‘অমন পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠের দেখা মেলা ভার’

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২১, ২০: ৪৯
আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২১, ২০: ৫৭

রবীন্দ্রনাথের গানে আজন্ম নিবেদিত এক শিল্পীর নাম মিতা হক। রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল যার জীবনের একমাত্র ব্রত। রবীন্দ্রসংগীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তার সংগীতলব্ধ জ্ঞান। নিরলস চেষ্টা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে আঁকড়ে ধরে সংগীত সাধনায় নিমগ্ন উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্র হারিয়ে গেলেন চিরতরে।

রোববার (১১ এপ্রিল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার নিকট স্বজন তারকারা স্মৃতিকাতর..

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা । ছবি: সংগৃহীতরেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা

ভোরেই একজন কল দিয়ে বিষণ্ণ খবরটা জানালেন। আচমকা কল আর খবরটা পেয়ে আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। কল রেখে শুয়ে রইলাম আরো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে বাসার সবাইকে জানালাম। আমাদের পথচলাটা একসঙ্গে, আর হঠাৎ করেই সেটা থেমে গেল? মেনে নিতে পারছি না। মিতা আর আমার পড়াশোনা একই জায়গায়। শান্তিনিকেতন। বিষয়ও একই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাকে প্রথমে আমি চিনি ওয়াহিদ ভাইয়ের মেয়ে হিসেবে। সেই শুরু। এরপর তো দেশে ফিরে এলাম। মিতা ব্যস্ত হয়ে গেল রবীন্দ্রসংগীতে। আমিও তাই। সাংগঠনিকভাবে তিনি কাজ করে চললেন। তবে এই জায়গায় আমাদের যোগাযোগটা কম হলো। কারণ মিতা ছায়ানট ও রবীন্দ্র সম্মিলন পরিষদ নিয়ে কাজ করছিলেন। আমি গান ও পরবর্তী সময়ে সংগঠন সুরের ধারা নিয়ে ব্যস্ত হলাম। এরপর বহু কাজ করে গেছেন মিতা। বহু অনুষ্ঠানে আমরা একমঞ্চে দাঁড়িয়েছি, শিল্পী হিসেবে।

মনে আছে, ২০১৭ সালে চ্যানেল আই রবীন্দ্র উৎসবে তাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। সেখানে আমিও ছিলাম। আজীবন সম্মান জানানোর মতোই ছিলেন তিনি। তার এই অসময়ে চলে যাওয়াটা সত্যিই কষ্টের। আমার চেয়ে বয়সে বছর পাঁচ ছোট হবে। আমিও করোনা পজিটিভ ছিলাম, এখন সুস্থ। ও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারল না। দীর্ঘদিন অসুস্থও ছিল, অবশেষে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আর যাওয়াটা এমন একটা সময়ে শেষ দেখা পাওয়ারও সুযোগ নেই। প্রার্থনা করি, এভাবে যেন আর কাউকে না হারাই।

শিমুল ইউসুফ । ছবি: সংগৃহীতশিমুল ইউসুফ

মিতার কন্ঠে সর্বশেষ যখন ‘যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙলো ঝড়ে’ শুনছিলাম, আমি তখন ওর পিঠে মাথা গুজে অঝোর ধারায় কাঁদছিলাম। পৃথিবীতে ওর মতো করে ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ আর কেউ কোনদিন গাইতে পারবেনা। দর্শক সারিতে বসে ওর গান শুনতাম, আর চোখ ভিজে আসতো। এত আবেগ এত ভালভাসা সেই গানে। হায় মিতা আমাদের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে অমন উৎকন্ঠা নিয়ে আর কেউ ফোন করে জিজ্ঞেস করবেনা ‘শিমূল দি বাচ্চুভাই কে সাবধানে রাখো’। ওর অমৃত কন্ঠস্বর হয়তো ঈশ্বরকেও মুগ্ধ করেছে। তাই ওকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেল না ফেরার দেশে। কিন্তু আমার বুকে বেঁচে থাকবে যতদিন আমি বাঁচবো। মিতা আর যুব (খালেদ খান)-কে নিয়ে আমার স্মৃতির ভাণ্ডার কোনদিন ফুরাবে না।

নিমা রহমান । ছবি: সংগৃহীতনিমা রহমান

মিতা আমার প্রাণের বন্ধু। ওর গান শুনতে শুনতে একসময় আমি ঘুমাতে যেতাম। ঘুম থেকে উঠতাম ওর গান শুনতে শুনতে। রবীন্দ্র দর্শনকে ধারণ করেই মিতা বড় হয়েছে। পরচর্চা করেছে, নেতিবাচক কিছু বলেছে তা আমি কখনো শুনিনি। রবীন্দ্র চর্চা ওকে একজন শুদ্ধ মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলেছে। অমলিন একটা মানুষ ছিল। কখনোই কারো পেছনে কোন দোষ বলতেন না। ও নাকি কারো দোষই খুঁজে পেত না। মিতা সরল মনের মানুষ ছিলেন। আমার পারিবারিক বন্ধু। ওর মেয়ে জয়ীতা আমার ছেলের আরিকের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। একসঙ্গে বড় হয়েছে ওরা। জয়ীতা বাবা মা দুজনকেই হারাল, আমি তারিক আছি ওর জন্য। আমরা নিজের সন্তানের মতো ওকে স্নেহ করি।

তপন মাহমুদ । ছবি: সংগৃহীততপন মাহমুদ

মিতাকে আমি কম হলেও ৩৫ বছর আগে থেকে জানি। লালমাটিয়া গার্লস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। বার্ষিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। আমি সেখানে গিয়েছিলাম বিচারক হিসেবে। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। প্রথম হলেন। এত সুন্দর কণ্ঠ যে আজও ভুলিনি। অনুষ্ঠান শেষে ওর পরিচয়ও জানলাম সেদিন। আমাদের বহু অনুষ্ঠানে মিতাকে নিয়ে এই স্মৃতিটা আমি বলতাম। এটা বলতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। আস্তে আস্তে তিনি গানে জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হলেন। তারপরই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেলেন। আমি অস্ট্রেলিয়াতে থাকলেও আমাদের যোগাযোগ ছিল। বয়সে আমার অনেক ছোট। কাজ করতে করতে সম্পর্কটা ভাইবোন ও বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিল। আমি আপনি করেই বলতাম। শেষ হয়ে গেল সব।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ । ছবি: সংগৃহীতনাসির উদ্দিন ইউসুফ

আহা! অমন পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠের দেখা মেলা ভার। আর মিলবে কিনা জানি না। জীবন ও শিল্পের এমন শুদ্ধতম মিলন কালেভদ্রে ঘটে। আনন্দের মাঝেই জীবন উথলিয়া ওঠে একথা মিতাকে দেখলেই মনে হতো। দু:খকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জীবনের আনন্দে শিশুর মত করতালি দিতো। এইতো মাত্র সাতদিন আগে হাসপাতাল থেকে ফোনে চিৎকার করে বলে- বাচ্চুভাই, আমারতো এইখানে ভাল্লাগেনা, ভাল্লাগেনা, ভাল্লাগেনা। আমারে বাসায় নিয়ে যায়না কেন! তার দু'তিনদিন পর কন্যা জয়ীতা ও সন্তানসম শাহীন ওদের করোনামুক্ত মাকে কেরাণীগঞ্জের বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু পরশু হঠৎই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবারো হাসপাতাল।আর আজ প্রত্যুষে আমার কন্যা এশা ও পুত্রবৎ সাকি হাসপাতাল থেকে ফিরে জানালো ‘মিতামা’ মারা গেছে। আমি নির্বাক। নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হই। ভাবি মিতার মত জীবনকে ভালেবাসতে আমি কাউকে দেখিনি। এমনভাবে কাউকে জীবন উদযাপন করতে দেখিনি। শত কষ্ট-দু:খের মাঝে কলকলিয়ে এভাবে হাসতেও দেখিনি কাউকে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত