গুঞ্জন রহমান
বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর ভূমিকা ছিল গায়কের। কিন্তু তাঁর ইমেজ ছিল নায়কের মতো। এই মিডিয়া বিস্ফোরণের কালে এসে যা-ই হোক, তাঁকে গণমাধ্যমে অল্পবিস্তর পাওয়া যেত। কিন্তু গত শতকের শেষ দুটো দশকে, যখন তিনি দাপটের সঙ্গে শাসন করছেন বাংলাদেশের সিনেমাকেন্দ্রিক সংগীতজগৎ, তখনো তিনি যেন এক রহস্য-মানব! রেডিও খুললেই একচেটিয়াভাবে তাঁর কণ্ঠ বাজে, সিনেমা তো তাঁর গান ছাড়া চলেই না, বাংলাদেশের পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি অদ্বিতীয়। অথচ তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
ইন্টারনেট-পূর্ব সেই যুগে বিশেষত চলচ্চিত্র তারকাদের সম্পর্কে জানার মাধ্যম বলতে পত্রপত্রিকার বিনোদন পাতাগুলোই ভরসা ছিল। সেসব পাতায় তাঁকে নিয়ে বিশেষ কিছু লেখা হয় না। তিনি টিভিতে আসেন না বললেই চলে, মাঝেমধ্যে কণ্ঠ শোনা গেলেও পর্দায় তাঁর উপস্থিতি নেই। স্টেজ শো করেন বলেও তেমন শোনা যায় না। কেবল সিনেমার গান গেয়েই তিনি খ্যাতির শীর্ষে! শুধু কণ্ঠের জোরেই তিনি নায়ক। বলা চলে মহানায়ক! ব্যাপারটি এ রকম যে ১৯৯৪ সালে সালমান শাহ ও মৌসুমীর প্রথম সিনেমা এবং ভারত থেকে কপিরাইট এনে পুনর্নির্মিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি যখন সুপার-ডুপার হিট হলো, তখন বিনোদন পাতায় লেখা হয়েছিল, গত এক দশকে এই প্রথম কোনো ছবি হিট করল অ্যান্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে একটিও গান ছাড়াই!
অ্যান্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। জন্ম ৪ নভেম্বর, ১৯৫৫; রাজশাহী শহরে। মৃত্যু ৬ জুলাই, ২০২০, ঢাকায়। মাত্র ৬৫ বছর বয়সের জীবনে তিনি অ্যান্ড্রু কিশোর নামে ছিলেন খ্যাতিমান। বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র বাড়ৈ ও মা মিনু বাড়ৈ। মিনু বাড়ৈ গান করতেন, ভক্ত ছিলেন কিশোর কুমারের। সে জন্য ছেলেরও নাম রেখেছিলেন কিশোর কুমার। চাইতেন, তাঁর ছেলেও বড় হয়ে কিশোর কুমারের মতোই গান গেয়ে নাম করুক। মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল বৈকি। খ্যাতিতে ভারতের কিশোর কুমারের চেয়ে বাংলাদেশের অ্যান্ড্রু কিশোর খুব যে পিছিয়ে নেই, তা নিয়ে দ্বিমত সম্ভবত কেউ করবেন না।
রাজশাহীর প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে ছয় বছর বয়সে অ্যান্ড্রু কিশোরের আনুষ্ঠানিক সংগীতশিক্ষায় হাতেখড়ি এবং সাত বছর বয়সে তালিকাভুক্তি রাজশাহী বেতারে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে গান করেছেন রাজপথে। গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকগীতি—সব ধরনের গান করেছেন। তারপর পাড়ি জমিয়েছেন প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রিতে। মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তাই কিশোর কুমারের মতো প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রিতে পা তো রাখতেই হতো। সে পর্বে পা রাখার আগে শেষ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। কিছুদিন চাকরিও করেছেন ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু যেদিন থেকে গানকেই জীবিকা হিসেবে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, চাকরি ছেড়ে দিলেন। এ প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম কোনো গায়ক, যিনি গান গাওয়াকেই একমাত্র জীবিকা হিসেবে বেছে নেওয়ার সাহস করেছিলেন। বলেছিলেন, অন্য কোনো পেশায় জড়িত থেকে, অর্থাৎ চাকরি বা ব্যবসা করে তার ফাঁকে ফাঁকে গান চালিয়ে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল, গানের প্রতি তাহলে নিবেদন সম্পূর্ণ হবে না। তখনকার দিনে রাজশাহী থেকে ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা খুব সুগম ছিল না। ট্রেন যোগাযোগ ভালো ছিল না এখনকার মতো। বাসে যাতায়াতও সহজ ছিল না। রাস্তা ছিল ভাঙাচোরা, অনেক সময় লেগে যেত যাতায়াতে, শরীরও কাহিল হয়ে পড়ত। এভাবে সারা দিন বা সারা রাত সফর করে ঢাকায় এসে গান গেয়ে আবার ফিরে গিয়ে অফিস করা, বিষয়টা খুব সুবিধাজনক ছিল না। তা ছাড়া যাত্রার ধকলে কাহিল শরীর নিয়ে ভালোমতো গানও গাওয়া যায় না। এসব কারণে তিনি ঢাকাতেই স্থায়ী হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঢাকায় কোনো চাকরির চেষ্টাটুকুও না করে পুরো সময় গানের জন্য বরাদ্দ করেন।
‘আমাকে প্রস্তুত থাকতে হতো, কখন কে ডাকবেন, তখনই তাঁর কাছে পৌঁছে যেতে হবে। এখনকার মতো তো তখনকার ব্যবস্থা ছিল না যে স্টুডিওতে গেলাম আর গান গেয়ে চলে এলাম। তখন একেকটা গানের পেছনে দু-তিন দিন থেকে সপ্তাহ পর্যন্তও সময় দিতে হতো। গান যখন লেখা হচ্ছে, তখনই শিল্পীকে ডেকে পাঠাতেন সংগীত পরিচালক। শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, ছবির কাহিনিকার, পরিচালক—সবাই উপস্থিত থাকতেন। এক লাইন, দুই লাইন করে লেখা হতো, তাতে সুর দেওয়া হতো, সবাই শুনতেন। ভালো লাগলে লেখা এগোত, না লাগলে পুরোটাই বাতিল করে আবার নতুন করে শুরু হতো। গায়ক-গায়িকাদের বসে থাকতে হতো পুরোটা সময়। সমস্তটা মিলে একটা প্রক্রিয়া ছিল সেটা।...চাকরি করে এর অংশ আমি হতে পারতাম না।’ ...এই ছিল অ্যান্ড্রু কিশোরের মনোভাব।
১৯৭৭ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায়। সে গানের শিরোনাম ছিল ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’। তবে প্রথম সাফল্য আসে আরও দুই বছর পর, ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রতিজ্ঞা’ ছবিতে, ‘এক চোর যায় চলে’ গানের মাধ্যমে। তারপর থেকে প্রায় চার দশক শাসন করেছেন বাংলাদেশের প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রি। গান করেছেন পনেরো হাজারের বেশি। কিন্তু তিনি কখনো কোনো অপেশাদারি পরিবেশে গান করেননি। কোনো ঘরোয়া বা ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে নয়, বিয়েবাড়ির কনসার্ট জাতীয় অনুষ্ঠানে তো একদমই নয়। গান করেননি নিজ কন্যার বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজনেও, যদিও তাঁর আমন্ত্রণে সেই অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে গিয়ে গান করেছিলেন দেশবরেণ্য অনেক শিল্পী।
অপেশাদারি পরিবেশে গান না গাওয়া বা নিজের নিয়ম ভেঙে কারও অনুরোধে গান না গাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বিটিভির ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের ঈদ স্পেশাল পর্বে প্রথম কথা বলেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হানিফ সংকেতের সঙ্গে। ১৯৯৪ বা ’৯৫ সালের সেই অনুষ্ঠানে গান শুরুর আগে হানিফ সংকেত তাঁর সম্পর্কে দুটো অজানা তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। তার প্রথমটি ছিল, তিনি কখনো কোনো ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে গান করেন না। হানিফ সংকেত তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন যদি হয় যে, আপনি আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আমন্ত্রণে তাঁর ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে গিয়েছেন এবং তিনি এমনভাবে অনুরোধ করেছেন যে আপনার গান না গেয়ে উপায় নেই...তখন কী করবেন?’
অ্যান্ড্রু কিশোর একদমই না ভেবে বললেন, ‘সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো দূরের কথা, আমার যেকোনো বন্ধুই জানেন, আমি প্রাইভেট পার্টিতে গান গাই না, তাই তাঁরা এই অনুরোধ করবেন না কখনো।’
হানিফ সংকেত নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘তবু যদি করেই বসেন অনুরোধ?’
কিশোর নির্বিকারভাবে বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে বন্ধুত্বই আর থাকবে না!’
আর চমকে দেওয়ার মতো দ্বিতীয় তথ্যটি ছিল, তখন পর্যন্ত প্লেব্যাক, নন-প্লেব্যাক মিলিয়ে তাঁর একটিও অডিও অ্যালবাম বাজারে ছিল না!
গায়ক হিসেবে অ্যান্ড্রু কিশোরের পেশাদারত্বের উদাহরণ হিসেবে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্ভবত ১৯৮৯ সালের কথা। বিটিভি সগৌরবে উদ্যাপন করে রজতজয়ন্তী। সে উপলক্ষে সাত দিন অথবা দশ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন তারা উপহার দেয় দর্শকদের, যার মধ্যে আকর্ষণীয় ছিল ২৫ ডিসেম্বর বিটিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনের লাইভ কনসার্ট। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি বিটিভির অডিটরিয়ামে বসে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন। সারা দেশের সবার দৃষ্টি স্থির টিভির পর্দায়, সবাই বিপুল উৎসাহে অনুষ্ঠান দেখছে আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, এই বুঝি অ্যান্ড্রু কিশোর এলেন মঞ্চে! একে একে আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আবদুল হাদী, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, খুরশীদ আলম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই, আজম খান, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা...আরও কতজন গেয়ে ফেললেন, কিন্তু অ্যান্ড্রু কিশোর এলেন না! ব্যাপার কী? রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান, যেখানে বসে আছেন খোদ রাষ্ট্রপ্রধান, সেই অনুষ্ঠানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গায়ক নেই কেন? অনেক পরে জানা গিয়েছিল, তিনি নিজেই কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েও তিনি গান করতে রাজি হননি। কারণ, বিটিভি তাঁকে কোনো সম্মানী দেবে না বলে জানিয়েছিল। তিনি আপত্তি করায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘গ্রেড সি আর্টিস্ট’ ক্যাটাগরির সম্মানী দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বিটিভির নিয়মিত শিল্পী তো ননই, অনিয়মিতও নন। তাই নিয়ম অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ এর বেশি দিতে অপারগ। তিনি সেই প্রস্তাবে অপমানিত বোধ করায় অনুষ্ঠানে তো যানইনি, ঢাকাতেই থাকেননি সেদিন। যাতে শেষ মুহূর্তে সর্বোচ্চ মহল থেকে ডাক পড়ে আর তিনি তা অগ্রাহ্য করতে না পারেন, তাই পরিবারের সঙ্গে ক্রিসমাস উদ্যাপনের অজুহাতে চলে যান রাজশাহীতে।
অ্যান্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার গায়ক, যিনি পেশাদারত্বের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটির কথাতেও নয়। এটা হলো তাঁর প্রফেশনালিজমের একটা ছোট্ট উদাহরণ। অথচ, এই মাত্রার চরম পেশাদার ব্যক্তিটিও নিজের নীতির সঙ্গে আপস করেছেন বিশেষ ক্ষেত্রে। তার মধ্যে একটি হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাজশাহীতে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে তিনি কখনো সম্মানীর বিনিময়ে গান করেননি। বরং তাঁর সঙ্গে আসা যন্ত্রশিল্পীদের সম্মানী ক্ষেত্রবিশেষে নিজেই পরিশোধ করে দিয়েছেন। আর, অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে গান করার উদাহরণ জীবনে একবারই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। একজন বিশেষ ব্যক্তির জন্য।
সেই বিশেষ ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হক। এই সব্যসাচী সাহিত্যিকের লেখা গান গেয়েই তিনি জীবনে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন, যে পুরস্কারের অনার্স বোর্ডে তাঁর নামটা লেখা হয়েছে রেকর্ড আটবার। যাহোক, সৈয়দ শামসুল হক যখন মৃত্যুশয্যায়, হাসপাতালে শুয়ে আছেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান অ্যান্ড্রু কিশোর। তখন আচমকা তাঁর কণ্ঠে খালি গলায় গান শুনতে চান হক সাহেব। কিশোর এটা জীবনে কখনো করেননি। তিনি কারও অনুরোধেই এভাবে হঠাৎ করে গান ধরেননি। এটা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী হক সাহেবের সামনে তিনি নীতির গোঁ ধরে বসে থাকতে পারলেন না। হাসপাতালের কেবিনে বসে গেয়ে শোনালেন সৈয়দ হকেরই লেখা অমর গান, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস।’ এখানেই শেষ নয়। সৈয়দ শামসুল হক ফিসফিস করে বললেন, ‘এখানে আমার পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে। স্ত্রী আছেন, আমার শ্যালিকারা আছেন। তাঁরা তোমার একটা গানের খুবই ভক্ত।’ কিশোর জানতে চাইলেন, ‘কোন গানটা?’ সৈয়দ শামসুল হক বললেন, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না, তোমার তুলনা’। কিশোর সেটাও গেয়ে শোনালেন খালি গলায়।
এর পরে আর একবারই তিনি অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে গান গেয়েছিলেন। ক্যানসারের চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসার আগে প্রবাসী ভক্তরা যখন বিদায় সংবর্ধনা দিলেন তাঁকে, সেই অনুষ্ঠানে হাসিমুখে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ গাইতে গাইতে ভক্তদের কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।
অ্যান্ড্রু কিশোর নিজেকে কখনো শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতেন না, বিনয় করে বলতেন, ‘আমি শিল্পী হতে পারিনি, বড়জোর একজন কণ্ঠশ্রমিক। শিল্পী অনেক বড় বিষয়। অনেক সাধনা লাগে শিল্পী হতে গেলে, শিল্পকে ধারণ করতে হয় নিজের ভেতরে। আমি সেটা পারিনি, সে চেষ্টাই করিনি। আমি বরাবর নিজের কণ্ঠকে শ্রমিকের মতো খাটিয়েছি গানের পেছনে। আমি কণ্ঠশ্রমিক।’ আর তাই, একদম শুরু থেকেই ‘গায়ক’ পেশাটাকে তিনি চ্যালেঞ্জের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং এক শ ভাগ পেশাদার শিল্পীর মতো কাজ করে গিয়েছেন নিরন্তর। তাঁর সময়ের সুরকারদের সবাই তাঁর জন্য সুর করেছেন, সব গীতিকারের কথায় গান গেয়েছেন। কারও সঙ্গে বিরোধে যাননি, কারও সঙ্গে সবিশেষ অন্তরঙ্গ জুটিও গড়েননি। সবাইকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, সমানভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশের কোনো সংগীত পরিচালক দাবি করতে পারবেন না যে কিশোরের জন্য সবচেয়ে সেরা গানগুলো তিনিই কম্পোজ করেছেন। আবার কেউ এমনটাও বলতে পারবেন না যে কিশোরের সঙ্গে অমুক সুরকারের গানগুলো ঠিক জমেনি। বরং উল্টোটাই দেখা গেছে। কোনো সুরকার বা সংগীত পরিচালক যদি দশজন শিল্পীকে দিয়ে গান করান আর তার মধ্যে একটিমাত্র গান হিট করে থাকে, তো সেই গানটি অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া। জুটি না বাঁধা প্রসঙ্গে কিশোর তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিবেশে আড্ডার অবকাশে একবার বলেছিলেন, ‘দেখ, কারও সাথে জুটি গড়া মানে, বাকিদের কম গুরুত্ব দেয়া। আমি তো সেটা করতে পারি না। আমি একজন পেশাদার গায়ক, আমাকে এক শ ভাগ নিরপেক্ষতা রক্ষা করে কাজ করে যেতে হবে। সংগীত পরিচালক, তিনি হতে পারেন পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিংবা মাত্রই বিশ বছর বয়সী, যখন আমি তাঁর গান করছি, তখন তিনি আমার গুরু। আর গুরুর মধ্যে ভেদাভেদ করা যায় না।...এই একই কথা সহশিল্পীর ক্ষেত্রেও। সংগীত পরিচালক ডুয়েট গানের জন্য আমার সঙ্গে যাকেই সিলেক্ট করবেন, তিনি আমার পার্টনার। বিশেষ কাউকে বেশি পছন্দ করি বলে তার সাথেই বেশি গাইব, বাকিদের সাথে কম, এটা ভালো চর্চা নয়। আমার পছন্দ-অপছন্দ তো ব্যাপারই না এখানে, ব্যাপার হলো কোনটা পরিচালকের পছন্দ।’ আর তাই সাবিনা ইয়াসমীন বা রুনা লায়লাদের মতো কিংবদন্তিদের সহ-কণ্ঠকেও সাবলীল গাইতে শোনা যায় সদ্য-কৈশোর পেরোনো লুইপার সঙ্গেও। সারা জীবনই তিনি এই ভালো চর্চাটা করে গেছেন। কারণ, তিনি পেশাদারত্বের ওপরে আর কোনো কিছুকে স্থান দেননি।
বিশ্বজুড়েই শোবিজ জগতে একটা চর্চা প্রচলিত যে, কোনো শিল্পীর জনপ্রিয়তা যত বাড়তে থাকে, তাঁর সম্মানী বা পারিশ্রমিকও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। অ্যান্ড্রু কিশোর একদম শুরু থেকেই হিটের পর হিট গান উপহার দিয়েছেন। একটা সময়ে এ দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে এমন কথা প্রচলিত ছিল, যে ছবিতে অ্যান্ড্রু কিশোরের গান নেই, সেই ছবি হিট করবে না, সেই ছবি দেখে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। এমন হিট গানের কারিগর কিশোরের সম্মানী অন্য সবার তুলনায় সব যুগেই খানিকটা বেশি ছিল বটে, তবে সেটা বরাবরই ছিল যেকোনো সংগীত পরিচালক বা প্রযোজকের সাধ্যের সীমানার ভেতরেই। কোনো গান যতই হিট করুক না কেন, তিনি তাঁর সম্মানীতে কখনো অস্বাভাবিক উল্লম্ফন ঘটাননি। ফলে যে-কেউ তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সামর্থ্য রাখতেন, সাহসও রাখতেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অ্যান্ড্রু কিশোর ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি প্লেব্যাকে কলকাতা ও মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিও মাতিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে থেকে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। আরডি বর্মনের মতো সুরকারের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও নয়। আবার মুম্বাই মাতানোর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার বাজারে নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাননি, যেমনটা করাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল।
নিজের কর্মস্থলকে তিনি শ্রদ্ধা করে গেছেন আমৃত্যু। বরাবরই তিনি রেকর্ডিংয়ের জন্য শিফট শুরুর যথেষ্ট আগে হাজির হতেন স্টুডিওতে। দীর্ঘ সময় হারমোনিয়ামে গলা সেধে তারপরই সিঙ্গার্স বুথে ঢুকতেন গান গাইতে। তাই কোনো রেকর্ডিংয়েই তাঁর কণ্ঠের অবনতির প্রমাণ কখনো পাওয়া যেত না। কিশোর এই জগৎটাকে ভালোবাসতেন, তাঁর একমাত্র ঠিকানা হিসেবে মানতেন সব সময়। শেষ বেলায়, ক্যানসারের আর চিকিৎসা নেই নিশ্চিত হওয়ার পর তাই ফিরে গেছেন নিজের শহরেই।
অ্যান্ড্রু কিশোর বিশেষ কোনো রাজনৈতিক আদর্শে চালিত হননি। চূড়ান্ত পেশাদার গায়কের মতো সবার তৈরি গান গেয়ে গেছেন সবার জন্য। নিজের কণ্ঠকে তিনি যন্ত্রের মতো ব্যবহার করতে দিয়েছেন, সম্ভবত সবচেয়ে সুরেলা, সবচেয়ে দরাজ আওয়াজের অধিকারী যন্ত্র। আপনি আপনার স্বীয় মুনশিয়ানায় কীভাবে তা বাজিয়ে নেবেন, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করে।
তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি নকল সুরের গান করেন কেন? আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হিট গানটাই তো একসময়ের জনপ্রিয় হিন্দি গানের নকল। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তুমি যখন কোনো যন্ত্রশিল্পীকে কোনো সুর বাজাতে শোনো, যেটা নাকি অন্য কারও সুর থেকে নকল করা, এই নকলের জন্য তুমি কাকে দোষ দাও? ওই শিল্পীকে, নাকি তার বাদ্যযন্ত্রকে? ধরো, আমি আমার নিজের গানের মিউজিক হিসেবে বাঁশিতে একটা সুর তুললাম, যেটা চৌরাসিয়া জির একটি বিখ্যাত সুর থেকে কাট-টু-কাট কপি করা। এর জন্য তুমি কাকে দোষারোপ করবে, আমাকে নাকি আমার বাঁশিটাকে?...আমার গানের সুর নকল কেন, এই প্রশ্ন বরং ওই গানটার সুরকারকে করো, আমার কণ্ঠকে নয়। আমি আমার কণ্ঠকে বাঁশি, বেহালা বা গিটারের মতো বাজাতে দিই। কেউ আমার কণ্ঠযন্ত্র ব্যবহার করে যদি মৌলিক সুর বের করতে পারেন, সেটা যেমন তাঁর কৃতিত্ব, কেউ নকল সুর বের করলেও সেটা তাঁরই ব্যর্থতা। আমি কিন্তু শিল্পী নই, আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। কণ্ঠ হলো আমার হাতিয়ার। শ্রমিকের যেমন হাতিয়ার থাকে, তেমনই। আমি শিল্প সৃষ্টি করতে আসিনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এসেছি গান গাইতে।’
ঠিক তাই। অ্যান্ড্রু কিশোর একজন স্বঘোষিত গায়ক, শিল্পী নন। তিনি নিজেই অনেকবার অনেক মাধ্যমে অকপটে বলেছেন, ‘আমি পেশাদার গায়ক হিসেবে সুরের বিপরীতে শব্দের স্ক্যানিং মেপে গান গাই, গীতিকার সুরকারের চাহিদামতো মেলোডি বা অন্য যেমন যা ফিলিংস প্রয়োজন, তা দেওয়ার চেষ্টা করি। গানের কথা ও সুর নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি তো আধুনিক গান গাই না যে, গানটা শাশ্বত বাংলা গান হয়ে যেহেতু থেকে যাবে, তাই এর মৌলিকত্ব, এর শিল্প-সৌন্দর্য ইত্যাদি নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে। প্লেব্যাক সং হচ্ছে একটা যৌগিক শিল্প, মৌলিক কিছু নয়। একটা সিনেমার বিশেষ একটা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওয়া গান। ওই পরিস্থিতির সাথে গানটাকে যত দূর সম্ভব খাপ খাওয়ানো, ওই পরিস্থিতির অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা—এটাই একজন গায়কের কাজ। পরিস্থিতি শেষ, গানের প্রয়োজনও শেষ। আমার কণ্ঠ আপনি শুনছেন, কিন্তু গানটা গাইতে দেখছেন অন্য কাউকে। সেই অন্য কেউ-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কণ্ঠ আমি কতটা হতে পারলাম, তার ওপর আমার পরিবেশনার সাফল্য নির্ভর করে, আর কিছু না। অমর গান সৃষ্টি করা আমার কাজ নয়। আমি শিল্প সৃষ্টিতে আসিনি, আমি গান গাইতে এসেছি। আমি শিল্পী নই, আমি গায়ক।’
