে হচ্ছে—এর বোঝাটা জনগণকেই টানতে হচ্ছে এবং হবে। যাদের বেশি আয়, তাদের করজালের মধ্যে আনার কোনো চেষ্টা সরকারের মধ্যে নেই। কারণ সরকার তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এ কারণে সরকার সাধারণ জনগণের মধ্যে করজালটা বিস্তার করে। তাদের ওপর কর বাড়ানো, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের এবং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো—এসবের মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর বোঝাটা বাড়ানো হয়। ফলে দেখা যায়, এসবের একটা স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে জনগণের ওপর করের বোঝাটা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন ব্যাংক, ঋণদানকারী সংস্থাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধস নেমেছে। কোনো ধরনের জবাবদিহি এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। যেমন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এমনভাবে সাজানো আছে, তারা সেখানে যা খুশি করতে পারে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হচ্ছে এসবের তদারকি করা, মানে একটা ব্যাংক অনিয়ম করে কি না, তা দেখা। দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম, দুর্নীতি, ঋণের নামে সম্পদ লোপাট করা, সেগুলোকে প্রতিরোধ করার আইন না করে বরং বড় বড় ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আইন পরিবর্তন করছে। আসলে তদারকি করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
ব্যাংক সেক্টরে যে বড় ধরনের লুণ্ঠন হচ্ছে, তার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার একটা সহযোগী ভূমিকা পালন করছে।
এসবের মধ্য দিয়ে সম্পদ কেন্দ্রীভবন হচ্ছে কিছু গোষ্ঠীর হাতে। সেই সব গোষ্ঠীকে আরও পুষ্ট করাই হচ্ছে বর্তমান উন্নয়ন মডেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্যাংক লুট, চুরি, জালিয়াতি ইত্যাদির মাধ্যমে যে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু গোষ্ঠীর হাতে, তাদের আরও পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করা হচ্ছে তার আরও একটা বৈশিষ্ট্য। এ কারণে সমাজের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। গত দশ বছরে সম্পদ কেন্দ্রীভবন এবং বৈষম্যটা অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণটা হচ্ছে সরকারি নীতি এবং তার উন্নয়ন মডেল।
আজকের পত্রিকা: আপনার কথামতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, আবার বৈষম্যও বাড়ছে। ধনবৈষম্য কমানোর সহজ উপায় আছে কি?
আনু মুহাম্মদ: ধনবৈষম্য কমানোর প্রধান উপায় হচ্ছে, স্বচ্ছতা আনা। মেগা প্রকল্প বোঝা তৈরি করবে কেন? আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রেলওয়ে খাত বিপর্যস্ত। রেলওয়ে সারা দেশে সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে সম্প্রসারণ হওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। শিক্ষা খাতে যেমন নতুনভাবে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। পাশাপাশি সরকারি স্কুলগুলোর জীর্ণ দশা। সেসবে যথেষ্ট শিক্ষক নেই।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে লোকবল, ভবনের সংকট। এসব খাতে অনেক বেশি মাত্রায় ব্যয় করা দরকার। কারণ শিক্ষা যদি বাণিজ্যিক না হয়, আর চিকিৎসা যদি জনগণের জন্য সহযোগী হয়, তাহলে জনগণের শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যয়টা কমে আসে। বৈষম্য বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হলো, এই দুই খাতের বাণিজ্যিকীকরণ। পাবলিক পরিবহন বাড়েনি। স্থায়ী কাজের নিশ্চয়তা নেই। পাটশিল্পের বিকাশ যদি হতো, তাহলে শ্রমিকের স্থায়ী কর্মসংস্থান হতো। এসব করলে মানুষের আয়টা ঠিক থাকত। রাষ্ট্র থেকে এসব খাতে নজর দিলে মানুষ উপকৃত হতো। চোরাই টাকার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে। তাই তাদের কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়া বন্ধ না করলে ধনবৈষম্য কমবে না। তার মানে, ধনবৈষম্য কমানোর জন্য, জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাতে বেশি করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
আর ক্ষুদ্র যে গোষ্ঠীটা চোরাই টাকার মালিক হয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছে, তাদের সেই প্রক্রিয়াটা বন্ধ করতে হবে। সরকার তো উল্টো কাজ করছে। জনগণের প্রয়োজনীয় খাতে বেশি ব্যয় বরাদ্দ করছে না। যাদের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এ কারণে ধনবৈষম্যটা বাড়ছে।
আজকের পত্রিকা: নির্বাচনের বছরেও সরকার কেন জনতুষ্টির বাজেট দিল না?
আনু মুহাম্মদ: জনতুষ্টির বাজেট বলে কোনো কথা নেই। সরকার তো জনগণের ওপর নির্ভর করে না। সরকার নির্ভর করে বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর, আর তারাই সবচেয়ে বেশি সংগঠিত। যেমন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন, রিয়েল এস্টেট মালিক অ্যাসোসিয়েশনসহ প্রভৃতি হলো বড় ধনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এ ছাড়া আমলা, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীও আছে। তারাই কিন্তু সরকারি নীতিমালাকে প্রভাবিত করে। তাদের খুশি রাখা সরকার নিজের দায়িত্ব মনে করে।
এরপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে খুশি রাখতে হবে। তাদের চাহিদামতো প্রকল্প নিতে হবে। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের খুশি করছে। বাজেটটা সেভাবেই করা হয়। জনগণকে তুষ্ট করার তো দরকার নেই!
আজকের পত্রিকা: বাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কীভাবে সম্ভব?
আনু মুহাম্মদ: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ব্যবসায়ী শ্রেণি আছে। যেমন খুচরা, পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন এবং তাঁদের একটা চেইন আছে। এই ব্যবসায়ীরা যে পণ্যের দাম বাড়ান, সেটা অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কারণে হয় না। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে খাজনা দিতে হয়। এক শ টাকার জিনিসের জন্য ৩০-৪০ টাকা খাজনা দিতে হয়। পুলিশ, সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকে চাঁদা দিতে হয়। সে কারণে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। যাঁরা খাজনা দেন এবং যারা এভাবে চাঁদাবাজি করে, তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। তারা তো সরকারের লোক। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের তো এসব বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া আছে। পণ্য বাজারের চেইনের চাঁদাবাজির জন্য আসলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এসব তো সরকারের কারণে হয়ে থাকে। তাই বলব, সরকারের কারণেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে।
আর সিন্ডিকেট বলে আলাদা কিছু নেই। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আছে। কিন্তু পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসা বা উৎপাদনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, কিছু গোষ্ঠীর লালে লাল হয়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।
আজকের পত্রিকা: বাজেট তো পাস হয়ে যাবে। তারপর দেশের পরিস্থিতি কেমন হবে?
আনু মুহাম্মদ: বাজেট তো জনগণের চাওয়া-পাওয়ার ওপর সরকার পাস করে না। আর এই সংসদে কোনো নির্বাচিত সংসদ সদস্য নেই। তাই সংসদ সদস্যদেরও জনগণের কাছে জবাবদিহি করার দরকার নেই। সুতরাং যেভাবে গায়ের জোরে দেশ ও অর্থনীতি চলছে, সেভাবেই চলবে। সরকারের উন্নয়নের মডেলের যে ধারাবাহিকতা, সেটাই অব্যাহত থাকবে বাজেটের মধ্য দিয়ে। জনগণের যে দুর্ভোগ, ঋণগ্রস্ততা ও করের বোঝা, এগুলোও বাড়বে।
আজকের পত্রিকা: কোনো সরকারের আমলেই বাজেট প্রশংসিত হয় না। সরকার কেন প্রশংসা পাওয়ার মতো বাজেট দেয় না?
আনু মুহাম্মদ: সরকার যাদের ওপর নির্ভর করে, তাদের তো খুশি করে। সেখানে শ্রেণিগত একটা ভিত্তির ব্যাপার আছে। শ্রেণির চাহিদার ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের ধনিক গোষ্ঠীর একটা চাহিদা আছে, তাদের সেই চাহিদা সরকার পূরণ করছে।
জনগণ সরকারের জন্য কোনো বিষয় না। যাদের ওপর সরকারের ক্ষমতায় থাকা নির্ভর করে, তাদেরই সরকার খুশি করছে। প্রতিবাদ, আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার জন্য সংসদে নির্বাচিত সংসদ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনের প্রতিনিধি থাকলে তা সম্ভব হতো না; বরং রাষ্ট্রনীতির মূল পরিচালিকা শক্তি হওয়ার কথা ছিলেন কৃষক, পোশাকশ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিকেরা। কিন্তু তাঁদের তো কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। আর বাজেট যখন পেশ করা হয়, তখন তো তাঁদের কোনো বক্তব্য নেওয়া হয় না। সব সরকারের আমলে বাজেটের ধরন বা কাঠামোর কোনো হেরফের হয় না। ধরনটা একই থাকে। সেই ধরনের ওপর নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়। তাই গত কয়েক বছরে বৈষম্য বৃদ্ধি, কালোটাকার মালিকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, এগুলোর গতিটা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
আনু মুহাম্মদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: সরকার বলছে, গরিবমুখী বাজেট হয়েছে। আপনার বক্তব্য কী?
আনু মুহাম্মদ: এবারের বাজেট গণমুখী নয়, সরকারমুখী হয়েছে নিঃসন্দেহে। সরকারের তো একটা উন্নয়ন মডেল আছে। তার একটা প্রতিফলন আছে এই বাজেটে। সেই উন্নয়ন মডেলের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অতি ব্যয়ে মেগা প্রকল্প করা। মেগা প্রকল্প করার জন্য অনেক স্বচ্ছতা থাকতে হয়। এসব মেগা প্রকল্প দিয়ে কী হবে, তার ফলাফল কী হবে—এ নিয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এসব বিষয় নিয়ে জনগণকে জানাতে হয়, তাদের মতামত থাকতে হয়। এগুলোর মধ্য দিয়ে যথাযথ অভিজ্ঞতা নিয়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন মডেলের নামে যেসব মেগা প্রকল্প হচ্ছে, সেগুলো অনেক ব্যয়বহুল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে এসব প্রকল্পে। এরপর এসবের সামাজিক, আর্থিক, পরিবেশগত কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে কোনো ধরনের সমীক্ষার প্রচার জনগণের মধ্যে করা হয়নি। মানুষের কোনো ধরনের ক্ষতি হলে, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। সেই সবের ধারাবাহিকতা এ বাজেটের মধ্যে আছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাছ-বিচারহীনভাবে দেশি ও বিদেশি ঋণ গ্রহণ করার প্রবণতা। সরকারও ঋণ নিচ্ছে আবার প্রাইভেট সেক্টরকে ঋণ করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। সেসব আবার সরকারের দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ করা হচ্ছে। ঋণগ্রস্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? প্রথমত, বেশি ব্যয়ে মেগা প্রকল্প করা হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, বিপুল পরিমাণ সম্পদ বা ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই দুটি কারণে দেশের মধ্যে টাকার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আর সরকার ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণ করছে।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই যে সম্পদ পাচার হচ্ছে, মেগা প্রকল্প হচ্ছে এবং ঋণ করতে হচ্ছে—এর বোঝাটা জনগণকেই টানতে হচ্ছে এবং হবে। যাদের বেশি আয়, তাদের করজালের মধ্যে আনার কোনো চেষ্টা সরকারের মধ্যে নেই। কারণ সরকার তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এ কারণে সরকার সাধারণ জনগণের মধ্যে করজালটা বিস্তার করে। তাদের ওপর কর বাড়ানো, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের এবং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো—এসবের মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর বোঝাটা বাড়ানো হয়। ফলে দেখা যায়, এসবের একটা স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে জনগণের ওপর করের বোঝাটা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন ব্যাংক, ঋণদানকারী সংস্থাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধস নেমেছে। কোনো ধরনের জবাবদিহি এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। যেমন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এমনভাবে সাজানো আছে, তারা সেখানে যা খুশি করতে পারে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হচ্ছে এসবের তদারকি করা, মানে একটা ব্যাংক অনিয়ম করে কি না, তা দেখা। দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম, দুর্নীতি, ঋণের নামে সম্পদ লোপাট করা, সেগুলোকে প্রতিরোধ করার আইন না করে বরং বড় বড় ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আইন পরিবর্তন করছে। আসলে তদারকি করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
ব্যাংক সেক্টরে যে বড় ধরনের লুণ্ঠন হচ্ছে, তার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার একটা সহযোগী ভূমিকা পালন করছে।
এসবের মধ্য দিয়ে সম্পদ কেন্দ্রীভবন হচ্ছে কিছু গোষ্ঠীর হাতে। সেই সব গোষ্ঠীকে আরও পুষ্ট করাই হচ্ছে বর্তমান উন্নয়ন মডেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্যাংক লুট, চুরি, জালিয়াতি ইত্যাদির মাধ্যমে যে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু গোষ্ঠীর হাতে, তাদের আরও পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করা হচ্ছে তার আরও একটা বৈশিষ্ট্য। এ কারণে সমাজের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। গত দশ বছরে সম্পদ কেন্দ্রীভবন এবং বৈষম্যটা অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণটা হচ্ছে সরকারি নীতি এবং তার উন্নয়ন মডেল।
আজকের পত্রিকা: আপনার কথামতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, আবার বৈষম্যও বাড়ছে। ধনবৈষম্য কমানোর সহজ উপায় আছে কি?
আনু মুহাম্মদ: ধনবৈষম্য কমানোর প্রধান উপায় হচ্ছে, স্বচ্ছতা আনা। মেগা প্রকল্প বোঝা তৈরি করবে কেন? আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রেলওয়ে খাত বিপর্যস্ত। রেলওয়ে সারা দেশে সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে সম্প্রসারণ হওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। শিক্ষা খাতে যেমন নতুনভাবে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। পাশাপাশি সরকারি স্কুলগুলোর জীর্ণ দশা। সেসবে যথেষ্ট শিক্ষক নেই।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে লোকবল, ভবনের সংকট। এসব খাতে অনেক বেশি মাত্রায় ব্যয় করা দরকার। কারণ শিক্ষা যদি বাণিজ্যিক না হয়, আর চিকিৎসা যদি জনগণের জন্য সহযোগী হয়, তাহলে জনগণের শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যয়টা কমে আসে। বৈষম্য বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হলো, এই দুই খাতের বাণিজ্যিকীকরণ। পাবলিক পরিবহন বাড়েনি। স্থায়ী কাজের নিশ্চয়তা নেই। পাটশিল্পের বিকাশ যদি হতো, তাহলে শ্রমিকের স্থায়ী কর্মসংস্থান হতো। এসব করলে মানুষের আয়টা ঠিক থাকত। রাষ্ট্র থেকে এসব খাতে নজর দিলে মানুষ উপকৃত হতো। চোরাই টাকার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে। তাই তাদের কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়া বন্ধ না করলে ধনবৈষম্য কমবে না। তার মানে, ধনবৈষম্য কমানোর জন্য, জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাতে বেশি করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
আর ক্ষুদ্র যে গোষ্ঠীটা চোরাই টাকার মালিক হয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছে, তাদের সেই প্রক্রিয়াটা বন্ধ করতে হবে। সরকার তো উল্টো কাজ করছে। জনগণের প্রয়োজনীয় খাতে বেশি ব্যয় বরাদ্দ করছে না। যাদের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এ কারণে ধনবৈষম্যটা বাড়ছে।
আজকের পত্রিকা: নির্বাচনের বছরেও সরকার কেন জনতুষ্টির বাজেট দিল না?
আনু মুহাম্মদ: জনতুষ্টির বাজেট বলে কোনো কথা নেই। সরকার তো জনগণের ওপর নির্ভর করে না। সরকার নির্ভর করে বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর, আর তারাই সবচেয়ে বেশি সংগঠিত। যেমন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন, রিয়েল এস্টেট মালিক অ্যাসোসিয়েশনসহ প্রভৃতি হলো বড় ধনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এ ছাড়া আমলা, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীও আছে। তারাই কিন্তু সরকারি নীতিমালাকে প্রভাবিত করে। তাদের খুশি রাখা সরকার নিজের দায়িত্ব মনে করে।
এরপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে খুশি রাখতে হবে। তাদের চাহিদামতো প্রকল্প নিতে হবে। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের খুশি করছে। বাজেটটা সেভাবেই করা হয়। জনগণকে তুষ্ট করার তো দরকার নেই!
আজকের পত্রিকা: বাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কীভাবে সম্ভব?
আনু মুহাম্মদ: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ব্যবসায়ী শ্রেণি আছে। যেমন খুচরা, পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন এবং তাঁদের একটা চেইন আছে। এই ব্যবসায়ীরা যে পণ্যের দাম বাড়ান, সেটা অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কারণে হয় না। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে খাজনা দিতে হয়। এক শ টাকার জিনিসের জন্য ৩০-৪০ টাকা খাজনা দিতে হয়। পুলিশ, সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকে চাঁদা দিতে হয়। সে কারণে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। যাঁরা খাজনা দেন এবং যারা এভাবে চাঁদাবাজি করে, তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। তারা তো সরকারের লোক। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের তো এসব বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া আছে। পণ্য বাজারের চেইনের চাঁদাবাজির জন্য আসলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এসব তো সরকারের কারণে হয়ে থাকে। তাই বলব, সরকারের কারণেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে।
আর সিন্ডিকেট বলে আলাদা কিছু নেই। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আছে। কিন্তু পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসা বা উৎপাদনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, কিছু গোষ্ঠীর লালে লাল হয়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।
আজকের পত্রিকা: বাজেট তো পাস হয়ে যাবে। তারপর দেশের পরিস্থিতি কেমন হবে?
আনু মুহাম্মদ: বাজেট তো জনগণের চাওয়া-পাওয়ার ওপর সরকার পাস করে না। আর এই সংসদে কোনো নির্বাচিত সংসদ সদস্য নেই। তাই সংসদ সদস্যদেরও জনগণের কাছে জবাবদিহি করার দরকার নেই। সুতরাং যেভাবে গায়ের জোরে দেশ ও অর্থনীতি চলছে, সেভাবেই চলবে। সরকারের উন্নয়নের মডেলের যে ধারাবাহিকতা, সেটাই অব্যাহত থাকবে বাজেটের মধ্য দিয়ে। জনগণের যে দুর্ভোগ, ঋণগ্রস্ততা ও করের বোঝা, এগুলোও বাড়বে।
আজকের পত্রিকা: কোনো সরকারের আমলেই বাজেট প্রশংসিত হয় না। সরকার কেন প্রশংসা পাওয়ার মতো বাজেট দেয় না?
আনু মুহাম্মদ: সরকার যাদের ওপর নির্ভর করে, তাদের তো খুশি করে। সেখানে শ্রেণিগত একটা ভিত্তির ব্যাপার আছে। শ্রেণির চাহিদার ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের ধনিক গোষ্ঠীর একটা চাহিদা আছে, তাদের সেই চাহিদা সরকার পূরণ করছে।
জনগণ সরকারের জন্য কোনো বিষয় না। যাদের ওপর সরকারের ক্ষমতায় থাকা নির্ভর করে, তাদেরই সরকার খুশি করছে। প্রতিবাদ, আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার জন্য সংসদে নির্বাচিত সংসদ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনের প্রতিনিধি থাকলে তা সম্ভব হতো না; বরং রাষ্ট্রনীতির মূল পরিচালিকা শক্তি হওয়ার কথা ছিলেন কৃষক, পোশাকশ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিকেরা। কিন্তু তাঁদের তো কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। আর বাজেট যখন পেশ করা হয়, তখন তো তাঁদের কোনো বক্তব্য নেওয়া হয় না। সব সরকারের আমলে বাজেটের ধরন বা কাঠামোর কোনো হেরফের হয় না। ধরনটা একই থাকে। সেই ধরনের ওপর নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়। তাই গত কয়েক বছরে বৈষম্য বৃদ্ধি, কালোটাকার মালিকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, এগুলোর গতিটা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
আনু মুহাম্মদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে