জাহীদ রেজা নূর
সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অবিশ্বাস্য আনন্দের জন্ম দিয়ে আমাদের মেয়েরা যেদিন ঢাকায় ফিরে এলেন, সেদিন বাফুফের প্রধান কাজী সালাউদ্দিনের একটা কথা ভেসে বেড়াতে লাগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংবাদ সম্মেলনে হাস্যকর কিছু কথা বলেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। তিনি নাকি তিনবার নেপালে যাওয়ার জন্য টিকিট করেছেন, কিন্তু তিনি নেপালে তাঁর উপস্থিতিতে মেয়েরা নাকি বাড়তি চাপ অনুভব করতেন। আর এই চাপ মেয়েদের খেলাকে ব্যাহত করত। এ কারণেই নাকি তিনি নেপালে যাননি।
বাফুফে সভাপতি আবার সাফেরও সভাপতি। ফলে ট্রফি তো তাঁর হাত থেকেই মেয়েরা নেবেন। কিন্তু মেয়েদের বাড়তি চাপ না দেওয়ার জন্য তিনি যাননি নেপালে।স্বভাবতই বাফুফে প্রধানের এ কথা নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কে কার আগে নিজের অনুভূতি জানাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা প্রতিক্রিয়া দেননি, তাঁদের সিংহভাগও বাফুফে সভাপতির বক্তব্যে কষ্ট পেয়েছেন। আসলে আমাদের নারীরা উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই শত প্রতিকূলতা ঠেলে যেভাবে নিজেদের প্রমাণ করছেন বারবার, তাতে আমাদের বাফুফে সভাপতির কোনো অবদান আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে ফুটবল খেলে নারী ও পুরুষ যে আয় করেন, সেই আয়ের বৈষম্যই তো বলে দেয়, আসলে আমাদের মেয়েদের সাফল্যের পেছনে সেই মেয়েদেরই মেধা, পরিশ্রম এবং প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার জেদটা কাজ করেছে বেশি, তুলনায় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তুচ্ছ।
মেয়েরা নেপাল থেকে দেশে ফিরে আসার পর ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার জন্য ভরে গেল বিমানবন্দর, ভরে গেল বাফুফের সংবাদ সম্মেলন। বিমানবন্দরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদচারণে ঢাকা পড়ে গেলেন মেয়েরা, মালা পরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন সংগঠকের দল, বাফুফের সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারগুলো দখল করে নিলেন পৃষ্ঠপোষকেরাই। চেয়ার থেকে উঠিয়ে দেওয়া হলো নারী ফুটবল দলের কোচ ও অধিনায়ককে। এই রুচিহীনতাই প্রমাণ করে, কেন আসলে আমাদের খেলাধুলা এ রকম কাদার মধ্যে পড়েছে।
দুই. ঘটনার উল্টো দিকও আছে। যেকোনো বিষয়েই অতি আবেগ বস্তুনিষ্ঠতাকে ম্লান করে দেয়। আবেগের ঘায়ে সত্য পালায়। আমাদের সমাজজীবনে আবেগের ঘনঘটা নতুন এক সত্যের জন্ম দিচ্ছে। এ সত্য বড়ই লজ্জার। যে কেউ যে কাউকে যুক্তিহীনভাবে আঘাত করতে পারবে, কিন্তু তার দায় নেবে না। কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কথা বলে দিয়েই যেন মুক্তি। এ কথাগুলো যদি আসে এমন কারও মুখ থেকে, যিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিংবা যাঁকে শ্রদ্ধা করে আমজনতা, তাহলে তিনি ভুল তথ্য ছড়িয়ে যতটা ক্ষতি করতে পারেন, তা কোনো পরিমাপেই ধরা যায় না।
অনেকের মতো, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হঠাৎ করে কাজী সালাউদ্দিনের নামে ছড়িয়ে পড়া একটি ট্রল শেয়ার করে নিজেই কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে অবমাননাকর কিছু কথা লিখে দিয়েছিলেন। বাফুফে নাকি মেয়েদের বিয়ের খরচ বহন করবে, এ রকম ছিল ট্রলের ভাষা। যেকোনো স্বাভাবিক বিচারেই এটা বোঝা কঠিন নয় যে বাফুফে সভাপতি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। এ কথা ভেবে আমি স্ট্যাটাসটিতে অনেকটা এ ধরনের মন্তব্য করেছিলাম, ‘কাজী সালাউদ্দিন কি সত্যিই এ রকম কথা বলেছেন? কথাটা কি ভ্যারিফাই করা হয়েছে?’
উত্তরে পোস্টদাতা বলেছেন, তিনি ভ্যারিফাই করেননি। আমি চাইলে ভ্যারিফাই করে তাঁকে জানাতে পারি।একজন মানুষ কোনো কথা বলেছেন কি বলেননি, সেটা যাচাই না করেই ফেসবুকে দিচ্ছেন, আবার সেটা প্রমাণ করার দায়িত্বও তাঁর নয়, এ রকম কথা বলে দিচ্ছেন তাঁরাও, যাঁদের প্রতি আস্থা রাখতে চায় মানুষ!
পরে যখন প্রমাণ হলো, সালাউদ্দিন এ রকম কোনো কথা বলেননি, সেই ব্যক্তি তখন ফেসবুক পোস্ট দিলেন যে তিনি স্ট্যাটাসটি প্রত্যাহার করে নিলেন এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ক্ষমাও চাইলেন না। শুধু প্রত্যাহার করে নেওয়াই যেন তাঁর মহানুভবতার প্রকাশ। এরই মধ্যে তাঁর ছড়ানো হাস্যরসে যে অগণিত মানুষ মন মজাল এবং যিনি যা ঘটাননি, তাঁকে সেই ঘটনায় দোষী করল, এই দায় কে নেবে? মানসিক এই বন্ধ্যত্বকেও তাহলে বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ গড়ে ওঠা শুরু হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে!
তিন. আমরা যে ক্রমেই চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি, সেটা নিজেরাই বুঝতে পারছি না। যেকোনো বিষয়ে নিজেদের মতামত দেওয়ার জন্য সবাই যেন উদগ্রীব হয়ে আছে। কী বলবে, তা নিয়ে ভাবছেও না। বলে ফেলছে দ্রুত। কোনো ঘটনা ঘটার পর তা বুঝে নিয়ে যুক্তিসংগত মন্তব্য না করে গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দিচ্ছে নিজেকে। সব বিষয়ে সবারই মতামত কেন দিতে হচ্ছে? না দিলে কি পিছিয়ে পড়বে মানুষ? অন্যদের চোখে হেয় হয়ে যাবে?
এই তো কদিন ধরে মরিয়ম নামের একটি মেয়ে ছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এক মাস ধরে মাকে খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়ার বাড়ি থেকে পানি তুলতে গিয়ে মরিয়ম মান্নানের মা কি তবে গুম হয়েছিলেন? ক্রন্দনরত মরিয়মের ছবি হাহাকার তুলেছিল মানুষের হৃদয়ে। একসময় ময়মনসিংহে একটি বস্তাবন্দী লাশের সন্ধান পাওয়ার পর মরিয়ম নিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন, এটা তাঁর মায়েরই লাশ। অথচ তাঁর মা রহিমা বেগমকে ফরিদপুর থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন।
মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম কেন স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন, তাঁর চার মেয়ে কেন অন্য একটি লাশকেই তাঁদের মায়ের লাশ বলে শনাক্ত করেছিলেন, জমিজমা-সংক্রান্ত কোনো ঘাপলা আছে কি না—সে রহস্যও একসময় উদ্ঘাটিত হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু মরিয়মের আহাজারির পর কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা যখন ‘গুম’ শব্দটির নানাবিধ ব্যবহার করছিলেন এবং ইঙ্গিত করছিলেন এর সঙ্গে সরকারি সংশ্লিষ্টতার, তখন বুঝতে হবে, যে চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার কথা বলছিলাম, এই হচ্ছে সেই চোরাবালি। যেকোনো বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে শক্ত ভিতে পা পড়ে না। তখনই চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক এবং অর্থনীতিতে পড়া আরেকজন মেধাবী সাংবাদিকের ফেসবুক দেয়ালেও মরিয়মকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট দেখেছি। আজ তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গিয়ে দেখি, তাঁরা সেই পোস্ট উধাও করে দিয়েছেন!
চার. ‘ধীরে চলো’ নীতিটা এখন আর কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। এখন তো সবাই শিক্ষক, শিক্ষার্থী কেউ নেই। তাই সবাই একই সঙ্গে শিক্ষা দিতে থাকেন। নিজের মনে যা আছে, সেটাই বলতে থাকেন। তাতে যুক্তি থাকল কি থাকল না, সেটা বড় কোনো ব্যাপার নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ইচ্ছে তা-ই লেখার অধিকার কী করে জন্মাচ্ছে, সেটাও তো দেখা দরকার। রাজনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক জীবন—সবটাই দখল করে নিচ্ছে পেশিশক্তি। যেদিকে তাকায় মানুষ, সেদিকেই দেখতে পায় ক্ষমতাবানদের আস্ফালন। তখন নিজেকে হেয় মনে হতে থাকে। মানুষ মনের সে জ্বালা জুড়ায় ফেসবুক বা অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যমে এসে।
তাই বলে ফেসবুকে কি শুধুই যুক্তিহীন কথকতার চাষবাস হয়? একেবারেই নয়। গত কয়েক বছরে সরকারি মহলেও এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপে পড়ে। সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। সংবাদপত্রে কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এমন কোনো সুগভীর ভাবনারও তো প্রকাশ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ নির্ভর করবে কার ওপর? কোথাও তো জ্ঞানচর্চা বা জ্ঞান সৃষ্টির কাজটা হচ্ছে না। ফলে মাথায় যদি মধ্যযুগ এসে স্থায়ী আসন গাড়তে চায়, হাজার বছর আগের জীবনযাপন পদ্ধতিকে আজকের জীবনের মধ্যে জোর করে প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে যেমন বিপদ, তেমনি বিপদ কোনো রাজনৈতিক মতবাদকে একমাত্র মতবাদ হিসেবে অন্যকে মানতে বাধ্য করার প্রবণতার প্রসার ঘটলে।
যেহেতু যৌক্তিকভাবে কোনো আলোচনায় বসার সুযোগ নেই, সেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যার স্বাধীন মত প্রকাশ করতে থাকে। ফেসবুক গভীর ভাবনার প্রকাশক নয়। যার মনে যা আছে, তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সেখানে। সেটাই সংগত। কিন্তু ‘যার মন’ বলে যা বলা হচ্ছে, সেই মনগুলোকে ঠিকপথে চালিত করার জন্য যে শিক্ষার আবহ গড়ে তোলা দরকার ছিল, সেটা কেন গড়ে উঠল না বা যেটুকু ছিল, সেটুকুও কেন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, সেটাও তো ভাবা দরকার। শেষ একটা কথা বলি। এ নিয়ে ভাবতে পারেন। আমাদের দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কি শুধু ধর্মব্যবসায়ীরাই দায়ী? যাঁরা এই ধর্ম-উন্মাদনাকে সহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যেতে পারতেন, তাঁরা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলেন? এ প্রশ্নটির যৌক্তিক কোনো উত্তর দেওয়া গেলেই বোঝা যাবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন এত অস্থিরতা!
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা
সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অবিশ্বাস্য আনন্দের জন্ম দিয়ে আমাদের মেয়েরা যেদিন ঢাকায় ফিরে এলেন, সেদিন বাফুফের প্রধান কাজী সালাউদ্দিনের একটা কথা ভেসে বেড়াতে লাগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংবাদ সম্মেলনে হাস্যকর কিছু কথা বলেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। তিনি নাকি তিনবার নেপালে যাওয়ার জন্য টিকিট করেছেন, কিন্তু তিনি নেপালে তাঁর উপস্থিতিতে মেয়েরা নাকি বাড়তি চাপ অনুভব করতেন। আর এই চাপ মেয়েদের খেলাকে ব্যাহত করত। এ কারণেই নাকি তিনি নেপালে যাননি।
বাফুফে সভাপতি আবার সাফেরও সভাপতি। ফলে ট্রফি তো তাঁর হাত থেকেই মেয়েরা নেবেন। কিন্তু মেয়েদের বাড়তি চাপ না দেওয়ার জন্য তিনি যাননি নেপালে।স্বভাবতই বাফুফে প্রধানের এ কথা নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কে কার আগে নিজের অনুভূতি জানাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা প্রতিক্রিয়া দেননি, তাঁদের সিংহভাগও বাফুফে সভাপতির বক্তব্যে কষ্ট পেয়েছেন। আসলে আমাদের নারীরা উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই শত প্রতিকূলতা ঠেলে যেভাবে নিজেদের প্রমাণ করছেন বারবার, তাতে আমাদের বাফুফে সভাপতির কোনো অবদান আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে ফুটবল খেলে নারী ও পুরুষ যে আয় করেন, সেই আয়ের বৈষম্যই তো বলে দেয়, আসলে আমাদের মেয়েদের সাফল্যের পেছনে সেই মেয়েদেরই মেধা, পরিশ্রম এবং প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার জেদটা কাজ করেছে বেশি, তুলনায় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তুচ্ছ।
মেয়েরা নেপাল থেকে দেশে ফিরে আসার পর ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার জন্য ভরে গেল বিমানবন্দর, ভরে গেল বাফুফের সংবাদ সম্মেলন। বিমানবন্দরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদচারণে ঢাকা পড়ে গেলেন মেয়েরা, মালা পরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন সংগঠকের দল, বাফুফের সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারগুলো দখল করে নিলেন পৃষ্ঠপোষকেরাই। চেয়ার থেকে উঠিয়ে দেওয়া হলো নারী ফুটবল দলের কোচ ও অধিনায়ককে। এই রুচিহীনতাই প্রমাণ করে, কেন আসলে আমাদের খেলাধুলা এ রকম কাদার মধ্যে পড়েছে।
দুই. ঘটনার উল্টো দিকও আছে। যেকোনো বিষয়েই অতি আবেগ বস্তুনিষ্ঠতাকে ম্লান করে দেয়। আবেগের ঘায়ে সত্য পালায়। আমাদের সমাজজীবনে আবেগের ঘনঘটা নতুন এক সত্যের জন্ম দিচ্ছে। এ সত্য বড়ই লজ্জার। যে কেউ যে কাউকে যুক্তিহীনভাবে আঘাত করতে পারবে, কিন্তু তার দায় নেবে না। কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কথা বলে দিয়েই যেন মুক্তি। এ কথাগুলো যদি আসে এমন কারও মুখ থেকে, যিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিংবা যাঁকে শ্রদ্ধা করে আমজনতা, তাহলে তিনি ভুল তথ্য ছড়িয়ে যতটা ক্ষতি করতে পারেন, তা কোনো পরিমাপেই ধরা যায় না।
অনেকের মতো, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হঠাৎ করে কাজী সালাউদ্দিনের নামে ছড়িয়ে পড়া একটি ট্রল শেয়ার করে নিজেই কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে অবমাননাকর কিছু কথা লিখে দিয়েছিলেন। বাফুফে নাকি মেয়েদের বিয়ের খরচ বহন করবে, এ রকম ছিল ট্রলের ভাষা। যেকোনো স্বাভাবিক বিচারেই এটা বোঝা কঠিন নয় যে বাফুফে সভাপতি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। এ কথা ভেবে আমি স্ট্যাটাসটিতে অনেকটা এ ধরনের মন্তব্য করেছিলাম, ‘কাজী সালাউদ্দিন কি সত্যিই এ রকম কথা বলেছেন? কথাটা কি ভ্যারিফাই করা হয়েছে?’
উত্তরে পোস্টদাতা বলেছেন, তিনি ভ্যারিফাই করেননি। আমি চাইলে ভ্যারিফাই করে তাঁকে জানাতে পারি।একজন মানুষ কোনো কথা বলেছেন কি বলেননি, সেটা যাচাই না করেই ফেসবুকে দিচ্ছেন, আবার সেটা প্রমাণ করার দায়িত্বও তাঁর নয়, এ রকম কথা বলে দিচ্ছেন তাঁরাও, যাঁদের প্রতি আস্থা রাখতে চায় মানুষ!
পরে যখন প্রমাণ হলো, সালাউদ্দিন এ রকম কোনো কথা বলেননি, সেই ব্যক্তি তখন ফেসবুক পোস্ট দিলেন যে তিনি স্ট্যাটাসটি প্রত্যাহার করে নিলেন এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ক্ষমাও চাইলেন না। শুধু প্রত্যাহার করে নেওয়াই যেন তাঁর মহানুভবতার প্রকাশ। এরই মধ্যে তাঁর ছড়ানো হাস্যরসে যে অগণিত মানুষ মন মজাল এবং যিনি যা ঘটাননি, তাঁকে সেই ঘটনায় দোষী করল, এই দায় কে নেবে? মানসিক এই বন্ধ্যত্বকেও তাহলে বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ গড়ে ওঠা শুরু হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে!
তিন. আমরা যে ক্রমেই চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি, সেটা নিজেরাই বুঝতে পারছি না। যেকোনো বিষয়ে নিজেদের মতামত দেওয়ার জন্য সবাই যেন উদগ্রীব হয়ে আছে। কী বলবে, তা নিয়ে ভাবছেও না। বলে ফেলছে দ্রুত। কোনো ঘটনা ঘটার পর তা বুঝে নিয়ে যুক্তিসংগত মন্তব্য না করে গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দিচ্ছে নিজেকে। সব বিষয়ে সবারই মতামত কেন দিতে হচ্ছে? না দিলে কি পিছিয়ে পড়বে মানুষ? অন্যদের চোখে হেয় হয়ে যাবে?
এই তো কদিন ধরে মরিয়ম নামের একটি মেয়ে ছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এক মাস ধরে মাকে খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়ার বাড়ি থেকে পানি তুলতে গিয়ে মরিয়ম মান্নানের মা কি তবে গুম হয়েছিলেন? ক্রন্দনরত মরিয়মের ছবি হাহাকার তুলেছিল মানুষের হৃদয়ে। একসময় ময়মনসিংহে একটি বস্তাবন্দী লাশের সন্ধান পাওয়ার পর মরিয়ম নিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন, এটা তাঁর মায়েরই লাশ। অথচ তাঁর মা রহিমা বেগমকে ফরিদপুর থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন।
মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম কেন স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন, তাঁর চার মেয়ে কেন অন্য একটি লাশকেই তাঁদের মায়ের লাশ বলে শনাক্ত করেছিলেন, জমিজমা-সংক্রান্ত কোনো ঘাপলা আছে কি না—সে রহস্যও একসময় উদ্ঘাটিত হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু মরিয়মের আহাজারির পর কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা যখন ‘গুম’ শব্দটির নানাবিধ ব্যবহার করছিলেন এবং ইঙ্গিত করছিলেন এর সঙ্গে সরকারি সংশ্লিষ্টতার, তখন বুঝতে হবে, যে চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার কথা বলছিলাম, এই হচ্ছে সেই চোরাবালি। যেকোনো বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে শক্ত ভিতে পা পড়ে না। তখনই চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক এবং অর্থনীতিতে পড়া আরেকজন মেধাবী সাংবাদিকের ফেসবুক দেয়ালেও মরিয়মকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট দেখেছি। আজ তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গিয়ে দেখি, তাঁরা সেই পোস্ট উধাও করে দিয়েছেন!
চার. ‘ধীরে চলো’ নীতিটা এখন আর কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। এখন তো সবাই শিক্ষক, শিক্ষার্থী কেউ নেই। তাই সবাই একই সঙ্গে শিক্ষা দিতে থাকেন। নিজের মনে যা আছে, সেটাই বলতে থাকেন। তাতে যুক্তি থাকল কি থাকল না, সেটা বড় কোনো ব্যাপার নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ইচ্ছে তা-ই লেখার অধিকার কী করে জন্মাচ্ছে, সেটাও তো দেখা দরকার। রাজনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক জীবন—সবটাই দখল করে নিচ্ছে পেশিশক্তি। যেদিকে তাকায় মানুষ, সেদিকেই দেখতে পায় ক্ষমতাবানদের আস্ফালন। তখন নিজেকে হেয় মনে হতে থাকে। মানুষ মনের সে জ্বালা জুড়ায় ফেসবুক বা অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যমে এসে।
তাই বলে ফেসবুকে কি শুধুই যুক্তিহীন কথকতার চাষবাস হয়? একেবারেই নয়। গত কয়েক বছরে সরকারি মহলেও এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপে পড়ে। সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। সংবাদপত্রে কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এমন কোনো সুগভীর ভাবনারও তো প্রকাশ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ নির্ভর করবে কার ওপর? কোথাও তো জ্ঞানচর্চা বা জ্ঞান সৃষ্টির কাজটা হচ্ছে না। ফলে মাথায় যদি মধ্যযুগ এসে স্থায়ী আসন গাড়তে চায়, হাজার বছর আগের জীবনযাপন পদ্ধতিকে আজকের জীবনের মধ্যে জোর করে প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে যেমন বিপদ, তেমনি বিপদ কোনো রাজনৈতিক মতবাদকে একমাত্র মতবাদ হিসেবে অন্যকে মানতে বাধ্য করার প্রবণতার প্রসার ঘটলে।
যেহেতু যৌক্তিকভাবে কোনো আলোচনায় বসার সুযোগ নেই, সেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যার স্বাধীন মত প্রকাশ করতে থাকে। ফেসবুক গভীর ভাবনার প্রকাশক নয়। যার মনে যা আছে, তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সেখানে। সেটাই সংগত। কিন্তু ‘যার মন’ বলে যা বলা হচ্ছে, সেই মনগুলোকে ঠিকপথে চালিত করার জন্য যে শিক্ষার আবহ গড়ে তোলা দরকার ছিল, সেটা কেন গড়ে উঠল না বা যেটুকু ছিল, সেটুকুও কেন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, সেটাও তো ভাবা দরকার। শেষ একটা কথা বলি। এ নিয়ে ভাবতে পারেন। আমাদের দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কি শুধু ধর্মব্যবসায়ীরাই দায়ী? যাঁরা এই ধর্ম-উন্মাদনাকে সহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যেতে পারতেন, তাঁরা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলেন? এ প্রশ্নটির যৌক্তিক কোনো উত্তর দেওয়া গেলেই বোঝা যাবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন এত অস্থিরতা!
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে