জাহীদ রেজা নূর
আমাদের দেশের কোনো কথা বলছি না। বলছি রাশিয়ার কথা। বলছি কসেনিয়া সাবচাকের কথা। লাস্যময়ী এই কোটিপতি রাশিয়ায় শুধু নন, সারা বিশ্বের অভিজাত মহলে ব্যাপক পরিচিত। যে ঘটনাটি ঘটেছে ৯ অক্টোবর, তাতে তিনি কোনো ধরনের অঘটন ঘটাননি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শোনার পর আপনারাই বলবেন, আসলে এখানে কসেনিয়ার কিছু করার ছিল কি না।
অনেকেই রাশিয়ায় পুতিনের লৌহশাসনের কথা বলেন। বলেন, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। অথচ সেই রাশিয়ার একটি পত্রিকার সাংবাদিক যদি এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে, সংবাদপত্র এখনো তার মূল দায়িত্ব ভুলে যায়নি। তারা ন্যায় ও অন্যায়ের যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখে।
অনেকেই ভুলে যাননি, এই তো কিছুদিন আগে ঢাকা মহানগরীর একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে একটি কমবয়সী মেয়ের আত্মহত্যাবিষয়ক খবর ছাপা হওয়ার পর আমাদের সাংবাদিক মহলের একটা বিশিষ্ট চেহারা ভেসে উঠেছিল। নগ্নভাবে মেয়েটিকে দোষারোপ করা হয়েছে, ঘটনাটি নিয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ ছাপা হয়নি অনেক বড় পত্রিকায়, যার দিকে ছিল সন্দেহের তির, তাকে পয়গম্বর বানানোর প্রতিযোগিতা হয়েছে।
সেই কথা মনে রেখেই আমরা রাশিয়ার গল্পটা বলব। বলার চেষ্টা করব, টাকা মানুষকে কতটা অমানবিক করে তোলে। এবং এখানে একবারও বলব না, করোনার ভয়াবহ বিস্তারের সময়টায় গার্মেন্টসশিল্পের কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে শ্রমিকদের কাজে যোগদান করতে বাধ্য করেছিলেন। ফেরিতে, রাস্তায় ধাবমান মানুষদের ছবি দেখে আমরা অনুমান করে নিয়েছি, এ যেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের হাতে পড়েছি, যাদের হৃদয় আর মস্তিষ্ক দুই ধরনের কথা বলে। মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃদয়ের কোনো যোগাযোগ নেই।
না, সে কথা এখানে বলা হবে না।
ঘটনাটা বলা যাক। ৯ অক্টোবর রাত ৯টার সময় রাশিয়ার দক্ষিণের শহর ক্রাসনাদারের কাছে আদলের আর ক্রাসনাইয়া পোলইয়ানায় কসেনিয়া সাবচাক যে মার্সেডিজ গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল একটি ফক্সওয়াগন গাড়ির। সেই গাড়িতে থাকা দুজন আরোহী নিহত হয়েছিলেন। আর একজন আরোহী আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন হাসপাতালে।
দুর্ঘটনার পর নিজের দেহরক্ষীদের সাহায্যে কসেনিয়া সাবচাক তক্ষুণি আরেকটি গাড়ি জোগাড় করে তাতে চড়ে বসেছেন। এবং যেন কিছুই হয়নি, সে রকমভাবে দুর্ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যামবুলেন্স ডেকে আনেন। পুলিশকে খবর দেন।
সাংবাদিকদের কানে খবরটা পৌঁছায় পরদিন; ১০ অক্টোবর। তখনই জানা যায়, একটি কনসার্টে অংশ নেওয়ার জন্য কসেনিয়া মস্কো থেকে এসেছিলেন সোচিতে। কনসার্ট শেষে মস্কো ফেরার জন্য এয়ারপোর্টের উদ্দেশে দলবলসহ রওনা হওয়ার পরই এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
এ কথা সত্যি, দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে মার্সেডিজ–এর চালক। দুর্ঘটনার সঙ্গে কসেনিয়া সাবচাকের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ছিলেন ভাড়া করা গাড়ির আরোহী মাত্র। ফলে এভাবে ঘটনাস্থল ত্যাগ করায় আইনগত কোনো সংকটও তৈরি করেননি।
সংকট যেটা তৈরি হয়েছে, সেটা নৈতিক। এত বড় মাপের, এতটা জনপ্রিয় একজন মানুষ এত বড় একটা দুর্ঘটনার পর কীভাবে কোনো দায়িত্ব না নিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন? শুধু কি তাই? এই দুর্ঘটনার পর তাঁর ইনস্টাগ্রাম থেকে একটা পোস্ট করেন তিনি। কীভাবে সুখের নাগাল পাওয়া যায়, তা নিয়েই ছিল পোস্টটি।
দুর্ঘটনাটি নিয়ে কসেনিয়া সাবচাক প্রথম মুখ খোলেন ১০ অক্টোবর বিকেল ৩টায়। তিনি লেখেন—‘আমি সেই গাড়িতে ছিলাম। গাড়িটাও আমার ছিল না, চালকও নয়। আমি গাড়িটাকে প্রতিযোগিতায় নামতে বলিনি। কেউই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়নি। যখন গাড়িটা যাচ্ছিল, তখন আমি জুম মিটিংয়ে ছিলাম, তার প্রমাণ রয়েছে। গাড়ির চালকই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।’
এ কথা বলে তিনি নিজে মাথায় আঘাত পেয়েছেন, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা পেয়েছেন, তারপরও হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে মস্কোর প্লেনে ওঠার কথাই ভেবেছেন। তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু সকাল সকাল ইনস্টাগ্রামে সুখ নিয়ে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিলেন কেন, তার উত্তরে কসেনিয়া বলছেন, ‘ওটা অলক্ষ্যে হাতের ছোঁয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজে দিতে চাননি।’
কথাটা বিশ্বাস করা যায় কিনা, সেটা আপনারাই বিচার করবেন।
এবার দেখুন, ডেইলি স্টর্মের সম্পাদক আনাস্তাসিয়া কাশেভারোভা বিষয়টি নিয়ে ব্যঙ্গ করে কী লিখেছেন: ‘আমিই পোস্টটা দিয়েছি। ঘোড়ার গাড়িটা আমার না, ঘোড়াটাও না। আমার সহকারী এইমাত্র আমাকে রান্নাঘর থেকে হল ঘরটায় নিয়ে এল। আমি খুব ভালো মেয়ে, এই দুর্ঘটনায় খুব বেশি আঘাত পেয়েছি। অন্যদের চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। আমাকে সাহায্য করুন। আমার জন্য দোয়া করুন। অন্যদের জন্য দোয়া করে লাভ নেই। ওরা মরে গেছে। ওদের তো আর সাহায্য করতে পারবেন না। মরা মানুষের সাহায্য লাগে না। আমার সাংবাদিক বন্ধুরা অকারণেই এই দুর্ঘটনা নিয়ে বাড়িয়ে কথা বলছে!’ কসেনিয়াকে এভাবে ব্যঙ্গ করার পর তিনি লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, যারা কসেনিয়াকে স্পনসর করে, তারা যেন এখন তার দিক থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। একটা দৈত্যের জন্ম দিয়েছেন তারা। হৃদয়হীন, অহঙ্কারী, বিবেকহীন এক দৈত্য! স্পনসরেরা বহু আগে থেকেই সেটা জানে, এখন শুধু সম্পর্ক শেষ করে দেওয়াটাই তাদের দিক থেকে একমাত্র কাজ হতে পারে। সাবচাকের ক্যারিয়ারে ক্রুশ পুঁতে দেওয়ার সময় এসেছে। ওকে ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই।’
তবে কেউ কেউ বলছেন, এ মুহূর্তে কসেনিয়া সাবচাককে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে বরং যারা নিহত হয়েছেন এই দুর্ঘটনায়, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দরকার। এদের মধ্যে আছেন টেলিভিশন ও রেডিও সাংবাদিক মাক্সিম কোনোনেঙ্কো।
তবে রুস্কি রেপার্তিওর–এর সহকারী সম্পাদক মারিনা আখমেদোভা ঝাঁঝের সঙ্গে লিখেছেন, ‘সামনের কয়েকটা দিন যে বিষয়টি আলোচনায় থাকবে, সেটি হলো, এয়ারপোর্টে যারা যাচ্ছিলেন ট্যাক্সিতে করে, তার যাত্রী কি এই ব্যাপারে অপরাধী? তিনি কি চালককে দ্রুত চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার ফলে চালক সীমাহীন গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে সামনের গাড়ির দুজন যাত্রীকে হত্যা করেছেন এবং তৃতীয়জনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন আশঙ্কাজনক অবস্থায়? যদি সত্যিই নিরপেক্ষভাবে ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে, হঠাৎ করে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গাড়ির চালকের খুব একটা গরজ থাকার কথা নয়। সে তো আর প্লেন মিস করছে না। যেভাবেই যাক না কেন, সে তার ভাড়া ঠিকই পেয়ে যাবে। সে তার গাড়ি জোরে চালাবে তখনই, যখন গাড়ির যাত্রী তাকে বলবে গতি বাড়াতে। সমাজবদ্ধ মানুষেরা সেই গাড়ির যাত্রীর নৈতিক অবস্থাটাও দেখবে, যে গাড়িটি দুজন মানুষকে হত্যা করেছে। তাহলে প্রশ্নটা হবে এ রকম: ট্র্যাজেডির জায়গা থেকে অন্য একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে যাত্রী কি এভাবে চলে যেতে পারেন? নৈতিকভাবে কি এভাবে চলে যাওয়া সম্ভব? এই কথা নিয়ে লেখালেখি চলতেই থাকবে এবং একসময় মানুষ তা ভুলে যাবে। এ কারণে ভুলে যাবে না যে, যাত্রীকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো, এ কারণে ভুলে যাবে যে, এই যাত্রীর কাছ থেকে এই আচরণই আশা করা যায়, আর কিছুই সে শেখেনি।’
ফক্সওয়াগনের যে দুজন যাত্রী মারা গেছেন, তাঁদের একজন ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী ইকাতেরিনা তারাসোভা। তিনি মেডিটেশনের শিক্ষক। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, ‘আমি বেঁচে থাকাকেই বেছে নিয়েছি, আমি বাঁচতে চাই, আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’
৩৯ বছর বয়সী মার্সেডিজ চালক আলেগ ৎসোই এরই মধ্যে নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি এখন পুলিশের জিম্মায় আছেন।
দুই.
কসেনিয়া আনাতোলিয়েভনা সাবচাক তাঁর ওভারকোটে যেন অন্যের রক্ত না লাগে, সেটা নিশ্চিত করতে গিয়ে এখন পুরো ওভারকোটটা মাখিয়ে ফেলেছেন মলমুত্রে। কাপুরুষতা, বিবেবহীনতাই সাবচাকের ভিত্তিমূল।
ভেবে দেখুন, সামনে দর্শক নেই, স্টুডিওতে শো হচ্ছে না, যা ঘটেছে তা বাস্তবজীবনে। এটা বাস্তবজীবনের দুর্ঘটনা, এটা বাস্তব জগতের মৃত্যুদৃশ্য। যে গাড়িতে কসেনিয়া ছিলেন, সেই গাড়িটাই আঘাত করেছে অন্য একটি গাড়িকে, সে গাড়ির আরোহীদের মধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন, আর কসেনিয়া কী করেছেন? তিনি লাশগুলোকে ঘটনাস্থলে রেখেই প্লেনে করে মস্কো চলে গেছেন। সামনে দর্শক নেই, স্টুডিওতে শো হচ্ছে না, আশপাশে কেউ নেই, কেউ দেখবে না। সুতরাং কসেনিয়া কাউকে কিছু না বলে প্লেনে করে উড়ে যেতেই পারেন। যেহেতু কেউ চিনতে পারেনি, সুতরাং ইনস্টাগ্রামে পরবর্তী অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও পোস্ট করতে পারেন।
কিন্তু হায় কপাল! এত ঢাক ঢাক গুড়গুড়ের মধ্যেও অনেকে জেনে ফেলেছেন মার্সেডিজে ছিলেন কসেনিয়া!
কসেনিয়া লিখেছেন, তিনি মাথায় ব্যথা পেয়েছেন, এখানে ওখানে ছুলে গেছে। কিন্তু পুলিশ রিপোর্ট কী বলছে? ‘দুর্ঘটনায় কসেনিয়া সাবচাক আহত হননি, পুলিশ আসার আগেই তিনি দুর্ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন।’ বিমানবন্দরে থাকা সিসি ক্যামেরা কী বলছে? ক্যামেরা বলছে, বেশ উৎফুল্ল মেজাজে কসেনিয়া ইমিগ্রেশন পার হয়ে প্লেনের দিকে যাচ্ছেন। এটা সেই দুর্ঘটনার মাত্র ৪০ মিনিট পরের ঘটনা।
কসেনিয়া অবশ্য লিখেছেন, ‘যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সাহায্য করব।’
বলেছেন তিনি। এ রকম অনেকেই বলেন। তারপর সে প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় ভেসে যায়। শুনুন, যিনি মারা গেছেন, তাঁর বান্ধবী কী বলছেন, তিনি এই দুর্ঘটনার পর কসেনিয়ার কাছে গিয়ে বলেছিলেন নিহতের ছয় বছর বয়সী মাশার কথা। সাবচাক একেবারেই পাত্তা দেননি। সুতরাং ওটা যে কথার কথা ছিল, সে রকম ভাবলে, তা খুব দোষের কিছু হবে না।
একজন সেলিব্রিটি বলে অনেকেই কসেনিয়ার ভক্ত। অনেকের জন্যই তিনি উদাহরণ। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাঁর যে চেহারা দেখা গেল, সেটা তাঁর পর্দার জীবনের একেবারে বিপরীত।
এখন হয়তো-বা তাঁর জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তনটি আসবে সত্যিকারের দুটি মৃত্যুর পর!
তিন.
এই যে এত কথা বলা হলো, তাতে কি বোঝা যাচ্ছে, রুশ দেশে সাংবাদিকেরা সেলিব্রিটিদেরও ছেড়ে কথা বলে না? পুলিশ অবলীলায় বলে দেয়, ৪০ মিনিট আগে যিনি ছিলেন দুর্ঘটনায় পতিত গাড়িতে, তিনি হাসতে হাসতেই উঠেছেন প্লেনে! নাহ! রাশিয়াকে নিয়ে হাসাহাসি বন্ধ করাই ভালো।
সেলিব্রিটি যদি অপরাধী হয়, হোক না সেটা নৈতিক অপরাধ, তারপরও তাঁকে দাঁড়াতে হয় বিবেকের কাঠগড়ায়।
দোহাই কেউ মনে করবেন না, এসব কথা বলে আমি অন্য কোনো দেশকে কটাক্ষ করছি।
সবকিছু ভালো থেকে ভালোতর হচ্ছে!
আমাদের দেশের কোনো কথা বলছি না। বলছি রাশিয়ার কথা। বলছি কসেনিয়া সাবচাকের কথা। লাস্যময়ী এই কোটিপতি রাশিয়ায় শুধু নন, সারা বিশ্বের অভিজাত মহলে ব্যাপক পরিচিত। যে ঘটনাটি ঘটেছে ৯ অক্টোবর, তাতে তিনি কোনো ধরনের অঘটন ঘটাননি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শোনার পর আপনারাই বলবেন, আসলে এখানে কসেনিয়ার কিছু করার ছিল কি না।
অনেকেই রাশিয়ায় পুতিনের লৌহশাসনের কথা বলেন। বলেন, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। অথচ সেই রাশিয়ার একটি পত্রিকার সাংবাদিক যদি এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে, সংবাদপত্র এখনো তার মূল দায়িত্ব ভুলে যায়নি। তারা ন্যায় ও অন্যায়ের যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখে।
অনেকেই ভুলে যাননি, এই তো কিছুদিন আগে ঢাকা মহানগরীর একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে একটি কমবয়সী মেয়ের আত্মহত্যাবিষয়ক খবর ছাপা হওয়ার পর আমাদের সাংবাদিক মহলের একটা বিশিষ্ট চেহারা ভেসে উঠেছিল। নগ্নভাবে মেয়েটিকে দোষারোপ করা হয়েছে, ঘটনাটি নিয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ ছাপা হয়নি অনেক বড় পত্রিকায়, যার দিকে ছিল সন্দেহের তির, তাকে পয়গম্বর বানানোর প্রতিযোগিতা হয়েছে।
সেই কথা মনে রেখেই আমরা রাশিয়ার গল্পটা বলব। বলার চেষ্টা করব, টাকা মানুষকে কতটা অমানবিক করে তোলে। এবং এখানে একবারও বলব না, করোনার ভয়াবহ বিস্তারের সময়টায় গার্মেন্টসশিল্পের কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে শ্রমিকদের কাজে যোগদান করতে বাধ্য করেছিলেন। ফেরিতে, রাস্তায় ধাবমান মানুষদের ছবি দেখে আমরা অনুমান করে নিয়েছি, এ যেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের হাতে পড়েছি, যাদের হৃদয় আর মস্তিষ্ক দুই ধরনের কথা বলে। মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃদয়ের কোনো যোগাযোগ নেই।
না, সে কথা এখানে বলা হবে না।
ঘটনাটা বলা যাক। ৯ অক্টোবর রাত ৯টার সময় রাশিয়ার দক্ষিণের শহর ক্রাসনাদারের কাছে আদলের আর ক্রাসনাইয়া পোলইয়ানায় কসেনিয়া সাবচাক যে মার্সেডিজ গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল একটি ফক্সওয়াগন গাড়ির। সেই গাড়িতে থাকা দুজন আরোহী নিহত হয়েছিলেন। আর একজন আরোহী আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন হাসপাতালে।
দুর্ঘটনার পর নিজের দেহরক্ষীদের সাহায্যে কসেনিয়া সাবচাক তক্ষুণি আরেকটি গাড়ি জোগাড় করে তাতে চড়ে বসেছেন। এবং যেন কিছুই হয়নি, সে রকমভাবে দুর্ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যামবুলেন্স ডেকে আনেন। পুলিশকে খবর দেন।
সাংবাদিকদের কানে খবরটা পৌঁছায় পরদিন; ১০ অক্টোবর। তখনই জানা যায়, একটি কনসার্টে অংশ নেওয়ার জন্য কসেনিয়া মস্কো থেকে এসেছিলেন সোচিতে। কনসার্ট শেষে মস্কো ফেরার জন্য এয়ারপোর্টের উদ্দেশে দলবলসহ রওনা হওয়ার পরই এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
এ কথা সত্যি, দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে মার্সেডিজ–এর চালক। দুর্ঘটনার সঙ্গে কসেনিয়া সাবচাকের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ছিলেন ভাড়া করা গাড়ির আরোহী মাত্র। ফলে এভাবে ঘটনাস্থল ত্যাগ করায় আইনগত কোনো সংকটও তৈরি করেননি।
সংকট যেটা তৈরি হয়েছে, সেটা নৈতিক। এত বড় মাপের, এতটা জনপ্রিয় একজন মানুষ এত বড় একটা দুর্ঘটনার পর কীভাবে কোনো দায়িত্ব না নিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন? শুধু কি তাই? এই দুর্ঘটনার পর তাঁর ইনস্টাগ্রাম থেকে একটা পোস্ট করেন তিনি। কীভাবে সুখের নাগাল পাওয়া যায়, তা নিয়েই ছিল পোস্টটি।
দুর্ঘটনাটি নিয়ে কসেনিয়া সাবচাক প্রথম মুখ খোলেন ১০ অক্টোবর বিকেল ৩টায়। তিনি লেখেন—‘আমি সেই গাড়িতে ছিলাম। গাড়িটাও আমার ছিল না, চালকও নয়। আমি গাড়িটাকে প্রতিযোগিতায় নামতে বলিনি। কেউই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়নি। যখন গাড়িটা যাচ্ছিল, তখন আমি জুম মিটিংয়ে ছিলাম, তার প্রমাণ রয়েছে। গাড়ির চালকই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।’
এ কথা বলে তিনি নিজে মাথায় আঘাত পেয়েছেন, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা পেয়েছেন, তারপরও হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে মস্কোর প্লেনে ওঠার কথাই ভেবেছেন। তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু সকাল সকাল ইনস্টাগ্রামে সুখ নিয়ে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিলেন কেন, তার উত্তরে কসেনিয়া বলছেন, ‘ওটা অলক্ষ্যে হাতের ছোঁয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজে দিতে চাননি।’
কথাটা বিশ্বাস করা যায় কিনা, সেটা আপনারাই বিচার করবেন।
এবার দেখুন, ডেইলি স্টর্মের সম্পাদক আনাস্তাসিয়া কাশেভারোভা বিষয়টি নিয়ে ব্যঙ্গ করে কী লিখেছেন: ‘আমিই পোস্টটা দিয়েছি। ঘোড়ার গাড়িটা আমার না, ঘোড়াটাও না। আমার সহকারী এইমাত্র আমাকে রান্নাঘর থেকে হল ঘরটায় নিয়ে এল। আমি খুব ভালো মেয়ে, এই দুর্ঘটনায় খুব বেশি আঘাত পেয়েছি। অন্যদের চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। আমাকে সাহায্য করুন। আমার জন্য দোয়া করুন। অন্যদের জন্য দোয়া করে লাভ নেই। ওরা মরে গেছে। ওদের তো আর সাহায্য করতে পারবেন না। মরা মানুষের সাহায্য লাগে না। আমার সাংবাদিক বন্ধুরা অকারণেই এই দুর্ঘটনা নিয়ে বাড়িয়ে কথা বলছে!’ কসেনিয়াকে এভাবে ব্যঙ্গ করার পর তিনি লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, যারা কসেনিয়াকে স্পনসর করে, তারা যেন এখন তার দিক থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। একটা দৈত্যের জন্ম দিয়েছেন তারা। হৃদয়হীন, অহঙ্কারী, বিবেকহীন এক দৈত্য! স্পনসরেরা বহু আগে থেকেই সেটা জানে, এখন শুধু সম্পর্ক শেষ করে দেওয়াটাই তাদের দিক থেকে একমাত্র কাজ হতে পারে। সাবচাকের ক্যারিয়ারে ক্রুশ পুঁতে দেওয়ার সময় এসেছে। ওকে ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই।’
তবে কেউ কেউ বলছেন, এ মুহূর্তে কসেনিয়া সাবচাককে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে বরং যারা নিহত হয়েছেন এই দুর্ঘটনায়, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দরকার। এদের মধ্যে আছেন টেলিভিশন ও রেডিও সাংবাদিক মাক্সিম কোনোনেঙ্কো।
তবে রুস্কি রেপার্তিওর–এর সহকারী সম্পাদক মারিনা আখমেদোভা ঝাঁঝের সঙ্গে লিখেছেন, ‘সামনের কয়েকটা দিন যে বিষয়টি আলোচনায় থাকবে, সেটি হলো, এয়ারপোর্টে যারা যাচ্ছিলেন ট্যাক্সিতে করে, তার যাত্রী কি এই ব্যাপারে অপরাধী? তিনি কি চালককে দ্রুত চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার ফলে চালক সীমাহীন গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে সামনের গাড়ির দুজন যাত্রীকে হত্যা করেছেন এবং তৃতীয়জনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন আশঙ্কাজনক অবস্থায়? যদি সত্যিই নিরপেক্ষভাবে ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে, হঠাৎ করে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গাড়ির চালকের খুব একটা গরজ থাকার কথা নয়। সে তো আর প্লেন মিস করছে না। যেভাবেই যাক না কেন, সে তার ভাড়া ঠিকই পেয়ে যাবে। সে তার গাড়ি জোরে চালাবে তখনই, যখন গাড়ির যাত্রী তাকে বলবে গতি বাড়াতে। সমাজবদ্ধ মানুষেরা সেই গাড়ির যাত্রীর নৈতিক অবস্থাটাও দেখবে, যে গাড়িটি দুজন মানুষকে হত্যা করেছে। তাহলে প্রশ্নটা হবে এ রকম: ট্র্যাজেডির জায়গা থেকে অন্য একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে যাত্রী কি এভাবে চলে যেতে পারেন? নৈতিকভাবে কি এভাবে চলে যাওয়া সম্ভব? এই কথা নিয়ে লেখালেখি চলতেই থাকবে এবং একসময় মানুষ তা ভুলে যাবে। এ কারণে ভুলে যাবে না যে, যাত্রীকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো, এ কারণে ভুলে যাবে যে, এই যাত্রীর কাছ থেকে এই আচরণই আশা করা যায়, আর কিছুই সে শেখেনি।’
ফক্সওয়াগনের যে দুজন যাত্রী মারা গেছেন, তাঁদের একজন ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী ইকাতেরিনা তারাসোভা। তিনি মেডিটেশনের শিক্ষক। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, ‘আমি বেঁচে থাকাকেই বেছে নিয়েছি, আমি বাঁচতে চাই, আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’
৩৯ বছর বয়সী মার্সেডিজ চালক আলেগ ৎসোই এরই মধ্যে নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি এখন পুলিশের জিম্মায় আছেন।
দুই.
কসেনিয়া আনাতোলিয়েভনা সাবচাক তাঁর ওভারকোটে যেন অন্যের রক্ত না লাগে, সেটা নিশ্চিত করতে গিয়ে এখন পুরো ওভারকোটটা মাখিয়ে ফেলেছেন মলমুত্রে। কাপুরুষতা, বিবেবহীনতাই সাবচাকের ভিত্তিমূল।
ভেবে দেখুন, সামনে দর্শক নেই, স্টুডিওতে শো হচ্ছে না, যা ঘটেছে তা বাস্তবজীবনে। এটা বাস্তবজীবনের দুর্ঘটনা, এটা বাস্তব জগতের মৃত্যুদৃশ্য। যে গাড়িতে কসেনিয়া ছিলেন, সেই গাড়িটাই আঘাত করেছে অন্য একটি গাড়িকে, সে গাড়ির আরোহীদের মধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন, আর কসেনিয়া কী করেছেন? তিনি লাশগুলোকে ঘটনাস্থলে রেখেই প্লেনে করে মস্কো চলে গেছেন। সামনে দর্শক নেই, স্টুডিওতে শো হচ্ছে না, আশপাশে কেউ নেই, কেউ দেখবে না। সুতরাং কসেনিয়া কাউকে কিছু না বলে প্লেনে করে উড়ে যেতেই পারেন। যেহেতু কেউ চিনতে পারেনি, সুতরাং ইনস্টাগ্রামে পরবর্তী অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও পোস্ট করতে পারেন।
কিন্তু হায় কপাল! এত ঢাক ঢাক গুড়গুড়ের মধ্যেও অনেকে জেনে ফেলেছেন মার্সেডিজে ছিলেন কসেনিয়া!
কসেনিয়া লিখেছেন, তিনি মাথায় ব্যথা পেয়েছেন, এখানে ওখানে ছুলে গেছে। কিন্তু পুলিশ রিপোর্ট কী বলছে? ‘দুর্ঘটনায় কসেনিয়া সাবচাক আহত হননি, পুলিশ আসার আগেই তিনি দুর্ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন।’ বিমানবন্দরে থাকা সিসি ক্যামেরা কী বলছে? ক্যামেরা বলছে, বেশ উৎফুল্ল মেজাজে কসেনিয়া ইমিগ্রেশন পার হয়ে প্লেনের দিকে যাচ্ছেন। এটা সেই দুর্ঘটনার মাত্র ৪০ মিনিট পরের ঘটনা।
কসেনিয়া অবশ্য লিখেছেন, ‘যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সাহায্য করব।’
বলেছেন তিনি। এ রকম অনেকেই বলেন। তারপর সে প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় ভেসে যায়। শুনুন, যিনি মারা গেছেন, তাঁর বান্ধবী কী বলছেন, তিনি এই দুর্ঘটনার পর কসেনিয়ার কাছে গিয়ে বলেছিলেন নিহতের ছয় বছর বয়সী মাশার কথা। সাবচাক একেবারেই পাত্তা দেননি। সুতরাং ওটা যে কথার কথা ছিল, সে রকম ভাবলে, তা খুব দোষের কিছু হবে না।
একজন সেলিব্রিটি বলে অনেকেই কসেনিয়ার ভক্ত। অনেকের জন্যই তিনি উদাহরণ। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাঁর যে চেহারা দেখা গেল, সেটা তাঁর পর্দার জীবনের একেবারে বিপরীত।
এখন হয়তো-বা তাঁর জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তনটি আসবে সত্যিকারের দুটি মৃত্যুর পর!
তিন.
এই যে এত কথা বলা হলো, তাতে কি বোঝা যাচ্ছে, রুশ দেশে সাংবাদিকেরা সেলিব্রিটিদেরও ছেড়ে কথা বলে না? পুলিশ অবলীলায় বলে দেয়, ৪০ মিনিট আগে যিনি ছিলেন দুর্ঘটনায় পতিত গাড়িতে, তিনি হাসতে হাসতেই উঠেছেন প্লেনে! নাহ! রাশিয়াকে নিয়ে হাসাহাসি বন্ধ করাই ভালো।
সেলিব্রিটি যদি অপরাধী হয়, হোক না সেটা নৈতিক অপরাধ, তারপরও তাঁকে দাঁড়াতে হয় বিবেকের কাঠগড়ায়।
দোহাই কেউ মনে করবেন না, এসব কথা বলে আমি অন্য কোনো দেশকে কটাক্ষ করছি।
সবকিছু ভালো থেকে ভালোতর হচ্ছে!
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
৮ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
৮ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
৮ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
১২ দিন আগে