আর তাঁর সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য, তা হলো তাঁর কণ্ঠ। আপনি মোহাম্মদ রফি বা কিশোর কুমারের মতো অবিকল কণ্ঠ অনেকের মধ্যে পাবেন। কিন্তু অ্যান্ড্রু কিশোর নিজেই একটা টাইপ। তাঁর কণ্ঠটাই এমন, যা তাঁর আগে আর কারও মধ্যে পাওয়া যায়নি, তাঁর পরেও না। হয়তো চেষ্টায় অনেকে তাঁর মতো করে গাইতে পারবে, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত খোলা গলার, দরাজ গলার, ঝলমলে গলার, গমগমে গলার গায়ক এমন আর আসবেন কি না সন্দেহ। এমন একটা কণ্ঠ, যে কণ্ঠে আনন্দ, বিষাদ, উল্লাস, হতাশা, প্রেম, বিরহ, বিপ্লব, দেশাত্মবোধ, গণচেতনা, হাস্যরস, শিশুতোষ, দুঃখবোধ...সব রকমের গান সুন্দরভাবে মানিয়ে যায়। অ্যান্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র ভার্সাটাইল সিঙ্গার, যিনি সব ধারার গান, সব ধরনের অনুভূতির গান সমান দক্ষতায় গেয়েছেন এবং জনপ্রিয় করেছেন।
দারুণ আমুদে, ফুর্তিবাজ স্বভাবের এই ব্যক্তি সুরসিকও ছিলেন। দরাজ গলার শিল্পী কথা বলতেন বিনয়ী মৃদু কণ্ঠে। ঘনিষ্ঠ মহলে রসিকতা করতেন প্রাণ খুলে, হাসতেন ঘর কাঁপিয়ে, অন্যদেরও হাসাতেন। একদিনের ঘটনা। অধুনালুপ্ত আর্ট অব নয়েজ স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে আড্ডা হচ্ছে। উপস্থিত আছেন আহমেদ ইউসুফ সাবের, অ্যান্ড্রু কিশোর, ফোয়াদ নাসের বাবুসহ সংগীতাঙ্গনের আরও কয়েকজন পরিচিত মুখ। কথা প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু কিশোরের কাছে একজন জানতে চাইলেন,
-আচ্ছা, দাদা, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্লে-ব্যাক করার রেকর্ড কার?
-সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে জানালেন, সংখ্যাটা তাঁর বিচারে বারো হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
-আচ্ছা, রুনা লায়লা গেয়েছেন কতগুলো?
-তা-ও দশ হাজারের কম না।
এবার জানতে চাওয়া হলো,
-দাদা, আপনার গাওয়া গানের সংখ্যা কত?
তিনি একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন,
-ছয়-সাত হাজার হবে হয়তো।
-কী বলেন! ওনারা দুজন নারী কণ্ঠ মিলে এতগুলো করে গাইলেন, আর পুরুষ কণ্ঠ হিসেবে আপনি তো প্রায় একচেটিয়া! তারপরও আপনার গানই কম?
-এইটার দুইটা কারণ। এক. আমি সাবিনা আপা আর রুনা আপার অনেক পরে শুরু করেছি।
-আর দুই?
-আরে, এইটা তো খুবই সহজ হিসাব। আমাদের সিনেমায় নায়কের মুখে একটা গান থাকলে নায়িকার মুখে থাকে পাঁচটা। নায়িকা প্রেমে পড়লে গান, প্রেম ছুটলেও গান। শহরের কাহিনিতে ছাদে উঠে গান, গ্রামে হলে গাছে উঠে গান। বাপ-মা মরলে গান, বাচ্চা জন্মালে গান। হাসতে হাসতে গান, কাঁদতে কাঁদতে গান!...আর এদিকে, নায়ক? বেকায়দায় পড়ে আটার বস্তা কোলে-পিঠে নিয়ে বড়জোর দু-একটা গান গাইতে গিয়েই তো দম ফেল! তা ছাড়া ভিলেনের দাবড়ানিতে এমন দৌড়ের উপরে থাকতে হয়!...ঢিসুম ঢিসুম করবে, নাকি গান গাইবে?
ছয়-সাত হাজারের যে সংখ্যাটা তিনি বলেছিলেন, সেটা অনেক কমিয়ে বলা। শেষ পর্যন্ত তাঁর গাওয়া গানের সংখ্যা পনেরো হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি ভক্তদের সামনে বিনয় করে সংখ্যাটা কমিয়ে বলতে পছন্দ করতেন। স্বল্পতম সময়ে তিনি গান গাইতে পারতেন। বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ে নতুন গান গলায় তুলতে পারার রেকর্ড পুরুষদের মধ্যে অ্যান্ড্রু কিশোর এবং নারীদের মধ্যে মমতাজের। আনকোরা নতুন সুর মাত্র একবার শুনেই গলায় তুলে নেওয়ার দক্ষতায় এঁরা অনন্য। এই প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু কিশোর একটি দারুণ কথা বলেছিলেন। তিনি সুর বোঝার আগেই সুরকারকে বোঝার চেষ্টা করতেন। মজা করে তাঁর মাতৃভাষায় বলেছিলেন, ‘আলম ভাই বুলো, সাদী ভাই বা আলাউদ্দীন ভাই, বুলবুল ভাই...কে কুন দিক দিয়ে সুর লিয়ে যাবে? উনাদের সব ওলিগলি প্যাঁশে লিয়্যাছি। একটা কর্ড শুনলেই গোটা গান গাওয়া হয়ে যায়!’
একই দিনে ২৬টি গান গেয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছেন কুমার শানু। সেই কথা বলতেই তিনি হেসেছিলেন। হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, ওইভাবে তো রেকর্ড রাখা হয়নি কখনো। কিন্তু তুমি শুধু শ্রুতি স্টুডিওর পুরোনো রেজিস্টার খুঁজে দেখো, লাগাতার দিনের পর দিন আমি বোথ শিফটে কতগুলো করে গান গেয়ে গেছি, তার হিসাব ওখানে থাকার কথা। ওরকম দিনে তিরিশটা গান আমি মাসে তিরিশ দিনও গেয়েছি। একটা সময় কারেন্ট চলে গেলে সেটা হতো আমার ভোকাল ব্রেক, তার আগে কেউ থামতে দিত না। একটা গান শেষ করে বাইরে এসে সিগারেট ধরাতাম, সেই সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই নতুন গানের মিউজিক ট্র্যাকের স্পুল চরানো হয়ে যেত।...দিনে কটা গান গাইলাম, সেই হিসাব দিয়েও যে রেকর্ড বইয়ে নাম তোলা যায়, এই ব্যাপারটাই মাথায় ছিল না কোনো দিন।
এই অসামান্য কণ্ঠযোদ্ধা দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন ২০২০ সালের ৬ জুলাই। তাঁর মাতৃভূমি রাজশাহীতে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর ভূমিকা ছিল গায়কের। কিন্তু তাঁর ইমেজ ছিল নায়কের মতো। এই মিডিয়া বিস্ফোরণের কালে এসে যা-ই হোক, তাঁকে গণমাধ্যমে অল্পবিস্তর পাওয়া যেত। কিন্তু গত শতকের শেষ দুটো দশকে, যখন তিনি দাপটের সঙ্গে শাসন করছেন বাংলাদেশের সিনেমাকেন্দ্রিক সংগীতজগৎ, তখনো তিনি যেন এক রহস্য-মানব! রেডিও খুললেই একচেটিয়াভাবে তাঁর কণ্ঠ বাজে, সিনেমা তো তাঁর গান ছাড়া চলেই না, বাংলাদেশের পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি অদ্বিতীয়। অথচ তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
ইন্টারনেট-পূর্ব সেই যুগে বিশেষত চলচ্চিত্র তারকাদের সম্পর্কে জানার মাধ্যম বলতে পত্রপত্রিকার বিনোদন পাতাগুলোই ভরসা ছিল। সেসব পাতায় তাঁকে নিয়ে বিশেষ কিছু লেখা হয় না। তিনি টিভিতে আসেন না বললেই চলে, মাঝেমধ্যে কণ্ঠ শোনা গেলেও পর্দায় তাঁর উপস্থিতি নেই। স্টেজ শো করেন বলেও তেমন শোনা যায় না। কেবল সিনেমার গান গেয়েই তিনি খ্যাতির শীর্ষে! শুধু কণ্ঠের জোরেই তিনি নায়ক। বলা চলে মহানায়ক! ব্যাপারটি এ রকম যে ১৯৯৪ সালে সালমান শাহ ও মৌসুমীর প্রথম সিনেমা এবং ভারত থেকে কপিরাইট এনে পুনর্নির্মিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি যখন সুপার-ডুপার হিট হলো, তখন বিনোদন পাতায় লেখা হয়েছিল, গত এক দশকে এই প্রথম কোনো ছবি হিট করল অ্যান্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে একটিও গান ছাড়াই!
অ্যান্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। জন্ম ৪ নভেম্বর, ১৯৫৫; রাজশাহী শহরে। মৃত্যু ৬ জুলাই, ২০২০, ঢাকায়। মাত্র ৬৫ বছর বয়সের জীবনে তিনি অ্যান্ড্রু কিশোর নামে ছিলেন খ্যাতিমান। বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র বাড়ৈ ও মা মিনু বাড়ৈ। মিনু বাড়ৈ গান করতেন, ভক্ত ছিলেন কিশোর কুমারের। সে জন্য ছেলেরও নাম রেখেছিলেন কিশোর কুমার। চাইতেন, তাঁর ছেলেও বড় হয়ে কিশোর কুমারের মতোই গান গেয়ে নাম করুক। মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল বৈকি। খ্যাতিতে ভারতের কিশোর কুমারের চেয়ে বাংলাদেশের অ্যান্ড্রু কিশোর খুব যে পিছিয়ে নেই, তা নিয়ে দ্বিমত সম্ভবত কেউ করবেন না।
রাজশাহীর প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে ছয় বছর বয়সে অ্যান্ড্রু কিশোরের আনুষ্ঠানিক সংগীতশিক্ষায় হাতেখড়ি এবং সাত বছর বয়সে তালিকাভুক্তি রাজশাহী বেতারে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে গান করেছেন রাজপথে। গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকগীতি—সব ধরনের গান করেছেন। তারপর পাড়ি জমিয়েছেন প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রিতে। মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তাই কিশোর কুমারের মতো প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রিতে পা তো রাখতেই হতো। সে পর্বে পা রাখার আগে শেষ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। কিছুদিন চাকরিও করেছেন ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু যেদিন থেকে গানকেই জীবিকা হিসেবে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, চাকরি ছেড়ে দিলেন। এ প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম কোনো গায়ক, যিনি গান গাওয়াকেই একমাত্র জীবিকা হিসেবে বেছে নেওয়ার সাহস করেছিলেন। বলেছিলেন, অন্য কোনো পেশায় জড়িত থেকে, অর্থাৎ চাকরি বা ব্যবসা করে তার ফাঁকে ফাঁকে গান চালিয়ে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল, গানের প্রতি তাহলে নিবেদন সম্পূর্ণ হবে না। তখনকার দিনে রাজশাহী থেকে ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা খুব সুগম ছিল না। ট্রেন যোগাযোগ ভালো ছিল না এখনকার মতো। বাসে যাতায়াতও সহজ ছিল না। রাস্তা ছিল ভাঙাচোরা, অনেক সময় লেগে যেত যাতায়াতে, শরীরও কাহিল হয়ে পড়ত। এভাবে সারা দিন বা সারা রাত সফর করে ঢাকায় এসে গান গেয়ে আবার ফিরে গিয়ে অফিস করা, বিষয়টা খুব সুবিধাজনক ছিল না। তা ছাড়া যাত্রার ধকলে কাহিল শরীর নিয়ে ভালোমতো গানও গাওয়া যায় না। এসব কারণে তিনি ঢাকাতেই স্থায়ী হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঢাকায় কোনো চাকরির চেষ্টাটুকুও না করে পুরো সময় গানের জন্য বরাদ্দ করেন।
‘আমাকে প্রস্তুত থাকতে হতো, কখন কে ডাকবেন, তখনই তাঁর কাছে পৌঁছে যেতে হবে। এখনকার মতো তো তখনকার ব্যবস্থা ছিল না যে স্টুডিওতে গেলাম আর গান গেয়ে চলে এলাম। তখন একেকটা গানের পেছনে দু-তিন দিন থেকে সপ্তাহ পর্যন্তও সময় দিতে হতো। গান যখন লেখা হচ্ছে, তখনই শিল্পীকে ডেকে পাঠাতেন সংগীত পরিচালক। শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, ছবির কাহিনিকার, পরিচালক—সবাই উপস্থিত থাকতেন। এক লাইন, দুই লাইন করে লেখা হতো, তাতে সুর দেওয়া হতো, সবাই শুনতেন। ভালো লাগলে লেখা এগোত, না লাগলে পুরোটাই বাতিল করে আবার নতুন করে শুরু হতো। গায়ক-গায়িকাদের বসে থাকতে হতো পুরোটা সময়। সমস্তটা মিলে একটা প্রক্রিয়া ছিল সেটা।...চাকরি করে এর অংশ আমি হতে পারতাম না।’ ...এই ছিল অ্যান্ড্রু কিশোরের মনোভাব।
১৯৭৭ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায়। সে গানের শিরোনাম ছিল ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’। তবে প্রথম সাফল্য আসে আরও দুই বছর পর, ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রতিজ্ঞা’ ছবিতে, ‘এক চোর যায় চলে’ গানের মাধ্যমে। তারপর থেকে প্রায় চার দশক শাসন করেছেন বাংলাদেশের প্লেব্যাক ইন্ডাস্ট্রি। গান করেছেন পনেরো হাজারের বেশি। কিন্তু তিনি কখনো কোনো অপেশাদারি পরিবেশে গান করেননি। কোনো ঘরোয়া বা ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে নয়, বিয়েবাড়ির কনসার্ট জাতীয় অনুষ্ঠানে তো একদমই নয়। গান করেননি নিজ কন্যার বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজনেও, যদিও তাঁর আমন্ত্রণে সেই অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে গিয়ে গান করেছিলেন দেশবরেণ্য অনেক শিল্পী।
অপেশাদারি পরিবেশে গান না গাওয়া বা নিজের নিয়ম ভেঙে কারও অনুরোধে গান না গাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বিটিভির ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের ঈদ স্পেশাল পর্বে প্রথম কথা বলেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হানিফ সংকেতের সঙ্গে। ১৯৯৪ বা ’৯৫ সালের সেই অনুষ্ঠানে গান শুরুর আগে হানিফ সংকেত তাঁর সম্পর্কে দুটো অজানা তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। তার প্রথমটি ছিল, তিনি কখনো কোনো ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে গান করেন না। হানিফ সংকেত তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন যদি হয় যে, আপনি আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আমন্ত্রণে তাঁর ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে গিয়েছেন এবং তিনি এমনভাবে অনুরোধ করেছেন যে আপনার গান না গেয়ে উপায় নেই...তখন কী করবেন?’
অ্যান্ড্রু কিশোর একদমই না ভেবে বললেন, ‘সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো দূরের কথা, আমার যেকোনো বন্ধুই জানেন, আমি প্রাইভেট পার্টিতে গান গাই না, তাই তাঁরা এই অনুরোধ করবেন না কখনো।’
হানিফ সংকেত নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘তবু যদি করেই বসেন অনুরোধ?’
কিশোর নির্বিকারভাবে বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে বন্ধুত্বই আর থাকবে না!’
আর চমকে দেওয়ার মতো দ্বিতীয় তথ্যটি ছিল, তখন পর্যন্ত প্লেব্যাক, নন-প্লেব্যাক মিলিয়ে তাঁর একটিও অডিও অ্যালবাম বাজারে ছিল না!
গায়ক হিসেবে অ্যান্ড্রু কিশোরের পেশাদারত্বের উদাহরণ হিসেবে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্ভবত ১৯৮৯ সালের কথা। বিটিভি সগৌরবে উদ্যাপন করে রজতজয়ন্তী। সে উপলক্ষে সাত দিন অথবা দশ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন তারা উপহার দেয় দর্শকদের, যার মধ্যে আকর্ষণীয় ছিল ২৫ ডিসেম্বর বিটিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনের লাইভ কনসার্ট। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি বিটিভির অডিটরিয়ামে বসে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন। সারা দেশের সবার দৃষ্টি স্থির টিভির পর্দায়, সবাই বিপুল উৎসাহে অনুষ্ঠান দেখছে আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, এই বুঝি অ্যান্ড্রু কিশোর এলেন মঞ্চে! একে একে আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আবদুল হাদী, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, খুরশীদ আলম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই, আজম খান, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা...আরও কতজন গেয়ে ফেললেন, কিন্তু অ্যান্ড্রু কিশোর এলেন না! ব্যাপার কী? রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান, যেখানে বসে আছেন খোদ রাষ্ট্রপ্রধান, সেই অনুষ্ঠানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গায়ক নেই কেন? অনেক পরে জানা গিয়েছিল, তিনি নিজেই কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েও তিনি গান করতে রাজি হননি। কারণ, বিটিভি তাঁকে কোনো সম্মানী দেবে না বলে জানিয়েছিল। তিনি আপত্তি করায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘গ্রেড সি আর্টিস্ট’ ক্যাটাগরির সম্মানী দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বিটিভির নিয়মিত শিল্পী তো ননই, অনিয়মিতও নন। তাই নিয়ম অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ এর বেশি দিতে অপারগ। তিনি সেই প্রস্তাবে অপমানিত বোধ করায় অনুষ্ঠানে তো যানইনি, ঢাকাতেই থাকেননি সেদিন। যাতে শেষ মুহূর্তে সর্বোচ্চ মহল থেকে ডাক পড়ে আর তিনি তা অগ্রাহ্য করতে না পারেন, তাই পরিবারের সঙ্গে ক্রিসমাস উদ্যাপনের অজুহাতে চলে যান রাজশাহীতে।
অ্যান্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার গায়ক, যিনি পেশাদারত্বের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটির কথাতেও নয়। এটা হলো তাঁর প্রফেশনালিজমের একটা ছোট্ট উদাহরণ। অথচ, এই মাত্রার চরম পেশাদার ব্যক্তিটিও নিজের নীতির সঙ্গে আপস করেছেন বিশেষ ক্ষেত্রে। তার মধ্যে একটি হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাজশাহীতে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে তিনি কখনো সম্মানীর বিনিময়ে গান করেননি। বরং তাঁর সঙ্গে আসা যন্ত্রশিল্পীদের সম্মানী ক্ষেত্রবিশেষে নিজেই পরিশোধ করে দিয়েছেন। আর, অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে গান করার উদাহরণ জীবনে একবারই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। একজন বিশেষ ব্যক্তির জন্য।
সেই বিশেষ ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হক। এই সব্যসাচী সাহিত্যিকের লেখা গান গেয়েই তিনি জীবনে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন, যে পুরস্কারের অনার্স বোর্ডে তাঁর নামটা লেখা হয়েছে রেকর্ড আটবার। যাহোক, সৈয়দ শামসুল হক যখন মৃত্যুশয্যায়, হাসপাতালে শুয়ে আছেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান অ্যান্ড্রু কিশোর। তখন আচমকা তাঁর কণ্ঠে খালি গলায় গান শুনতে চান হক সাহেব। কিশোর এটা জীবনে কখনো করেননি। তিনি কারও অনুরোধেই এভাবে হঠাৎ করে গান ধরেননি। এটা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী হক সাহেবের সামনে তিনি নীতির গোঁ ধরে বসে থাকতে পারলেন না। হাসপাতালের কেবিনে বসে গেয়ে শোনালেন সৈয়দ হকেরই লেখা অমর গান, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস।’ এখানেই শেষ নয়। সৈয়দ শামসুল হক ফিসফিস করে বললেন, ‘এখানে আমার পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে। স্ত্রী আছেন, আমার শ্যালিকারা আছেন। তাঁরা তোমার একটা গানের খুবই ভক্ত।’ কিশোর জানতে চাইলেন, ‘কোন গানটা?’ সৈয়দ শামসুল হক বললেন, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না, তোমার তুলনা’। কিশোর সেটাও গেয়ে শোনালেন খালি গলায়।
এর পরে আর একবারই তিনি অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে গান গেয়েছিলেন। ক্যানসারের চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসার আগে প্রবাসী ভক্তরা যখন বিদায় সংবর্ধনা দিলেন তাঁকে, সেই অনুষ্ঠানে হাসিমুখে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ গাইতে গাইতে ভক্তদের কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।
অ্যান্ড্রু কিশোর নিজেকে কখনো শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতেন না, বিনয় করে বলতেন, ‘আমি শিল্পী হতে পারিনি, বড়জোর একজন কণ্ঠশ্রমিক। শিল্পী অনেক বড় বিষয়। অনেক সাধনা লাগে শিল্পী হতে গেলে, শিল্পকে ধারণ করতে হয় নিজের ভেতরে। আমি সেটা পারিনি, সে চেষ্টাই করিনি। আমি বরাবর নিজের কণ্ঠকে শ্রমিকের মতো খাটিয়েছি গানের পেছনে। আমি কণ্ঠশ্রমিক।’ আর তাই, একদম শুরু থেকেই ‘গায়ক’ পেশাটাকে তিনি চ্যালেঞ্জের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং এক শ ভাগ পেশাদার শিল্পীর মতো কাজ করে গিয়েছেন নিরন্তর। তাঁর সময়ের সুরকারদের সবাই তাঁর জন্য সুর করেছেন, সব গীতিকারের কথায় গান গেয়েছেন। কারও সঙ্গে বিরোধে যাননি, কারও সঙ্গে সবিশেষ অন্তরঙ্গ জুটিও গড়েননি। সবাইকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, সমানভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশের কোনো সংগীত পরিচালক দাবি করতে পারবেন না যে কিশোরের জন্য সবচেয়ে সেরা গানগুলো তিনিই কম্পোজ করেছেন। আবার কেউ এমনটাও বলতে পারবেন না যে কিশোরের সঙ্গে অমুক সুরকারের গানগুলো ঠিক জমেনি। বরং উল্টোটাই দেখা গেছে। কোনো সুরকার বা সংগীত পরিচালক যদি দশজন শিল্পীকে দিয়ে গান করান আর তার মধ্যে একটিমাত্র গান হিট করে থাকে, তো সেই গানটি অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া। জুটি না বাঁধা প্রসঙ্গে কিশোর তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিবেশে আড্ডার অবকাশে একবার বলেছিলেন, ‘দেখ, কারও সাথে জুটি গড়া মানে, বাকিদের কম গুরুত্ব দেয়া। আমি তো সেটা করতে পারি না। আমি একজন পেশাদার গায়ক, আমাকে এক শ ভাগ নিরপেক্ষতা রক্ষা করে কাজ করে যেতে হবে। সংগীত পরিচালক, তিনি হতে পারেন পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিংবা মাত্রই বিশ বছর বয়সী, যখন আমি তাঁর গান করছি, তখন তিনি আমার গুরু। আর গুরুর মধ্যে ভেদাভেদ করা যায় না।...এই একই কথা সহশিল্পীর ক্ষেত্রেও। সংগীত পরিচালক ডুয়েট গানের জন্য আমার সঙ্গে যাকেই সিলেক্ট করবেন, তিনি আমার পার্টনার। বিশেষ কাউকে বেশি পছন্দ করি বলে তার সাথেই বেশি গাইব, বাকিদের সাথে কম, এটা ভালো চর্চা নয়। আমার পছন্দ-অপছন্দ তো ব্যাপারই না এখানে, ব্যাপার হলো কোনটা পরিচালকের পছন্দ।’ আর তাই সাবিনা ইয়াসমীন বা রুনা লায়লাদের মতো কিংবদন্তিদের সহ-কণ্ঠকেও সাবলীল গাইতে শোনা যায় সদ্য-কৈশোর পেরোনো লুইপার সঙ্গেও। সারা জীবনই তিনি এই ভালো চর্চাটা করে গেছেন। কারণ, তিনি পেশাদারত্বের ওপরে আর কোনো কিছুকে স্থান দেননি।
বিশ্বজুড়েই শোবিজ জগতে একটা চর্চা প্রচলিত যে, কোনো শিল্পীর জনপ্রিয়তা যত বাড়তে থাকে, তাঁর সম্মানী বা পারিশ্রমিকও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। অ্যান্ড্রু কিশোর একদম শুরু থেকেই হিটের পর হিট গান উপহার দিয়েছেন। একটা সময়ে এ দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে এমন কথা প্রচলিত ছিল, যে ছবিতে অ্যান্ড্রু কিশোরের গান নেই, সেই ছবি হিট করবে না, সেই ছবি দেখে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। এমন হিট গানের কারিগর কিশোরের সম্মানী অন্য সবার তুলনায় সব যুগেই খানিকটা বেশি ছিল বটে, তবে সেটা বরাবরই ছিল যেকোনো সংগীত পরিচালক বা প্রযোজকের সাধ্যের সীমানার ভেতরেই। কোনো গান যতই হিট করুক না কেন, তিনি তাঁর সম্মানীতে কখনো অস্বাভাবিক উল্লম্ফন ঘটাননি। ফলে যে-কেউ তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সামর্থ্য রাখতেন, সাহসও রাখতেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অ্যান্ড্রু কিশোর ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি প্লেব্যাকে কলকাতা ও মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিও মাতিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে থেকে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। আরডি বর্মনের মতো সুরকারের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও নয়। আবার মুম্বাই মাতানোর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার বাজারে নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাননি, যেমনটা করাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল।
নিজের কর্মস্থলকে তিনি শ্রদ্ধা করে গেছেন আমৃত্যু। বরাবরই তিনি রেকর্ডিংয়ের জন্য শিফট শুরুর যথেষ্ট আগে হাজির হতেন স্টুডিওতে। দীর্ঘ সময় হারমোনিয়ামে গলা সেধে তারপরই সিঙ্গার্স বুথে ঢুকতেন গান গাইতে। তাই কোনো রেকর্ডিংয়েই তাঁর কণ্ঠের অবনতির প্রমাণ কখনো পাওয়া যেত না। কিশোর এই জগৎটাকে ভালোবাসতেন, তাঁর একমাত্র ঠিকানা হিসেবে মানতেন সব সময়। শেষ বেলায়, ক্যানসারের আর চিকিৎসা নেই নিশ্চিত হওয়ার পর তাই ফিরে গেছেন নিজের শহরেই।
অ্যান্ড্রু কিশোর বিশেষ কোনো রাজনৈতিক আদর্শে চালিত হননি। চূড়ান্ত পেশাদার গায়কের মতো সবার তৈরি গান গেয়ে গেছেন সবার জন্য। নিজের কণ্ঠকে তিনি যন্ত্রের মতো ব্যবহার করতে দিয়েছেন, সম্ভবত সবচেয়ে সুরেলা, সবচেয়ে দরাজ আওয়াজের অধিকারী যন্ত্র। আপনি আপনার স্বীয় মুনশিয়ানায় কীভাবে তা বাজিয়ে নেবেন, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করে।
তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি নকল সুরের গান করেন কেন? আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হিট গানটাই তো একসময়ের জনপ্রিয় হিন্দি গানের নকল। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তুমি যখন কোনো যন্ত্রশিল্পীকে কোনো সুর বাজাতে শোনো, যেটা নাকি অন্য কারও সুর থেকে নকল করা, এই নকলের জন্য তুমি কাকে দোষ দাও? ওই শিল্পীকে, নাকি তার বাদ্যযন্ত্রকে? ধরো, আমি আমার নিজের গানের মিউজিক হিসেবে বাঁশিতে একটা সুর তুললাম, যেটা চৌরাসিয়া জির একটি বিখ্যাত সুর থেকে কাট-টু-কাট কপি করা। এর জন্য তুমি কাকে দোষারোপ করবে, আমাকে নাকি আমার বাঁশিটাকে?...আমার গানের সুর নকল কেন, এই প্রশ্ন বরং ওই গানটার সুরকারকে করো, আমার কণ্ঠকে নয়। আমি আমার কণ্ঠকে বাঁশি, বেহালা বা গিটারের মতো বাজাতে দিই। কেউ আমার কণ্ঠযন্ত্র ব্যবহার করে যদি মৌলিক সুর বের করতে পারেন, সেটা যেমন তাঁর কৃতিত্ব, কেউ নকল সুর বের করলেও সেটা তাঁরই ব্যর্থতা। আমি কিন্তু শিল্পী নই, আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। কণ্ঠ হলো আমার হাতিয়ার। শ্রমিকের যেমন হাতিয়ার থাকে, তেমনই। আমি শিল্প সৃষ্টি করতে আসিনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এসেছি গান গাইতে।’
ঠিক তাই। অ্যান্ড্রু কিশোর একজন স্বঘোষিত গায়ক, শিল্পী নন। তিনি নিজেই অনেকবার অনেক মাধ্যমে অকপটে বলেছেন, ‘আমি পেশাদার গায়ক হিসেবে সুরের বিপরীতে শব্দের স্ক্যানিং মেপে গান গাই, গীতিকার সুরকারের চাহিদামতো মেলোডি বা অন্য যেমন যা ফিলিংস প্রয়োজন, তা দেওয়ার চেষ্টা করি। গানের কথা ও সুর নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি তো আধুনিক গান গাই না যে, গানটা শাশ্বত বাংলা গান হয়ে যেহেতু থেকে যাবে, তাই এর মৌলিকত্ব, এর শিল্প-সৌন্দর্য ইত্যাদি নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে। প্লেব্যাক সং হচ্ছে একটা যৌগিক শিল্প, মৌলিক কিছু নয়। একটা সিনেমার বিশেষ একটা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওয়া গান। ওই পরিস্থিতির সাথে গানটাকে যত দূর সম্ভব খাপ খাওয়ানো, ওই পরিস্থিতির অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা—এটাই একজন গায়কের কাজ। পরিস্থিতি শেষ, গানের প্রয়োজনও শেষ। আমার কণ্ঠ আপনি শুনছেন, কিন্তু গানটা গাইতে দেখছেন অন্য কাউকে। সেই অন্য কেউ-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কণ্ঠ আমি কতটা হতে পারলাম, তার ওপর আমার পরিবেশনার সাফল্য নির্ভর করে, আর কিছু না। অমর গান সৃষ্টি করা আমার কাজ নয়। আমি শিল্প সৃষ্টিতে আসিনি, আমি গান গাইতে এসেছি। আমি শিল্পী নই, আমি গায়ক।’
আর তাঁর সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য, তা হলো তাঁর কণ্ঠ। আপনি মোহাম্মদ রফি বা কিশোর কুমারের মতো অবিকল কণ্ঠ অনেকের মধ্যে পাবেন। কিন্তু অ্যান্ড্রু কিশোর নিজেই একটা টাইপ। তাঁর কণ্ঠটাই এমন, যা তাঁর আগে আর কারও মধ্যে পাওয়া যায়নি, তাঁর পরেও না। হয়তো চেষ্টায় অনেকে তাঁর মতো করে গাইতে পারবে, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত খোলা গলার, দরাজ গলার, ঝলমলে গলার, গমগমে গলার গায়ক এমন আর আসবেন কি না সন্দেহ। এমন একটা কণ্ঠ, যে কণ্ঠে আনন্দ, বিষাদ, উল্লাস, হতাশা, প্রেম, বিরহ, বিপ্লব, দেশাত্মবোধ, গণচেতনা, হাস্যরস, শিশুতোষ, দুঃখবোধ...সব রকমের গান সুন্দরভাবে মানিয়ে যায়। অ্যান্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র ভার্সাটাইল সিঙ্গার, যিনি সব ধারার গান, সব ধরনের অনুভূতির গান সমান দক্ষতায় গেয়েছেন এবং জনপ্রিয় করেছেন।
দারুণ আমুদে, ফুর্তিবাজ স্বভাবের এই ব্যক্তি সুরসিকও ছিলেন। দরাজ গলার শিল্পী কথা বলতেন বিনয়ী মৃদু কণ্ঠে। ঘনিষ্ঠ মহলে রসিকতা করতেন প্রাণ খুলে, হাসতেন ঘর কাঁপিয়ে, অন্যদেরও হাসাতেন। একদিনের ঘটনা। অধুনালুপ্ত আর্ট অব নয়েজ স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে আড্ডা হচ্ছে। উপস্থিত আছেন আহমেদ ইউসুফ সাবের, অ্যান্ড্রু কিশোর, ফোয়াদ নাসের বাবুসহ সংগীতাঙ্গনের আরও কয়েকজন পরিচিত মুখ। কথা প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু কিশোরের কাছে একজন জানতে চাইলেন,
-আচ্ছা, দাদা, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্লে-ব্যাক করার রেকর্ড কার?
-সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে জানালেন, সংখ্যাটা তাঁর বিচারে বারো হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
-আচ্ছা, রুনা লায়লা গেয়েছেন কতগুলো?
-তা-ও দশ হাজারের কম না।
এবার জানতে চাওয়া হলো,
-দাদা, আপনার গাওয়া গানের সংখ্যা কত?
তিনি একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন,
-ছয়-সাত হাজার হবে হয়তো।
-কী বলেন! ওনারা দুজন নারী কণ্ঠ মিলে এতগুলো করে গাইলেন, আর পুরুষ কণ্ঠ হিসেবে আপনি তো প্রায় একচেটিয়া! তারপরও আপনার গানই কম?
-এইটার দুইটা কারণ। এক. আমি সাবিনা আপা আর রুনা আপার অনেক পরে শুরু করেছি।
-আর দুই?
-আরে, এইটা তো খুবই সহজ হিসাব। আমাদের সিনেমায় নায়কের মুখে একটা গান থাকলে নায়িকার মুখে থাকে পাঁচটা। নায়িকা প্রেমে পড়লে গান, প্রেম ছুটলেও গান। শহরের কাহিনিতে ছাদে উঠে গান, গ্রামে হলে গাছে উঠে গান। বাপ-মা মরলে গান, বাচ্চা জন্মালে গান। হাসতে হাসতে গান, কাঁদতে কাঁদতে গান!...আর এদিকে, নায়ক? বেকায়দায় পড়ে আটার বস্তা কোলে-পিঠে নিয়ে বড়জোর দু-একটা গান গাইতে গিয়েই তো দম ফেল! তা ছাড়া ভিলেনের দাবড়ানিতে এমন দৌড়ের উপরে থাকতে হয়!...ঢিসুম ঢিসুম করবে, নাকি গান গাইবে?
ছয়-সাত হাজারের যে সংখ্যাটা তিনি বলেছিলেন, সেটা অনেক কমিয়ে বলা। শেষ পর্যন্ত তাঁর গাওয়া গানের সংখ্যা পনেরো হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি ভক্তদের সামনে বিনয় করে সংখ্যাটা কমিয়ে বলতে পছন্দ করতেন। স্বল্পতম সময়ে তিনি গান গাইতে পারতেন। বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ে নতুন গান গলায় তুলতে পারার রেকর্ড পুরুষদের মধ্যে অ্যান্ড্রু কিশোর এবং নারীদের মধ্যে মমতাজের। আনকোরা নতুন সুর মাত্র একবার শুনেই গলায় তুলে নেওয়ার দক্ষতায় এঁরা অনন্য। এই প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু কিশোর একটি দারুণ কথা বলেছিলেন। তিনি সুর বোঝার আগেই সুরকারকে বোঝার চেষ্টা করতেন। মজা করে তাঁর মাতৃভাষায় বলেছিলেন, ‘আলম ভাই বুলো, সাদী ভাই বা আলাউদ্দীন ভাই, বুলবুল ভাই...কে কুন দিক দিয়ে সুর লিয়ে যাবে? উনাদের সব ওলিগলি প্যাঁশে লিয়্যাছি। একটা কর্ড শুনলেই গোটা গান গাওয়া হয়ে যায়!’
একই দিনে ২৬টি গান গেয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছেন কুমার শানু। সেই কথা বলতেই তিনি হেসেছিলেন। হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, ওইভাবে তো রেকর্ড রাখা হয়নি কখনো। কিন্তু তুমি শুধু শ্রুতি স্টুডিওর পুরোনো রেজিস্টার খুঁজে দেখো, লাগাতার দিনের পর দিন আমি বোথ শিফটে কতগুলো করে গান গেয়ে গেছি, তার হিসাব ওখানে থাকার কথা। ওরকম দিনে তিরিশটা গান আমি মাসে তিরিশ দিনও গেয়েছি। একটা সময় কারেন্ট চলে গেলে সেটা হতো আমার ভোকাল ব্রেক, তার আগে কেউ থামতে দিত না। একটা গান শেষ করে বাইরে এসে সিগারেট ধরাতাম, সেই সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই নতুন গানের মিউজিক ট্র্যাকের স্পুল চরানো হয়ে যেত।...দিনে কটা গান গাইলাম, সেই হিসাব দিয়েও যে রেকর্ড বইয়ে নাম তোলা যায়, এই ব্যাপারটাই মাথায় ছিল না কোনো দিন।
এই অসামান্য কণ্ঠযোদ্ধা দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন ২০২০ সালের ৬ জুলাই। তাঁর মাতৃভূমি রাজশাহীতে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
সারা বছর ঝিমিয়ে থাকলেও ঈদের সময় চাঙা হয়ে ওঠে দেশের সিনেমা হলগুলো। নির্মাতা ও প্রযোজকেরা দুই ঈদ ঘিরে সিনেমা বানাতে চান। রোজার ঈদের এখনো সাড়ে চার মাস বাকি, এরই মধ্যে ঈদের সিনেমা নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জানা গেছে, রোজার ঈদে নতুন সিনেমা নিয়ে আসছেন শাকিব খান, আফরান নিশো ও সিয়াম আহমেদ।
২ ঘণ্টা আগেতরুণ রক মিউজিশিয়ানদের খোঁজে শুরু হচ্ছে ট্যালেন্ট হান্ট রিয়েলিটি শো ‘দ্য কেইজ’। অনলাইন অডিশনের মাধ্যমে ‘দ্য কেইজ’-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। শীর্ষ ১০০ প্রার্থী সরাসরি অডিশনের জন্য নির্বাচিত হবেন।
২ ঘণ্টা আগেপ্রায় আট বছর পর ‘লাল গোলাপ’ অনুষ্ঠান নিয়ে ফিরছেন সাংবাদিক ও উপস্থাপক শফিক রেহমান। এরই মধ্যে দুই পর্বের শুটিংও শেষ করেছেন, যা সম্প্রচার হবে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে।
২ ঘণ্টা আগেপ্রতি সপ্তাহেই নতুন সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের জন্য দর্শকের নজর থাকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাবে নানা দেশের, নানা ভাষার কনটেন্ট। বাছাই করা এমন কিছু কনটেন্টের খবর থাকছে এই প্রতিবেদনে।
২ ঘণ্টা আগে