ইশতিয়াক হাসান
আজ বিশ্ব হাতি দিবস। তিনটি হাতির বাচ্চার কথা বড় বেশি মনে পড়ছে। প্রথমটির গল্প মন খারাপ করে দেওয়া। গত বছরের নভেম্বরের এক সকালে পত্রিকাতে খবরটা দেখেই মনটা কেঁদে উঠল। কক্সবাজারের চকোরিয়ায় তিন বছর বয়সের একটা হাতির বাচ্চাকে গুলি করে মারা হয়। মাদী বাচ্চা হাতিটাকে মেরে পুতে ফেলা হয়েছিল মাটির নিচে! কীভাবে সম্ভব! একটা বাচ্চা হাতি, তাও মাদি, কাজেই ওর থেকে দাঁত পাওয়ার সুযোগ নেই! শুধু ধান খাওয়ার অপরাধে মেরে ফেলল ছোট্ট হাতিটাকে?
এই লেখার সূত্র ধরেই আমার নিজের হাতিপ্রীতির কথা না বলে পারছি না। এটা এতটাই যে, বন্ধু ও সহকর্মীরা মজা করে হাতি ইশতিয়াকও ডাকে! তবে এতে আমার গা জ্বালা করে না মোটেই! হাতির খোঁজে চষে বেড়িয়েছি রাঙামাটির কাপ্তাই, বান্দরবানের লামা-আলীকদম, দুধপুকুরিয়াসহ কত জঙ্গলে। কাসালং ফরেস্টের রাঙ্গীপাড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম হাতির পালের ১০ গজের মধ্যে। তখন হাতিগুলো মানুষের যন্ত্রণায় ছিল খুব অস্থির, তারপরও আমাকে কিছুই করেনি।
ওই রাঙ্গীপাড়াতেই মা আর বাচ্চা হাতির সঙ্গে হয়েছিল আশ্চর্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আজ সকালে কেন যেন মনে পড়ছে কাসালং রিজার্ভের রাঙ্গীপাড়ার ওই বাচ্চা হাতির কথা, যে মায়ের সঙ্গে আটকা পড়েছিল জঙ্গলে। চারপাশ থেকে মানুষজন ঘিরে ফেলেছিল ওদের। এমনকি গাছের ওপর উঠেও ওদের দেখছিল উৎসুক জনতা। কী অসহায় লাগছিল মা ও বাচ্চাটাকে যখন ওরা এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছিল। সত্যি কি বুনো হাতিদের জন্য আর জায়গা নেই আমাদের বনে?
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৬ সালের জরিপ বলছে এ দেশে স্থায়ী বুনো হাতি আছে ২৭০ টির মতো। আশ্চর্যজনক হলেও কক্সবাজার ও এর আশপাশের বন-পাহাড়ে গত নভেম্বরে এক সপ্তাহর কিছু বেশি সময়ের মধ্যে হত্যা করা হয় চারটি বন্য হাতি।
সাধারণত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় দাঁতের জন্য হাতি মারে চোরাশিকারিরা। এটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় অপরাধ! তবে আশ্চর্য ব্যাপার কক্সবাজারের এই হাতিগুলোকে এমনকি দাঁতের জন্যও মারা হয়নি। এদের বেশির ভাগ হয় মাদি, নয়তো শিশু। তার মানে কেবল ধান খাওয়া, মরিচ খাওয়ার মতো অপরাধে এদের মেরে ফেলা হয়েছে। কারা মারছে? আমরা; এই সভ্য, বুদ্ধিমান মানুষেরা!
গত দেড়-দুই বছর ধরে একের পর এক হাতি মারা যাওয়ার খবর পাচ্ছি আমাদের অরণ্যগুলো থেকে। কক্সবাজার-টেকনাফ-লামা-আলীকদম—এই জায়গাগুলোয় বেশ কয়েকটি বড় পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতিদের, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। রোহিঙ্গা বসতির কারণে ওগুলোর কয়েকটি এক রকম বন্দীজীবন কাটাচ্ছে। আছে চরম খাবার সংকটে।
মাঝখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল খান ভাই কক্সবাজারের বুনো হাতির পালের ছবি তুলেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি হাতি ছিল একেবারেই কঙ্কালসার। কোনো হাতির চেহারা যে এতটা পলকা হতে পারে, তা কল্পনাও করিনি। হয়তো খাবার অভাবেই ওদের এই হাল!
ইদানীং, চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে একের পর এক হাতি মৃত্যুর যে ঘটনা ঘটছে, তার প্রায় সবগুলোই কক্সবাজার-লামার বন-পাহাড়ে। এর মধ্যে অনেকগুলো মারা পড়েছে কীভাবে শুনবেন? বিদ্যুতায়িত তারের স্পর্শে। বেশ কিছুকে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। আমরা মানুষেরা পরিকল্পিতভাবে এটা করেছি।
আইইউসিএনের পাঁচ বছর আগের জরিপ বলছে, দেশের স্থায়ী বুনো হাতির অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ১৪৭ টির (গড়) আস্তানা কক্সবাজার-লামার বনাঞ্চলে। যে হারে হাতি মারা পড়ছে ওই এলাকায়, এখন আর কতটি বুনো হাতি আছে কে জানে?
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাতির বিচরণ আছে—এমন তিনটি সংরক্ষিত অরণ্য চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ২৭ কিলোমিটার বনাঞ্চল কেটে যাবে রেললাইনটি। যত দূর জানি, ওই রেলপথ যাবে হাতি চলাচলের অন্তত ছয়টি করিডরের ওপর দিয়ে। ভারতে নীলগিরিসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় হাতি চলাচলের রাস্তার ওপর দিয়ে রেললাইন গেছে। ওদের ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক ভালো। তারপর সেখানেও রেলগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে হাতি মারা পড়ার রেকর্ড আছে প্রচুর।
এখন হাতি মারা হচ্ছে গুলি করে, বিদ্যুতায়িত করে; রেললাইন তৈরি হলে রেলগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে আরও কিছু মারা পড়া খুব স্বাভাবিক। কারণ, ওই হাতিগুলোর রেলগাড়ি নামক যন্ত্রদানবের সঙ্গে পরিচয়ই নেই। অবশ্য যে পরিস্থিতি ট্রেন চলাচল শুরু পর্যন্ত আর কতটি বুনো হাতি ওই এলাকায় টিকে থাকে—এটাও ভাববার বিষয়। রেললাইন তৈরির বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। তবে বুনো হাতির ব্যাপারটা মাথায় রেখে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি।
কক্সবাজার-লামা বাদে তাহলে হাতিরা ভালো আছে? একেবারেই না, ওই সব অরণ্যে হাতির অবস্থা আগে থেকেই ভয়াবহ। আমার জানামতে, সিলেট বিভাগে লাঠিটিলা বাদে আর কোথাও এখন এমনকি সীমান্ত পেরিয়েও আসে না হাতিরা। এই বুনো জন্তুরাও বুঝে গেছে, সীমানা পেরোলেই বিপদ! ওই হিসাবে জামালপুর-শেরপুরের দিকটায় গারো পাহাড়ের ভারতের অংশ থেকে নামা হাতিগুলো নিরেট গর্দভ! বছরে কয়েক মাস আমাদের সীমানায় কাটায় এরা। তবে যেগুলো আসে, সবগুলো ফিরতে পারে না। বিদ্যুতায়িত করে এই এলাকায়ও হাতি মারা হয় নিয়মিতই।
আমাদের স্থায়ী বুনো হাতি আছে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে। আগেই বলেছি আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপে সংখ্যাটা ২৭০ টির মতো বলে ধারণা করা হয়েছে। যেভাবে বুনো হাতি হত্যা হচ্ছে, সংখ্যাটা কতটা কমেছে খোদা জানে! অথচ ড. রেজা খান ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের বনগুলোতে ৪০০ টির মতো স্থায়ী বন্য হাতি আছে বলে ধারণা করেছিলেন। তবে আমার ধারণা সংখ্যায় হয়তো আরও বেশিই ছিল বুনো হাতিরা তখন।
২০১৬ সালের জরিপে রাঙামাটির কাসালং, কাপ্তাই মিলিয়ে সাকল্যে ৫০ টির মতো বুনো হাতি থাকার খবরও অশনিসংকেত আমাদের জন্য। নয় বছর আগে রাঙামাটির রাঙ্গীপাড়ায় বুনো হাতির যে দল দেখেছিলাম, সেখানে একটিও দাঁতাল হাতি ছিল না। দাঁতাল হাতির সংখ্যা এতই কমছে যে, এক সময় জিন পুল থেকেই এদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে!
অথচ আগে হাতিরা কী সুন্দর দিন কাটাত। ইউসুফ এস আহমদ, এনায়েত মাওলার বই থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, বিংশ শতকের মাঝামাঝির দিকে রাঙামাটির কাসালংয়ের মাইনিমুখ, মাহিল্লা, শিশক, কাপ্তাইয়ের অরণ্যে ঘটা করে খেদার আয়োজন হতো। এক একটা খেদায় ত্রিশ-চল্লিশ, এমনকি ষাট-সত্তরটি হাতিও ধরা পড়ত। ওই জঙ্গলগুলোতে যে তখন বিস্তর হাতি ঘুরে বেড়াত, তাতে নিশ্চয় সন্দেহ নেই। মাইনিতে এক বৃদ্ধ বলেছিলেন, তরুণ বয়সে কাসালংয়ের অরণ্যে ১০০ হাতির পালও দেখেছেন। ১০ বছর আগে আমি প্রায় ৩০টি হাতির দলের সন্ধান পেয়েছিলাম।
এনায়েত মাওলার ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে থানচি থেকে সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রির দিকে যাওয়ার পথে মধু নামের এক জায়গায় পাগলা হাতি শিকারের বর্ণনা আছে। ওই হাতিটার ভয়ে মুরংরা গাছের ওপর মাচা বানিয়ে থাকা শুরু করেছিল। ওই সময় তো বটেই মধু, বড় মোদক ও সাঙ্গু রিজার্ভে বুনো হাতির বিচরণ ছিল বেশ। তবে এখন আর ওদিকে স্থায়ী হাতির আস্তানা নেই। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপ অনুসারে সাঙ্গু রিজার্ভে ১৫-২০টি বুনো হাতি মিয়ানমারের সীমানা পেরিয়ে বেড়াতে আসে কখনো-সখনো।
মধুপুর জঙ্গলেও বিচরণ ছিল বুনো হাতির। ময়মনসিংহের মহারাজারা গারো পাহাড়ে খেদার আয়োজন করতেন। অবশ্য এটি সোয়া শ বছর আগের ঘটনা! তেমনি সিলেটের লালাখালের ওদিকটাসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় এই কয়েক দশক আগেও হাতিরা নামত ভারত থেকে। বুঝুন তাহলে, বুনো হাতির দিক থেকে মোটামুটি গর্ব করার জায়গায় ছিলাম আমরা!
নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে যা বুঝেছি, এশীয় হাতি আছে এখন যে তেরোটি দেশে, তার সবগুলোই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ওসব এলাকার হাতিরা অনেক ভালো আছে আমাদেরগুলোর চেয়ে!
দারুণ বুদ্ধিমান এক জন্তু হাতি। এদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া একটুও কি কষ্ট দেয় না আমাদের? আমরা মানুষেরা যেমন কেউ মারা গেলে দুঃখ পাই, শোক করি, হাতিরাও তাই করে। শুঁড় দিয়ে মৃত সঙ্গীর শরীরটা ছুঁয়ে দেখে, কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতিদের মধ্যে কেউ মারা গেলে সঙ্গীর দেহটা কবর দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল একবার দারুণ এক ভিডিও প্রকাশ করেছিল। সেখানে একটা মেয়ে হাতিকে মৃত সঙ্গীর দাঁত শুঁড় দিয়ে পরম মমতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এখন আপনি হয়তো ভাবছেন, তো হাতিরা জঙ্গলে থাকলেই পারে? তাদের লোকালয়ে আসার দরকার কি ধান-সবজি খেতে? জঙ্গলও কি খালি রেখেছি আমরা। কত মানুষ আস্তানা গেড়েছে অরণ্যে। তা ছাড়া বনের গাছপালা কেটে বিশাল জন্তুটার খাওয়ার জন্য তেমন কিছু রাখিনি আমরা। এখন যেসব জায়গায় মানুষের বসতি, ধানখেত, সেখানে এক সময় ছিল হাতিদের আস্তানা। ওদের এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে যাওয়ার পথও আমরা আটকে দিয়েছি নানা স্থাপনা তুলে। বলুন তো হাতিরা যাবে কোথায়?
রাঙ্গীপাড়ার ছোট্ট সে হাতির গল্পে ফিরে আসছি আবার। এখন তরতাজা যুবক বা যুবতী হওয়ার কথা তার। কারণ, হাতিরা অনায়াসে সত্তর-আশি বছর বাঁচে। তবে যেভাবে হাতি শিকার হচ্ছে আমার আশঙ্কা হয়তো প্রিয় ওই ছোট্ট হাতিটা বড়ই হতে পারেনি, এর আগেই ওটা মারা পড়েছে। আমার মনে ইদানীং একটা ভয় ঘুরপাক খাচ্ছে, হয়তো বাঘের আগেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বুনো হাতি। তখন কেবল রূপকথা গল্পেই ওদের কথা পড়বে আমাদের শিশুরা। সত্যি কী বুনো হাতিদের জন্য জায়গা নেই আমাদের বনে?
তারপরও শেষটা করতে চাই ভালো খবর দিয়ে। ওই যে শুরুতে তিন হাতি শিশুর কথা বলেছিলাম। তার তিন নম্বর এটি। এই আগস্টের শুরুতেই কক্সবাজারের টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের হোয়াইক্যং রেঞ্জে বনের ভেতর জন্ম নেয় ছোট্ট এক হাতি শিশু। হাতির পাল ঘিরে ছিল হস্তিশিশু ও তার মায়ের নিরাপত্তায়। বন বিভাগের একটি টহল দলও খেয়াল রাখছিল, যেন বাচ্চাটার ক্ষতি না হয়। ছোট্ট সেই হাতির ছানা পরে তার মা-বাবা আর খালা-স্বজনদের সঙ্গে ছোট ছোট পা ফেলে চলে যায় পাহাড়ের গভীরে। কক্সবাজার-টেকনাফের অরণ্যে এই হাতি শিশুসহ বুনো হাতিরা মহানন্দে ঘুরে বেড়াবে, ভালো থাকবে দেশের সব বুনো হাতি, হাতি দিবসে এই চাওয়া।
আজ বিশ্ব হাতি দিবস। তিনটি হাতির বাচ্চার কথা বড় বেশি মনে পড়ছে। প্রথমটির গল্প মন খারাপ করে দেওয়া। গত বছরের নভেম্বরের এক সকালে পত্রিকাতে খবরটা দেখেই মনটা কেঁদে উঠল। কক্সবাজারের চকোরিয়ায় তিন বছর বয়সের একটা হাতির বাচ্চাকে গুলি করে মারা হয়। মাদী বাচ্চা হাতিটাকে মেরে পুতে ফেলা হয়েছিল মাটির নিচে! কীভাবে সম্ভব! একটা বাচ্চা হাতি, তাও মাদি, কাজেই ওর থেকে দাঁত পাওয়ার সুযোগ নেই! শুধু ধান খাওয়ার অপরাধে মেরে ফেলল ছোট্ট হাতিটাকে?
এই লেখার সূত্র ধরেই আমার নিজের হাতিপ্রীতির কথা না বলে পারছি না। এটা এতটাই যে, বন্ধু ও সহকর্মীরা মজা করে হাতি ইশতিয়াকও ডাকে! তবে এতে আমার গা জ্বালা করে না মোটেই! হাতির খোঁজে চষে বেড়িয়েছি রাঙামাটির কাপ্তাই, বান্দরবানের লামা-আলীকদম, দুধপুকুরিয়াসহ কত জঙ্গলে। কাসালং ফরেস্টের রাঙ্গীপাড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম হাতির পালের ১০ গজের মধ্যে। তখন হাতিগুলো মানুষের যন্ত্রণায় ছিল খুব অস্থির, তারপরও আমাকে কিছুই করেনি।
ওই রাঙ্গীপাড়াতেই মা আর বাচ্চা হাতির সঙ্গে হয়েছিল আশ্চর্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আজ সকালে কেন যেন মনে পড়ছে কাসালং রিজার্ভের রাঙ্গীপাড়ার ওই বাচ্চা হাতির কথা, যে মায়ের সঙ্গে আটকা পড়েছিল জঙ্গলে। চারপাশ থেকে মানুষজন ঘিরে ফেলেছিল ওদের। এমনকি গাছের ওপর উঠেও ওদের দেখছিল উৎসুক জনতা। কী অসহায় লাগছিল মা ও বাচ্চাটাকে যখন ওরা এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছিল। সত্যি কি বুনো হাতিদের জন্য আর জায়গা নেই আমাদের বনে?
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৬ সালের জরিপ বলছে এ দেশে স্থায়ী বুনো হাতি আছে ২৭০ টির মতো। আশ্চর্যজনক হলেও কক্সবাজার ও এর আশপাশের বন-পাহাড়ে গত নভেম্বরে এক সপ্তাহর কিছু বেশি সময়ের মধ্যে হত্যা করা হয় চারটি বন্য হাতি।
সাধারণত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় দাঁতের জন্য হাতি মারে চোরাশিকারিরা। এটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় অপরাধ! তবে আশ্চর্য ব্যাপার কক্সবাজারের এই হাতিগুলোকে এমনকি দাঁতের জন্যও মারা হয়নি। এদের বেশির ভাগ হয় মাদি, নয়তো শিশু। তার মানে কেবল ধান খাওয়া, মরিচ খাওয়ার মতো অপরাধে এদের মেরে ফেলা হয়েছে। কারা মারছে? আমরা; এই সভ্য, বুদ্ধিমান মানুষেরা!
গত দেড়-দুই বছর ধরে একের পর এক হাতি মারা যাওয়ার খবর পাচ্ছি আমাদের অরণ্যগুলো থেকে। কক্সবাজার-টেকনাফ-লামা-আলীকদম—এই জায়গাগুলোয় বেশ কয়েকটি বড় পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতিদের, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। রোহিঙ্গা বসতির কারণে ওগুলোর কয়েকটি এক রকম বন্দীজীবন কাটাচ্ছে। আছে চরম খাবার সংকটে।
মাঝখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল খান ভাই কক্সবাজারের বুনো হাতির পালের ছবি তুলেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি হাতি ছিল একেবারেই কঙ্কালসার। কোনো হাতির চেহারা যে এতটা পলকা হতে পারে, তা কল্পনাও করিনি। হয়তো খাবার অভাবেই ওদের এই হাল!
ইদানীং, চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে একের পর এক হাতি মৃত্যুর যে ঘটনা ঘটছে, তার প্রায় সবগুলোই কক্সবাজার-লামার বন-পাহাড়ে। এর মধ্যে অনেকগুলো মারা পড়েছে কীভাবে শুনবেন? বিদ্যুতায়িত তারের স্পর্শে। বেশ কিছুকে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। আমরা মানুষেরা পরিকল্পিতভাবে এটা করেছি।
আইইউসিএনের পাঁচ বছর আগের জরিপ বলছে, দেশের স্থায়ী বুনো হাতির অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ১৪৭ টির (গড়) আস্তানা কক্সবাজার-লামার বনাঞ্চলে। যে হারে হাতি মারা পড়ছে ওই এলাকায়, এখন আর কতটি বুনো হাতি আছে কে জানে?
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাতির বিচরণ আছে—এমন তিনটি সংরক্ষিত অরণ্য চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ২৭ কিলোমিটার বনাঞ্চল কেটে যাবে রেললাইনটি। যত দূর জানি, ওই রেলপথ যাবে হাতি চলাচলের অন্তত ছয়টি করিডরের ওপর দিয়ে। ভারতে নীলগিরিসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় হাতি চলাচলের রাস্তার ওপর দিয়ে রেললাইন গেছে। ওদের ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক ভালো। তারপর সেখানেও রেলগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে হাতি মারা পড়ার রেকর্ড আছে প্রচুর।
এখন হাতি মারা হচ্ছে গুলি করে, বিদ্যুতায়িত করে; রেললাইন তৈরি হলে রেলগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে আরও কিছু মারা পড়া খুব স্বাভাবিক। কারণ, ওই হাতিগুলোর রেলগাড়ি নামক যন্ত্রদানবের সঙ্গে পরিচয়ই নেই। অবশ্য যে পরিস্থিতি ট্রেন চলাচল শুরু পর্যন্ত আর কতটি বুনো হাতি ওই এলাকায় টিকে থাকে—এটাও ভাববার বিষয়। রেললাইন তৈরির বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। তবে বুনো হাতির ব্যাপারটা মাথায় রেখে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি।
কক্সবাজার-লামা বাদে তাহলে হাতিরা ভালো আছে? একেবারেই না, ওই সব অরণ্যে হাতির অবস্থা আগে থেকেই ভয়াবহ। আমার জানামতে, সিলেট বিভাগে লাঠিটিলা বাদে আর কোথাও এখন এমনকি সীমান্ত পেরিয়েও আসে না হাতিরা। এই বুনো জন্তুরাও বুঝে গেছে, সীমানা পেরোলেই বিপদ! ওই হিসাবে জামালপুর-শেরপুরের দিকটায় গারো পাহাড়ের ভারতের অংশ থেকে নামা হাতিগুলো নিরেট গর্দভ! বছরে কয়েক মাস আমাদের সীমানায় কাটায় এরা। তবে যেগুলো আসে, সবগুলো ফিরতে পারে না। বিদ্যুতায়িত করে এই এলাকায়ও হাতি মারা হয় নিয়মিতই।
আমাদের স্থায়ী বুনো হাতি আছে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে। আগেই বলেছি আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপে সংখ্যাটা ২৭০ টির মতো বলে ধারণা করা হয়েছে। যেভাবে বুনো হাতি হত্যা হচ্ছে, সংখ্যাটা কতটা কমেছে খোদা জানে! অথচ ড. রেজা খান ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের বনগুলোতে ৪০০ টির মতো স্থায়ী বন্য হাতি আছে বলে ধারণা করেছিলেন। তবে আমার ধারণা সংখ্যায় হয়তো আরও বেশিই ছিল বুনো হাতিরা তখন।
২০১৬ সালের জরিপে রাঙামাটির কাসালং, কাপ্তাই মিলিয়ে সাকল্যে ৫০ টির মতো বুনো হাতি থাকার খবরও অশনিসংকেত আমাদের জন্য। নয় বছর আগে রাঙামাটির রাঙ্গীপাড়ায় বুনো হাতির যে দল দেখেছিলাম, সেখানে একটিও দাঁতাল হাতি ছিল না। দাঁতাল হাতির সংখ্যা এতই কমছে যে, এক সময় জিন পুল থেকেই এদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে!
অথচ আগে হাতিরা কী সুন্দর দিন কাটাত। ইউসুফ এস আহমদ, এনায়েত মাওলার বই থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, বিংশ শতকের মাঝামাঝির দিকে রাঙামাটির কাসালংয়ের মাইনিমুখ, মাহিল্লা, শিশক, কাপ্তাইয়ের অরণ্যে ঘটা করে খেদার আয়োজন হতো। এক একটা খেদায় ত্রিশ-চল্লিশ, এমনকি ষাট-সত্তরটি হাতিও ধরা পড়ত। ওই জঙ্গলগুলোতে যে তখন বিস্তর হাতি ঘুরে বেড়াত, তাতে নিশ্চয় সন্দেহ নেই। মাইনিতে এক বৃদ্ধ বলেছিলেন, তরুণ বয়সে কাসালংয়ের অরণ্যে ১০০ হাতির পালও দেখেছেন। ১০ বছর আগে আমি প্রায় ৩০টি হাতির দলের সন্ধান পেয়েছিলাম।
এনায়েত মাওলার ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে থানচি থেকে সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রির দিকে যাওয়ার পথে মধু নামের এক জায়গায় পাগলা হাতি শিকারের বর্ণনা আছে। ওই হাতিটার ভয়ে মুরংরা গাছের ওপর মাচা বানিয়ে থাকা শুরু করেছিল। ওই সময় তো বটেই মধু, বড় মোদক ও সাঙ্গু রিজার্ভে বুনো হাতির বিচরণ ছিল বেশ। তবে এখন আর ওদিকে স্থায়ী হাতির আস্তানা নেই। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপ অনুসারে সাঙ্গু রিজার্ভে ১৫-২০টি বুনো হাতি মিয়ানমারের সীমানা পেরিয়ে বেড়াতে আসে কখনো-সখনো।
মধুপুর জঙ্গলেও বিচরণ ছিল বুনো হাতির। ময়মনসিংহের মহারাজারা গারো পাহাড়ে খেদার আয়োজন করতেন। অবশ্য এটি সোয়া শ বছর আগের ঘটনা! তেমনি সিলেটের লালাখালের ওদিকটাসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় এই কয়েক দশক আগেও হাতিরা নামত ভারত থেকে। বুঝুন তাহলে, বুনো হাতির দিক থেকে মোটামুটি গর্ব করার জায়গায় ছিলাম আমরা!
নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে যা বুঝেছি, এশীয় হাতি আছে এখন যে তেরোটি দেশে, তার সবগুলোই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ওসব এলাকার হাতিরা অনেক ভালো আছে আমাদেরগুলোর চেয়ে!
দারুণ বুদ্ধিমান এক জন্তু হাতি। এদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া একটুও কি কষ্ট দেয় না আমাদের? আমরা মানুষেরা যেমন কেউ মারা গেলে দুঃখ পাই, শোক করি, হাতিরাও তাই করে। শুঁড় দিয়ে মৃত সঙ্গীর শরীরটা ছুঁয়ে দেখে, কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতিদের মধ্যে কেউ মারা গেলে সঙ্গীর দেহটা কবর দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল একবার দারুণ এক ভিডিও প্রকাশ করেছিল। সেখানে একটা মেয়ে হাতিকে মৃত সঙ্গীর দাঁত শুঁড় দিয়ে পরম মমতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এখন আপনি হয়তো ভাবছেন, তো হাতিরা জঙ্গলে থাকলেই পারে? তাদের লোকালয়ে আসার দরকার কি ধান-সবজি খেতে? জঙ্গলও কি খালি রেখেছি আমরা। কত মানুষ আস্তানা গেড়েছে অরণ্যে। তা ছাড়া বনের গাছপালা কেটে বিশাল জন্তুটার খাওয়ার জন্য তেমন কিছু রাখিনি আমরা। এখন যেসব জায়গায় মানুষের বসতি, ধানখেত, সেখানে এক সময় ছিল হাতিদের আস্তানা। ওদের এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে যাওয়ার পথও আমরা আটকে দিয়েছি নানা স্থাপনা তুলে। বলুন তো হাতিরা যাবে কোথায়?
রাঙ্গীপাড়ার ছোট্ট সে হাতির গল্পে ফিরে আসছি আবার। এখন তরতাজা যুবক বা যুবতী হওয়ার কথা তার। কারণ, হাতিরা অনায়াসে সত্তর-আশি বছর বাঁচে। তবে যেভাবে হাতি শিকার হচ্ছে আমার আশঙ্কা হয়তো প্রিয় ওই ছোট্ট হাতিটা বড়ই হতে পারেনি, এর আগেই ওটা মারা পড়েছে। আমার মনে ইদানীং একটা ভয় ঘুরপাক খাচ্ছে, হয়তো বাঘের আগেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বুনো হাতি। তখন কেবল রূপকথা গল্পেই ওদের কথা পড়বে আমাদের শিশুরা। সত্যি কী বুনো হাতিদের জন্য জায়গা নেই আমাদের বনে?
তারপরও শেষটা করতে চাই ভালো খবর দিয়ে। ওই যে শুরুতে তিন হাতি শিশুর কথা বলেছিলাম। তার তিন নম্বর এটি। এই আগস্টের শুরুতেই কক্সবাজারের টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের হোয়াইক্যং রেঞ্জে বনের ভেতর জন্ম নেয় ছোট্ট এক হাতি শিশু। হাতির পাল ঘিরে ছিল হস্তিশিশু ও তার মায়ের নিরাপত্তায়। বন বিভাগের একটি টহল দলও খেয়াল রাখছিল, যেন বাচ্চাটার ক্ষতি না হয়। ছোট্ট সেই হাতির ছানা পরে তার মা-বাবা আর খালা-স্বজনদের সঙ্গে ছোট ছোট পা ফেলে চলে যায় পাহাড়ের গভীরে। কক্সবাজার-টেকনাফের অরণ্যে এই হাতি শিশুসহ বুনো হাতিরা মহানন্দে ঘুরে বেড়াবে, ভালো থাকবে দেশের সব বুনো হাতি, হাতি দিবসে এই চাওয়া।
দূষণের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া জোট ‘কিক বিগ পলিউটার্স আউট’–এর এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই বছরের আয়োজক দেশ আজারবাইজান, আগামী বছরের আয়োজক ব্রাজিল এবং তুরস্ক ছাড়া প্রতিটি দেশ থেকে কপ সম্মেলনের প্রতিনিধির চেয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের (তদবিরের লোকজন) সংখ্যা বেশি।
৩ ঘণ্টা আগেজঙ্গলে গিয়েছেন ঘুরতে। সেখানে বাঘ দেখাটা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর এক ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎ যদি দেখেন আপনার সামনেই মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছে দুই বাঘ, নিশ্চয় আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হবে। খুব বেশি সাহসী হলে রোমাঞ্চটা আরও বেশি উপভোগ করবেন। এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন ভারতের এক জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া কিছু প
৭ ঘণ্টা আগেএশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী তাপ ধারণকারী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে শীর্ষে রয়েছে। নতুন তথ্য অনুযায়ী, চীনের সাংহাই এ তালিকার শীর্ষে। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিশ্লেষণ করে এই বিষয়টি জানা গেছে। তথ্য প্রকাশ করেছে সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল
১ দিন আগেবার্ষিক শত বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের শর্ত পূরণ হয়নি গত এক দশকেও। এর মধ্যেই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কাছে বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর পক্ষ থেকে।
১ দিন আগে