নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
গত রোববার রাতে মাথা ও বুকে হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলেন নারায়ণগঞ্জের সাহানা বেগম। তাঁকে প্রথমে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের বেসরকারি একটি হাসপাতালে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মস্তিষ্কের জটিলতা ধারণা করে সেখানকার চিকিৎসকেরা সাহানাকে পাঠান রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে। নিউরোসায়েন্সেসের চিকিৎসকেরা হৃদ্যন্ত্রের জটিলতার কথা জানিয়ে তাঁকে আবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে পাঠান। সেখানকার চিকিৎসকেরা বলেন, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী সাহানা অনেকগুলো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। ফলে তাঁকে পাঠানো হয় পাশের সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
অচেতন মধ্যবয়সী সাহানা বেগমকে নিয়ে এভাবে এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে ছুটেছেন তাঁর ছেলেরা। সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে তাঁকে বহির্বিভাগে পাঠানো হয়। বহির্বিভাগের চিকিৎসক কয়েকটি পরীক্ষার নির্দেশনা দেন।
জানা যায়, সেগুলোর ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে বিকেল পর্যন্ত। এরপর মিলবে ভর্তির নির্দেশনা। ৬ ঘণ্টার বেশি সময় বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দুপুর ১২টায়ও চিকিৎসা শুরু হয়নি সাহানার। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে নারায়ণগঞ্জে ফিরিয়ে নিয়ে যান স্বজনেরা।
সাহানা বেগমের ভাতিজা মো. সেলিম চিকিৎসা ছাড়াই তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় আজকের পত্রিকাকে এ বিষয়ে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পাঠাল। এখানে তিনটি বড় হাসপাতাল ঘুরেছি। কিন্তু কেউ চিকিৎসা শুরুই করেনি। আমার চাচি এখনো অচেতন। তাঁর ঠিক কী হয়েছে, তাই এখনো জানি না। আমরা নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাচ্ছি। সেখানকার বেসরকারি হাসপাতালেই তাঁর চিকিৎসা করাব।’
রাজধানীতে অবস্থিত দেশের প্রধান বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ ধরনের ঘটনা মোটেই বিরল নয়। গত রবি ও গতকাল সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট (এনআইকেডিইউ), জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল (এনআইসিভিডি) ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘুরে অব্যবস্থাপনা, সেবার ঘাটতি ও রোগীদের অসন্তুষ্টির বিভিন্ন চিত্র দেখা যায়। কর্তৃপক্ষ এ জন্য অতিরিক্ত রোগীর চাপ এবং পুঞ্জীভূত সমস্যার কথা বললেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ব্যবস্থাপনার ত্রুটি একটি বড় কারণ।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বাভাবিকের চেয়ে দুই মাস ধরে রোগীদের ভিড় বেড়েছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী সেবা নিতে আসছে এখন। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে শয্যাসংখ্যা এক হাজার ২৫০ হলেও নিয়মিতভাবে পৌনে দুই হাজারের কাছাকাছি রোগী ভর্তি থাকে। তাঁরা বলছেন, সেবার সংখ্যা এবং পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
হাসপাতালের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা যায়, রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ব্যবস্থাপনা সেই বরাবরের মতোই। একজন রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হলে টিকিট নিয়ে যেতে হয় কয়েকটি জায়গায়। এতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ার পাশাপাশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেবাপ্রত্যাশীদের। দেখা গেল, অন্তর্বিভাগ এবং বহির্বিভাগের রোগীদের একই কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে হয়। হাসপাতাল থেকে সরকারি ওষুধ পাওয়ার প্রক্রিয়াও মসৃণ নয়।
দেশের সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালের বহির্বিভাগে সব ধরনের চিকিৎসা ও পরীক্ষা সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত চলে। তবে টিকিট দেওয়া হয় দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
দিনাজপুর থেকে বুকের হাড়ের ব্যথা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছেন সুজন হাওলাদার (২৫)। তিনি জানান, অর্থোপেডিক চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসক তাঁকে সময় দিয়েছেন মাত্র দেড় মিনিট। হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে তাঁকে তিন দিনের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। পটুয়াখালীর ইমরান মাহমুদের মা যক্ষ্মার সঙ্গে মস্তিষ্কের জটিলতার জন্য দুই মাস নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ছিলেন। গত শনিবার মাকে সোহরাওয়ার্দীতে নিয়ে এসেছেন ইমরান। এখানকার চিকিৎসকেরা তাঁর মায়ের স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি বিশদে বুঝিয়ে বলেননি। এতে উদ্বেগে রয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ১ হাজার ৩৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তির হার ১৫০ শতাংশ, অর্থাৎ সক্ষমতার দেড় গুণ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে আড়াই লাখের বেশি মানুষ। আর ভর্তি হয়েছে ৪১ হাজার।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। জনবল এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও আগের চেয়ে সেবার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো হয়রানির ঘটনা ঘটলে তার সমাধান করা হচ্ছে।’
গত রোববার মায়ের চিকিৎসার জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে এসেছেন শাহিন আলম। চিকিৎসক পায়ের রক্তনালিতে জটিলতার কথা জানিয়ে হৃদ্যন্ত্র ও পায়ের রক্তনালির দুটি পরীক্ষা করতে বলেছেন। পরীক্ষা দুটির জন্য সোম ও বুধবার আসতে বলা হয়েছে। মফস্বল থেকে আসা শাহিন আলম একই রোগীর দুটি পরীক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দিন আসতে বলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের প্রাথমিক পরামর্শের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল নিয়ে চূড়ান্ত পরামর্শ পেতে একজন রোগীকে অন্তত পাঁচ দিন হাসপাতালে আসতে হয়। এরপরও কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলার নিশ্চয়তা নেই।
সরকারের তথ্য অনুয়ায়ী, হৃদ্রোগের চিকিৎসার জন্য ১ হাজার ২৫০ শয্যার একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালটিতে এ বছর গত আগস্ট পর্যন্ত সোয়া এক লাখ মানুষ বহির্বিভাগের চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ৬৮ হাজার।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, আটটি অস্ত্রোপচার কক্ষের মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র পাঁচটি। সম্প্রতি মেডিসিনের ২০টি ইউনিট কমিয়ে ১০টি করা হয়েছে। মূল করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) সংস্কারকাজ চলছে দেড় বছর ধরে। জরুরি সেবাটি দেওয়া হচ্ছে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা সিসিইউতে।
পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেড় যুগের বেশি সময় ধরে জবাবদিহি ছিল না। হঠাৎ করেই আমরা সব চাহিদা পূরণ করতে পারব না। তবে এক মাসের ব্যবধানে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো হয়েছে।’
বহির্বিভাগের ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ছে এনআইকেডিইউ হাসপাতালের সেবাপ্রত্যাশীরা। সরকারিভাবে ওষুধ পাওয়ার জন্য রোগীদের যেতে হয় দুই জায়গায়। গতকাল রাজধানীর অদূরের চিটাগাং রোড থেকে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তৃতীয় দিনের মতো এসেছিলেন মজিবর রহমান। মজিবর রহমান বলেন, হাসপাতালে বিনা মূল্যে কিছু ওষুধ পাওয়া যায়, তা বাইরের লোকের কাছে জেনেছেন তিনি।
এরপর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে যান। সেখান থেকে একটি কাগজে কিছু ওষুধের নাম লিখে দেওয়া হয়। কাগজটি নিয়ে অন্য একটি কক্ষে চিকিৎসকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আবার ডিসপেনসারিতে যাওয়ার পর চার দিনের ওষুধ পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করেছেন এক মাসের ওষুধের কথা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কিডনি ও ইউরোলজির চিকিৎসার জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে গত আট মাসে সোয়া এক লাখ মানুষ বহির্বিভাগের চিকিৎসা নিয়েছে; ভর্তি হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার।
এনআইকেডিইউর পরিচালক অধ্যাপক ডা. বাবরুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভর্তি রোগীর প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধই দিয়ে থাকি। তবে বহির্বিভাগের ওষুধের ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন করে ডিসপেনসারি প্রস্তুতের কাজ চলেছে। ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।’
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা এক হাজার। শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার ১০০ শতাংশের বেশি। প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগের চিকিৎসার জন্য আসে। বহির্বিভাগের রোগীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ টিকিট কাউন্টারের হয়রানি ও এক্স-রে করা নিয়ে বিড়ম্বনা।
গতকাল সকালে গাজীপুর থেকে ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে আসেন সাইফুল ইসলাম। এখানে আসার আগে এক মাস ধরে তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বেলা ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও এক্স-রে করতে পারেননি তিনি। অথচ বহির্বিভাগের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায় বেলা ২টায়। তাঁর মতো এক্স-রে করার অপেক্ষায় ছিলেন সাভারের রোকসানা বেগম। দ্বিতীয় দিনের মতো এসেছেন তিনি। এক্স-রে করা হলেও চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য তাঁকে আরও এক দিন আসতে হবে।
সমস্যাগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, শয্যার বাইরেও বহু রোগী ভর্তি করতে হওয়ায় অনেক সময় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর পর্যবেক্ষণ
জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্তরা মনে করেন, রোগীর উচ্চ সংখ্যা ও সম্পদের অভাব বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের চিরন্তন সমস্যা। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও উন্নত ব্যবস্থাপনা সমস্যার মাত্রা লাঘবে সহায়তা করতে পারে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (পিএইচএবি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ বিষয়ে বলেন, ‘দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে বোঝেন, দেশে এমন লোকের অভাব রয়েছে। হাসপাতাল যে মূলত সেবা প্রতিষ্ঠান, সে বিষয়ে আমাদের মনোযোগও নেই।’
গত রোববার রাতে মাথা ও বুকে হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলেন নারায়ণগঞ্জের সাহানা বেগম। তাঁকে প্রথমে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের বেসরকারি একটি হাসপাতালে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মস্তিষ্কের জটিলতা ধারণা করে সেখানকার চিকিৎসকেরা সাহানাকে পাঠান রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে। নিউরোসায়েন্সেসের চিকিৎসকেরা হৃদ্যন্ত্রের জটিলতার কথা জানিয়ে তাঁকে আবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে পাঠান। সেখানকার চিকিৎসকেরা বলেন, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী সাহানা অনেকগুলো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। ফলে তাঁকে পাঠানো হয় পাশের সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
অচেতন মধ্যবয়সী সাহানা বেগমকে নিয়ে এভাবে এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে ছুটেছেন তাঁর ছেলেরা। সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে তাঁকে বহির্বিভাগে পাঠানো হয়। বহির্বিভাগের চিকিৎসক কয়েকটি পরীক্ষার নির্দেশনা দেন।
জানা যায়, সেগুলোর ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে বিকেল পর্যন্ত। এরপর মিলবে ভর্তির নির্দেশনা। ৬ ঘণ্টার বেশি সময় বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দুপুর ১২টায়ও চিকিৎসা শুরু হয়নি সাহানার। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে নারায়ণগঞ্জে ফিরিয়ে নিয়ে যান স্বজনেরা।
সাহানা বেগমের ভাতিজা মো. সেলিম চিকিৎসা ছাড়াই তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় আজকের পত্রিকাকে এ বিষয়ে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পাঠাল। এখানে তিনটি বড় হাসপাতাল ঘুরেছি। কিন্তু কেউ চিকিৎসা শুরুই করেনি। আমার চাচি এখনো অচেতন। তাঁর ঠিক কী হয়েছে, তাই এখনো জানি না। আমরা নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাচ্ছি। সেখানকার বেসরকারি হাসপাতালেই তাঁর চিকিৎসা করাব।’
রাজধানীতে অবস্থিত দেশের প্রধান বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ ধরনের ঘটনা মোটেই বিরল নয়। গত রবি ও গতকাল সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট (এনআইকেডিইউ), জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল (এনআইসিভিডি) ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘুরে অব্যবস্থাপনা, সেবার ঘাটতি ও রোগীদের অসন্তুষ্টির বিভিন্ন চিত্র দেখা যায়। কর্তৃপক্ষ এ জন্য অতিরিক্ত রোগীর চাপ এবং পুঞ্জীভূত সমস্যার কথা বললেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ব্যবস্থাপনার ত্রুটি একটি বড় কারণ।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বাভাবিকের চেয়ে দুই মাস ধরে রোগীদের ভিড় বেড়েছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী সেবা নিতে আসছে এখন। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে শয্যাসংখ্যা এক হাজার ২৫০ হলেও নিয়মিতভাবে পৌনে দুই হাজারের কাছাকাছি রোগী ভর্তি থাকে। তাঁরা বলছেন, সেবার সংখ্যা এবং পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
হাসপাতালের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা যায়, রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ব্যবস্থাপনা সেই বরাবরের মতোই। একজন রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হলে টিকিট নিয়ে যেতে হয় কয়েকটি জায়গায়। এতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ার পাশাপাশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেবাপ্রত্যাশীদের। দেখা গেল, অন্তর্বিভাগ এবং বহির্বিভাগের রোগীদের একই কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে হয়। হাসপাতাল থেকে সরকারি ওষুধ পাওয়ার প্রক্রিয়াও মসৃণ নয়।
দেশের সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালের বহির্বিভাগে সব ধরনের চিকিৎসা ও পরীক্ষা সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত চলে। তবে টিকিট দেওয়া হয় দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
দিনাজপুর থেকে বুকের হাড়ের ব্যথা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছেন সুজন হাওলাদার (২৫)। তিনি জানান, অর্থোপেডিক চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসক তাঁকে সময় দিয়েছেন মাত্র দেড় মিনিট। হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে তাঁকে তিন দিনের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। পটুয়াখালীর ইমরান মাহমুদের মা যক্ষ্মার সঙ্গে মস্তিষ্কের জটিলতার জন্য দুই মাস নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ছিলেন। গত শনিবার মাকে সোহরাওয়ার্দীতে নিয়ে এসেছেন ইমরান। এখানকার চিকিৎসকেরা তাঁর মায়ের স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি বিশদে বুঝিয়ে বলেননি। এতে উদ্বেগে রয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ১ হাজার ৩৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তির হার ১৫০ শতাংশ, অর্থাৎ সক্ষমতার দেড় গুণ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে আড়াই লাখের বেশি মানুষ। আর ভর্তি হয়েছে ৪১ হাজার।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। জনবল এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও আগের চেয়ে সেবার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো হয়রানির ঘটনা ঘটলে তার সমাধান করা হচ্ছে।’
গত রোববার মায়ের চিকিৎসার জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে এসেছেন শাহিন আলম। চিকিৎসক পায়ের রক্তনালিতে জটিলতার কথা জানিয়ে হৃদ্যন্ত্র ও পায়ের রক্তনালির দুটি পরীক্ষা করতে বলেছেন। পরীক্ষা দুটির জন্য সোম ও বুধবার আসতে বলা হয়েছে। মফস্বল থেকে আসা শাহিন আলম একই রোগীর দুটি পরীক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দিন আসতে বলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের প্রাথমিক পরামর্শের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল নিয়ে চূড়ান্ত পরামর্শ পেতে একজন রোগীকে অন্তত পাঁচ দিন হাসপাতালে আসতে হয়। এরপরও কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলার নিশ্চয়তা নেই।
সরকারের তথ্য অনুয়ায়ী, হৃদ্রোগের চিকিৎসার জন্য ১ হাজার ২৫০ শয্যার একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালটিতে এ বছর গত আগস্ট পর্যন্ত সোয়া এক লাখ মানুষ বহির্বিভাগের চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ৬৮ হাজার।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, আটটি অস্ত্রোপচার কক্ষের মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র পাঁচটি। সম্প্রতি মেডিসিনের ২০টি ইউনিট কমিয়ে ১০টি করা হয়েছে। মূল করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) সংস্কারকাজ চলছে দেড় বছর ধরে। জরুরি সেবাটি দেওয়া হচ্ছে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা সিসিইউতে।
পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেড় যুগের বেশি সময় ধরে জবাবদিহি ছিল না। হঠাৎ করেই আমরা সব চাহিদা পূরণ করতে পারব না। তবে এক মাসের ব্যবধানে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো হয়েছে।’
বহির্বিভাগের ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ছে এনআইকেডিইউ হাসপাতালের সেবাপ্রত্যাশীরা। সরকারিভাবে ওষুধ পাওয়ার জন্য রোগীদের যেতে হয় দুই জায়গায়। গতকাল রাজধানীর অদূরের চিটাগাং রোড থেকে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তৃতীয় দিনের মতো এসেছিলেন মজিবর রহমান। মজিবর রহমান বলেন, হাসপাতালে বিনা মূল্যে কিছু ওষুধ পাওয়া যায়, তা বাইরের লোকের কাছে জেনেছেন তিনি।
এরপর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে যান। সেখান থেকে একটি কাগজে কিছু ওষুধের নাম লিখে দেওয়া হয়। কাগজটি নিয়ে অন্য একটি কক্ষে চিকিৎসকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আবার ডিসপেনসারিতে যাওয়ার পর চার দিনের ওষুধ পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করেছেন এক মাসের ওষুধের কথা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কিডনি ও ইউরোলজির চিকিৎসার জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে গত আট মাসে সোয়া এক লাখ মানুষ বহির্বিভাগের চিকিৎসা নিয়েছে; ভর্তি হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার।
এনআইকেডিইউর পরিচালক অধ্যাপক ডা. বাবরুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভর্তি রোগীর প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধই দিয়ে থাকি। তবে বহির্বিভাগের ওষুধের ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন করে ডিসপেনসারি প্রস্তুতের কাজ চলেছে। ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।’
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা এক হাজার। শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার ১০০ শতাংশের বেশি। প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগের চিকিৎসার জন্য আসে। বহির্বিভাগের রোগীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ টিকিট কাউন্টারের হয়রানি ও এক্স-রে করা নিয়ে বিড়ম্বনা।
গতকাল সকালে গাজীপুর থেকে ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে আসেন সাইফুল ইসলাম। এখানে আসার আগে এক মাস ধরে তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বেলা ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও এক্স-রে করতে পারেননি তিনি। অথচ বহির্বিভাগের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায় বেলা ২টায়। তাঁর মতো এক্স-রে করার অপেক্ষায় ছিলেন সাভারের রোকসানা বেগম। দ্বিতীয় দিনের মতো এসেছেন তিনি। এক্স-রে করা হলেও চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য তাঁকে আরও এক দিন আসতে হবে।
সমস্যাগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, শয্যার বাইরেও বহু রোগী ভর্তি করতে হওয়ায় অনেক সময় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর পর্যবেক্ষণ
জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্তরা মনে করেন, রোগীর উচ্চ সংখ্যা ও সম্পদের অভাব বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের চিরন্তন সমস্যা। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও উন্নত ব্যবস্থাপনা সমস্যার মাত্রা লাঘবে সহায়তা করতে পারে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (পিএইচএবি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ বিষয়ে বলেন, ‘দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে বোঝেন, দেশে এমন লোকের অভাব রয়েছে। হাসপাতাল যে মূলত সেবা প্রতিষ্ঠান, সে বিষয়ে আমাদের মনোযোগও নেই।’
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে