হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে চার ভাই ও এক ভাগনে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জের কুমেদপুর ইউনিয়নের বগেরবাড়ি গ্রামের বাহারাম বাদশা (৫৬)। সংসার জীবনে তাঁর চার ছেলে এক মেয়ে। সর্বশেষ দুমাস আগে ছোট ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে সেই ছেলেকে দেখার ইচ্ছে জানান বাহারাম। ছেলেও প্রস্তুতি নেয় বাবার সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু দেখা আর হলো না। আজ শুক্রবার কারাগারেই মারা যান বাহারাম।
বাবার মৃত্যুর খবরে বড় ভাইদের সঙ্গে ছুটে আসেন ছোট ছেলে নাজমুল ইসলামও। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বিলাপ করতে থাকেন, ‘বাবা, আমাক দেখবা না। আমি তো আসছি। কোথায় বাবা। আমার বাবাকে কে মারল। বাবার সাথে কি আমার শেষ দেখা হবার নায়। বাবা তো সুস্থ আসল। কেমনে বাবা মারা যায়।’
কান্না থামিয়ে নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এক প্রতিবেশীক কয়দিন আগোত পুলিশ ধরি জেল দিছল। নয়া সরকার তাক মুক্তি দিছে। বাবা তাক কইছে মোক নাকি দেখবে। জেলখানা আসির কইছি। মুই বৃহস্পতিবার দেখা করার কথা আসলো কিন্তু বাবা তো আর বাঁচি নাই। শুনছি বাবাকে নাকি পিটিয়ে মারা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।’
বড় ছেলে ফারুক হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘শুনছি হত্যা মামলা দিয়া বাবাক জেলোত দিছে। সেই বাপোক মোর হত্যা করি মারি ফেলাল। হামরা বাবার হত্যাকারীর বিচার চাই।’
কারাগার কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসক ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে হত্যা মামলায় তিনিসহ চারভাই ও ভাগনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। জামিন না হওয়ায় সে সময় থেকেই কারাগারে ছিলেন বাহারাম বাদশা।
আজ শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে পালি অনুযায়ী কারাগার ঝাড়ু দিচ্ছিলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি রফিকুল ইসলাম। এ সময় পাশের গাছ থেকে লাঠি দিয়ে আমড়া পারছিলেন বাহারাম। এতে ঝাড়ু দেওয়া অংশে গাছে পাতা ও আমড়া পরে নষ্ট হওয়ায় রফিকুল তাঁকে বকাঝকা করেন। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা সৃষ্টির একপর্যায়ে বাহারাম রফিকুলের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এরপর রফিকুলসহ কয়েকজন কয়েদি বাহারামকে মারধর করেন।
এ সময় কারারক্ষী শাহাজাহান ও মোতালেব তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করেন। এরই একপর্যায়ে তাঁরা বাহারামকে প্রহার করেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্মরত চিকিৎসক তাঁকে ব্রথ ডেড বলে জানান।
বাহারামের মৃত্যুর খবর কয়েদিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কারাগারে হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় বিক্ষোভ করতে থাকেন কয়েদিরা এবং কারাগারে প্রবেশদ্বার গেট ধাক্কাধাক্কি করে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। এমন পরিস্থিতিতে ফাঁকাগুলি ছুড়তে থাকেন কারারক্ষীরা। এরপর একে একে কারাগারে ছুটে আসেন পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার। তাঁরা দফায় দফায় কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করেন। এ ঘটনায় কারারক্ষী মোতালেব ও শাহাজানকে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘কয়েদি বাহারাম বাদশার মৃত্যুর ঘটনায় প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টে পেয়েছি। সেখানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় দুই কারারক্ষীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে সিনিয়র সহকারী কমিশনার কাইয়ুম খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।’