ইশতিয়াক হাসান
গত ২০ ডিসেম্বর নীলফামারীতে একটি চিতা বাঘকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে গ্রামবাসী। গত বছর একই জেলায় বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা পড়ে অপর একটি চিতা বাঘ। উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় এর আগেও চিতা বাঘকে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। এই চিতা বাঘেরা আসছে কোথা থেকে এবং এদের কীভাবে এমন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে লেখাটিতে।
২০ ডিসেম্বর। দুপুরের দিকে হঠাৎ এক প্রতিনিধির পাঠানো নিউজে চোখ আটকে গেল। চিতা বাঘের আক্রমণে কয়েকজন আহত হওয়ার খবর। প্রথম দেখাতেই ধরে নিয়েছিলাম মেছো বিড়ালকে ভুল করে চিতা বাঘ লেখা হয়েছে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ চিতা বাঘকে মেছো বিড়ালের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। তার পরই নিউজটির পড়তে গিয়ে দেখলাম ঘটনাস্থল নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা। তখনই সন্দেহটা দানা বাঁধল। তাড়াতাড়ি প্রতিনিধি কী ছবি পাঠিয়েছেন দেখায় মন দিলাম। আরে, এ তো চিতা বাঘই। আরও পরিষ্কারভাবে বললে ছবিগুলো মৃত চিতা বাঘের। এবার নিউজটি পড়ে জানলাম, বন বিভাগের লোকেরা পৌঁছার আগেই চিতা বাঘটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে গ্রামবাসী। মনটা কেঁদে উঠল, আহহা! আবার নীলফামারী! আবার চিতা বাঘের মৃত্যু!
উত্তরাঞ্চলে কেন বারবার প্রাণ দিতে হয় চিতা বাঘদের
২০ ডিসেম্বরের ঘটনার বর্ণনায় পরে আসছি। আগে নীলফামারীর প্রসঙ্গে কেন নড়েচড়ে বসেছিলাম সেটা পরিষ্কার করা দরকার। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ঘটনা। নীলফামারী সদর উপজেলার চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের কাঞ্চনপাড়া গ্রাম। সেখানকার এক মুরগির খামারে ৩ হাজারের বেশি মুরগি আছে। বনবিড়াল ও শিয়ালের কবল থেকে মুরগি বাঁচাতে খামারমালিক পুরো খামারটি জিআই তার দিয়ে ঘিরে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেন। তবে সেখানে এক বৃহস্পতিবার রাতে (১৭ মার্চ ২০২২) ঘটল অস্বাভাবিক এক কাণ্ড। রাত তখন পৌনে ৩টা। খামারের পেছনে বন্যপ্রাণীর আওয়াজ পাওয়া গেল। দেরি না করে সুইচ টিপে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পরই একটি জন্তু বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পড়ার শব্দ। তবে আওয়াজটা বলে দিচ্ছিল বন বিড়াল বা শিয়াল নয়, অনেক বড় কোনো জন্তু আটকা পড়েছে ফাঁদে। আতঙ্কিত হয়ে বাড়ির মানুষ টর্চলাইট জ্বেলে চমকে ওঠেন। একটি চিতা বাঘ বিদ্যুতায়িত তারের স্পর্শে মরে পড়ে আছে।
বাঘ মারা পড়েছে—এটা তো বড় আনন্দের খবর; অন্তত আমাদের কাছে, তাই না! সকালে মৃত বাঘটির গলায় দড়ি পেঁচিয়ে বাইরে আনা হতেই একে দেখতে জড়ো হলো আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। তখন কেউ কেউ ওই খামারের পেছনের ভুট্টাখেতে ওপর অপর একটি চিতা বাঘ অদৃশ্য হওয়ার কথা বললেও নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। পত্রিকা মারফত এবং পঞ্চগড়ের বন্যপ্রাণীপ্রেমী ও আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহর সঙ্গে কথা বলে নীলফামারীর চিতা বাঘ সম্পর্কে মোটামুটি এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম।
তবে দ্বিতীয় কোনো চিতা বাঘ সেদিন থেকে সেখানে থাকলে তার ভাগ্যটা ভালোই বলতে হয়। না হলে মানুষের পিটুনিতে ওটাকে হয়তো পৃথিবীর মায়া কাটাতে হতো। তবে ২০ ডিসেম্বরের দুর্ভাগা চিতা বাঘটি মারা গেছে মানুষের পিটুনিতেই।
এ সুযোগে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, ‘ডিটেকটিং দ্য স্পটস: আ রিভিও অন ল্যাপার্ড অকারেন্সেস ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি গবেষণাপত্রে থেকে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে শুধু উত্তরের, মানে রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে মানুষের পিটুনিতে মারা পড়েছে ছয়টি চিতা বাঘ। এর সঙ্গে ২০২২ ও ২০২৩ সালের ঘটনা দুটি যোগ করলে চিতা বাঘের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে আটে। কী আশ্চর্য বিষয়, ঠিক না! এমন অদ্ভুত সুন্দর একটি প্রাণীর বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই!
দুর্ভাগা চিতা বাঘ
এবার তাহলে গত ২০ ডিসেম্বরের ঘটনাটির দিকে নজর দেই। বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ থেকে ও খোঁজখবর নিয়ে যদ্দুর জানা যায়, এদিন অর্থাৎ বুধবার বেলা ১১টার দিকে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রংপুর-দিনাজপুর তিস্তা ক্যানেল ব্রিজসংলগ্ন গাছে একটি চিতা বাঘ দেখতে পান কৃষকেরা। জায়গাটি পড়েছে মাগুরা ইউনিয়নের আকালীবেচাপাড়া গ্রামের সীমানায়। ওই লোকগুলো চিৎকার দিলে এলাকার লোকজন বাঘ দেখার জন্য ভিড় জমায়। গাছটির দিকেও ঢিলও ছোড়ে অনেকে। সবকিছু মিলিয়ে সম্ভবত ঘাবড়ে যায় প্রাণীটি। গাছ থেকে নেমে পালাতে যায়। এ সময় প্রাণীটির সামনে পড়া গ্রামের কয়েক জন এর আক্রমণে আহত হয়। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। স্থানীয় লোকজন বাঘটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। শুধু তাই নয়, ওটাকে গাছের মধ্যে ঝুলিয়ে দিল। আর এই মৃতদেহ দেখতে ভেঙে পড়ল আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ।
পরে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে নালার মধ্যে চিতা বাঘটির বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করা এবং একে মারার দৃশ্য দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। যেভাবে বহু মানুষ মিলে তাড়া করে এত সুন্দর একটি প্রাণীকে মেরে ফেলল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। প্রাণীটির নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পরও চলছিল আঘাত।
সত্যি কী এমন মৃত্যু প্রাপ্য চিতা বাঘেদের?
এখন মুরগির খামারের মুরগি চুরি নিঃসন্দেহ গৃহস্থের ক্ষতির কারণ। তেমনি মানুষ আক্রান্ত হওয়া তার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে এমন মৃত্যু কি চিতা বাঘেদের প্রাপ্য? এমন একটি সুন্দর প্রাণীকে মারার পর গাছে ঝুলিয়ে রাখা কতটা মানবিক? ঘটনা হলো, একটা সময় আমাদের উত্তরাঞ্চলে অনেক চিতা বাঘই ছিল। তখন মানুষের বসতি কম ছিল, অনেক গ্রামীণ বন ছিল। কিন্তু আমরা মানুষই তো ওই বন ধ্বংস করে দিয়েছি। তাই এখানে চিতা বাঘ হয়ে গেছে এক অপরিচিত প্রাণী। এদিকে চিতা বাঘগুলো যখন এই এলাকায় আসে, তখন থাকার মতো জায়গা বা খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত বন্যপ্রাণী না থাকায় এরা লোকালয়ে চলে আসে। এদিকে আমাদের মধ্যেও যে বন্যপ্রাণী দেখলে, এমনকি এরা কোনো ক্ষতি করলে তাদের মেরে ফেলার একটা প্রবণতা আছে তাতে সন্দেহ নেই। মানুষ এদের বিরক্ত না করলে অনেক সংঘাতই মনে হয় এড়ানো যেত।
এল কীভাবে?
কিন্তু ঘটনা হলো, নীলফামারীতে চিতা বাঘ এল কীভাবে? এটা সত্যি—একসময় পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম এলাকায় চিতা বাঘের দেখা মিলত বিস্তর। কিন্তু এই এলাকায় এখন বড় বন নেই। গ্রামীণ বনও কমে গেছে। তাই এদিকটায় চিতা বাঘের বসতির খবরও শোনা যায়নি। তবে কথা হলো, আমাদের উত্তরের এই জেলাগুলোর ওপাশেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও ডুয়ার্স এলাকা। চিতা বাঘের আড্ডাখানা। এখানকার চিতা বাঘেরা কোচবিহারে ও ডুয়ার্সের সবুজ চা-বাগানে ঘুরে বেড়ায় মনের আনন্দে। আর ওগুলোর মধ্যে যেগুলো একটু দুর্ভাগা, সেগুলোই হয়তো আমাদের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এলাকায় চলে আসে। তারপর কোনো গৃহস্থের মুরগির খামারে হানা দেওয়ার অপরাধে কিংবা নিজেদের হলুদে-কালোয় মেশানো সুন্দর চেহারাটা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার কারণে মারা পড়ে গ্রামবাসীর পিটুনিতে। অথচ আমাদের বরং প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর এই প্রাণীগুলো এখনো এদিকটায় পা দেওয়ায় খুশি হওয়ার কথা।
এই অঞ্চলের পঞ্চগড়েই জীবিত চিতা বাঘের দুর্লভ একটি ছবি তুলছিলেন বন্যপ্রাণীপ্রেমী ও আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। সেটা ২০১৮ সালে। একটা ঝোপে আশ্রয় নিয়েছিল বাঘটা। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল উৎসুক জনতা। মরিয়া চিতা বাঘটা হুংকার দিচ্ছিল, লেজ নাচাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেকোনো মুহূর্তে ঝোপ থেকে লাফ দেবে। এর মধ্যেই কাছে গিয়ে কয়েকটা ছবি তোলেন সাবাহ। অবশ্য উত্তেজিত জনতার রোষ থেকে আশ্চর্য সুন্দর সেই বাঘকে বাঁচানো যায়নি।
ফিরোজ আল সাবাহ এ ছাড়া তিনবার চিতা বাঘের আনাগোনার খবর পান বলে জানান। ২০১৫ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ভজনপুরের ডাহুক নদীর তীরে চিতা বাঘ দেখা গেছে খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে পায়ের ছাপ পেয়েছেন। ২০২০ সালে ভজনপুর ১০ মাইল এলাকায় চিতা বাঘ দেখা যাওয়ার খবর পান। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর দেখা পাননি। ২০২২ সালে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায়ও চিতা বাঘের আস্তানা গাড়ার সংবাদ পেয়েছিলেন।
এবার একটু অন্যদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি। ভারত থেকে আসছে এই চিতা বাঘ, ঠিক আছে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে, সেখান থেকে ভারতের সীমান্ত অনেক দূরে। তেমনি গত ২০ ডিসেম্বরের ঘটনাস্থল কিশোরগঞ্জের ওই গ্রাম থেকেও সীমান্ত মোটামুটি কিলোমিটার চল্লিশেক দূরে বলে জেনেছি। চিতা বাঘের পক্ষে বড় দূরত্ব পেরোনো কঠিন কিছু নয়। তবে কথা হলো, এত লম্বা একটা এলাকা লোকবসতির মধ্যে পেরোল কীভাবে? আর এগুলো কি দেখা যাওয়ার দু-এক দিন আগেই সীমান্ত পেরিয়ে আসে? তারপর এত দূর চলে আসে? নাকি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে চিতা বাঘের স্থায়ী কোনো বসতি না থাকলেও দীর্ঘ সময় কাটানোর মতো জায়গা আছে!
বর্তমানে শিক্ষাকালীন ছুটিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে শুরু করে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত সীমান্তের ওই পাশে ভারতে প্রচুর চা-বাগান আছে। এসব চা-বাগান ও আশপাশের জঙ্গলে প্রচুর চিতাবাঘ আছে। ওই দিক থেকে বাংলাদেশের অংশে সহজে চিতা বাঘ চলে আসতে পারে। তবে আমার ধারণা, এসব চিতা বাঘ এক-দুই দিনের জন্য আসে না। বরং বাংলাদেশের এই অংশে এদের নিয়মিত বিচরণ আছে। কখনো কখনো দীর্ঘ সময় এদের এই এলাকায় বাস করাও বিচিত্র নয়। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভুট্টা ও আখখেত। এসব জায়গায় চিতা বাঘ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। ছোটখাটো প্রাণী শিকার করেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাৎ, মোটামুটি দীর্ঘ সময় থাকার জায়গা হিসেবেই উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নির্জন এলাকা ব্যবহার করার সম্ভাবনা চিতা বাঘদের। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এসব চিতা বাঘ রক্ষা করা।’
এদিকে ফিরোজ আল সাবাহও উত্তরের কোনো জেলায় চিতা বাঘের মোটামুটি দীর্ঘ সময় আস্তানা গাড়ার সম্ভাবনার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, এপাশে এলে চিতা বাঘের থাকার জায়গা চর এলাকাগুলো। এই চর এলাকাগুলো ভুট্টা ও আখখেতে ভর্তি থাকে। অনেক চরে মানুষের আনাগোনা নেই। এসব এলাকায় বনবিড়াল, বুনো খরগোশ, শিয়ালের মতো প্রাণীও আছে। এ বছর ও ২০২২ সালে চিতা বাঘের মৃত্যুর ঘটনা দুটো যে জায়গাগুলোয় ঘটেছে, সেগুলো সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। পরপর দুই বছর দুটি চিতা বাঘ মারা যাওয়ায় ধারণা করছি, চর এলাকায় এদের দীর্ঘ সময় কাটানোর মতো আবাসস্থল আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান অবশ্য মনে করেন, ভারতের অংশের বন থেকে আসা চিতা বাঘদের দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকার মতো পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি নেই এদিকে। কারণ বড় একটি প্রাণী থাকলে একে দেখা না গেলেও ছাগল-কুকুর মারা পড়ত। ভারতের অংশের সংরক্ষিত এলাকাগুলোর গ্রাস ল্যান্ডে অনেক সময় আগুন দেওয়া হয়। তখন এরা এদিকে হয়তো আসে। তবে পঞ্চগড়ে চা-বাগান তৈরি হওয়ায় এখানে ডুয়ার্সের দিক থেকে আসা চিতা বাঘদের বেশি সময় আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা আছে বলে মনে করেন মনিরুল খান।
আমাদের কী করা উচিত
এখন আমাদের তাহলে কী করা উচিত? কীভাবে আমরা এদের রক্ষা করব? ভারতের অনেক জায়গাতেই মানুষ-চিতা বাঘ পাশাপাশি অবস্থানের নজির আছে। ভারতের রাজস্থানের বেরা, মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স প্রভৃতি এলাকায় মানুষের আশপাশেই প্রচুর চিতাবাঘ বাস করে। তাহলে আমাদের দেশেই কেন চিতা বাঘ দেখলেই মেরে ফেলতে হবে? তাহলে আমাদের কী করা উচিত?
মুনতাসির আকাশের মতে, সুন্দরবন অঞ্চলে যেমন টাইগার রেসপন্স টিম কিংবা গারো পাহাড় অঞ্চলে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম কাজ করে, এখানে তেমনি ল্যাপার্ড রেসপন্স টিম গঠন করা যেতে পারে, যারা সাধারণ মানুষকে চিতা বাঘ দেখলেই মেরে না ফেলার ব্যাপারে সচেতন করবেন। তেমনি লোকালয়ে চিতা বাঘ দেখা গেলে এদের সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে দিতে কাজ করবে।
মনিরুল খান বলেন, এরা সাধারণত আক্রান্ত হলেই মানুষকে আক্রমণ করে। মিডিয়ায় সাধারণত আসে মানুষকে আক্রমণ করায় এদের পিটিয়ে মারা হয় এমন খবর। মানুষকে সচেতন করাই একমাত্র উপায়। চিতা বাঘ দেখা গেলেই যেন বন বিভাগকে জানানো হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘প্রাণীটা আমাদের দেশের নয়। বাইরে থেকে (সীমান্ত পেরিয়ে) আসে। নীলগাইয়ের মতো প্রাণী এলে মানুষ সাধারণত আতঙ্কিত হয় না। কখনো অবশ্য খাওয়ার জন্য শিকার করে ফেলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চিতা বাঘের নামের সঙ্গে বাঘ থাকায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মানুষ যখন এদের ঘিরে বড় জমায়েত করে কিংবা একে আক্রমণ করে, তখন এরাও নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে পাল্টা আক্রমণ করে। যেকোনো প্রাণী এটাই করে। তখন মানুষ আরও ক্রুদ্ধ হয়ে এদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। ওই এলাকায় সচেতনতা বাড়ানোই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান দেখছি। ইদানীং এ ধরনের চিতা বাঘ মারা পড়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, আমরা উচ্চ পর্যায়ে মিটিং করে একটা সিদ্ধান্ত নেব। খুব সম্ভব আমাদের অ্যাওয়ারনেস বা সচেতনতা বৃদ্ধির যেসব প্রোগ্রাম আছে, তার আওতাভুক্ত করা হবে এটিকে।’
আশা রাখতে চাই
বাংলাদেশের বনে যে চিতা বাঘের মতো এত আশ্চর্য সুন্দর একটি প্রাণী আছে, এটি শিশুরা তো বটেই, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই জানেন না। তবে গবেষকদের গবেষণায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনে চিতা বাঘের স্থায়ী বসতি যে এখনো আছে, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তেমনি সিলেট বিভাগের কোনো কোনো অরণ্যেও এদের দেখা যাওয়ার কথা শোনা যায় কখনো কখনো। এদিকে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও এদের আনাগোনার খবর মিলছে নিয়মিত বিরতিতেই। এখানে এলে এদের করুণ পরিণতির শিকার হওয়ার পরও আশার কথা, পূর্বপুরুষের পুরোনো আস্তানাকে এখনো একেবারে ভুলে যায়নি নয়া জমানার চিতা বাঘেরা। এখন জরুরি মানুষের সঙ্গে এদের সংঘাতটা এড়ানো। আর যখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এদের বিচরণ থাকে, তখন দরকার মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ একটি অবস্থান নিশ্চিত করা।
গত ২০ ডিসেম্বর নীলফামারীতে একটি চিতা বাঘকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে গ্রামবাসী। গত বছর একই জেলায় বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা পড়ে অপর একটি চিতা বাঘ। উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় এর আগেও চিতা বাঘকে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। এই চিতা বাঘেরা আসছে কোথা থেকে এবং এদের কীভাবে এমন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে লেখাটিতে।
২০ ডিসেম্বর। দুপুরের দিকে হঠাৎ এক প্রতিনিধির পাঠানো নিউজে চোখ আটকে গেল। চিতা বাঘের আক্রমণে কয়েকজন আহত হওয়ার খবর। প্রথম দেখাতেই ধরে নিয়েছিলাম মেছো বিড়ালকে ভুল করে চিতা বাঘ লেখা হয়েছে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ চিতা বাঘকে মেছো বিড়ালের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। তার পরই নিউজটির পড়তে গিয়ে দেখলাম ঘটনাস্থল নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা। তখনই সন্দেহটা দানা বাঁধল। তাড়াতাড়ি প্রতিনিধি কী ছবি পাঠিয়েছেন দেখায় মন দিলাম। আরে, এ তো চিতা বাঘই। আরও পরিষ্কারভাবে বললে ছবিগুলো মৃত চিতা বাঘের। এবার নিউজটি পড়ে জানলাম, বন বিভাগের লোকেরা পৌঁছার আগেই চিতা বাঘটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে গ্রামবাসী। মনটা কেঁদে উঠল, আহহা! আবার নীলফামারী! আবার চিতা বাঘের মৃত্যু!
উত্তরাঞ্চলে কেন বারবার প্রাণ দিতে হয় চিতা বাঘদের
২০ ডিসেম্বরের ঘটনার বর্ণনায় পরে আসছি। আগে নীলফামারীর প্রসঙ্গে কেন নড়েচড়ে বসেছিলাম সেটা পরিষ্কার করা দরকার। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ঘটনা। নীলফামারী সদর উপজেলার চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের কাঞ্চনপাড়া গ্রাম। সেখানকার এক মুরগির খামারে ৩ হাজারের বেশি মুরগি আছে। বনবিড়াল ও শিয়ালের কবল থেকে মুরগি বাঁচাতে খামারমালিক পুরো খামারটি জিআই তার দিয়ে ঘিরে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেন। তবে সেখানে এক বৃহস্পতিবার রাতে (১৭ মার্চ ২০২২) ঘটল অস্বাভাবিক এক কাণ্ড। রাত তখন পৌনে ৩টা। খামারের পেছনে বন্যপ্রাণীর আওয়াজ পাওয়া গেল। দেরি না করে সুইচ টিপে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পরই একটি জন্তু বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পড়ার শব্দ। তবে আওয়াজটা বলে দিচ্ছিল বন বিড়াল বা শিয়াল নয়, অনেক বড় কোনো জন্তু আটকা পড়েছে ফাঁদে। আতঙ্কিত হয়ে বাড়ির মানুষ টর্চলাইট জ্বেলে চমকে ওঠেন। একটি চিতা বাঘ বিদ্যুতায়িত তারের স্পর্শে মরে পড়ে আছে।
বাঘ মারা পড়েছে—এটা তো বড় আনন্দের খবর; অন্তত আমাদের কাছে, তাই না! সকালে মৃত বাঘটির গলায় দড়ি পেঁচিয়ে বাইরে আনা হতেই একে দেখতে জড়ো হলো আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। তখন কেউ কেউ ওই খামারের পেছনের ভুট্টাখেতে ওপর অপর একটি চিতা বাঘ অদৃশ্য হওয়ার কথা বললেও নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। পত্রিকা মারফত এবং পঞ্চগড়ের বন্যপ্রাণীপ্রেমী ও আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহর সঙ্গে কথা বলে নীলফামারীর চিতা বাঘ সম্পর্কে মোটামুটি এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম।
তবে দ্বিতীয় কোনো চিতা বাঘ সেদিন থেকে সেখানে থাকলে তার ভাগ্যটা ভালোই বলতে হয়। না হলে মানুষের পিটুনিতে ওটাকে হয়তো পৃথিবীর মায়া কাটাতে হতো। তবে ২০ ডিসেম্বরের দুর্ভাগা চিতা বাঘটি মারা গেছে মানুষের পিটুনিতেই।
এ সুযোগে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, ‘ডিটেকটিং দ্য স্পটস: আ রিভিও অন ল্যাপার্ড অকারেন্সেস ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি গবেষণাপত্রে থেকে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে শুধু উত্তরের, মানে রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে মানুষের পিটুনিতে মারা পড়েছে ছয়টি চিতা বাঘ। এর সঙ্গে ২০২২ ও ২০২৩ সালের ঘটনা দুটি যোগ করলে চিতা বাঘের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে আটে। কী আশ্চর্য বিষয়, ঠিক না! এমন অদ্ভুত সুন্দর একটি প্রাণীর বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই!
দুর্ভাগা চিতা বাঘ
এবার তাহলে গত ২০ ডিসেম্বরের ঘটনাটির দিকে নজর দেই। বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ থেকে ও খোঁজখবর নিয়ে যদ্দুর জানা যায়, এদিন অর্থাৎ বুধবার বেলা ১১টার দিকে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রংপুর-দিনাজপুর তিস্তা ক্যানেল ব্রিজসংলগ্ন গাছে একটি চিতা বাঘ দেখতে পান কৃষকেরা। জায়গাটি পড়েছে মাগুরা ইউনিয়নের আকালীবেচাপাড়া গ্রামের সীমানায়। ওই লোকগুলো চিৎকার দিলে এলাকার লোকজন বাঘ দেখার জন্য ভিড় জমায়। গাছটির দিকেও ঢিলও ছোড়ে অনেকে। সবকিছু মিলিয়ে সম্ভবত ঘাবড়ে যায় প্রাণীটি। গাছ থেকে নেমে পালাতে যায়। এ সময় প্রাণীটির সামনে পড়া গ্রামের কয়েক জন এর আক্রমণে আহত হয়। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। স্থানীয় লোকজন বাঘটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। শুধু তাই নয়, ওটাকে গাছের মধ্যে ঝুলিয়ে দিল। আর এই মৃতদেহ দেখতে ভেঙে পড়ল আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ।
পরে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে নালার মধ্যে চিতা বাঘটির বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করা এবং একে মারার দৃশ্য দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। যেভাবে বহু মানুষ মিলে তাড়া করে এত সুন্দর একটি প্রাণীকে মেরে ফেলল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। প্রাণীটির নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পরও চলছিল আঘাত।
সত্যি কী এমন মৃত্যু প্রাপ্য চিতা বাঘেদের?
এখন মুরগির খামারের মুরগি চুরি নিঃসন্দেহ গৃহস্থের ক্ষতির কারণ। তেমনি মানুষ আক্রান্ত হওয়া তার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে এমন মৃত্যু কি চিতা বাঘেদের প্রাপ্য? এমন একটি সুন্দর প্রাণীকে মারার পর গাছে ঝুলিয়ে রাখা কতটা মানবিক? ঘটনা হলো, একটা সময় আমাদের উত্তরাঞ্চলে অনেক চিতা বাঘই ছিল। তখন মানুষের বসতি কম ছিল, অনেক গ্রামীণ বন ছিল। কিন্তু আমরা মানুষই তো ওই বন ধ্বংস করে দিয়েছি। তাই এখানে চিতা বাঘ হয়ে গেছে এক অপরিচিত প্রাণী। এদিকে চিতা বাঘগুলো যখন এই এলাকায় আসে, তখন থাকার মতো জায়গা বা খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত বন্যপ্রাণী না থাকায় এরা লোকালয়ে চলে আসে। এদিকে আমাদের মধ্যেও যে বন্যপ্রাণী দেখলে, এমনকি এরা কোনো ক্ষতি করলে তাদের মেরে ফেলার একটা প্রবণতা আছে তাতে সন্দেহ নেই। মানুষ এদের বিরক্ত না করলে অনেক সংঘাতই মনে হয় এড়ানো যেত।
এল কীভাবে?
কিন্তু ঘটনা হলো, নীলফামারীতে চিতা বাঘ এল কীভাবে? এটা সত্যি—একসময় পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম এলাকায় চিতা বাঘের দেখা মিলত বিস্তর। কিন্তু এই এলাকায় এখন বড় বন নেই। গ্রামীণ বনও কমে গেছে। তাই এদিকটায় চিতা বাঘের বসতির খবরও শোনা যায়নি। তবে কথা হলো, আমাদের উত্তরের এই জেলাগুলোর ওপাশেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও ডুয়ার্স এলাকা। চিতা বাঘের আড্ডাখানা। এখানকার চিতা বাঘেরা কোচবিহারে ও ডুয়ার্সের সবুজ চা-বাগানে ঘুরে বেড়ায় মনের আনন্দে। আর ওগুলোর মধ্যে যেগুলো একটু দুর্ভাগা, সেগুলোই হয়তো আমাদের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এলাকায় চলে আসে। তারপর কোনো গৃহস্থের মুরগির খামারে হানা দেওয়ার অপরাধে কিংবা নিজেদের হলুদে-কালোয় মেশানো সুন্দর চেহারাটা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার কারণে মারা পড়ে গ্রামবাসীর পিটুনিতে। অথচ আমাদের বরং প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর এই প্রাণীগুলো এখনো এদিকটায় পা দেওয়ায় খুশি হওয়ার কথা।
এই অঞ্চলের পঞ্চগড়েই জীবিত চিতা বাঘের দুর্লভ একটি ছবি তুলছিলেন বন্যপ্রাণীপ্রেমী ও আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। সেটা ২০১৮ সালে। একটা ঝোপে আশ্রয় নিয়েছিল বাঘটা। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল উৎসুক জনতা। মরিয়া চিতা বাঘটা হুংকার দিচ্ছিল, লেজ নাচাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেকোনো মুহূর্তে ঝোপ থেকে লাফ দেবে। এর মধ্যেই কাছে গিয়ে কয়েকটা ছবি তোলেন সাবাহ। অবশ্য উত্তেজিত জনতার রোষ থেকে আশ্চর্য সুন্দর সেই বাঘকে বাঁচানো যায়নি।
ফিরোজ আল সাবাহ এ ছাড়া তিনবার চিতা বাঘের আনাগোনার খবর পান বলে জানান। ২০১৫ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ভজনপুরের ডাহুক নদীর তীরে চিতা বাঘ দেখা গেছে খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে পায়ের ছাপ পেয়েছেন। ২০২০ সালে ভজনপুর ১০ মাইল এলাকায় চিতা বাঘ দেখা যাওয়ার খবর পান। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর দেখা পাননি। ২০২২ সালে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায়ও চিতা বাঘের আস্তানা গাড়ার সংবাদ পেয়েছিলেন।
এবার একটু অন্যদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি। ভারত থেকে আসছে এই চিতা বাঘ, ঠিক আছে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে, সেখান থেকে ভারতের সীমান্ত অনেক দূরে। তেমনি গত ২০ ডিসেম্বরের ঘটনাস্থল কিশোরগঞ্জের ওই গ্রাম থেকেও সীমান্ত মোটামুটি কিলোমিটার চল্লিশেক দূরে বলে জেনেছি। চিতা বাঘের পক্ষে বড় দূরত্ব পেরোনো কঠিন কিছু নয়। তবে কথা হলো, এত লম্বা একটা এলাকা লোকবসতির মধ্যে পেরোল কীভাবে? আর এগুলো কি দেখা যাওয়ার দু-এক দিন আগেই সীমান্ত পেরিয়ে আসে? তারপর এত দূর চলে আসে? নাকি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে চিতা বাঘের স্থায়ী কোনো বসতি না থাকলেও দীর্ঘ সময় কাটানোর মতো জায়গা আছে!
বর্তমানে শিক্ষাকালীন ছুটিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে শুরু করে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত সীমান্তের ওই পাশে ভারতে প্রচুর চা-বাগান আছে। এসব চা-বাগান ও আশপাশের জঙ্গলে প্রচুর চিতাবাঘ আছে। ওই দিক থেকে বাংলাদেশের অংশে সহজে চিতা বাঘ চলে আসতে পারে। তবে আমার ধারণা, এসব চিতা বাঘ এক-দুই দিনের জন্য আসে না। বরং বাংলাদেশের এই অংশে এদের নিয়মিত বিচরণ আছে। কখনো কখনো দীর্ঘ সময় এদের এই এলাকায় বাস করাও বিচিত্র নয়। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভুট্টা ও আখখেত। এসব জায়গায় চিতা বাঘ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। ছোটখাটো প্রাণী শিকার করেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাৎ, মোটামুটি দীর্ঘ সময় থাকার জায়গা হিসেবেই উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নির্জন এলাকা ব্যবহার করার সম্ভাবনা চিতা বাঘদের। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এসব চিতা বাঘ রক্ষা করা।’
এদিকে ফিরোজ আল সাবাহও উত্তরের কোনো জেলায় চিতা বাঘের মোটামুটি দীর্ঘ সময় আস্তানা গাড়ার সম্ভাবনার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, এপাশে এলে চিতা বাঘের থাকার জায়গা চর এলাকাগুলো। এই চর এলাকাগুলো ভুট্টা ও আখখেতে ভর্তি থাকে। অনেক চরে মানুষের আনাগোনা নেই। এসব এলাকায় বনবিড়াল, বুনো খরগোশ, শিয়ালের মতো প্রাণীও আছে। এ বছর ও ২০২২ সালে চিতা বাঘের মৃত্যুর ঘটনা দুটো যে জায়গাগুলোয় ঘটেছে, সেগুলো সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। পরপর দুই বছর দুটি চিতা বাঘ মারা যাওয়ায় ধারণা করছি, চর এলাকায় এদের দীর্ঘ সময় কাটানোর মতো আবাসস্থল আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান অবশ্য মনে করেন, ভারতের অংশের বন থেকে আসা চিতা বাঘদের দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকার মতো পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি নেই এদিকে। কারণ বড় একটি প্রাণী থাকলে একে দেখা না গেলেও ছাগল-কুকুর মারা পড়ত। ভারতের অংশের সংরক্ষিত এলাকাগুলোর গ্রাস ল্যান্ডে অনেক সময় আগুন দেওয়া হয়। তখন এরা এদিকে হয়তো আসে। তবে পঞ্চগড়ে চা-বাগান তৈরি হওয়ায় এখানে ডুয়ার্সের দিক থেকে আসা চিতা বাঘদের বেশি সময় আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা আছে বলে মনে করেন মনিরুল খান।
আমাদের কী করা উচিত
এখন আমাদের তাহলে কী করা উচিত? কীভাবে আমরা এদের রক্ষা করব? ভারতের অনেক জায়গাতেই মানুষ-চিতা বাঘ পাশাপাশি অবস্থানের নজির আছে। ভারতের রাজস্থানের বেরা, মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স প্রভৃতি এলাকায় মানুষের আশপাশেই প্রচুর চিতাবাঘ বাস করে। তাহলে আমাদের দেশেই কেন চিতা বাঘ দেখলেই মেরে ফেলতে হবে? তাহলে আমাদের কী করা উচিত?
মুনতাসির আকাশের মতে, সুন্দরবন অঞ্চলে যেমন টাইগার রেসপন্স টিম কিংবা গারো পাহাড় অঞ্চলে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম কাজ করে, এখানে তেমনি ল্যাপার্ড রেসপন্স টিম গঠন করা যেতে পারে, যারা সাধারণ মানুষকে চিতা বাঘ দেখলেই মেরে না ফেলার ব্যাপারে সচেতন করবেন। তেমনি লোকালয়ে চিতা বাঘ দেখা গেলে এদের সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে দিতে কাজ করবে।
মনিরুল খান বলেন, এরা সাধারণত আক্রান্ত হলেই মানুষকে আক্রমণ করে। মিডিয়ায় সাধারণত আসে মানুষকে আক্রমণ করায় এদের পিটিয়ে মারা হয় এমন খবর। মানুষকে সচেতন করাই একমাত্র উপায়। চিতা বাঘ দেখা গেলেই যেন বন বিভাগকে জানানো হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘প্রাণীটা আমাদের দেশের নয়। বাইরে থেকে (সীমান্ত পেরিয়ে) আসে। নীলগাইয়ের মতো প্রাণী এলে মানুষ সাধারণত আতঙ্কিত হয় না। কখনো অবশ্য খাওয়ার জন্য শিকার করে ফেলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চিতা বাঘের নামের সঙ্গে বাঘ থাকায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মানুষ যখন এদের ঘিরে বড় জমায়েত করে কিংবা একে আক্রমণ করে, তখন এরাও নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে পাল্টা আক্রমণ করে। যেকোনো প্রাণী এটাই করে। তখন মানুষ আরও ক্রুদ্ধ হয়ে এদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। ওই এলাকায় সচেতনতা বাড়ানোই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান দেখছি। ইদানীং এ ধরনের চিতা বাঘ মারা পড়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, আমরা উচ্চ পর্যায়ে মিটিং করে একটা সিদ্ধান্ত নেব। খুব সম্ভব আমাদের অ্যাওয়ারনেস বা সচেতনতা বৃদ্ধির যেসব প্রোগ্রাম আছে, তার আওতাভুক্ত করা হবে এটিকে।’
আশা রাখতে চাই
বাংলাদেশের বনে যে চিতা বাঘের মতো এত আশ্চর্য সুন্দর একটি প্রাণী আছে, এটি শিশুরা তো বটেই, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই জানেন না। তবে গবেষকদের গবেষণায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনে চিতা বাঘের স্থায়ী বসতি যে এখনো আছে, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তেমনি সিলেট বিভাগের কোনো কোনো অরণ্যেও এদের দেখা যাওয়ার কথা শোনা যায় কখনো কখনো। এদিকে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও এদের আনাগোনার খবর মিলছে নিয়মিত বিরতিতেই। এখানে এলে এদের করুণ পরিণতির শিকার হওয়ার পরও আশার কথা, পূর্বপুরুষের পুরোনো আস্তানাকে এখনো একেবারে ভুলে যায়নি নয়া জমানার চিতা বাঘেরা। এখন জরুরি মানুষের সঙ্গে এদের সংঘাতটা এড়ানো। আর যখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এদের বিচরণ থাকে, তখন দরকার মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ একটি অবস্থান নিশ্চিত করা।
ঢাকার বাতাস আজ খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সকালে পরিমাপ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের স্কোর ২৪৫। অন্যদিকে বায়ুদূষণের শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর। গুরুতর বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। এ ছাড়া দূষণের শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় ঘুরে ফিরে এই তিন দেশেরই বিভিন্ন
৫ ঘণ্টা আগেআজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জলবায়ু ও পরিবেশ সাংবাদিকদের সংগঠন ‘সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম’ (সাকজেএফ) এর নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেসেন্টমার্টিনের প্রবাল রক্ষায় সেখানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপকে কেন্দ্র করে গত কিছুদিন ধরেই আলোচনায় দ্বীপটি । এরই মধ্যে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল আবিষ্কৃত হলো প্রশান্ত মহাসাগরে। অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রাণী একসঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি প্রাচীরের পরিবর্তে একটি বিশালাকায় প্রবাল গঠন করেছে সেখা
১ দিন আগেঢাকার বাতাস আজও অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ওপরে উঠে দাঁড়িয়েছে পাঁচ এ। সকালে পরিমাপ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের স্কোর ১২৩। অন্যদিকে একদিনের ব্যবধানে আবারও বায়ুদূষণের শীর্ষে পাকিস্তানের লাহোর। গুরুতর বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। এ ছাড়া দূষণের শীর্ষ পাঁচ দেশের
১ দিন আগে