ফুলবাড়ীতে পৌনে দুইশ প্রতিষ্ঠানের ভার ইউএনওর কাঁধে, সেবা পেতে ভোগান্তি

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) 
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১৩: ৪৬

দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ৬১টি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপজেলা পরিষদ, এসিল্যান্ড অফিস, পৌরসভাসহ অন্তত ১৭৪টি প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর মো. আল কামাহ্‌ তমালকে। এতে দাপ্তরিক কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে এবং সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন বলে অভিযোগ করেন নাগরিকেরা ।

ফুলবাড়ী উপজেলায় ৩৪টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৫টি কলেজ, একটি মহিলা কলেজ, ৪টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৪টি মাদ্রাসা ও ৩টি কারিগরি বিএম কলেজসহ মোট ৬১টি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতার কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় ইউএনওকে। দেখতে হয় তাদের ফাইলপত্রও। কোনো প্রতিষ্ঠানের মামলা থাকলে সেখানে বাড়তি সময় ব্যয় হয়। এ ছাড়া উপজেলা (প্রাথমিক) শিক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে ১০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বও তাকেই সামলাতে হচ্ছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রশিক্ষণের জন্য দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ায় উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একই ব্যক্তি উপজেলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছেন। এতে সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নাগরিকদের। 

অপরদিকে উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের স্থায়ী কমিটির ৯টিতে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আর ৮ টিতে পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কয়েকটি কমিটিতে উপদেষ্টা এবং কিছু কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকেন। তারা না থাকায় ওই সব কমিটির দায়িত্ব এখন ইউএনওর কাঁধে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা কমিটি থেকে শুরু করে শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন, প্রতিবন্ধী ভাতা, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, বয়স্ক-বিধবা ভাতা, টেন্ডার, টিআর-কাবিখাসহ উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দপ্তরগুলোর বিভিন্ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ইউএনও। 

এদিকে ফুলবাড়ী থানায় গত এক মাস থেকে শূন্য পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) পদটি, গত ৫ আগস্টের পর ৫ জন উপপরিদর্শক (এসআই) অন্যত্র বদলি হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে পদায়ন করা হয়নি। একই ভাবে ১৪ জন পুলিশ কনস্টেবলের পদও শূন্য রয়েছে। সম্প্রতি বদলি হয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। ফলে ওসির দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ উপপরিদর্শক আরিফুজ্জামান। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজেও ইউএনওকে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। জনবলের এত ঘাটতি নিয়ে ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ ২৩০ বর্গকিলোমিটারের উপজেলায় দুই লাখ জনগণের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বিভিন্ন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকাল সরকার পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ ভেঙে দেয়। এরপর থেকে উপজেলা পরিষদসহ ৭টি ইউনিয়নের দায়িত্বে আছেন ইউএনও মীর মো. আল কামাহ্‌ তমাল ও পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ জাফর আরিফ চৌধুরী। সাম্প্রতিক সময়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ৪০ দিনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণে যাওয়ায় এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছে ইউএনও।

এ ছাড়া গত ২০ আগস্ট এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি ভেঙে দিয়ে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইউএনওকে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ অংশ নিতে হচ্ছে এই কর্মকর্তাকে। এদিকে পৌর পরিষদের কাউন্সিলরদের অপসারণের পর উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রধানদের দেওয়া হয়েছে এই দায়িত্ব। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, নিজেদের দপ্তরের সঙ্গে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে নাগরিক সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে ভেঙে পড়েছে দাপ্তরিক কার্যক্রমসহ নাগরিক সেবা। 

এদিকে ফুলবাড়ী থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর ফুলবাড়ী থানার এসআই তন্ময়, আরিফুল ইসলাম, বদিউজ্জামান, মুকতাদির ও আবুল কালাম আজাদকে বদলি করা হয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর বদলি করা হয় পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সুলতান মাহমুদকে, তারপর গত ১৫ অক্টোবর ওসি মোস্তাফিজার রহমান বদলি করায় পরিদর্শক শূন্য হয়ে পড়েছে থানাটি। এ ছাড়া গত ২ মাসে ১৪ জন পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হলেও নতুন করে পদায়ন করা হয়নি। 

ওসির দায়িত্বে থাকা এসআই আরিফুজ্জামান বলেন, পুলিশের দায়িত্ব সব সময় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। তাই সরকারি দায়িত্ব পালন করতে কোনো অসুবিধা হয় না। 

এ বিষয়ে দিনাজপুর পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ‘অতিরিক্ত ফোর্স দিয়ে টহল দেওয়া হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে থানায় নতুন ওসি পদায়ন করা হবে।’ 

এদিকে সাবেক জনপ্রতিনিধিরা জানান, তাদের কাছে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসতেন বিভিন্ন ধরনের সেবা নেওয়ার জন্য। তবে দায়িত্ব না থাকায় সব কাজের চাপ পড়েছে ইউএনওর ওপর। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ইউএনওর ওপর চাপ কমাতে কিছু কাজ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া যেতে পারে। কারণ ইউএনওর পদটি এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাকে চাপমুক্ত রাখলে ভালো সেবা পাওয়া যাবে। এসব বাস্তবায়নে সরকারের ওপর মহলের সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশনা প্রয়োজন। 

পৌরসভায় সেবা নিতে আসা চক সাহাবাজপুরের আনেস সরকার জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে না পাওয়ায় একটি কাজের জন্য তাকে কয়েক দিন আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।

কৃষ্ণপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক জানান, ওয়ারিশ সনদ নিতে এসে কর্মকর্তা না থাকায় ফেরত যেতে হচ্ছে। একই সমস্যায় পড়েছেন কাটাবাড়ী গ্রামের একরামুল হক। 

উপজেলা পরিষদ ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে গিয়ে সেবা নিতে আসা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, নামজারিসহ নানা জরুরি কাজে এসেছেন। কিন্তু সহকারী কমিশনার (ভূমি) নেই। ইউএনও অন্য কাজে ব্যস্ত, তাই ফিরে যেতে হচ্ছে। 

পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী ও পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফুল হুদা চৌধুরী বলেন, পৌর পরিষদ ভেঙে দেওয়ায় ইউএনও ও এসিল্যান্ড প্রশাসক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের নিজেদের দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সে কারণে নিয়মিত অফিস করতে পারছেন না, এর পরেও কোনো কাজ থেমে নেই। নিয়ম অনুযায়ী চলছে। তবে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মো. আল কামাহ্‌ তমাল বলেন, সরকারি দায়িত্ব পালনে কোনো অজুহাত চলে না। রুটিন মোতাবেক কাজ করা হচ্ছে। কাজের চাপ বেশি হলেও নাগরিক সেবা ঠিক রাখার চেষ্টা করছি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত