ইশতিয়াক হাসান
বান্দরবান। সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে পৌঁছাতে তখনো বেশ খানিকটা বাকি। বড় মোদকের কাছাকাছি জায়গাটি। সাঙ্গু নদী ধরে চলছে আমাদের নৌকা। সালটা ২০১১। হঠাৎই এক অদ্ভুত জায়গায় চলে এলাম। চারদিকে সুনসান, নেই মানুষের আনাগোনা, কেবল পাখি আর পোকামাকড়ের শব্দ। নৌকা দাঁড় করতে বললাম মাঝিদের। নদীর মাঝখানে বড় একটা পাথুরে জায়গা জেগে দ্বীপের মতো। সেখানে আয়েশ করে বসলাম।
নদীর বাম পাশে এক কৃষক মারফা বা পাহাড়ি শসা চাষ করেছেন। একটা বানর মজা করে মারফা খাচ্ছে কৃষকের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে। মারফাখেতের পাশ থেকেই শুরু জঙ্গলের। সেদিকে তাকালাম। তখনই এক ঝলকের জন্য দেখলাম জন্তুটাকে। লালচে শরীর, মাঝারি আকারের কুকুরের আকৃতি। পরমুহূর্তেই হারিয়ে গেল অরণ্যে। ঢোল বা বুনো কুকুর। পাহাড়–অরণ্যে দীর্ঘ ঘোরাঘুরিতে ওই একবারই আড়ালে থাকতে পছন্দ করা জন্তুটিকে দেখার সৌভাগ্য হয়।
এ তো গেল প্রথম ও একমাত্র সাক্ষাতের গল্প। এবার বরং ঢোল জন্তুটি কী, তা একটু জেনে নেওয়া যাক। একধরনের বন্য কেনিড এরা। বৈজ্ঞানিক নাম কুয়ন আলপিনাস। লালচে রঙের এই জন্তু মূলত মধ্য, পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই এলাকার গভীর জঙ্গলের বাতাস প্রায়ই আলোড়িত হয় এদের শিস, চিৎকারে; সম্বার, বুনো শূকরের মতো প্রাণীদের আত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোয় এদের আছে নানা নাম। যেমন শিস দেওয়া কুকুর, লাল নেকড়ে, রাম কুত্তা। ইংরেজি নাম এশিয়ান ওয়াইল্ড ডগ। আইইউসিএনের তথ্য অনুয়ায়ী, দুনিয়ায় মুক্তভাবে বিচরণ করা ঢোলের সংখ্যা ৯৪৯ থেকে ২ হাজার ২১৫, যা বুনো পরিবেশে টিকে থাকা বাঘের সংখ্যা থেকেও কম। কিন্তু তার পরও সাধারণ মানুষ তো বটেই, সংরক্ষণবিদ ও গবেষকদের কাছেও অনেকটা অচ্ছুত এরা।
এবার বুনো কুকুরের আরেকটি মজার বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। সালটা ২০০৪–০৫। বেড়াতে গিয়েছি সীতাকুণ্ডের ইকো পার্কে। তখন আলাপ জমল এক বিট কর্মকর্তা ও কয়েকজন বনকর্মীর সঙ্গে। কথায় কথায় তাঁরা জানালেন এক অদ্ভুত ঘটনা। আহত এক মায়া হরিণকে উদ্ধার করে একটি খাঁচায় রাখা হয়েছিল পার্কের ভেতরে। রাতে অতর্কিতে হামলা চালায় ঢোল বা বন্য কুকুরদের একটা দল। সীতাকুণ্ডে ঢোল আছে এটা শুনে তখন অবাক হয়েছিলাম। তারপর তাঁরা দিলেন আরেক আশ্চর্য তথ্য। ঢোলরা নাকি চোখে প্রস্রাব ছুড়ে সাময়িক অন্ধ করে দেয় শিকারকে। তখন কথাটা ঠিক হজম করতে পারিনি, তবে পরে বিখ্যাত শিকারি, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখক এবং পরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষক এন্ডারসনের বইয়েও পেয়েছিলাম একই ধরনের বর্ণনা। সীতাকুণ্ডের ওই সফরের পর থেকেই বন্য কুকুরের প্রতি আগ্রহের শুরু। অবশ্য এরও কয়েক বছর আগে পত্রিকায় একটা খবর দেখেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছ আজও। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া কিংবা সাতকানিয়ার দিকে পাহাড় কাটা শ্রমিকেরা ঢোলের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। যত দূর জানি, এখনো সীতাকুণ্ড–মিরসরাইয়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় ঢোল বা বন্য কুকুরেরা। কদিন আগেই ইকো পার্কটির দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হই এ বিষয়ে।
তবে তুখোড় শিকারি হলেও গায়ে–গতরে এদের মোটেই বিশাল বলা যাবে না। আকারে অস্বাভাবিক রকম ছোট। ওজন কেবল ১২ থেকে ২০ কেজি, যা নেকড়ের চেয়ে অনেক কম, অনেকটা মাঝারি আকারের কুকুরের সমান।
ঢোলদের শিকারের ক্ষমতা নির্ভর করে দলের সদস্যসংখ্যা ও পরিস্থিতির ওপর। সাধারণ এক–একটি দলে ৫ থেকে ১৫টি ঢোল থাকে। কোনো কোনো গবেষণায় চল্লিশটি, এমনকি এক শটি পর্যন্ত সদস্যের দলের কথাও শোনা যায়। শিকারে ঢোলরা নানা পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। কখনো কখনো ছোট দল পাঠায় স্কাউট করার জন্য। তবে সফল হলে মোটেই শিকারকে গলায় কামড়ে ধরে মারে না বাঘ বা চিতা বাঘের মতো। বরং ধরাশায়ী করে সরাসরি খেতে শুরু করে। এমনকি জীবন্ত অবস্থায় শিকারের চারপাশ থেকে ঘিরে আক্রমণ করে খাবলা–খাবলা মাংস তুলে নেওয়ার বিবরণও পাওয়া যায়। তবে ঢোলদের ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য পাওয়া মুশকিল। কারণ, এদের দেখা পাওয়া ভার। চেহারাও এমন যে একটি থেকে আরেকটিকে, এমনকি স্ত্রী–পুরুষ আলাদা করাও মুশকিল।
বাঘের মতো পরাক্রমশালী প্রাণীকে হার মানিয়ে দেওয়ার রেকর্ড আছে ঢোলের। বিখ্যাত শিকারি অ্যান্ডারসনের বইয়ে এ রকম অন্তত দুটো ঘটনার বিবরণ আছে। এর মধ্যে একবার পরের দিন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় কেবল বাঘটার কিছু চামড়ার টুকরো। বুনো কুকুরের দলটি বাঘটিকে কোণঠাসা করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ১৮০৭ সালের এক পেইন্টিংও কিন্তু এ ধরনের ঘটনাকেই সমর্থন করে, সেখানে এক দল ঢোলকে দেখা যায় একটি বাঘকে তাড়া করতে।
ঢোলদের কথা পাওয়া যায় আরও অনেক শিকারি ও অ্যাডভেঞ্চারের বইয়েও। এদের একজন এ মারভিন স্মিথ। বিশালদেহী বুনো মোষ আর সাম্বারদের ধরাশায়ী করার কাহিনি বর্ণনা করেছেন তিনি। এমনকি এক বন্ধু দুটো ঢোলের বাচ্চা পোষার ঘটনারও বিবরণ দিয়েছেন। ওগুলোর গায়ে এমন গন্ধ ছিল যে, বহুবার ধুয়েও গন্ধ দূর করা সম্ভব হয়নি। একটাকে পেলেপুষে বড় করলেও বুনো স্বভাব পুরোপুরি যায়নি। এমনকি সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর ওটাও পালিয়ে যায়।
যেসব এলাকায় বাঘ বা চিতা বাঘের সঙ্গে একত্রে বাস করতে হয়, সেখানে টিকে থাকার একটি সূত্র আছে ঢোলদের। তারা অরণ্যের পরাক্রমশালী ওই প্রাণীদের তুলনায় অন্য ধরনের শিকার বেছে নেয়। কখনো কখনো সরাসরি প্রতিযোগিতাও হয়। এমনকি বাঘের আক্রমণে ঢোল মারা যাওয়ার কিংবা চিতা বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়ার ঘটনাও শোনা যায়।
বাঘ–চিতার সঙ্গে লড়াই করে হয়তো টিকে থাকা সম্ভব, তবে সবচেয়ে ভয়ানক শত্রু মানুষের হাত থেকে বাঁচা কঠিন। বন ধ্বংসের পাশাপাশি এদের শিকার কমে যাওয়াও একটা সমস্যা। ঢোল কোনো গবাদিপশু মারলে মালিক ওই পশুটার শরীরে বিষ মাখিয়ে রাখে। এতে একবারে গোটা একটা ঢোলের দলও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এভাবে অবশ্য বাঘ, চিতা কিংবা শকুনও মারে জঙ্গল এলাকার আশপাশে বসবাস করা অধিবাসীরা। এ ধরনের বিষ মাখিয়ে ঢোল বা চিতা বাঘ হত্যার কথা শোনা যায় বাংলাদেশেও।
গত দশ বছরে ঢোলের বিচরণের এলাকা অন্তত ৫০ শতাংশ কমেছে বলে দাবি করেন গবেষকেরা। তবে ঢোলদের গতিবিধি অনুসরণ করা মুশকিল। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে খুব দুর্গম এলাকায় বাস ঢোলদের। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা ভুটানের সাধারণ বনে এদের আবাস থাকলেও নিজেদের জাহির করার অভ্যাস নেই মোটেই।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শিকারি প্রাণী হওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খলে এদের দারুণ ভূমিকা রয়েছে। ওখানকার কোনো কোনো এলাকা থেকে বাঘ বিদায় নেওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খলের ওপরে উঠে এসেছে ঢোল। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতেও তাই দারুণ ভূমিকা এদের। আর আশ্চর্যজনক হলেও মানুষকে আক্রমণ করার প্রবণতা এদের একেবারেই কম।
চুনারুঘাটের তরাপ হিলে অবস্থিত কালেঙ্গার অরণ্যে বন্য কুকুরের গল্প শুনেছে অনেকেই। সাম্প্রতিক সময়েও এই অরণ্যে ঢোলের আক্রমণের খবর মিলেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের অনেক বনেই টিকে আছে এই ধূর্ত প্রাণীরা। হালকা-পাতলা গড়ন ও সাবধানী চলাফেরার কারণে লোকচক্ষুর অনেকটাই আড়ালে থাকে এরা। আবার হরিণ কিংবা বিড়াল গোত্রের প্রাণীদের মতো এদের প্রতি চোরা শিকারিদের আগ্রহ কম থাকাও একটা বড় কারণ।
বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের বসানো ক্যামেরা ট্র্যাপে বান্দরবানের সাঙ্গু রিজার্ভে ধরা পড়েছে ঢোলের একাধিক ছবি। এমনকি হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ছোট্ট এক বন সাতছড়িতেও সন্ধান মিলেছে এদের। ভারতের বারোমুরা হিলের সবচেয়ে উত্তর-পুবের সীমানায় অবস্থান রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্গত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। এখানেই ক্যামেরা ট্র্যাপে ঢোলদের বন্দী করেছেন তিন গবেষক তানিয়া জাকির, হারিশ দেববর্মা ও মুনতাসির আকাশ।
বন বিভাগে চাকরি করা মাহফুজুল হক রাঙামাটি-বান্দরবানে কয়েকবারই ঢোল দেখার কথা বলেছিলেন। কাসালং সংরক্ষিত বনেও এরা আছে। রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয় চাকমার কাছ থেকে শুনেছি, এখনো দুর্গ পাড়ার বাসিন্দাদের গবাদিপশু মারা পড়ার ঘটনা ঘটে ঢোলের আক্রমণে।
প্রকৃতিপ্রেমী মইনুল ইসলাম কাপ্তাইয়ে থাকতেন বাবার চাকরি সূত্রে, সেটা অন্তত বছর তিরিশেক আগের কথা। জানালেন, তখন নৌবাহিনীর এলাকায় বুনো কুকুরের অনেক বড় একটা দল দেখতেন প্রায়ই। কাপ্তাইয়ের ঢোলের ওই দলের বংশধরেরা কী এখনো মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাপ্তাইয়ের বন–পাহাড়ে? নাকি আরও অনেক বন্যপ্রাণীর মতো মানুষের হিংস্রতার বলি হয়ে তারা আস্তানা পাল্টেছে কিংবা হারিয়েই গেছে।
আরও পড়ুন
বান্দরবান। সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে পৌঁছাতে তখনো বেশ খানিকটা বাকি। বড় মোদকের কাছাকাছি জায়গাটি। সাঙ্গু নদী ধরে চলছে আমাদের নৌকা। সালটা ২০১১। হঠাৎই এক অদ্ভুত জায়গায় চলে এলাম। চারদিকে সুনসান, নেই মানুষের আনাগোনা, কেবল পাখি আর পোকামাকড়ের শব্দ। নৌকা দাঁড় করতে বললাম মাঝিদের। নদীর মাঝখানে বড় একটা পাথুরে জায়গা জেগে দ্বীপের মতো। সেখানে আয়েশ করে বসলাম।
নদীর বাম পাশে এক কৃষক মারফা বা পাহাড়ি শসা চাষ করেছেন। একটা বানর মজা করে মারফা খাচ্ছে কৃষকের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে। মারফাখেতের পাশ থেকেই শুরু জঙ্গলের। সেদিকে তাকালাম। তখনই এক ঝলকের জন্য দেখলাম জন্তুটাকে। লালচে শরীর, মাঝারি আকারের কুকুরের আকৃতি। পরমুহূর্তেই হারিয়ে গেল অরণ্যে। ঢোল বা বুনো কুকুর। পাহাড়–অরণ্যে দীর্ঘ ঘোরাঘুরিতে ওই একবারই আড়ালে থাকতে পছন্দ করা জন্তুটিকে দেখার সৌভাগ্য হয়।
এ তো গেল প্রথম ও একমাত্র সাক্ষাতের গল্প। এবার বরং ঢোল জন্তুটি কী, তা একটু জেনে নেওয়া যাক। একধরনের বন্য কেনিড এরা। বৈজ্ঞানিক নাম কুয়ন আলপিনাস। লালচে রঙের এই জন্তু মূলত মধ্য, পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই এলাকার গভীর জঙ্গলের বাতাস প্রায়ই আলোড়িত হয় এদের শিস, চিৎকারে; সম্বার, বুনো শূকরের মতো প্রাণীদের আত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোয় এদের আছে নানা নাম। যেমন শিস দেওয়া কুকুর, লাল নেকড়ে, রাম কুত্তা। ইংরেজি নাম এশিয়ান ওয়াইল্ড ডগ। আইইউসিএনের তথ্য অনুয়ায়ী, দুনিয়ায় মুক্তভাবে বিচরণ করা ঢোলের সংখ্যা ৯৪৯ থেকে ২ হাজার ২১৫, যা বুনো পরিবেশে টিকে থাকা বাঘের সংখ্যা থেকেও কম। কিন্তু তার পরও সাধারণ মানুষ তো বটেই, সংরক্ষণবিদ ও গবেষকদের কাছেও অনেকটা অচ্ছুত এরা।
এবার বুনো কুকুরের আরেকটি মজার বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। সালটা ২০০৪–০৫। বেড়াতে গিয়েছি সীতাকুণ্ডের ইকো পার্কে। তখন আলাপ জমল এক বিট কর্মকর্তা ও কয়েকজন বনকর্মীর সঙ্গে। কথায় কথায় তাঁরা জানালেন এক অদ্ভুত ঘটনা। আহত এক মায়া হরিণকে উদ্ধার করে একটি খাঁচায় রাখা হয়েছিল পার্কের ভেতরে। রাতে অতর্কিতে হামলা চালায় ঢোল বা বন্য কুকুরদের একটা দল। সীতাকুণ্ডে ঢোল আছে এটা শুনে তখন অবাক হয়েছিলাম। তারপর তাঁরা দিলেন আরেক আশ্চর্য তথ্য। ঢোলরা নাকি চোখে প্রস্রাব ছুড়ে সাময়িক অন্ধ করে দেয় শিকারকে। তখন কথাটা ঠিক হজম করতে পারিনি, তবে পরে বিখ্যাত শিকারি, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখক এবং পরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষক এন্ডারসনের বইয়েও পেয়েছিলাম একই ধরনের বর্ণনা। সীতাকুণ্ডের ওই সফরের পর থেকেই বন্য কুকুরের প্রতি আগ্রহের শুরু। অবশ্য এরও কয়েক বছর আগে পত্রিকায় একটা খবর দেখেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছ আজও। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া কিংবা সাতকানিয়ার দিকে পাহাড় কাটা শ্রমিকেরা ঢোলের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। যত দূর জানি, এখনো সীতাকুণ্ড–মিরসরাইয়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় ঢোল বা বন্য কুকুরেরা। কদিন আগেই ইকো পার্কটির দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হই এ বিষয়ে।
তবে তুখোড় শিকারি হলেও গায়ে–গতরে এদের মোটেই বিশাল বলা যাবে না। আকারে অস্বাভাবিক রকম ছোট। ওজন কেবল ১২ থেকে ২০ কেজি, যা নেকড়ের চেয়ে অনেক কম, অনেকটা মাঝারি আকারের কুকুরের সমান।
ঢোলদের শিকারের ক্ষমতা নির্ভর করে দলের সদস্যসংখ্যা ও পরিস্থিতির ওপর। সাধারণ এক–একটি দলে ৫ থেকে ১৫টি ঢোল থাকে। কোনো কোনো গবেষণায় চল্লিশটি, এমনকি এক শটি পর্যন্ত সদস্যের দলের কথাও শোনা যায়। শিকারে ঢোলরা নানা পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। কখনো কখনো ছোট দল পাঠায় স্কাউট করার জন্য। তবে সফল হলে মোটেই শিকারকে গলায় কামড়ে ধরে মারে না বাঘ বা চিতা বাঘের মতো। বরং ধরাশায়ী করে সরাসরি খেতে শুরু করে। এমনকি জীবন্ত অবস্থায় শিকারের চারপাশ থেকে ঘিরে আক্রমণ করে খাবলা–খাবলা মাংস তুলে নেওয়ার বিবরণও পাওয়া যায়। তবে ঢোলদের ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য পাওয়া মুশকিল। কারণ, এদের দেখা পাওয়া ভার। চেহারাও এমন যে একটি থেকে আরেকটিকে, এমনকি স্ত্রী–পুরুষ আলাদা করাও মুশকিল।
বাঘের মতো পরাক্রমশালী প্রাণীকে হার মানিয়ে দেওয়ার রেকর্ড আছে ঢোলের। বিখ্যাত শিকারি অ্যান্ডারসনের বইয়ে এ রকম অন্তত দুটো ঘটনার বিবরণ আছে। এর মধ্যে একবার পরের দিন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় কেবল বাঘটার কিছু চামড়ার টুকরো। বুনো কুকুরের দলটি বাঘটিকে কোণঠাসা করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ১৮০৭ সালের এক পেইন্টিংও কিন্তু এ ধরনের ঘটনাকেই সমর্থন করে, সেখানে এক দল ঢোলকে দেখা যায় একটি বাঘকে তাড়া করতে।
ঢোলদের কথা পাওয়া যায় আরও অনেক শিকারি ও অ্যাডভেঞ্চারের বইয়েও। এদের একজন এ মারভিন স্মিথ। বিশালদেহী বুনো মোষ আর সাম্বারদের ধরাশায়ী করার কাহিনি বর্ণনা করেছেন তিনি। এমনকি এক বন্ধু দুটো ঢোলের বাচ্চা পোষার ঘটনারও বিবরণ দিয়েছেন। ওগুলোর গায়ে এমন গন্ধ ছিল যে, বহুবার ধুয়েও গন্ধ দূর করা সম্ভব হয়নি। একটাকে পেলেপুষে বড় করলেও বুনো স্বভাব পুরোপুরি যায়নি। এমনকি সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর ওটাও পালিয়ে যায়।
যেসব এলাকায় বাঘ বা চিতা বাঘের সঙ্গে একত্রে বাস করতে হয়, সেখানে টিকে থাকার একটি সূত্র আছে ঢোলদের। তারা অরণ্যের পরাক্রমশালী ওই প্রাণীদের তুলনায় অন্য ধরনের শিকার বেছে নেয়। কখনো কখনো সরাসরি প্রতিযোগিতাও হয়। এমনকি বাঘের আক্রমণে ঢোল মারা যাওয়ার কিংবা চিতা বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়ার ঘটনাও শোনা যায়।
বাঘ–চিতার সঙ্গে লড়াই করে হয়তো টিকে থাকা সম্ভব, তবে সবচেয়ে ভয়ানক শত্রু মানুষের হাত থেকে বাঁচা কঠিন। বন ধ্বংসের পাশাপাশি এদের শিকার কমে যাওয়াও একটা সমস্যা। ঢোল কোনো গবাদিপশু মারলে মালিক ওই পশুটার শরীরে বিষ মাখিয়ে রাখে। এতে একবারে গোটা একটা ঢোলের দলও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এভাবে অবশ্য বাঘ, চিতা কিংবা শকুনও মারে জঙ্গল এলাকার আশপাশে বসবাস করা অধিবাসীরা। এ ধরনের বিষ মাখিয়ে ঢোল বা চিতা বাঘ হত্যার কথা শোনা যায় বাংলাদেশেও।
গত দশ বছরে ঢোলের বিচরণের এলাকা অন্তত ৫০ শতাংশ কমেছে বলে দাবি করেন গবেষকেরা। তবে ঢোলদের গতিবিধি অনুসরণ করা মুশকিল। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে খুব দুর্গম এলাকায় বাস ঢোলদের। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা ভুটানের সাধারণ বনে এদের আবাস থাকলেও নিজেদের জাহির করার অভ্যাস নেই মোটেই।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শিকারি প্রাণী হওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খলে এদের দারুণ ভূমিকা রয়েছে। ওখানকার কোনো কোনো এলাকা থেকে বাঘ বিদায় নেওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খলের ওপরে উঠে এসেছে ঢোল। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতেও তাই দারুণ ভূমিকা এদের। আর আশ্চর্যজনক হলেও মানুষকে আক্রমণ করার প্রবণতা এদের একেবারেই কম।
চুনারুঘাটের তরাপ হিলে অবস্থিত কালেঙ্গার অরণ্যে বন্য কুকুরের গল্প শুনেছে অনেকেই। সাম্প্রতিক সময়েও এই অরণ্যে ঢোলের আক্রমণের খবর মিলেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের অনেক বনেই টিকে আছে এই ধূর্ত প্রাণীরা। হালকা-পাতলা গড়ন ও সাবধানী চলাফেরার কারণে লোকচক্ষুর অনেকটাই আড়ালে থাকে এরা। আবার হরিণ কিংবা বিড়াল গোত্রের প্রাণীদের মতো এদের প্রতি চোরা শিকারিদের আগ্রহ কম থাকাও একটা বড় কারণ।
বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের বসানো ক্যামেরা ট্র্যাপে বান্দরবানের সাঙ্গু রিজার্ভে ধরা পড়েছে ঢোলের একাধিক ছবি। এমনকি হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ছোট্ট এক বন সাতছড়িতেও সন্ধান মিলেছে এদের। ভারতের বারোমুরা হিলের সবচেয়ে উত্তর-পুবের সীমানায় অবস্থান রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্গত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। এখানেই ক্যামেরা ট্র্যাপে ঢোলদের বন্দী করেছেন তিন গবেষক তানিয়া জাকির, হারিশ দেববর্মা ও মুনতাসির আকাশ।
বন বিভাগে চাকরি করা মাহফুজুল হক রাঙামাটি-বান্দরবানে কয়েকবারই ঢোল দেখার কথা বলেছিলেন। কাসালং সংরক্ষিত বনেও এরা আছে। রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয় চাকমার কাছ থেকে শুনেছি, এখনো দুর্গ পাড়ার বাসিন্দাদের গবাদিপশু মারা পড়ার ঘটনা ঘটে ঢোলের আক্রমণে।
প্রকৃতিপ্রেমী মইনুল ইসলাম কাপ্তাইয়ে থাকতেন বাবার চাকরি সূত্রে, সেটা অন্তত বছর তিরিশেক আগের কথা। জানালেন, তখন নৌবাহিনীর এলাকায় বুনো কুকুরের অনেক বড় একটা দল দেখতেন প্রায়ই। কাপ্তাইয়ের ঢোলের ওই দলের বংশধরেরা কী এখনো মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাপ্তাইয়ের বন–পাহাড়ে? নাকি আরও অনেক বন্যপ্রাণীর মতো মানুষের হিংস্রতার বলি হয়ে তারা আস্তানা পাল্টেছে কিংবা হারিয়েই গেছে।
আরও পড়ুন
ঢাকার বাতাস আজ খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সকালে পরিমাপ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের স্কোর ২৪৫। অন্যদিকে বায়ুদূষণের শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর। গুরুতর বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। এ ছাড়া দূষণের শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় ঘুরে ফিরে এই তিন দেশেরই বিভিন্ন
১৬ ঘণ্টা আগেআজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জলবায়ু ও পরিবেশ সাংবাদিকদের সংগঠন ‘সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম’ (সাকজেএফ) এর নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে।
১ দিন আগেসেন্টমার্টিনের প্রবাল রক্ষায় সেখানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপকে কেন্দ্র করে গত কিছুদিন ধরেই আলোচনায় দ্বীপটি । এরই মধ্যে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল আবিষ্কৃত হলো প্রশান্ত মহাসাগরে। অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রাণী একসঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি প্রাচীরের পরিবর্তে একটি বিশালাকায় প্রবাল গঠন করেছে সেখা
১ দিন আগেঢাকার বাতাস আজও অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ওপরে উঠে দাঁড়িয়েছে পাঁচ এ। সকালে পরিমাপ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের স্কোর ১২৩। অন্যদিকে একদিনের ব্যবধানে আবারও বায়ুদূষণের শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর। গুরুতর বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। এ ছাড়া দূষণের শীর্ষ পাঁচ দেশের
২ দিন আগে