দিন দিন লাগামহীন দামে রংপুরে সংকটের মুখে পড়েছে সোনার ব্যবসা। ক্রেতাশূন্য হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। কাজ না থাকায় পেশা বদল করছেন অনেক স্বর্ণকার (কারিগর)। কেউ কেউ চালাচ্ছেন রিকশা, কেউ কেউ কৃষি কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এই অবস্থার জন্য সিন্ডিকেট কারসাজিকে দায়ী করছেন জুয়েলারি মালিক সমিতির নেতারা।
বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলা শাখা থেকে জানা গেছে, রংপুর জেলায় স্বর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আট শতাধিক। বর্তমানে জেলায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক ও কারিগর। এক বছর আগেও প্রতি মাসে এই শিল্পে বাণিজ্য হতো ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা।
বর্তমানে কেনাবেচা কমে যাওয়ায় সোনার বাণিজ্য এসে ঠেকেছে এক থেকে দেড় কোটি টাকায়। চলতি বছর ১৭ বার ওঠানামা করেছে সোনার দাম। গত জুলাই মাসে দাম ছাড়িয়েছে লাখ টাকা। সোনার এমন লাগামহীন দামে ক্রেতাশূন্য হওয়ায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন বলে রংপুরের জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন জানায়।
সরেজমিনে জানা গেছে, টুং টাং শব্দে মুখরিত ছিল রংপুরের বানিয়াপট্টি। আগের মতো তেমন নেই কর্মব্যস্ততা। থরে থরে সাজিয়ে রাখা সোনার অলংকারগুলো জ্বলজ্বল করলেও ক্রেতার সংকটে পট্টি যেন নিষ্প্রাণ।
সোনার দোকানের মালিকেরা বলছেন, দিন শেষে যে কাজ হয় তাতে সংসার চালানো দায় স্বর্ণকারদের। তাই কমে যাচ্ছে এই পেশার শ্রমিক ও কারিগর।
নগরীর বেতপট্টি এলাকার রুমা জুয়েলার্সের মালিক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। এমনও সময় যাচ্ছে ১৫ দিনে এক দিন ব্যবসা হয়। দফায় দফায় দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে সোনা কেনার সামর্থ্য চলে গেছে। এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দেশে বড় বড় সিন্ডিকেটের কারণে। লোকসানে এই ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি।’
রংপুরের স্বর্ণকার হেলেন মিয়া বলেন, ‘একসময় স্বর্ণশিল্পী মানেই ছিল অভিজাত পেশা। এখন সেই পেশা বড় সংকটে। অনেকেই এই কাজ ছেড়ে দিয়ে রিকশা, অটোরিকশা চালাচ্ছেন। অনেকে কৃষিকাজেও ঢুকে পড়েছেন।’
রংপুরের তারাগঞ্জের বানিয়াপাড়া গ্রামে শতাধিক স্বর্ণকার ছিলেন। এখন হাতে গোনা ১০ জনের মতো আছেন এই পেশায়। কথা হলে স্বর্ণকার অতুল রায় বলেন, ‘মানুষ এখন আর আগের মতো সোনার অলংকার তৈরি করছেন না। একসময় কাজ করতে দিশে (ব্যস্ততা) পেতাম না। এখন চার-পাঁচ দিন পর বিয়ে-শাদির টুকিটাকি কাজ পেলেও সংসার চালানোর মতো আয় হয় না। ভাবছি এই পেশা ছেড়ে দেব।’
তিন মাস আগে স্বর্ণকারের কাজ ছেড়েছেন বানিয়াপাড়া গ্রামের অমৃত সাধু। এখন পেশা হিসেবে অটোরিকশা চালনাকে বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১৫ বছর ধরে রংপুরের বড় বড় জুয়েলার্সে কারিগরির কাজ করেছি। সোনার দাম আকাশচুম্বী হয়েছে, মানুষ ভাত খেতে পারছে না সোনা কিনবে কী দিয়ে? আগের মতো এখন আর কাজ নেই। তাই কাজ ছেড়ে দিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছি। এ পেশায় অনেক ভালো আছি।’
বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাড়ছে সোনার দাম। এই শিল্পকে বাঁচাতে স্বর্ণনীতির পূর্ণ বাস্তবায়নসহ ব্যাংকিং সুবিধা সৃষ্টির দাবি করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রাজু বলেন, ‘সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমনও মাস আছে এক দিন দাম কমলে ১৫ দিন সোনার দাম বেড়েছে। এখন লাখ টাকা সোনার ভরি ছাড়িয়েছে। সোনার দাম বাড়ার কারণে আমরা লোকসানের মুখে আছি। কাজ না থাকায় অনেক দক্ষ কারিগর এখন পেশা বদল করছেন।’
চলতি বছর ১৭ বার সোনার দাম ওঠানামা করার কথা জানান বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলা শাখার সভাপতি এনামুল হক সোহেল। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে সোনার অলংকার তৈরি ও কেনার সামর্থ্য। এতে আমরা ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছি। এই অবস্থায় আমরা চাই জুয়েলারি মালিকেরা ঋণসুবিধা পাক। তাহলে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারব।’