বিভুরঞ্জন সরকার
২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭৪ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ দরবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথম মাতৃভাষায় ভাষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, বাঙালি জাতির সব বড় ও মহতী অর্জন তাঁর হাত ধরেই হয়েছে।
বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর লেখা থেকে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই এই নিবন্ধ লেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, তোফায়েল আহমেদ তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর ফারুক চৌধুরী ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।
বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি তখন ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডনে যাওয়া চলবে না। তুমি আমার সঙ্গে নিউইয়র্কে যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করব, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করবে।’
এ কথা শুনে ফারুক চৌধুরী একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে, যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’
ফারুক চৌধুরীর লেখা ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সফরের আগে পররাষ্ট্রসচিব একদিন বলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রণয়নে সে সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খুবই আগ্রহ দেখান। ঠাকুর এর আগে ইত্তেফাকের রিপোর্টার ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলা ভাষায় তাঁর খুব দখল রয়েছে। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলাতেই ভাষণ দেবেন, এটি জানার পর তাহের ঠাকুর বাংলায় ভাষণের একটি খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। পরে জানা যায়, তাহের ঠাকুরের ওই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়নি।
সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। জাতিসংঘে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির একটি খসড়া তৈরি করে পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের পদস্থ কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
ভাষণ পাঠ শেষে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বলেন, ‘ভালোই তো তোমাদের ফরেন সার্ভিসের বক্তৃতা। কিন্তু তোমরা যে আসল কথাই লেখনি। দেশে বন্যা হয়ে গেল, দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে, সেই কথাটিই তো আমি জাতিসংঘে বলবার চাই। বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিশ্ববাসী আমার মুখ থেকেই শুনুক। তোমাদের সংশয় কেন?’
সাঁটলিপিকার রোজারিওকে ডেকে আনা হলো। অদূরে সোফা দেখিয়ে ফারুক চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ওখানে বসে আসন্ন খাদ্যাভাব সম্বন্ধে একটি লাইন তুমি আমার বক্তৃতায় জুড়ে দাও।’
এটা এখন জানা তথ্য যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হলেও জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও প্রায় তিন বছর। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুর নিরলস কূটনৈতিক চেষ্টার একটি বড় সাফল্য। এর মাত্র আট দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলায় যুগান্তকারী ভাষণটি দেন।
জাতিসংঘের সেক্রেটারিয়েট থেকে ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ওই সময় জাতিসংঘে যে ছয়টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, তার মধ্যে বাংলা ভাষা ছিল না। বঙ্গবন্ধু আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বাংলায় ভাষণ দেবেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুগ্ধ হন।
এর আগে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে চীন সফরে গিয়েও তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। … কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? … পূর্ববাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন, দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’
এই কর্তব্যবোধ থেকেই বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘেও মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধুকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে তাঁকে মঞ্চে তুলে নেন। গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের চশমা আর ব্যাকব্রাশ করা চুলের উন্নত শির বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়ান। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি নানা দেশের প্রতিনিধিরা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনকারী দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মিলিত সংগ্রাম।’
তিনি জাতিসংঘের আদর্শ, শান্তি ও ন্যায়বিচারের বাণীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বাংলার লাখো শহীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণপূর্বক বিশ্বশান্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান জানান। জাতির পিতা তাঁর ভাষণে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের লড়াই ও ত্যাগের উদাহরণ টেনে বলেন, অন্যায় এখনো চলছে এবং বর্ণবাদও পূর্ণমাত্রায় বিলুপ্ত হয়নি। জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার ও বর্ণবাদের অবসান ঘটাতে নতুন বিশ্বব্যবস্থার আহ্বান জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে একদিকে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, অন্যদিকে ক্ষুধায় আক্রান্ত দেশগুলোর জন্য জরুরি সহায়তার কথাও বলেছেন। তিনি অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে প্রতিটি মানুষের জন্য সুখী ও শ্রদ্ধাশীল জীবন নিশ্চয়তার তাগিদ দেন। অনাহার, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
যে ব্যবস্থায় বিশ্বের সমস্ত সম্পদ ও প্রযুক্তিজ্ঞানের যথাযথ বণ্টনের মাধ্যমে একটি জাতির কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত হবে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা পাবে। তিনি বলেছেন, ‘আমি জীবনকে ভালোবাসি, তবে আমি মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ভয় পাই না।’
একাধিক বিশিষ্টজনের লেখা থেকে জানা যায়, জাতিসংঘ অধিবেশনে সচরাচর সবাই উপস্থিত থাকেন না। অনেক চেয়ার খালি পড়ে থাকে। কিন্তু ওই দিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় অধিবেশনকক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। গ্যালারিগুলোতেও ছিল অভিন্ন চিত্র। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন কেবল একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া একটি নতুন দেশের স্থপতি। সারা বিশ্বে আলোচিত তিনি। তাই সবাই এই নেতাকে দেখার জন্য, বক্তৃতা শোনার জন্য অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।
ভাষণের সূচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ এই মহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন’ বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক মুজিব’ বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া পত্রস্থ করা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘এযাবৎ আমরা কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব।’
এর আগে বিশ্ব পরিসরে মাতৃভাষা বাংলাকে এমন করে কেউ পরিচয় করিয়ে দেয়নি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর মাধ্যমে বিশ্বদরবারে প্রথম বাংলা ভাষা পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাঙ্গনের কোথাও তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেননি।
জাতির পিতার পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে চেতনায় ধারণ ও লালন করছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনিও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে থাকেন সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে। এবারও তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয় এ কারণেই যে, তিনিই প্রথম বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ অনৈক্য যখন চরমে, তখন মনে হয়, আহা, বঙ্গবন্ধুকে যদি ওভাবে হত্যা করা না হতো!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭৪ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ দরবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথম মাতৃভাষায় ভাষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, বাঙালি জাতির সব বড় ও মহতী অর্জন তাঁর হাত ধরেই হয়েছে।
বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর লেখা থেকে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই এই নিবন্ধ লেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, তোফায়েল আহমেদ তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর ফারুক চৌধুরী ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।
বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি তখন ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডনে যাওয়া চলবে না। তুমি আমার সঙ্গে নিউইয়র্কে যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করব, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করবে।’
এ কথা শুনে ফারুক চৌধুরী একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে, যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’
ফারুক চৌধুরীর লেখা ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সফরের আগে পররাষ্ট্রসচিব একদিন বলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রণয়নে সে সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খুবই আগ্রহ দেখান। ঠাকুর এর আগে ইত্তেফাকের রিপোর্টার ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলা ভাষায় তাঁর খুব দখল রয়েছে। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলাতেই ভাষণ দেবেন, এটি জানার পর তাহের ঠাকুর বাংলায় ভাষণের একটি খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। পরে জানা যায়, তাহের ঠাকুরের ওই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়নি।
সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। জাতিসংঘে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির একটি খসড়া তৈরি করে পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের পদস্থ কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
ভাষণ পাঠ শেষে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বলেন, ‘ভালোই তো তোমাদের ফরেন সার্ভিসের বক্তৃতা। কিন্তু তোমরা যে আসল কথাই লেখনি। দেশে বন্যা হয়ে গেল, দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে, সেই কথাটিই তো আমি জাতিসংঘে বলবার চাই। বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিশ্ববাসী আমার মুখ থেকেই শুনুক। তোমাদের সংশয় কেন?’
সাঁটলিপিকার রোজারিওকে ডেকে আনা হলো। অদূরে সোফা দেখিয়ে ফারুক চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ওখানে বসে আসন্ন খাদ্যাভাব সম্বন্ধে একটি লাইন তুমি আমার বক্তৃতায় জুড়ে দাও।’
এটা এখন জানা তথ্য যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হলেও জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও প্রায় তিন বছর। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুর নিরলস কূটনৈতিক চেষ্টার একটি বড় সাফল্য। এর মাত্র আট দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলায় যুগান্তকারী ভাষণটি দেন।
জাতিসংঘের সেক্রেটারিয়েট থেকে ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ওই সময় জাতিসংঘে যে ছয়টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, তার মধ্যে বাংলা ভাষা ছিল না। বঙ্গবন্ধু আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বাংলায় ভাষণ দেবেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুগ্ধ হন।
এর আগে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে চীন সফরে গিয়েও তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। … কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? … পূর্ববাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন, দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’
এই কর্তব্যবোধ থেকেই বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘেও মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধুকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে তাঁকে মঞ্চে তুলে নেন। গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের চশমা আর ব্যাকব্রাশ করা চুলের উন্নত শির বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়ান। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি নানা দেশের প্রতিনিধিরা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনকারী দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মিলিত সংগ্রাম।’
তিনি জাতিসংঘের আদর্শ, শান্তি ও ন্যায়বিচারের বাণীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বাংলার লাখো শহীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণপূর্বক বিশ্বশান্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান জানান। জাতির পিতা তাঁর ভাষণে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের লড়াই ও ত্যাগের উদাহরণ টেনে বলেন, অন্যায় এখনো চলছে এবং বর্ণবাদও পূর্ণমাত্রায় বিলুপ্ত হয়নি। জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার ও বর্ণবাদের অবসান ঘটাতে নতুন বিশ্বব্যবস্থার আহ্বান জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে একদিকে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, অন্যদিকে ক্ষুধায় আক্রান্ত দেশগুলোর জন্য জরুরি সহায়তার কথাও বলেছেন। তিনি অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে প্রতিটি মানুষের জন্য সুখী ও শ্রদ্ধাশীল জীবন নিশ্চয়তার তাগিদ দেন। অনাহার, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
যে ব্যবস্থায় বিশ্বের সমস্ত সম্পদ ও প্রযুক্তিজ্ঞানের যথাযথ বণ্টনের মাধ্যমে একটি জাতির কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত হবে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা পাবে। তিনি বলেছেন, ‘আমি জীবনকে ভালোবাসি, তবে আমি মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ভয় পাই না।’
একাধিক বিশিষ্টজনের লেখা থেকে জানা যায়, জাতিসংঘ অধিবেশনে সচরাচর সবাই উপস্থিত থাকেন না। অনেক চেয়ার খালি পড়ে থাকে। কিন্তু ওই দিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় অধিবেশনকক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। গ্যালারিগুলোতেও ছিল অভিন্ন চিত্র। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন কেবল একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া একটি নতুন দেশের স্থপতি। সারা বিশ্বে আলোচিত তিনি। তাই সবাই এই নেতাকে দেখার জন্য, বক্তৃতা শোনার জন্য অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।
ভাষণের সূচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ এই মহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন’ বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক মুজিব’ বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া পত্রস্থ করা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘এযাবৎ আমরা কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব।’
এর আগে বিশ্ব পরিসরে মাতৃভাষা বাংলাকে এমন করে কেউ পরিচয় করিয়ে দেয়নি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর মাধ্যমে বিশ্বদরবারে প্রথম বাংলা ভাষা পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাঙ্গনের কোথাও তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেননি।
জাতির পিতার পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে চেতনায় ধারণ ও লালন করছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনিও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে থাকেন সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে। এবারও তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয় এ কারণেই যে, তিনিই প্রথম বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ অনৈক্য যখন চরমে, তখন মনে হয়, আহা, বঙ্গবন্ধুকে যদি ওভাবে হত্যা করা না হতো!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে