জাহীদ রেজা নূর
বইমেলা আসছে। করোনার প্রতাপে দুই বছর বইমেলা ছিল কিছুটা হতোদ্যম। এবার তোড়জোড় করেই শুরু হচ্ছে মেলা। আগামী
১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা চলবে।
মেলা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে জল্পনা-কল্পনা। কাগজসহ প্রকাশনাশিল্পের আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর দাম বাড়ার কারণে প্রকাশকেরা মনে করছেন, এবার বইয়ের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। বাড়তি দামে পাঠকেরা বই কিনবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তরুণ প্রতিভাবান প্রকাশকেরাও এবার নতুন, ভালো বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রচারের একটা ধরন দেখতে পাচ্ছি, যা নতুন নয় যদিও, কিন্তু এবার হচ্ছে তার বহুল ব্যবহার। লেখকেরা ফেসবুকে নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ প্রকাশ করে প্রি-অর্ডারের জন্য আহ্বান রাখছেন। এতে কতটা কাজ হচ্ছে জানি না, কিন্তু বই সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য এই পথ মন্দ নয়। ফেসবুক এখন অনেক বড় বড় সংবাদমাধ্যমের চেয়েও বেশি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে কারও কারও কাছে।
বলতে হয়, গণমাধ্যম এখন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাহসী নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারে অজস্র ভুল-মহাভুলের পরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেসবুকই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। এমনও দেখা গেছে, ফেসবুকে জনমতের প্রকাশ দেখে সরকারও কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর চেয়ে ফেসবুক অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। সেই ফেসবুককে প্রচারের কাজে ঠিকভাবে লাগাতে পারলে বই বিক্রির ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখতেই পারে।
একটি ব্যাপারে কথা না বললেই নয়। এবার মেলায় আদর্শ প্রকাশনী বলে একটি প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই প্রকাশনীর তিনটি বইয়ে নাকি সরকারবিরোধী প্রচারণা আছে। কথা হলো, কেউ কি বইগুলো পড়ে দেখেছেন? যেকোনো বইয়ে যে কারও বিরুদ্ধে সমালোচনা থাকতেই পারে, তাতে সে বইটি নিষিদ্ধ করতে হবে কেন? এইটুকু সহিষ্ণুতা থাকা উচিত। সরকারবিরোধিতা থাকলে কি কোনো বই নিষিদ্ধ করা যায়? সমালোচনার উত্তর দেওয়ার মতো সাহস কি সরকারের নেই? এ বিষয় নিয়ে বড় করে আলোচনা হতে হবে।নইলে ভবিষ্যতে লেখালেখির ক্ষেত্রে সেন্সরের ভূত এসে গলা টিপে ধরতে পারে।
দুই. দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশকেরা ভালো বই লুফে নেন। তবে ভালো বই গ্রহণ করার আগে তাঁরা লেখকের ‘ধার’ ও ‘ভার’ পরীক্ষা করে নেন। একটি বই ভালো হলেই হয় না, সেই বই কে লিখেছেন, সেটাও বিবেচনার বিষয়। যদি লেখক তেমন পরিচিত না হন, তবে তিনি ভালো লিখলেও সেই বই পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চল আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।বলতে চাইছি, বেশির ভাগ প্রকাশনালয়ে এমন কোনো সম্পাদকমণ্ডলী নেই, যাঁরা পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাই করে তা ছাপার যোগ্য কি অযোগ্য সেই মত দিতে পারেন। এমন কোনো সম্পাদকমণ্ডলী নেই, যাঁরা একটি বইকে সুসম্পাদিত করে তারপর বাজারে আনার ব্যবস্থা করেন। এই ঘাটতিটা রয়েই গেছে। ভালো বই এবং নামী লেখক হলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু ভালো বই ও অনামী লেখককে চিনে নেওয়ার প্রবণতা না থাকলে নতুন লেখক উঠে আসবে না।
লেখকের জনপ্রিয়তা প্রকাশকের মুখে হাসি ফোটায় বটে, বইয়ের কাটতি বাড়ায় বটে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। ফিকশন একসময় বই কেনাকাটায় সবচেয়ে বড় জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বই কেনার জন্য পাঠকের যে বিশাল সারি দেখা যেত, সে কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায়নি। তেমনি মারজুক রাসেল কিংবা সাদাত হোসাইনের বইয়ের জন্যও এখন পাঠকের বড় সারি দেখা গেছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন কিংবা আনিসুল হকও স্টলে গেলে তাঁদের দস্তখত নেওয়ার জন্য পাঠকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। এ রকম লেখক নিশ্চয়ই আরও আছেন। কবিতাপ্রেমী বাঙালি এখন কবিতার বই কেন কম পড়ে, সেটাও ভাববার বিষয় বটে।আজকাল ইতিহাস, স্মৃতিকথা ধরনের বইয়ের পাঠকও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের ইতিহাসের নানা জায়গায় যে শূন্যতাগুলো তৈরি হয়েছে, যে ব্যাখ্যাগুলো দাঁড় করানো হয়েছে, তার বাইরেও যে সত্য রয়েছে, সে কথা জানার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছে মানুষ। বিশেষ করে বাঙালির ইতিহাস বা বাংলার ইতিহাসের নানা কিছু নিয়ে আগ্রহ জাগছে। এই ভূখণ্ডে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়কার নেতাদের পুনর্মূল্যায়ন, ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ, ভাষা আন্দোলনের অজানা অধ্যায়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন-পরবর্তী ঘটনাবলি, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন নতুন বই। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, জিয়াউর রহমানের শাসনামল হয়ে এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসনামল নিয়েও পাঠকের আগ্রহ আছে। সেই সব বইয়ের কাটতিও রয়েছে।
আমাদের এদিককার মানুষের মধ্যে স্মৃতিকথা লেখার চল নেই বললেই চলে। অথচ খ্যাতিমান মানুষেরা যদি স্মৃতিকথা লিখে যেতেন, তাহলে আমরা আমাদের প্রবহমান সময়কে ধারাবাহিকভাবে তুলে আনতে পারতাম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিক্ষেত্রের প্রথিতযশা মানুষদের আত্মজীবনী আমাদের ঋদ্ধ করতে পারত। খুঁজতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহার মতো মানুষের আত্মজীবনী (পূর্ণ অথবা খণ্ডিত) পাওয়া গেছে। কামরুদ্দীন আহমদের বিখ্যাত চারটি বই (‘বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ’, ‘বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী’, ‘পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি’, ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’) আত্মজীবনী না হলেও তাতে আত্মজীবনীর রেশ পাওয়া যায় এবং তাতে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আবহ ফুটে ওঠে।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিনোদিনী দাসী, উত্তম কুমার, সলিল দত্ত, সুনির্মল বসুসহ সংস্কৃতিজগতের অনেকের নামই বলা যাবে, যাঁরা আত্মজীবনী লিখেছেন। চিত্রনায়িকা কবরীও তাঁর আত্মজীবনীর একটি অংশ লিখেছিলেন। আবদুল আহাদ, সন্জীদা খাতুন, ফেরদৌসী মজুমদারও লিখেছেন। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার রয়েছে অপরিসীম মূল্য। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি এই বইগুলোর কদর বাড়লে ভালো।
তিন. ১৯৭১ সাল নিয়ে লেখালেখি আরও বেশি হওয়া দরকার। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে আরও ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করা দরকার। দুই সশস্ত্র সেনাদলের সম্মুখ লড়াই কিংবা গেরিলা লড়াই দিয়েই যদি এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ইতিহাসের একটি খণ্ডিত অংশের সঙ্গে পরিচিত হয় মানুষ।অবরুদ্ধ নগরীতে বসে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, যাঁরা বিভিন্ন গ্রামে-নগরে-বন্দরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছেন, অন্তত নিজের আদরের মোরগটি কেটে মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা খাইয়েছেন, যাঁরা খেলার মাঠে কিংবা সংস্কৃতির মাঠে অবদান রেখেছেন, তাঁদের কি আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব না? খেতাবগুলো কেন বহুলাংশে অস্ত্রধারী যোদ্ধারাই পেলেন, তা নিয়ে এখন ভেবে দেখারও অবকাশ আছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে বই হতেই পারে। সম্প্রতি একাত্তর সালে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের সাংবাদিকতার বিষয়ে গবেষণালব্ধ একটি বই লেখা হয়েছে, সেই বইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেকেই বলে থাকেন, ইত্তেফাক সে সময় সামরিক সরকারের দালালি করেছিল। এই বয়ান যাদের মুখে মুখে, তাদের মধ্যে রয়েছেন চীনপন্থী বাম, পাকিস্তানপন্থী ডানেরা। আর বিস্ময়ের ব্যাপার, জাতীয়তাবাদীরাও এ ব্যাপারে থাকেন মৌন। ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া’ বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে একাত্তরে অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে ঝুঁকির মুখে কোন ধরনের সাংবাদিকতা করা হয়েছিল। এ ধরনের আরও অনেক বই বাজারে আসা উচিত। মহিউদ্দীন আহমদ একাত্তর ও তার আশপাশের সময়টা নিয়ে নিজ মূল্যায়নে কিছু বই লিখছেন, সেগুলোও নজরে পড়েছে। ইতিহাসের এই সময়টি ধরে গবেষণালব্ধ বই যত বেশি আসবে, ততই ঋদ্ধ হবে আমাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ভিত্তি। এবং সূক্ষ্মভাবে সেই বইগুলোয় কোনো মতবাদকে তুলে ধরা হচ্ছে কি না, অথবা অন্য কোনো মতবাদ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে কি না, সেটাও আসবে পরবর্তী আলোচনায়।
চার. একটি ভালো বিফ অথবা চিকেন বার্গার খেতে ৪০০ টাকা খরচ হয়। ২০০ পৃষ্ঠার একটি ভালো বইয়ের দাম এই ৪০০ টাকার কাছাকাছি। তাই একটি বার্গার না খেয়ে একটি ভালো বই কিনবেন কি কিনবেন না, সেই ভাবনা পাঠকের। কেউ যদি বার্গার আর বইয়ের এই হিসাব না মেলাতে চান, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। একটি দেশে কত দ্রুত একের পর এক খাবারের দোকান গড়ে ওঠে এবং তা ব্যবসা করে চলে এবং একই সঙ্গে সেই দেশেরই একটি পরিচিত বইয়ের মার্কেট কত দ্রুত কাপড়ের মার্কেটে পরিণত হয়, সেটা তো আমরা নিজের চোখেই দেখলাম।
শুধু এই পরিবর্তনকে গালাগাল করলেই তো হবে না, কেন কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় এই পরিবর্তনটা হয়ে গেল, তা নিয়েও তো হতে পারে মনকাড়া বই। সেখানেই হয়তো লুকিয়ে থাকবে জিয়নকাঠি-মরণকাঠি। সেই গবেষণায়ই হয়তো পাওয়া যাবে বেঁচে থাকার দিশা।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বইমেলা আসছে। করোনার প্রতাপে দুই বছর বইমেলা ছিল কিছুটা হতোদ্যম। এবার তোড়জোড় করেই শুরু হচ্ছে মেলা। আগামী
১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা চলবে।
মেলা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে জল্পনা-কল্পনা। কাগজসহ প্রকাশনাশিল্পের আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর দাম বাড়ার কারণে প্রকাশকেরা মনে করছেন, এবার বইয়ের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। বাড়তি দামে পাঠকেরা বই কিনবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তরুণ প্রতিভাবান প্রকাশকেরাও এবার নতুন, ভালো বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রচারের একটা ধরন দেখতে পাচ্ছি, যা নতুন নয় যদিও, কিন্তু এবার হচ্ছে তার বহুল ব্যবহার। লেখকেরা ফেসবুকে নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ প্রকাশ করে প্রি-অর্ডারের জন্য আহ্বান রাখছেন। এতে কতটা কাজ হচ্ছে জানি না, কিন্তু বই সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য এই পথ মন্দ নয়। ফেসবুক এখন অনেক বড় বড় সংবাদমাধ্যমের চেয়েও বেশি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে কারও কারও কাছে।
বলতে হয়, গণমাধ্যম এখন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাহসী নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারে অজস্র ভুল-মহাভুলের পরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেসবুকই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। এমনও দেখা গেছে, ফেসবুকে জনমতের প্রকাশ দেখে সরকারও কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর চেয়ে ফেসবুক অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। সেই ফেসবুককে প্রচারের কাজে ঠিকভাবে লাগাতে পারলে বই বিক্রির ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখতেই পারে।
একটি ব্যাপারে কথা না বললেই নয়। এবার মেলায় আদর্শ প্রকাশনী বলে একটি প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই প্রকাশনীর তিনটি বইয়ে নাকি সরকারবিরোধী প্রচারণা আছে। কথা হলো, কেউ কি বইগুলো পড়ে দেখেছেন? যেকোনো বইয়ে যে কারও বিরুদ্ধে সমালোচনা থাকতেই পারে, তাতে সে বইটি নিষিদ্ধ করতে হবে কেন? এইটুকু সহিষ্ণুতা থাকা উচিত। সরকারবিরোধিতা থাকলে কি কোনো বই নিষিদ্ধ করা যায়? সমালোচনার উত্তর দেওয়ার মতো সাহস কি সরকারের নেই? এ বিষয় নিয়ে বড় করে আলোচনা হতে হবে।নইলে ভবিষ্যতে লেখালেখির ক্ষেত্রে সেন্সরের ভূত এসে গলা টিপে ধরতে পারে।
দুই. দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশকেরা ভালো বই লুফে নেন। তবে ভালো বই গ্রহণ করার আগে তাঁরা লেখকের ‘ধার’ ও ‘ভার’ পরীক্ষা করে নেন। একটি বই ভালো হলেই হয় না, সেই বই কে লিখেছেন, সেটাও বিবেচনার বিষয়। যদি লেখক তেমন পরিচিত না হন, তবে তিনি ভালো লিখলেও সেই বই পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চল আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।বলতে চাইছি, বেশির ভাগ প্রকাশনালয়ে এমন কোনো সম্পাদকমণ্ডলী নেই, যাঁরা পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাই করে তা ছাপার যোগ্য কি অযোগ্য সেই মত দিতে পারেন। এমন কোনো সম্পাদকমণ্ডলী নেই, যাঁরা একটি বইকে সুসম্পাদিত করে তারপর বাজারে আনার ব্যবস্থা করেন। এই ঘাটতিটা রয়েই গেছে। ভালো বই এবং নামী লেখক হলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু ভালো বই ও অনামী লেখককে চিনে নেওয়ার প্রবণতা না থাকলে নতুন লেখক উঠে আসবে না।
লেখকের জনপ্রিয়তা প্রকাশকের মুখে হাসি ফোটায় বটে, বইয়ের কাটতি বাড়ায় বটে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। ফিকশন একসময় বই কেনাকাটায় সবচেয়ে বড় জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বই কেনার জন্য পাঠকের যে বিশাল সারি দেখা যেত, সে কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায়নি। তেমনি মারজুক রাসেল কিংবা সাদাত হোসাইনের বইয়ের জন্যও এখন পাঠকের বড় সারি দেখা গেছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন কিংবা আনিসুল হকও স্টলে গেলে তাঁদের দস্তখত নেওয়ার জন্য পাঠকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। এ রকম লেখক নিশ্চয়ই আরও আছেন। কবিতাপ্রেমী বাঙালি এখন কবিতার বই কেন কম পড়ে, সেটাও ভাববার বিষয় বটে।আজকাল ইতিহাস, স্মৃতিকথা ধরনের বইয়ের পাঠকও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের ইতিহাসের নানা জায়গায় যে শূন্যতাগুলো তৈরি হয়েছে, যে ব্যাখ্যাগুলো দাঁড় করানো হয়েছে, তার বাইরেও যে সত্য রয়েছে, সে কথা জানার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছে মানুষ। বিশেষ করে বাঙালির ইতিহাস বা বাংলার ইতিহাসের নানা কিছু নিয়ে আগ্রহ জাগছে। এই ভূখণ্ডে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়কার নেতাদের পুনর্মূল্যায়ন, ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ, ভাষা আন্দোলনের অজানা অধ্যায়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন-পরবর্তী ঘটনাবলি, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন নতুন বই। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, জিয়াউর রহমানের শাসনামল হয়ে এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসনামল নিয়েও পাঠকের আগ্রহ আছে। সেই সব বইয়ের কাটতিও রয়েছে।
আমাদের এদিককার মানুষের মধ্যে স্মৃতিকথা লেখার চল নেই বললেই চলে। অথচ খ্যাতিমান মানুষেরা যদি স্মৃতিকথা লিখে যেতেন, তাহলে আমরা আমাদের প্রবহমান সময়কে ধারাবাহিকভাবে তুলে আনতে পারতাম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিক্ষেত্রের প্রথিতযশা মানুষদের আত্মজীবনী আমাদের ঋদ্ধ করতে পারত। খুঁজতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহার মতো মানুষের আত্মজীবনী (পূর্ণ অথবা খণ্ডিত) পাওয়া গেছে। কামরুদ্দীন আহমদের বিখ্যাত চারটি বই (‘বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ’, ‘বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী’, ‘পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি’, ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’) আত্মজীবনী না হলেও তাতে আত্মজীবনীর রেশ পাওয়া যায় এবং তাতে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আবহ ফুটে ওঠে।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিনোদিনী দাসী, উত্তম কুমার, সলিল দত্ত, সুনির্মল বসুসহ সংস্কৃতিজগতের অনেকের নামই বলা যাবে, যাঁরা আত্মজীবনী লিখেছেন। চিত্রনায়িকা কবরীও তাঁর আত্মজীবনীর একটি অংশ লিখেছিলেন। আবদুল আহাদ, সন্জীদা খাতুন, ফেরদৌসী মজুমদারও লিখেছেন। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার রয়েছে অপরিসীম মূল্য। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি এই বইগুলোর কদর বাড়লে ভালো।
তিন. ১৯৭১ সাল নিয়ে লেখালেখি আরও বেশি হওয়া দরকার। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে আরও ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করা দরকার। দুই সশস্ত্র সেনাদলের সম্মুখ লড়াই কিংবা গেরিলা লড়াই দিয়েই যদি এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ইতিহাসের একটি খণ্ডিত অংশের সঙ্গে পরিচিত হয় মানুষ।অবরুদ্ধ নগরীতে বসে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, যাঁরা বিভিন্ন গ্রামে-নগরে-বন্দরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছেন, অন্তত নিজের আদরের মোরগটি কেটে মুক্তিযোদ্ধাদের একবেলা খাইয়েছেন, যাঁরা খেলার মাঠে কিংবা সংস্কৃতির মাঠে অবদান রেখেছেন, তাঁদের কি আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব না? খেতাবগুলো কেন বহুলাংশে অস্ত্রধারী যোদ্ধারাই পেলেন, তা নিয়ে এখন ভেবে দেখারও অবকাশ আছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে বই হতেই পারে। সম্প্রতি একাত্তর সালে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের সাংবাদিকতার বিষয়ে গবেষণালব্ধ একটি বই লেখা হয়েছে, সেই বইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেকেই বলে থাকেন, ইত্তেফাক সে সময় সামরিক সরকারের দালালি করেছিল। এই বয়ান যাদের মুখে মুখে, তাদের মধ্যে রয়েছেন চীনপন্থী বাম, পাকিস্তানপন্থী ডানেরা। আর বিস্ময়ের ব্যাপার, জাতীয়তাবাদীরাও এ ব্যাপারে থাকেন মৌন। ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া’ বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে একাত্তরে অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে ঝুঁকির মুখে কোন ধরনের সাংবাদিকতা করা হয়েছিল। এ ধরনের আরও অনেক বই বাজারে আসা উচিত। মহিউদ্দীন আহমদ একাত্তর ও তার আশপাশের সময়টা নিয়ে নিজ মূল্যায়নে কিছু বই লিখছেন, সেগুলোও নজরে পড়েছে। ইতিহাসের এই সময়টি ধরে গবেষণালব্ধ বই যত বেশি আসবে, ততই ঋদ্ধ হবে আমাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ভিত্তি। এবং সূক্ষ্মভাবে সেই বইগুলোয় কোনো মতবাদকে তুলে ধরা হচ্ছে কি না, অথবা অন্য কোনো মতবাদ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে কি না, সেটাও আসবে পরবর্তী আলোচনায়।
চার. একটি ভালো বিফ অথবা চিকেন বার্গার খেতে ৪০০ টাকা খরচ হয়। ২০০ পৃষ্ঠার একটি ভালো বইয়ের দাম এই ৪০০ টাকার কাছাকাছি। তাই একটি বার্গার না খেয়ে একটি ভালো বই কিনবেন কি কিনবেন না, সেই ভাবনা পাঠকের। কেউ যদি বার্গার আর বইয়ের এই হিসাব না মেলাতে চান, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। একটি দেশে কত দ্রুত একের পর এক খাবারের দোকান গড়ে ওঠে এবং তা ব্যবসা করে চলে এবং একই সঙ্গে সেই দেশেরই একটি পরিচিত বইয়ের মার্কেট কত দ্রুত কাপড়ের মার্কেটে পরিণত হয়, সেটা তো আমরা নিজের চোখেই দেখলাম।
শুধু এই পরিবর্তনকে গালাগাল করলেই তো হবে না, কেন কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় এই পরিবর্তনটা হয়ে গেল, তা নিয়েও তো হতে পারে মনকাড়া বই। সেখানেই হয়তো লুকিয়ে থাকবে জিয়নকাঠি-মরণকাঠি। সেই গবেষণায়ই হয়তো পাওয়া যাবে বেঁচে থাকার দিশা।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে