শিপুল ইসলাম, পঞ্চগড় থেকে
পোড়া গন্ধ বাতাসে উড়ছে। পড়ে আছে ছাই আর কাঠ-কয়লা। কোলাহল, পদচারণা নেই সাধারণ মানুষের। যে দিকে চোখ যায় শুধু পুলিশ, বিজিবি আর র্যাব সদস্যরা। পঞ্চগড়ের আহমদিয়া জামায়াতের ‘সালানা জলসা’কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, নিহত, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনার চার দিন পরও এমন অবস্থা দেখা গেছে গ্রামগুলো ঘুরে। তবে রোববার থেকে শহরের সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। খুলেছে দোকানপাট। এ ঘটনায় বিরোধী দলগুলো প্রশাসনের দুর্বলতার কথা বলছে। আর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দুষছেন বিএনপি-জামাতকে।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়ন ও বোদা উপজেলার বিংহারী ইউনিয়নের করতোয়া নদীর দক্ষিণ ধারে ৫ কিলোমিটার জুড়ে আহমদনগর, ফুলতলা, সালসিড়ি, গোয়ালপাড়া, সোনাতলা গ্রামের তিন হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পরিবারের বসবাস। গত শুক্রবার ‘সালানা জলসা’ বন্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামগুলোর ১৭৯টি পরিবারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট করেন দুর্বৃত্তরা। এরপর শনিবার ফের গুজব রটিয়ে হামলা চালায়, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার পর গ্রাম ছেড়েছেন আহমদিয়ারা। ফের হামলার আতঙ্কে গ্রামে ফিরছেন না কেউ।
ঘটনার চার দিনেও সরকারি কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। তবে আজ সোমবার সকালে হামলার শিকার এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর বাড়ি সংস্কারের আশ্বাস দেন রেলপথমন্ত্রী ও পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড নুরুল ইসলাম সুজন। এ সময় তিনি আহমদিয়া নেতাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক লাখ টাকা, শাড়ি ও কম্বল দেন।
এ সময় রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল আলিম মাহমুদ, পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার এমএম সিরাজুল হুদা, আহমদিয়া মুসলিম জামাতের বহিঃসম্পর্ক, গণসংযোগ ও প্রেস বিভাগের প্রধান আহমদ তবশির চৌধুরী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ আহমদিয়া জামায়াতের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় মন্ত্রী বলেন, একটি গোষ্ঠী সব সময় ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নানা ফৌজদারি অপরাধ ঘটাচ্ছে। পঞ্চগড়ে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিএনপি-জামাত যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা একাত্তরের নৃশংসতাকেও হার মানায়। বিএনপি-জামাত নামে-বেনামে গুপ্ত হামলা করে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
গত শুক্রবারের হামলার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছে। পঞ্চগড় জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক জানান, প্রতি বছরই আহমদিয়া সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে জলসা করে আসছে। কিন্তু স্থানীয় মুসল্লিরা তা মেনে নিতে চায় না। প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে, আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে জানমালের ক্ষতি হতো না। তবে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, বিএনপি জামায়াতের লোকজনই এই তাণ্ডব চালিয়েছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ লুটপাটের উদ্দেশ্যেই তাঁরা এ ঘটনা ঘটায়।
সাবেক সাংসদ ও কেন্দ্রীয় জাসদের সেক্রেটারি নাজমুল হক প্রধান বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সেখানে এমন ঘটনা ঘটেছিল। প্রশাসন নীরব দর্শক ছিল মাত্র। এবারেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মজাহারুল হক প্রধান বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। হামলাকারীদের হাতে অস্ত্র ও মুখে গামছা প্যাঁচানো ছিল। বহিরাগতরা পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালিয়েছে। তবে প্রশাসন চেষ্টা করলে বিষয়টি এত দূর গড়াতো না।
এদিকে কথা হলে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ নিয়ে যে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতি আমরা চাইনি। জলসা বন্ধসহ তাদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ করেছি মাত্র।
ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রহমান বলেন, তৃতীয় কোনো শক্তি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে ফিরে এসেছি। এরপর কি ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে তা আমরা জানি না।
ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাফেজ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, হামলার উদ্দেশ্যে আমরা বিক্ষোভ করিনি। আমরা শুধু জলসা বন্ধ করতে চেয়েছি। তবে প্রশাসন বৃহস্পতিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে যদি পদক্ষেপ নিয়ে জলসা বন্ধ করত তাহলে তৃতীয় শক্তি এই হামলার সুযোগ পেত না।
আজ সোমবার বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া ও হামলার শিকার ঘরবাড়িগুলোর ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে। যে বাড়িগুলোতে হামলা চালানো হয়নি তাঁরা বাড়িতে থাকলেও তেমন বাইরে বের হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্রাম পুলিশেরা এলাকাগুলো ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন।
ফুলতলা গ্রামের স্বামীহারা গৃহবধূ তহুরা বেগম বলেন, ‘স্বামী ছাইড়া গেছে চাইর বছর। দুই ছাওয়াল নিয়া বাবার একটা ভাঙা ঘরে সেলাই করি পেট চালাইতাম। ওরা আগুন দিয়া সব পুড়াই দিছে। চার দিন থাকি একবেলা খিচড়ি খায়া আছি। সরকারি কোনো লোক আইসে নাই। সহযোগিতা করে নাই। আমার বাঁচার সম্বল হারাই গেছে।’
তহুরার বাবা-ভাইসহ পরিবারের ৫টি ঘরের সব পুড়ে গেছে। কিন্তু দুই হাত গাঁ ঘেঁষা রমিছা বেগমের বাড়িতে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কথা হলে রমিছা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চোখের সামনে দাউ দাউ করি সব পুড়ছে। কিছুই কইরার পাই নাই। মুখে-চোখে কাপড় বান্ধি ডিজেল-পেট্রল, মবিল ছিটিয়া আগুন ধরা দিছে।’
তহুরার পাশেই রওশন আরার বাড়ি। আহমদিয়া সম্প্রদায়ে নয় তাই তাঁর বাড়িও বেঁচে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী এই নারী বলেন, ‘হু হু করে ১৮-৪৫ বছর বয়সী লোকজন গ্রামে ঢুকে পড়ে। আহমদিয়ারা তখন জলসায়। এমন অবস্থা যে, তাঁদের ঘরে কেউ থাকলে তাঁরাসহ পুড়ে যেত। জুস, আরসির বোতলে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগায় তাঁরা। ঘরহারা মানুষগুলো এখন গ্রাম ছেড়ে রংপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। কারেন্ট নাই, অন্ধকারে ফাঁকা গ্রামে রাতের বেলায় খুব ভয় হয়। কেউ যদি ক্ষতি করে।’
ওই গ্রামের সুজন আলী এনজিও থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ইজিবাইক কিনেছিলেন। আগুনে তাঁর বাড়িঘরসহ ইজিবাইকটি পুড়ে গেছে। এখন পড়নে শার্ট-লুঙ্গি ছাড়া কিছুই নেই। সুজন আলী জানান, সপ্তাহে ৪ হাজার ৬০০ টাকা কিস্তি। আইজ (সোমবার) সকালে ফিল্ডম্যান আসছিল, ঘুরে গেছে। এই ঋণ এখন কীভাবে শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না। সরকারের সহযোগিতা দরকার।
ঘটনার চার দিনেও সরকারি কোনো সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্তরা না পেলেও বিকেল ৩টার দিকে ফুলতলা বাজার এলাকা বিংহারী ইউনিয়নের এক গ্রামপুলিশকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে দেখা যায়। এ সময় গ্রাম পুলিশ আজগার আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইউএনওর নির্দেশে চেয়ারম্যান আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে পাঠিয়েছে। আমরা গ্রাম ঘুরে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি। তবে অধিকাংশ বাড়িতে লোকজন না থাকায় তালিকা করতে সময় লাগছে।’
আহমদিয়া মুসলিম জামাতের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘থাকার জায়গা ও নিরাপত্তা নেই। তাই লোকজন বাড়ি ফিরছেন না। ১৭৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। যে দুই চারজন মসজিদে আছেন তাদের আমরা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াচ্ছি। পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরতে চাচ্ছেন না। একটি হত্যা মামলা থানায় নথিভুক্ত হয়েছে। অন্যান্য মামলাগুলো দায়ের প্রক্রিয়া চলছে।’
পুলিশ বলছে, ‘সালানা জলসা’ বন্ধকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, সরকারি কাজে বাঁধা ও গুজব রটানোসহ পৃথক ৬টি মামলায় নাম ও অজ্ঞাত ৮ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৬টি মামলার মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে ৪টি, একটি র্যাব-১৩ ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ১টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে শনিবার ৩টি ও রোববার ৩টি মামলা করা হয়।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, ৬টি মামলায় ৮১ জন এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। নিরপরাধ সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে জন্য ভিডিও ফুটেজ দেখে, সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বর্তমানে পুলিশি নিয়ন্ত্রণে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখা, সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের নেতা-কর্মীরা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়।
এরপর শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করেন ইসলামি আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ সময় মিছিলে বাধা দেওয়ায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুজন নিহত হয়েছেন। এরপর শনিবার রাতে ফের গুজব রটিয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর পুরো এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গতকাল রোববার ৩৬ ঘণ্টা পর ইন্টারনেট সেবা সচল করা হয়।
পোড়া গন্ধ বাতাসে উড়ছে। পড়ে আছে ছাই আর কাঠ-কয়লা। কোলাহল, পদচারণা নেই সাধারণ মানুষের। যে দিকে চোখ যায় শুধু পুলিশ, বিজিবি আর র্যাব সদস্যরা। পঞ্চগড়ের আহমদিয়া জামায়াতের ‘সালানা জলসা’কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, নিহত, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনার চার দিন পরও এমন অবস্থা দেখা গেছে গ্রামগুলো ঘুরে। তবে রোববার থেকে শহরের সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। খুলেছে দোকানপাট। এ ঘটনায় বিরোধী দলগুলো প্রশাসনের দুর্বলতার কথা বলছে। আর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দুষছেন বিএনপি-জামাতকে।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়ন ও বোদা উপজেলার বিংহারী ইউনিয়নের করতোয়া নদীর দক্ষিণ ধারে ৫ কিলোমিটার জুড়ে আহমদনগর, ফুলতলা, সালসিড়ি, গোয়ালপাড়া, সোনাতলা গ্রামের তিন হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পরিবারের বসবাস। গত শুক্রবার ‘সালানা জলসা’ বন্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামগুলোর ১৭৯টি পরিবারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট করেন দুর্বৃত্তরা। এরপর শনিবার ফের গুজব রটিয়ে হামলা চালায়, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার পর গ্রাম ছেড়েছেন আহমদিয়ারা। ফের হামলার আতঙ্কে গ্রামে ফিরছেন না কেউ।
ঘটনার চার দিনেও সরকারি কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। তবে আজ সোমবার সকালে হামলার শিকার এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর বাড়ি সংস্কারের আশ্বাস দেন রেলপথমন্ত্রী ও পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড নুরুল ইসলাম সুজন। এ সময় তিনি আহমদিয়া নেতাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক লাখ টাকা, শাড়ি ও কম্বল দেন।
এ সময় রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল আলিম মাহমুদ, পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার এমএম সিরাজুল হুদা, আহমদিয়া মুসলিম জামাতের বহিঃসম্পর্ক, গণসংযোগ ও প্রেস বিভাগের প্রধান আহমদ তবশির চৌধুরী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ আহমদিয়া জামায়াতের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় মন্ত্রী বলেন, একটি গোষ্ঠী সব সময় ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নানা ফৌজদারি অপরাধ ঘটাচ্ছে। পঞ্চগড়ে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিএনপি-জামাত যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা একাত্তরের নৃশংসতাকেও হার মানায়। বিএনপি-জামাত নামে-বেনামে গুপ্ত হামলা করে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
গত শুক্রবারের হামলার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছে। পঞ্চগড় জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক জানান, প্রতি বছরই আহমদিয়া সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে জলসা করে আসছে। কিন্তু স্থানীয় মুসল্লিরা তা মেনে নিতে চায় না। প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে, আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে জানমালের ক্ষতি হতো না। তবে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, বিএনপি জামায়াতের লোকজনই এই তাণ্ডব চালিয়েছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ লুটপাটের উদ্দেশ্যেই তাঁরা এ ঘটনা ঘটায়।
সাবেক সাংসদ ও কেন্দ্রীয় জাসদের সেক্রেটারি নাজমুল হক প্রধান বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সেখানে এমন ঘটনা ঘটেছিল। প্রশাসন নীরব দর্শক ছিল মাত্র। এবারেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মজাহারুল হক প্রধান বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। হামলাকারীদের হাতে অস্ত্র ও মুখে গামছা প্যাঁচানো ছিল। বহিরাগতরা পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালিয়েছে। তবে প্রশাসন চেষ্টা করলে বিষয়টি এত দূর গড়াতো না।
এদিকে কথা হলে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ নিয়ে যে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতি আমরা চাইনি। জলসা বন্ধসহ তাদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ করেছি মাত্র।
ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রহমান বলেন, তৃতীয় কোনো শক্তি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে ফিরে এসেছি। এরপর কি ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে তা আমরা জানি না।
ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাফেজ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, হামলার উদ্দেশ্যে আমরা বিক্ষোভ করিনি। আমরা শুধু জলসা বন্ধ করতে চেয়েছি। তবে প্রশাসন বৃহস্পতিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে যদি পদক্ষেপ নিয়ে জলসা বন্ধ করত তাহলে তৃতীয় শক্তি এই হামলার সুযোগ পেত না।
আজ সোমবার বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া ও হামলার শিকার ঘরবাড়িগুলোর ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে। যে বাড়িগুলোতে হামলা চালানো হয়নি তাঁরা বাড়িতে থাকলেও তেমন বাইরে বের হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্রাম পুলিশেরা এলাকাগুলো ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন।
ফুলতলা গ্রামের স্বামীহারা গৃহবধূ তহুরা বেগম বলেন, ‘স্বামী ছাইড়া গেছে চাইর বছর। দুই ছাওয়াল নিয়া বাবার একটা ভাঙা ঘরে সেলাই করি পেট চালাইতাম। ওরা আগুন দিয়া সব পুড়াই দিছে। চার দিন থাকি একবেলা খিচড়ি খায়া আছি। সরকারি কোনো লোক আইসে নাই। সহযোগিতা করে নাই। আমার বাঁচার সম্বল হারাই গেছে।’
তহুরার বাবা-ভাইসহ পরিবারের ৫টি ঘরের সব পুড়ে গেছে। কিন্তু দুই হাত গাঁ ঘেঁষা রমিছা বেগমের বাড়িতে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কথা হলে রমিছা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চোখের সামনে দাউ দাউ করি সব পুড়ছে। কিছুই কইরার পাই নাই। মুখে-চোখে কাপড় বান্ধি ডিজেল-পেট্রল, মবিল ছিটিয়া আগুন ধরা দিছে।’
তহুরার পাশেই রওশন আরার বাড়ি। আহমদিয়া সম্প্রদায়ে নয় তাই তাঁর বাড়িও বেঁচে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী এই নারী বলেন, ‘হু হু করে ১৮-৪৫ বছর বয়সী লোকজন গ্রামে ঢুকে পড়ে। আহমদিয়ারা তখন জলসায়। এমন অবস্থা যে, তাঁদের ঘরে কেউ থাকলে তাঁরাসহ পুড়ে যেত। জুস, আরসির বোতলে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগায় তাঁরা। ঘরহারা মানুষগুলো এখন গ্রাম ছেড়ে রংপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। কারেন্ট নাই, অন্ধকারে ফাঁকা গ্রামে রাতের বেলায় খুব ভয় হয়। কেউ যদি ক্ষতি করে।’
ওই গ্রামের সুজন আলী এনজিও থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ইজিবাইক কিনেছিলেন। আগুনে তাঁর বাড়িঘরসহ ইজিবাইকটি পুড়ে গেছে। এখন পড়নে শার্ট-লুঙ্গি ছাড়া কিছুই নেই। সুজন আলী জানান, সপ্তাহে ৪ হাজার ৬০০ টাকা কিস্তি। আইজ (সোমবার) সকালে ফিল্ডম্যান আসছিল, ঘুরে গেছে। এই ঋণ এখন কীভাবে শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না। সরকারের সহযোগিতা দরকার।
ঘটনার চার দিনেও সরকারি কোনো সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্তরা না পেলেও বিকেল ৩টার দিকে ফুলতলা বাজার এলাকা বিংহারী ইউনিয়নের এক গ্রামপুলিশকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে দেখা যায়। এ সময় গ্রাম পুলিশ আজগার আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইউএনওর নির্দেশে চেয়ারম্যান আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে পাঠিয়েছে। আমরা গ্রাম ঘুরে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি। তবে অধিকাংশ বাড়িতে লোকজন না থাকায় তালিকা করতে সময় লাগছে।’
আহমদিয়া মুসলিম জামাতের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘থাকার জায়গা ও নিরাপত্তা নেই। তাই লোকজন বাড়ি ফিরছেন না। ১৭৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। যে দুই চারজন মসজিদে আছেন তাদের আমরা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াচ্ছি। পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরতে চাচ্ছেন না। একটি হত্যা মামলা থানায় নথিভুক্ত হয়েছে। অন্যান্য মামলাগুলো দায়ের প্রক্রিয়া চলছে।’
পুলিশ বলছে, ‘সালানা জলসা’ বন্ধকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, সরকারি কাজে বাঁধা ও গুজব রটানোসহ পৃথক ৬টি মামলায় নাম ও অজ্ঞাত ৮ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৬টি মামলার মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে ৪টি, একটি র্যাব-১৩ ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ১টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে শনিবার ৩টি ও রোববার ৩টি মামলা করা হয়।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, ৬টি মামলায় ৮১ জন এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। নিরপরাধ সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে জন্য ভিডিও ফুটেজ দেখে, সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বর্তমানে পুলিশি নিয়ন্ত্রণে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখা, সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের নেতা-কর্মীরা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়।
এরপর শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করেন ইসলামি আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ সময় মিছিলে বাধা দেওয়ায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুজন নিহত হয়েছেন। এরপর শনিবার রাতে ফের গুজব রটিয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর পুরো এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গতকাল রোববার ৩৬ ঘণ্টা পর ইন্টারনেট সেবা সচল করা হয়।
নিজেদের অবস্থান জানান দিতে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদসহ আশপাশের সড়কে বড় জমায়েত করে গতকাল শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করেছেন তাবলিগ জামায়াতের সাদপন্থীরা। নামাজ শেষে যাওয়ার আগে আগামী ৭ ডিসেম্বর বড় জমায়েতের ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
২ ঘণ্টা আগেনারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন মাসুম হত্যায় আরও এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার সকালে রুকু আক্তার নামের ওই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়
২ ঘণ্টা আগেনারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গত বুধবার উদ্ধার হওয়া খণ্ডবিখণ্ড লাশটি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন মাসুমের (৬২)। তিনি ফতুল্লার চাঁদ ডাইং ফ্যাক্টরির মালিক। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় রুমা আক্তার নামের এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
৩ ঘণ্টা আগেরাজশাহীতে মাসব্যাপী তাঁতবস্ত্র ও কুটিরশিল্প মেলা শুরু হয়েছে। আজ শুক্রবার বিকেলে নগর ভবনের গ্রিন প্লাজায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম শরীফ উদ্দিন প্রধান অতিথি হিসেবে এ মেলার উদ্বোধন করেন।
৪ ঘণ্টা আগে