শফিকুল কবীর চন্দন
টাঙ্গাইল শাড়ি পাথরাইল, নলশোদা, বাজিতপুর, চণ্ডীর নাকি ফুলিয়া, কালনা, ধাত্রীগ্রাম, নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়ের, নাকি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার? নাকি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া বা বর্ধমান জেলার?
কয়েক দিন ধরে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ নিয়ে বেশ কিছু গবেষক কথা বলছেন। কিন্তু যাঁদের শ্রম, ঘাম ও মেধায় এই বয়নশিল্প গড়ে উঠেছে, সেই কারিগরদের কোনো বয়ান নেই কেন? আসলে এই কারিগরদের জোরের জায়গাটা হলো তাঁদের পরম্পরা কাজের নির্ভীক দক্ষতা।
আমি নিজে কারিগর কিসিমের মানুষ। প্রায় তিরিশ বছর ধরে তাঁত বুনি। তবে পরম্পরা কারিগর নই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কারিগরের স্বাধীনতা খর্বকারী এই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য সনদের পক্ষে নই। থাকার কোনো কারণ অন্তত স্বাধীন কোনো কারুশিল্পীর নেই। এই যে হাজার বছর ধরে কারিগরেরা দিব্যি টিকে আছেন, তাঁদের জোরের জায়গাটা একবার যদি চিন্তা করি, তাহলে দেখব তাঁদের জিআই সনদ নিয়ে ভাবনা আর ভদ্রলোকীয়দের ভাবনার মধ্যে ফারাক আছে। সামগ্রিকভাবে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতির প্রতি কারিগরদের বিরোধিতা তাঁদের শৈল্পিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক জীবিকা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং বৈশ্বিক বাজারের জটিলতাগুলো মোকাবিলা করার ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রভাব সম্পর্কে তাঁদের উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে।
ক্রমেই জিআই সনদ যেন ভদ্রলোকীয় পরিভাষায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বীকৃতির পাকা সড়ক ধরে উপস্থিত হচ্ছে! অথচ পণ্য আগে না উৎপাদক আগে—এর মীমাংসা তাদের কাছে কেমন? ফলে জিআই স্বীকৃতি মিললেও, হস্তচালিত তাঁতে বোনা টাঙ্গাইল শাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে সেখানকার হস্ত তাঁত কারিগরদের।
ফলে জিআই সনদের বিরোধিতা মানে, বাজারে একচেটিয়া পণ্যের আধিপত্যকে বাতিল করে কারিগরি দক্ষতা এবং পণ্যের মানের উৎকর্ষের প্রতিযোগিতা, যা আবার উৎপাদন করণকৌশল হিসেবে সামাজিক সম্পদে পরিণত হচ্ছে। আমরা তো দেখছি কীভাবে বড় পুঁজি নীরবে, সরবে ও সবলে দখল করে সমগ্র উৎপাদক কারিগরি পেশার মানুষদের বাপ-দাদার পেশা থেকে উচ্ছেদ করে তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিকে পরিণত করছে; নিজেদের অর্জিত পরম্পরা জ্ঞান, দক্ষতা বাজারের অহংকার হারিয়ে দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে।
তাঁদের জন্য ভদ্রবিত্তরা কী চিন্তাভাবনা করছেন? আছে কোনো সরকারি হিসাব? স্বাধীনতার ৫২ বছরে উন্নয়ন উদ্বাস্তুদের জীবনে কী ঘটেছে, আমরা ভদ্রবিত্তরা কেউ জানি না। একটা মামুলি প্রশ্ন করে রাখা দরকার, এই সনদে কারিগরের কী লাভ? ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে, আপনার দেখা ২০-৪০ বছর আগের চাষি, কারিগরদের অবস্থা কি আগের মতো আছে? জাতিবাদী, আঞ্চলিকতার দুষ্টপাকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আরবান ভদ্রবিত্তের জন্য জিআই, মসলিন রিভাইভাল স্রেফ ‘লেবেঞ্চুস’ মাত্র নয় কি?
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উৎসাহী মানুষজন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই বিষয় নিয়ে যারপরনাই ভাবিত, কিন্তু তাঁরা এর কিয়দংশও যদি ভাবিত হতো—তাঁতিদের সব কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে পাওয়ারলুমের (যান্ত্রিক তাঁত) দৌরাত্ম্য! উচ্ছেদের আশঙ্কা মাথায় নিয়েও, রাষ্ট্র প্রতিমুহূর্তে তাঁর রুটি ও রুজি খেয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে জেনেও চাষি ও কারিগরেরা ঘাড় গুঁজেই কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ তাঁরা তাঁদের কাজ ও পেশাকে ভালোবাসেন। তাঁরা তাঁদের পেশার প্রতি বিশ্বস্ত। তাই তো তাঁরা পারিবারিক অবশেষের পেশায় হাত চালাতে চালাতে বলেন, ‘কী করমু, বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে তো পারি না, অন্য কোনো কাজ তো শিখি নাই!’
পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের ভদ্রবিত্তের লোকদের অতি উৎসাহের নিদান হলো, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ছিল, আমাদেরই থাকবে’গোছের আপ্তবাক্য! তাঁত বিষয়ে রাষ্ট্রের বৈমাত্রেয় নীতি আর পাওয়ারলুমের ঠেলায় টাঙ্গাইলে তাঁতি আছে কি নেই, সে বিষয়ে না জেনে শিক্ষিত ভদ্রবিত্তের কথায় আমরা অনেকে বেহুঁশ হয়ে পড়েছি।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে। শত বা হাজার বছর যে পণ্যের এমন সনদ লাগল না, তা আজ কেন লাগছে? কারা এর জন্য বেশি উৎসাহী? বলা হয়, কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এই পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।
এবার দেখা যাক জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি দিয়েছে যে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ইন্ডিয়া, তাদের ওয়েবসাইটে যেসব তথ্য জুড়ে দিয়েছে, তা খুব আগ্রহোদ্দীপক। যেমন ভৌগোলিক নির্দেশক বিষয় হিসেবে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন এই ‘বেঙ্গল’ কোথায়? ভারতবর্ষে অফিশিয়ালি ‘বেঙ্গল’ বলে কোন জায়গাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে? আসলে ফাঁকিটাই বা কোথায়? ফলে বাণিজ্য বুদ্ধির চক্রে কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। সত্যই কি তাই নয়? এ মিথ্যাচার নাকি অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা?
শ্রী রবীন্দ্রনাথ রায় ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যে নোটারি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেছেন, সেখানে উল্লিখিত ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’।নথিতে ম্যাপ যুক্ত করে, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে ওয়েস্ট বেঙ্গল বাদ দিয়ে বেঙ্গল হয়েছে। আর বাংলায় করা হয়েছে ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’।
৭০২ নম্বর আবেদনপত্রের বিপরীতে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য আবেদনে জুড়ে দেওয়া ‘রিপোর্ট অন টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, স্টেটমেন্ট অব কেস’-এ বলা হচ্ছে, ‘ইট মে বি সারপ্রাইজিং টু নোট দ্যাট টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিড নট কাম ফ্রম টাঙ্গাইল ইন ইস্টওয়েস্ট (নাও বাংলাদেশ), র্যাদার ইট ইজ এ হাইব্রিড অব শান্তিপুর ডিজাইন অ্যান্ড ঢাকা-টাঙ্গাইল’।
‘বেঙ্গল’ যদি হাইব্রিডই হবে তাহলে আসলের নকল হিসেবে এখানে টাঙ্গাইল নাম ব্যবহারের ন্যায্যতা থাকে কি? বুঝতে হবে কাজটি হাইব্রিড হলেও, ভৌগোলিক স্থান-নাম হিসেবে টাঙ্গাইল হাইব্রিড নয়, এই যা রক্ষে! এবার আসা যাক কতিপয় ভাষ্যের ব্যবচ্ছেদে। অনেকে মধ্যপন্থায় আশ্রয় খোঁজে, ‘কাঁটাতার পেরিয়ে টাঙ্গাইলের যে তাঁতিরা এপারে এসেছেন, তাঁরাও বুকের ভেতর জন্মের ভূমি টাঙ্গাইলকে লালন করেন, তাঁদেরও স্বত্ব পাওয়ার অধিকার আছে। দুই দেশেই থাকুক স্বত্ব।’ এই মধ্যপন্থা মাঝটুকুতে ভরসা রাখে, আগে-পিছে দায় নিতে জানে না।
বিবিসি বাংলা অনলাইনের বরাতে পাওয়া আরও কিছু খোঁড়া যুক্তির নমুনা—‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে মুর্শিদাবাদ জেলার বালুচর এলাকায় এই শাড়ির জন্ম হলেও, পরবর্তীকালে বন্যার কারণে বালুচরি তাঁতিরা বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। পরে সেখানে এই শাড়ির প্রসার ঘটে।’ আর ‘স্থানান্তরিত হলেও বালুচরি শাড়ি “বিষ্ণুপুরি” বা অন্য কোনো নাম পরিগ্রহ করেনি; বরং বালুচরি নামেই জিআই পেয়েছে’ বলে জানান ফুলিয়ার এক তাঁতশিল্প গবেষক। খুবই খোঁড়া যুক্তি! বালুচরে অবশিষ্ট তাঁতিরা ছিলেন নাকি সবাই চলে এসেছিলেন বিষ্ণুপুরে? আর বালুচর ও বিষ্ণুপুর দুটি আলাদা সার্বভৌম দেশের জায়গা তো নয়!
আরেকজন বলছেন, দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে চলে এলেও ‘টাঙ্গাইল’ শব্দটি ছিল বসাক তাঁতিদের অস্থিমজ্জাগত। ফলে উদ্বাস্তু এই তাঁতিরা নিজেদের বয়নীকৃত শাড়ির নাম বা বয়নকৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করেননি। এই যে কল্পনাও করেননি তা কি টাঙ্গাইল শাড়ির প্রয়োজনে, নাকি নিজেদের রুটি রুজির প্রয়োজনে? নাকি বলা যায়, শাড়ির নাম বা বয়নকৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করতে পারেননি? তা তো বটেই, পারেননি বলেই না ফুলিয়ায় ‘টাঙ্গাইল তন্তুজীবী উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামের সমবায় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়! টাঙ্গাইল শাড়ির সাকিন ‘টাঙ্গাইল’ এখানে ‘ব্র্যান্ড নেইম’। নইলে ভারতে বোনা শাড়ির নাম হতো ভিন্ন।
ফুলিয়ার তাঁতিদের প্রতি কোনো বিরূপতা নেই। তাঁরা বাংলাদেশ (টাঙ্গাইল) থেকে গেছেন, কিন্তু স্বতন্ত্র একটা ধারা কিন্তু গড়ে তুলেছেন, যা টাঙ্গাইলের ধারা থেকে গ্রহণ করা আবার আলাদাও। যেমন বেনারসির ডিজাইনে বাংলাদেশে শাড়ি বানালেও সেটা বেনারসির বড়জোর রেপ্লিকা। মানে-গুণে যদি ভালোও হয়, তবু আসল বেনারসি নয়। এভাবে না বুঝলে তো আপনি না বুঝে এঁড়েতর্ক করছেন। অথবা বুঝেশুনে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যক্তিনির্ভর নয়, তা স্থাননির্ভর কৃষ্টির পর্যায়ে উপনীত। পরম্পরা জ্ঞানের এই এক প্রক্রিয়া। কারিগরেরা সচরাচর বাপ-দাদার কারিগরি কৌশল, মুনশিয়ানা পুঁজি করেই এগোতে চান। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। অভিবাসী হিসেবে ভূগোল টপকে পারিবারিক, আঞ্চলিক পেশার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গের ‘বাঙাল তাঁতিরা’ টাঙ্গাইল শাড়ি বুনেছেন, বুনছেন, বুনবেন, এর উৎকর্ষ আরোপ করবেন—এমনটাই হোক। আর এটা হলে টাঙ্গাইলের মূলভূমিপুত্রসহ শাড়ির কারিগরেরা তথা ভূভাগের মানুষেরা গর্বিত হবেন বইকি।
ফুলিয়ার তন্তুবায়রা আমাদের স্বজন। তাঁরা পরম্পরা দক্ষতায় শাড়ি বোনেন কুরুম-ধলেশ্বরীর জল-তাপ হৃদয়ে ধারণ করে, রং আর নকশা মিশিয়ে। আমরা একই বয়ন কারিগরির উত্তরাধিকার, এখানেই আমাদের অভিন্নতা।
টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। কারণ এলাকা, অঞ্চল বা নগর হিসেবে টাঙ্গাইলের অবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও নয়। এ সহজ কথাটা বুঝতে হবে, মানতে হবে। এখানে কোনো বিতর্ক চলে না।
শফিকুল কবীর চন্দন, চারুশিল্পী, লেখক ও গবেষক
টাঙ্গাইল শাড়ি পাথরাইল, নলশোদা, বাজিতপুর, চণ্ডীর নাকি ফুলিয়া, কালনা, ধাত্রীগ্রাম, নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়ের, নাকি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার? নাকি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া বা বর্ধমান জেলার?
কয়েক দিন ধরে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ নিয়ে বেশ কিছু গবেষক কথা বলছেন। কিন্তু যাঁদের শ্রম, ঘাম ও মেধায় এই বয়নশিল্প গড়ে উঠেছে, সেই কারিগরদের কোনো বয়ান নেই কেন? আসলে এই কারিগরদের জোরের জায়গাটা হলো তাঁদের পরম্পরা কাজের নির্ভীক দক্ষতা।
আমি নিজে কারিগর কিসিমের মানুষ। প্রায় তিরিশ বছর ধরে তাঁত বুনি। তবে পরম্পরা কারিগর নই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কারিগরের স্বাধীনতা খর্বকারী এই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য সনদের পক্ষে নই। থাকার কোনো কারণ অন্তত স্বাধীন কোনো কারুশিল্পীর নেই। এই যে হাজার বছর ধরে কারিগরেরা দিব্যি টিকে আছেন, তাঁদের জোরের জায়গাটা একবার যদি চিন্তা করি, তাহলে দেখব তাঁদের জিআই সনদ নিয়ে ভাবনা আর ভদ্রলোকীয়দের ভাবনার মধ্যে ফারাক আছে। সামগ্রিকভাবে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতির প্রতি কারিগরদের বিরোধিতা তাঁদের শৈল্পিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক জীবিকা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং বৈশ্বিক বাজারের জটিলতাগুলো মোকাবিলা করার ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রভাব সম্পর্কে তাঁদের উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে।
ক্রমেই জিআই সনদ যেন ভদ্রলোকীয় পরিভাষায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বীকৃতির পাকা সড়ক ধরে উপস্থিত হচ্ছে! অথচ পণ্য আগে না উৎপাদক আগে—এর মীমাংসা তাদের কাছে কেমন? ফলে জিআই স্বীকৃতি মিললেও, হস্তচালিত তাঁতে বোনা টাঙ্গাইল শাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে সেখানকার হস্ত তাঁত কারিগরদের।
ফলে জিআই সনদের বিরোধিতা মানে, বাজারে একচেটিয়া পণ্যের আধিপত্যকে বাতিল করে কারিগরি দক্ষতা এবং পণ্যের মানের উৎকর্ষের প্রতিযোগিতা, যা আবার উৎপাদন করণকৌশল হিসেবে সামাজিক সম্পদে পরিণত হচ্ছে। আমরা তো দেখছি কীভাবে বড় পুঁজি নীরবে, সরবে ও সবলে দখল করে সমগ্র উৎপাদক কারিগরি পেশার মানুষদের বাপ-দাদার পেশা থেকে উচ্ছেদ করে তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিকে পরিণত করছে; নিজেদের অর্জিত পরম্পরা জ্ঞান, দক্ষতা বাজারের অহংকার হারিয়ে দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে।
তাঁদের জন্য ভদ্রবিত্তরা কী চিন্তাভাবনা করছেন? আছে কোনো সরকারি হিসাব? স্বাধীনতার ৫২ বছরে উন্নয়ন উদ্বাস্তুদের জীবনে কী ঘটেছে, আমরা ভদ্রবিত্তরা কেউ জানি না। একটা মামুলি প্রশ্ন করে রাখা দরকার, এই সনদে কারিগরের কী লাভ? ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে, আপনার দেখা ২০-৪০ বছর আগের চাষি, কারিগরদের অবস্থা কি আগের মতো আছে? জাতিবাদী, আঞ্চলিকতার দুষ্টপাকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আরবান ভদ্রবিত্তের জন্য জিআই, মসলিন রিভাইভাল স্রেফ ‘লেবেঞ্চুস’ মাত্র নয় কি?
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উৎসাহী মানুষজন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই বিষয় নিয়ে যারপরনাই ভাবিত, কিন্তু তাঁরা এর কিয়দংশও যদি ভাবিত হতো—তাঁতিদের সব কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে পাওয়ারলুমের (যান্ত্রিক তাঁত) দৌরাত্ম্য! উচ্ছেদের আশঙ্কা মাথায় নিয়েও, রাষ্ট্র প্রতিমুহূর্তে তাঁর রুটি ও রুজি খেয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে জেনেও চাষি ও কারিগরেরা ঘাড় গুঁজেই কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ তাঁরা তাঁদের কাজ ও পেশাকে ভালোবাসেন। তাঁরা তাঁদের পেশার প্রতি বিশ্বস্ত। তাই তো তাঁরা পারিবারিক অবশেষের পেশায় হাত চালাতে চালাতে বলেন, ‘কী করমু, বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে তো পারি না, অন্য কোনো কাজ তো শিখি নাই!’
পশ্চিমবঙ্গের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের ভদ্রবিত্তের লোকদের অতি উৎসাহের নিদান হলো, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ছিল, আমাদেরই থাকবে’গোছের আপ্তবাক্য! তাঁত বিষয়ে রাষ্ট্রের বৈমাত্রেয় নীতি আর পাওয়ারলুমের ঠেলায় টাঙ্গাইলে তাঁতি আছে কি নেই, সে বিষয়ে না জেনে শিক্ষিত ভদ্রবিত্তের কথায় আমরা অনেকে বেহুঁশ হয়ে পড়েছি।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে। শত বা হাজার বছর যে পণ্যের এমন সনদ লাগল না, তা আজ কেন লাগছে? কারা এর জন্য বেশি উৎসাহী? বলা হয়, কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এই পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।
এবার দেখা যাক জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি দিয়েছে যে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ইন্ডিয়া, তাদের ওয়েবসাইটে যেসব তথ্য জুড়ে দিয়েছে, তা খুব আগ্রহোদ্দীপক। যেমন ভৌগোলিক নির্দেশক বিষয় হিসেবে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন এই ‘বেঙ্গল’ কোথায়? ভারতবর্ষে অফিশিয়ালি ‘বেঙ্গল’ বলে কোন জায়গাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে? আসলে ফাঁকিটাই বা কোথায়? ফলে বাণিজ্য বুদ্ধির চক্রে কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। সত্যই কি তাই নয়? এ মিথ্যাচার নাকি অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা?
শ্রী রবীন্দ্রনাথ রায় ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যে নোটারি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেছেন, সেখানে উল্লিখিত ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’।নথিতে ম্যাপ যুক্ত করে, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে ওয়েস্ট বেঙ্গল বাদ দিয়ে বেঙ্গল হয়েছে। আর বাংলায় করা হয়েছে ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’।
৭০২ নম্বর আবেদনপত্রের বিপরীতে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য আবেদনে জুড়ে দেওয়া ‘রিপোর্ট অন টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, স্টেটমেন্ট অব কেস’-এ বলা হচ্ছে, ‘ইট মে বি সারপ্রাইজিং টু নোট দ্যাট টাঙ্গাইল শাড়ি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিড নট কাম ফ্রম টাঙ্গাইল ইন ইস্টওয়েস্ট (নাও বাংলাদেশ), র্যাদার ইট ইজ এ হাইব্রিড অব শান্তিপুর ডিজাইন অ্যান্ড ঢাকা-টাঙ্গাইল’।
‘বেঙ্গল’ যদি হাইব্রিডই হবে তাহলে আসলের নকল হিসেবে এখানে টাঙ্গাইল নাম ব্যবহারের ন্যায্যতা থাকে কি? বুঝতে হবে কাজটি হাইব্রিড হলেও, ভৌগোলিক স্থান-নাম হিসেবে টাঙ্গাইল হাইব্রিড নয়, এই যা রক্ষে! এবার আসা যাক কতিপয় ভাষ্যের ব্যবচ্ছেদে। অনেকে মধ্যপন্থায় আশ্রয় খোঁজে, ‘কাঁটাতার পেরিয়ে টাঙ্গাইলের যে তাঁতিরা এপারে এসেছেন, তাঁরাও বুকের ভেতর জন্মের ভূমি টাঙ্গাইলকে লালন করেন, তাঁদেরও স্বত্ব পাওয়ার অধিকার আছে। দুই দেশেই থাকুক স্বত্ব।’ এই মধ্যপন্থা মাঝটুকুতে ভরসা রাখে, আগে-পিছে দায় নিতে জানে না।
বিবিসি বাংলা অনলাইনের বরাতে পাওয়া আরও কিছু খোঁড়া যুক্তির নমুনা—‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে মুর্শিদাবাদ জেলার বালুচর এলাকায় এই শাড়ির জন্ম হলেও, পরবর্তীকালে বন্যার কারণে বালুচরি তাঁতিরা বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। পরে সেখানে এই শাড়ির প্রসার ঘটে।’ আর ‘স্থানান্তরিত হলেও বালুচরি শাড়ি “বিষ্ণুপুরি” বা অন্য কোনো নাম পরিগ্রহ করেনি; বরং বালুচরি নামেই জিআই পেয়েছে’ বলে জানান ফুলিয়ার এক তাঁতশিল্প গবেষক। খুবই খোঁড়া যুক্তি! বালুচরে অবশিষ্ট তাঁতিরা ছিলেন নাকি সবাই চলে এসেছিলেন বিষ্ণুপুরে? আর বালুচর ও বিষ্ণুপুর দুটি আলাদা সার্বভৌম দেশের জায়গা তো নয়!
আরেকজন বলছেন, দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে চলে এলেও ‘টাঙ্গাইল’ শব্দটি ছিল বসাক তাঁতিদের অস্থিমজ্জাগত। ফলে উদ্বাস্তু এই তাঁতিরা নিজেদের বয়নীকৃত শাড়ির নাম বা বয়নকৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করেননি। এই যে কল্পনাও করেননি তা কি টাঙ্গাইল শাড়ির প্রয়োজনে, নাকি নিজেদের রুটি রুজির প্রয়োজনে? নাকি বলা যায়, শাড়ির নাম বা বয়নকৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করতে পারেননি? তা তো বটেই, পারেননি বলেই না ফুলিয়ায় ‘টাঙ্গাইল তন্তুজীবী উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামের সমবায় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়! টাঙ্গাইল শাড়ির সাকিন ‘টাঙ্গাইল’ এখানে ‘ব্র্যান্ড নেইম’। নইলে ভারতে বোনা শাড়ির নাম হতো ভিন্ন।
ফুলিয়ার তাঁতিদের প্রতি কোনো বিরূপতা নেই। তাঁরা বাংলাদেশ (টাঙ্গাইল) থেকে গেছেন, কিন্তু স্বতন্ত্র একটা ধারা কিন্তু গড়ে তুলেছেন, যা টাঙ্গাইলের ধারা থেকে গ্রহণ করা আবার আলাদাও। যেমন বেনারসির ডিজাইনে বাংলাদেশে শাড়ি বানালেও সেটা বেনারসির বড়জোর রেপ্লিকা। মানে-গুণে যদি ভালোও হয়, তবু আসল বেনারসি নয়। এভাবে না বুঝলে তো আপনি না বুঝে এঁড়েতর্ক করছেন। অথবা বুঝেশুনে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যক্তিনির্ভর নয়, তা স্থাননির্ভর কৃষ্টির পর্যায়ে উপনীত। পরম্পরা জ্ঞানের এই এক প্রক্রিয়া। কারিগরেরা সচরাচর বাপ-দাদার কারিগরি কৌশল, মুনশিয়ানা পুঁজি করেই এগোতে চান। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। অভিবাসী হিসেবে ভূগোল টপকে পারিবারিক, আঞ্চলিক পেশার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গের ‘বাঙাল তাঁতিরা’ টাঙ্গাইল শাড়ি বুনেছেন, বুনছেন, বুনবেন, এর উৎকর্ষ আরোপ করবেন—এমনটাই হোক। আর এটা হলে টাঙ্গাইলের মূলভূমিপুত্রসহ শাড়ির কারিগরেরা তথা ভূভাগের মানুষেরা গর্বিত হবেন বইকি।
ফুলিয়ার তন্তুবায়রা আমাদের স্বজন। তাঁরা পরম্পরা দক্ষতায় শাড়ি বোনেন কুরুম-ধলেশ্বরীর জল-তাপ হৃদয়ে ধারণ করে, রং আর নকশা মিশিয়ে। আমরা একই বয়ন কারিগরির উত্তরাধিকার, এখানেই আমাদের অভিন্নতা।
টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। কারণ এলাকা, অঞ্চল বা নগর হিসেবে টাঙ্গাইলের অবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও নয়। এ সহজ কথাটা বুঝতে হবে, মানতে হবে। এখানে কোনো বিতর্ক চলে না।
শফিকুল কবীর চন্দন, চারুশিল্পী, লেখক ও গবেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে