প্লাস্টিক দূষণ রোধের জোট অপসারণের চেয়ে উৎপাদন করেছে ১ হাজার গুণ বেশি

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৮: ৫৪
প্লাস্টিকের অগণিত টুকরো, মাইক্রো প্লাস্টিক এবং আবর্জনা সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। ছবি: এএফপি

পাঁচ বছর আগে প্লাস্টিক দূষণ রোধের লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ের এক জোট গড়ে তুলেছিল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ তেল ও রাসায়নিক কোম্পানি। কিন্তু নতুন তথ্য বলছে, এই সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ নতুন প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে, তা তাদের অপসারিত বর্জ্যের তুলনায় ১ হাজার গুণ বেশি।

পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের এক তদন্তে এই তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৯ সালে এক্সনমোবিল, ডাও, শেল, টোটাল এনার্জিস এবং শেভরন ফিলিপসের মতো শীর্ষ প্লাস্টিক উৎপাদক কোম্পানিগুলো অ্যালায়েন্স টু ইন্ড প্লাস্টিক ওয়েস্ট (এইপিডব্লিউ) নামে জোট করে। জোটটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ২০২৩ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ থেকে অপসারণ করবে। লক্ষ্য ছিল বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারে উন্নতি আনা এবং প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারযোগ্য চক্র তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে তাদের কার্যক্রম ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে ফারাক ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

লক্ষ্য হাওয়া, প্লাস্টিক উৎপাদন অব্যাহত
প্রথম থেকেই এই জোটের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল। গ্রিনপিসের দল আনআর্থড বিভিন্ন পাবলিক রিলেশনস কোম্পানির কাছ থেকে এসব কোম্পানির প্লাস্টিক উৎপাদন ও বর্জ্য অপসারণের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, এইপিডব্লিউ মূলত প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার জনমত বদলানোর চেষ্টা করছিল। ২০১৯ সালে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা নিয়ে তীব্র গণ প্রতিক্রিয়ার মুখে বিভিন্ন দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর পদক্ষেপের কথা ভাবছিল। সেই সময়েও তাঁদের নথিতে বলা হয়, প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে ‘সরলীকৃত নিষেধাজ্ঞার’ পরিবর্তে ‘বাস্তবসম্মত দীর্ঘমেয়াদি সমাধান’ প্রচারের কথা।

২০২২ সালের শুরুর দিকে ‘১৫ মিলিয়ন টন বর্জ্য অপসারণের’ লক্ষ্য ‘অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বলে চুপিসারে বাতিল করা হয়।

প্লাস্টিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই জোটের পাঁচটি প্রধান কোম্পানির তথ্য বিশ্লেষণ করেছে জ্বালানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জি। এদের মধ্যে রয়েছে এইপিডব্লিউয়ের চেয়ারম্যান রাসায়নিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ডাওসহ তেল কোম্পানি এক্সনমোবিল, শেল, টোটালএনার্জিজ ও শেভরনফিলিপস। শেভরনফিলিপস মার্কিন তেল জায়ান্ট শেভরন ও ফিলিপস ৬৬-এর একটি যৌথ উদ্যোগ।

মুখে যত কথাই বলুক বাস্তবে এই জোটের কার্যক্রম অনেকটাই বিপরীতমুখী। উড ম্যাকেঞ্জির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জোটের সদস্য পাঁচ কোম্পানি মিলে গত পাঁচ বছরে নতুন করে ১৩২ মিলিয়ন টন পলিথিন (পিই) এবং পলিপ্রোপিলিন (পিপি) প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে, যা তাদের সরানো ১ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টন বর্জ্যের চেয়ে ১ হাজার গুণ বেশি।

এইপিডব্লিউয়ের নথি অনুযায়ী, অপসারিত এই প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশির ভাগই মেকানিক্যাল বা কেমিক্যাল রিসাইক্লিং, ল্যান্ডফিলে স্থানান্তর অথবা জ্বালানির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত প্লাস্টিকের পরিমাণ সম্ভবত আরও বেশি, কারণ এই তথ্য কেবলমাত্র সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত দুটি পলিমার—পলিথিন, যা প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং পলিপ্রোপিলিন, যা খাদ্য প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয়—এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতে পলিস্টাইরিনের মতো অন্যান্য প্রধান প্লাস্টিকের তথ্য নেই।

নতুন তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় জাতিসংঘের উদ্যোগে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে প্রথমবারের মতো একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই চুক্তির লক্ষ্য পুরো প্লাস্টিক উৎপাদন চক্রকে নিয়ন্ত্রণে আনা। তবে এই আলোচনায় এইপিডব্লিউ জোট এবং জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো নানা তদবির করার চেষ্টা করছে। আলোচনাটি এখন সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। চূড়ান্ত চুক্তিতে বৈশ্বিক প্লাস্টিক উৎপাদনের সীমা নির্ধারণ করা হবে কিনা, তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে।

এইপিডব্লিউ ও ফসিল ফুয়েল কোম্পানিগুলো এই সীমার বিরোধিতা করছে। তবে যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন উভয়েই এই সীমার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের নতুন লেবার সরকার দেশের অবস্থান বদলে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণাপত্রে সই করেছে, যেখানে চুক্তিতে প্রাথমিক প্লাস্টিক পলিমারের উৎপাদন ও ব্যবহার টেকসই মাত্রায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারে টেকসই মাত্রা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর চুক্তি দরকার।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রও এই গ্রীষ্মে বৈশ্বিক প্লাস্টিক উৎপাদনে সীমা নির্ধারণের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান এখনো জানা যায়নি।

কী বলছে গ্রিনপিস?
গ্রিনপিস যুক্তরাজ্যের সহপরিচালক উইল ম্যাককালাম বলেন, এই তথ্যে পরিষ্কার যে, তেল কোম্পানিগুলো যতটা প্লাস্টিক উৎপাদন করছে, তা তাঁদের প্রচারিত পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রকল্পগুলোর চেয়ে খুব সামান্য। এটি সুস্পষ্ট গ্রিনওয়াশিং বা পরিবেশ বিষয়ে চোখে ধুলা দেওয়া।

উইল ম্যাককালাম আরও বলেন, ‘কোম্পানিগুলো যেসব রিসাইক্লিং প্রকল্পগুলো প্রচার করছে, সেগুলো তাঁদের বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদনের কাছে একেবারেই অকার্যকর। তাঁরা একদিকে বাঁধ কেটে দিয়ে দিয়ে পানি ছাড়ছে, আর অন্যদিকে চামচ দিয়ে সেই পানি তোলার চেষ্টা করছে। এসব করে কোনো কাজ হবে না। প্রথমেই প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ কমাতে হবে। এটিই একমাত্র সমাধান।’

মার্কিন পরিবেশবিদ বিল ম্যাককিবেন বলেন, এটি গ্রিনওয়াশিংয়ের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। তেল ও গ্যাস শিল্প আসলে প্লাস্টিক শিল্পেরই আরেক রূপ। তাঁরা কয়েক দশক ধরেই এমন করছে।

এইপিডব্লিউয়ের অবস্থান
পিআর কোম্পানি ওয়েবার শ্যান্ডউইকের নথি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে এএপিডব্লিউ গঠনের পেছনে আমেরিকান কেমিক্যাল কাউন্সিলের উদ্যোগ ছিল। তাঁরা প্লাস্টিকের ‘বিরূপ ধারণা’ দূর করতে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবের বিরোধিতা করার উপায় খুঁজছিল। ২০১৯ সালে এই কাজের জন্য এএপিডব্লিউ ওয়েবার শ্যান্ডউইককে ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার দেয়।

জোটটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এসব অভিযোগ ও ভিত্তিহীন ধারণাগুলোকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের উদ্দেশ্য হলো কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা ও প্লাস্টিক বর্জ্য দূরীকরণে অবদান রাখা।’

জাতিসংঘের প্লাস্টিক বর্জ্য সংক্রান্ত আলোচনায় এইপিডব্লিউ দীর্ঘদিন ধরেই তদবির চালিয়ে আসছে, যা সোমবার শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করবে। সংগঠনের প্রতিনিধিরা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ কমানোর বিষয়টি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়।

এএপিডব্লিউয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘কোনো একক সংগঠন প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। জোটটি এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সংগ্রহ, শ্রেণিবিন্যাস ও পুনর্ব্যবহারসহ কার্যকর পদ্ধতি চিহ্নিত করতে কাজ করছে। একটি চক্রাকার অর্থনীতির প্রসার ঘটাচ্ছে।’

ওয়েবার শ্যান্ডউইকের নথিতে উল্লেখ করা হয়, জোটটি স্বল্পমেয়াদি প্লাস্টিক নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবসম্মত সমাধান’ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছিল, যার মধ্যে ছিল পুনর্ব্যবহার।

এদিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল রব বন্টা এক্সনমোবিলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সেপ্টেম্বর মাসে দাখিল করা ওই মামলার নথিতে বলা হয়েছে, এক্সনমোবিল ৫০ বছর ধরে পুনর্ব্যবহারের সক্ষমতা নিয়ে জনসাধারণকে ভুল বুঝিয়েছে ও চটকদার বিপণনের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করেছে।

এরপরও এক্সনমোবিল বলেছে, ‘সমস্যা প্লাস্টিক নয়, সমস্যা হলো প্লাস্টিক বর্জ্য। আমরা পুনর্ব্যবহারের মতো প্রকৃত সমাধান নিয়ে আসছি। ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ নির্মূলের বৈশ্বিক চুক্তির লক্ষ্য পূরণে কাজ করছি।’

এক্সনমোবিল আরও বলেছে, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মামলা না করে ক্যালিফোর্নিয়ার কর্মকর্তারা সমস্যার সমাধানে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারতেন। আমরা বাস্তব সমাধান আনছি, এমনভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করছি যা সাধারণ পদ্ধতিতে করা কঠিন। আমরা আমাদের গ্রাহকদের প্রতি সব সময় সৎ থেকেছি এবং আমাদের প্রকাশিত বিবৃতিগুলোর ওপর আস্থা রাখি।’

অন্যদিকে, শেল এবং টোটালএনার্জিস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

প্লাস্টিক দূষণের মূলে উৎপাদন
বিশ্বে প্লাস্টিকের উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বার্ষিক প্লাস্টিক উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ৪৬০ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। একই সময়ে প্লাস্টিক বর্জ্য ১৫৬ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ৩৫৩ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে, যার মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে।

প্লাস্টিকের অগণিত টুকরো, মাইক্রো প্লাস্টিক এবং আবর্জনা সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার হারমানাসে বিগ ওশান ক্লিন আপ কার্যক্রমে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সমস্যার মূল উৎপাদনে। যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেভল্যুশন প্লাস্টিকস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক স্টিভ ফ্লেচার বলেছেন, নতুন প্লাস্টিক পলিমারের উৎপাদন কমানো ছাড়া প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসের কোনো বাস্তবসম্মত উপায় নেই।

জাতিসংঘের আসন্ন চুক্তি হয়তো এই সংকট নিরসনে নতুন দিক নির্দেশনা দেবে, তবে এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে বড় কোম্পানিগুলোর সদিচ্ছার ওপর।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত