আশিকুর রিমেল, ঢাকা
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে গত ২৮ জুলাই। ফল প্রকাশের তারিখ ঘোষণার দিন থেকেই পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উত্তেজনা–উদ্বেগ ভর করে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ইদানীংকালে এই উদ্বেগটা মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। আজ থেকে দুই দশক আগেও পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু এখন জিপিএ-৫ না পাওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলে–মেয়ের আত্মহত্যা নানা মাত্রায় সামাজিক অস্থিরতা–অসংগতির ইঙ্গিত দিলেও পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে গড়ে ৮০ শতাংশ নম্বর না পাওয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া সম্ভবত অন্য কিছুরও ইঙ্গিত দেয়, যেটি আমরা উপেক্ষা করে যাচ্ছি।
এ বছর ২৯ হাজার ৭১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এ বছর পাস ও জিপিএ–৫ দুটির হারই কমেছে।
পাসের হার কমেছে নাকি বেড়েছে, জিপিএ-৫ কমেছে নাকি বেড়েছে সেটি আজকের আলোচনার বিষয় নয়। বরং অপ্রিয় হলেও সত্য ৪ লাখ ৪৫০ জন পরীক্ষায় ফেল করেছে।
এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের দিন ঢাকায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমাবেশ দেশের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর মধ্যে মোটা দাগে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ, জিপিএ-৫, পাস-ফেলের হার কেমন, কমল নাকি বাড়ল, কারা এগিয়ে, কোন বোর্ড এগিয়ে গেল, কোন বোর্ড পেছাল নানান দিক থেকে বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমগুলো। এরই মধ্যে ‘জিপিএ-৫ না পাওয়ায় আত্মহত্যা’র অন্তত তিনটি খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত দুজন কিশোরীর আত্মহত্যার প্রসঙ্গেই বলা যাক।
শিক্ষার্থী দুজন হলো—ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খোঁচাবাড়ি গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিষ্টি রায় (১৬) ও নাটোর লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মম (১৬)। দুজনই পরিবারের কাছে বলেছিল, তাদের প্রত্যাশা জিপিএ-৫ পাবে। কিন্তু মিষ্টি রায় পেয়েছে জিপিএ ৪.২৮ ও মম পেয়েছে জিপিএ-৩.৮০।
গণমাধ্যমগুলোতে খুঁজলেই মিলবে—পরীক্ষায় ফেল করায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জিপিএ-৫ না পাওয়া। আমাদের জন্য ‘অশনিসংকেত’ হলো প্রায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা।
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিনে পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যার একটি হিসাব তুলে ধরা যাক—এ বছর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ছয়জন শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে গেছে অন্তত দুজন। ২০১৮ সালে ফল প্রকাশের সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২২ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে ১০ জন মারা যায়। ২০২০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার করে যাদের মধ্যে ১৯ জনই ছিল কিশোরী।
গ্রেডিং বা জিপিএ পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর (২০০১) এসএসসিতে জিপিএ-৫–এর সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৬ জন। সে সময় কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে জিপিএ-৫–এর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়তে শুরু করে। আর গত দুই দশকে এ সংখ্যা বেড়েছে কয়েক শ গুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিষ্টি রায় যে বিদ্যালয়ে পড়ত সেখান থেকে কোনো শিক্ষার্থীই জিপিএ-৫ পায়নি। সেখানে অকৃতকার্য হয়েছে ২০ জন। আর লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অর্থাৎ মম যে বিদ্যালয়ে পড়ত সেখানে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫ জন ও অকৃতকার্য হয়েছে ২৯ জন।
ওই দিনের পরিস্থিতি জানতে মিষ্টি রায়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি সাদ্দাম হোসেন। মিষ্টি রায়ের বাবা প্রেমানন্দ রায় তাঁকে জানিয়েছেন, বান্ধবীরা তার চেয়ে ভালো ফল করেছে। এ নিয়ে সে খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল। শ্রেণিশিক্ষক জানিয়েছেন, ক্লাসে মিষ্টি রায় ছিল প্রথম। ‘আত্মসম্মানে’ আঘাত লাগায় হয়তো সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন ওঠে তাহলে সমাজে বা বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে যেতে অস্বস্তি বা লজ্জাই কি প্রভাব ফেলেছে মিষ্টির ওপর?
মমর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার লালপুর প্রতিনিধি ইমাম হাসান মুক্তি। মমর বাবা মহসিন আলী তাঁকে জানিয়েছেন, ফলাফল নিয়ে মমকে কোনো চাপ বা বকাঝকা করা হয়নি। আত্মীয়স্বজনেরা কল দিয়ে জানতে চাইলে তার মা মন খারাপ করে ফলাফল জানাচ্ছিলেন। মেয়ের ফলাফল নিয়ে মাও বেশ কয়েকবার কেঁদেছেন। এর মধ্যেই মম সবার অলক্ষ্যে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাহলে পরিবারে একটা পরোক্ষ চাপ বা প্রকাশিত অসন্তোষের প্রভাব কি পড়েছিল মমর ওপর?
আমরা ওই বয়সী শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের বিষয়ে জানতে কথা বলেছিলাম সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনারের কাউন্সিলর অধ্যাপক সানজিদা শাহরিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রথমত পরিবার, দ্বিতীয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ পরিসরে সমাজের প্রভাবে কিশোর-কিশোরীরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষার্থীরা বয়ঃসন্ধিতে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। এ সময় বিশেষ করে অভিভাবক, শিক্ষকেরা তাদের পরিস্থিতি অনুধাবন না করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের ওপর প্রতিযোগিতার মানদণ্ড ঠিক করে দেন। পরবর্তীতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেলে শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’
কাউন্সেলর হিসেবে নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এ মনোচিকিৎসক বলেন, ‘আমার কাছে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের কাউন্সেলিং করানোর জন্য আসেন। সেখানে মূলত অভিভাবকেরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমার কাছ থেকে পরামর্শ দাবি করেন। সেখানে ওই কিশোর-কিশোরীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা আগ্রহ প্রকাশের সুযোগ খুব কম থাকে। ফলে ওই কিশোর-কিশোরীর “ব্যক্তি সত্তার” সঙ্গে পরিচয় ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। আমরা আসলে কখনোই সন্তানদের মন বুঝতে চাই না।’
শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষক, পরিবারের সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের কার্যকর নীতি প্রণয়নে দুর্বলতার কারণেও শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের চেয়ে সনদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে অভিভাবকেরা সন্তানের ভালো ফলাফল নিশ্চিত করতে টাকা ঢালছেন। অপরদিকে শিক্ষকেরাও সহজ ও ‘শর্টকাট’ পথে হাঁটছেন। মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে শিক্ষাজীবন পার করছে ছেলে–মেয়েরা। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাণিজ্য।
দেশের বাস্তবতা হলো কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউটর কেন্দ্রিক শিক্ষা। স্কুল-কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন কোচিং কিংবা প্রাইভেটে শিক্ষকেরা যতটা যত্নশীল, শ্রেণিকক্ষে ওই শিক্ষকেরাই ততটা উদাসীন। কোনো বিষয়ে না বুঝতে পারলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যতটা সংকুচিত, কোচিং কিংবা প্রাইভেটে ওই শিক্ষার্থীরাই তত বেশি অকপট।
এ ছাড়া দেশের প্রসিদ্ধ, খ্যাতনামা অনেক কলেজে ভর্তির জন্য এখন ন্যূনতম যোগ্যতা ধরা হচ্ছে জিপিএ-৫।
এদিকেই ইঙ্গিত করছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ও শিক্ষা বার্তার সম্পাদক এএন রাশেদা। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ দায়ই শিক্ষা ব্যবস্থার, সরকার এবং রাষ্ট্রের। শুধু বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই হবে না। সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতীয়করণ আর সরকারিকরণের পার্থক্যটা আলাদা করতে জানতে হবে। শিক্ষকদের যদি সঠিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া না যায়, তবে শিক্ষার্থীদের কী পড়াবে কী শেখাবে তাঁরা? কারণ এর সঙ্গে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটও দায়ী।’
এমন পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেছি, যেখানে আমরা জিপিএ-৫ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করছি। অথচ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক চর্চা যেমন নাচ গান খেলাধুলা থাকা বাধ্যতামূলক। তাহলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার বিকাশটা ঘটবে। শিক্ষাজীবনে আনন্দের বিষয়গুলো থাকলে আর এমনটা ঘটত না। অথচ শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়া, গলাধঃকরণ করা, আর জিপিএ-৫ পাওয়াটাই যেন এখন শিক্ষা হয়ে গেছে। আর এই চর্চাটা পরিবার পর্যন্ত ঢুকে গেছে।’
এ থেকে তাহলে উত্তরণের পথ কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের অধ্যাপক শিক্ষাবিদ হাফিজুর রহমান বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতার ওপরও জোর দেন তিনি।
মনোচিকিৎসক সানজিদা শাহরিয়া বলেন, ‘পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বোপরি সমাজে এর বিরুদ্ধে সচেতনতাই পারে আমাদের এ সংকট থেকে উতরে যেতে। সেই সঙ্গে অবশ্যই আমাদের পরিবারগুলোকে সন্তানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মন বোঝার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
সেই সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁদের সম্মানী বাড়ানোর জন্যও সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদ এএন রাশেদা। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। তা বাড়িয়ে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করে দিলেই হবে না, শিক্ষকদের মান নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষা ব্যবস্থার আমলা নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই ছাত্র–ছাত্রীরা ভালো কিছু শিখবে, এভাবে হতাশ হবে না, আত্মহত্যার মত পথও বেঁচে নেবে না।’
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে গত ২৮ জুলাই। ফল প্রকাশের তারিখ ঘোষণার দিন থেকেই পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উত্তেজনা–উদ্বেগ ভর করে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ইদানীংকালে এই উদ্বেগটা মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। আজ থেকে দুই দশক আগেও পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু এখন জিপিএ-৫ না পাওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলে–মেয়ের আত্মহত্যা নানা মাত্রায় সামাজিক অস্থিরতা–অসংগতির ইঙ্গিত দিলেও পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে গড়ে ৮০ শতাংশ নম্বর না পাওয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া সম্ভবত অন্য কিছুরও ইঙ্গিত দেয়, যেটি আমরা উপেক্ষা করে যাচ্ছি।
এ বছর ২৯ হাজার ৭১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এ বছর পাস ও জিপিএ–৫ দুটির হারই কমেছে।
পাসের হার কমেছে নাকি বেড়েছে, জিপিএ-৫ কমেছে নাকি বেড়েছে সেটি আজকের আলোচনার বিষয় নয়। বরং অপ্রিয় হলেও সত্য ৪ লাখ ৪৫০ জন পরীক্ষায় ফেল করেছে।
এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের দিন ঢাকায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমাবেশ দেশের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর মধ্যে মোটা দাগে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ, জিপিএ-৫, পাস-ফেলের হার কেমন, কমল নাকি বাড়ল, কারা এগিয়ে, কোন বোর্ড এগিয়ে গেল, কোন বোর্ড পেছাল নানান দিক থেকে বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমগুলো। এরই মধ্যে ‘জিপিএ-৫ না পাওয়ায় আত্মহত্যা’র অন্তত তিনটি খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত দুজন কিশোরীর আত্মহত্যার প্রসঙ্গেই বলা যাক।
শিক্ষার্থী দুজন হলো—ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খোঁচাবাড়ি গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিষ্টি রায় (১৬) ও নাটোর লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মম (১৬)। দুজনই পরিবারের কাছে বলেছিল, তাদের প্রত্যাশা জিপিএ-৫ পাবে। কিন্তু মিষ্টি রায় পেয়েছে জিপিএ ৪.২৮ ও মম পেয়েছে জিপিএ-৩.৮০।
গণমাধ্যমগুলোতে খুঁজলেই মিলবে—পরীক্ষায় ফেল করায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জিপিএ-৫ না পাওয়া। আমাদের জন্য ‘অশনিসংকেত’ হলো প্রায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা।
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিনে পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যার একটি হিসাব তুলে ধরা যাক—এ বছর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ছয়জন শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে গেছে অন্তত দুজন। ২০১৮ সালে ফল প্রকাশের সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২২ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে ১০ জন মারা যায়। ২০২০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার করে যাদের মধ্যে ১৯ জনই ছিল কিশোরী।
গ্রেডিং বা জিপিএ পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর (২০০১) এসএসসিতে জিপিএ-৫–এর সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৬ জন। সে সময় কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে জিপিএ-৫–এর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়তে শুরু করে। আর গত দুই দশকে এ সংখ্যা বেড়েছে কয়েক শ গুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিষ্টি রায় যে বিদ্যালয়ে পড়ত সেখান থেকে কোনো শিক্ষার্থীই জিপিএ-৫ পায়নি। সেখানে অকৃতকার্য হয়েছে ২০ জন। আর লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অর্থাৎ মম যে বিদ্যালয়ে পড়ত সেখানে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫ জন ও অকৃতকার্য হয়েছে ২৯ জন।
ওই দিনের পরিস্থিতি জানতে মিষ্টি রায়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি সাদ্দাম হোসেন। মিষ্টি রায়ের বাবা প্রেমানন্দ রায় তাঁকে জানিয়েছেন, বান্ধবীরা তার চেয়ে ভালো ফল করেছে। এ নিয়ে সে খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল। শ্রেণিশিক্ষক জানিয়েছেন, ক্লাসে মিষ্টি রায় ছিল প্রথম। ‘আত্মসম্মানে’ আঘাত লাগায় হয়তো সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন ওঠে তাহলে সমাজে বা বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে যেতে অস্বস্তি বা লজ্জাই কি প্রভাব ফেলেছে মিষ্টির ওপর?
মমর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার লালপুর প্রতিনিধি ইমাম হাসান মুক্তি। মমর বাবা মহসিন আলী তাঁকে জানিয়েছেন, ফলাফল নিয়ে মমকে কোনো চাপ বা বকাঝকা করা হয়নি। আত্মীয়স্বজনেরা কল দিয়ে জানতে চাইলে তার মা মন খারাপ করে ফলাফল জানাচ্ছিলেন। মেয়ের ফলাফল নিয়ে মাও বেশ কয়েকবার কেঁদেছেন। এর মধ্যেই মম সবার অলক্ষ্যে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাহলে পরিবারে একটা পরোক্ষ চাপ বা প্রকাশিত অসন্তোষের প্রভাব কি পড়েছিল মমর ওপর?
আমরা ওই বয়সী শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের বিষয়ে জানতে কথা বলেছিলাম সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনারের কাউন্সিলর অধ্যাপক সানজিদা শাহরিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রথমত পরিবার, দ্বিতীয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ পরিসরে সমাজের প্রভাবে কিশোর-কিশোরীরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষার্থীরা বয়ঃসন্ধিতে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। এ সময় বিশেষ করে অভিভাবক, শিক্ষকেরা তাদের পরিস্থিতি অনুধাবন না করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের ওপর প্রতিযোগিতার মানদণ্ড ঠিক করে দেন। পরবর্তীতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেলে শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’
কাউন্সেলর হিসেবে নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এ মনোচিকিৎসক বলেন, ‘আমার কাছে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের কাউন্সেলিং করানোর জন্য আসেন। সেখানে মূলত অভিভাবকেরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমার কাছ থেকে পরামর্শ দাবি করেন। সেখানে ওই কিশোর-কিশোরীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা আগ্রহ প্রকাশের সুযোগ খুব কম থাকে। ফলে ওই কিশোর-কিশোরীর “ব্যক্তি সত্তার” সঙ্গে পরিচয় ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। আমরা আসলে কখনোই সন্তানদের মন বুঝতে চাই না।’
শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষক, পরিবারের সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের কার্যকর নীতি প্রণয়নে দুর্বলতার কারণেও শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের চেয়ে সনদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে অভিভাবকেরা সন্তানের ভালো ফলাফল নিশ্চিত করতে টাকা ঢালছেন। অপরদিকে শিক্ষকেরাও সহজ ও ‘শর্টকাট’ পথে হাঁটছেন। মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে শিক্ষাজীবন পার করছে ছেলে–মেয়েরা। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাণিজ্য।
দেশের বাস্তবতা হলো কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউটর কেন্দ্রিক শিক্ষা। স্কুল-কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন কোচিং কিংবা প্রাইভেটে শিক্ষকেরা যতটা যত্নশীল, শ্রেণিকক্ষে ওই শিক্ষকেরাই ততটা উদাসীন। কোনো বিষয়ে না বুঝতে পারলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যতটা সংকুচিত, কোচিং কিংবা প্রাইভেটে ওই শিক্ষার্থীরাই তত বেশি অকপট।
এ ছাড়া দেশের প্রসিদ্ধ, খ্যাতনামা অনেক কলেজে ভর্তির জন্য এখন ন্যূনতম যোগ্যতা ধরা হচ্ছে জিপিএ-৫।
এদিকেই ইঙ্গিত করছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ও শিক্ষা বার্তার সম্পাদক এএন রাশেদা। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ দায়ই শিক্ষা ব্যবস্থার, সরকার এবং রাষ্ট্রের। শুধু বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই হবে না। সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতীয়করণ আর সরকারিকরণের পার্থক্যটা আলাদা করতে জানতে হবে। শিক্ষকদের যদি সঠিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া না যায়, তবে শিক্ষার্থীদের কী পড়াবে কী শেখাবে তাঁরা? কারণ এর সঙ্গে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটও দায়ী।’
এমন পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেছি, যেখানে আমরা জিপিএ-৫ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করছি। অথচ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক চর্চা যেমন নাচ গান খেলাধুলা থাকা বাধ্যতামূলক। তাহলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার বিকাশটা ঘটবে। শিক্ষাজীবনে আনন্দের বিষয়গুলো থাকলে আর এমনটা ঘটত না। অথচ শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়া, গলাধঃকরণ করা, আর জিপিএ-৫ পাওয়াটাই যেন এখন শিক্ষা হয়ে গেছে। আর এই চর্চাটা পরিবার পর্যন্ত ঢুকে গেছে।’
এ থেকে তাহলে উত্তরণের পথ কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের অধ্যাপক শিক্ষাবিদ হাফিজুর রহমান বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতার ওপরও জোর দেন তিনি।
মনোচিকিৎসক সানজিদা শাহরিয়া বলেন, ‘পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বোপরি সমাজে এর বিরুদ্ধে সচেতনতাই পারে আমাদের এ সংকট থেকে উতরে যেতে। সেই সঙ্গে অবশ্যই আমাদের পরিবারগুলোকে সন্তানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মন বোঝার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
সেই সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁদের সম্মানী বাড়ানোর জন্যও সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদ এএন রাশেদা। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। তা বাড়িয়ে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করে দিলেই হবে না, শিক্ষকদের মান নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষা ব্যবস্থার আমলা নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই ছাত্র–ছাত্রীরা ভালো কিছু শিখবে, এভাবে হতাশ হবে না, আত্মহত্যার মত পথও বেঁচে নেবে না।’
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি ২০২৪ সালের ফল সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে। ১৩ ও ১৪ নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়টির মাল্টিপার হলে আয়োজিত মোট চারটি সেশনে বিভিন্ন বিভাগের নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হয়।
৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল এবং গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের আইকিউএসি’র যৌথ উদ্যোগে ‘প্রিপারেশন ফর অ্যাক্রেডিটেশন: ডকুমেন্টেশন অ্যান্ড এভিডেন্স’ শীর্ষক একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার গ্রিন ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট রুমে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯ ঘণ্টা আগেএইচএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণে ৯ টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ৪ হাজার ৪০৫ জন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছেন ৮৭২ জন, নতুন করে জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন ৫৯২ জন। আর ফেল থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন ২ জন।
১ দিন আগেমেরিন ফিশারিজ একাডেমি (এমএফএ) বা বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমি (বিএমএফএ) মৎস্য শিল্প, বণিক জাহাজ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মেরিটাইম শিল্পগুলোতে প্রবেশ করতে আগ্রহী ক্যাডেটদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বা
১ দিন আগে