বইয়ের চেয়ে তাস কেনায় বরাদ্দ বেশি

  • ইউএসএইড থেকে পুরোনো আসবাব ক্রয়
  • ভাড়া করা খেলোয়াড়ে টুর্নামেন্টে অংশ নেয় টাউন ক্লাব
  • তাস খেলায় বছরে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়, বই কেনায় বরাদ্দ অপ্রতুল
  • ঠিক সময়ে বেতন পাচ্ছেন না কর্মচারীরা
জাহিদ হাসান, যশোর 
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০: ৪৭
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১: ১৪
ছবি: সংগৃহীত

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছিল অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতে প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষী যশোর ইনস্টিটিউট। একটা সময় যশোরের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগৎ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে মাতৃস্থানীয় এ সংগঠন। এটির ছায়াতলে বিকশিত হয় নাট্যাঙ্গন, ক্রীড়াঙ্গন। কিন্তু কালের আবর্তে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যশোর ইনস্টিটিউটের প্রতিটি বিভাগ এখন কাঠামোসর্বস্ব। এমনকি বই কেনার চেয়ে তাস কেনায় বরাদ্দ বেশি দেওয়া হচ্ছে এখন।

বিভিন্ন সম্পত্তি থেকে যশোর ইনস্টিটিউটের বার্ষিক আয়ের পরিমাণও একেবারে কম নয়। অথচ কয়েক বছর আগে বিদেশি একটি সংস্থা ইউএসএইড (ইউনাইটেড স্টেট এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) থেকে লক্ষাধিক টাকার পুরোনো আসবাবপত্র কেনা হয়। আর পুরোনো এসব জিনিস কেনা নিয়ে সে সময়কার সদস্যদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

যশোর ইনস্টিটিউটের সাবেক সহসভাপতি বিশিষ্ট ক্রীড়াব্যক্তিত্ব এ জেড এম সালেক স্বপন বলেন, তাঁর সময়কালে ও অতীতে প্রতিষ্ঠানটির জন্য কখনো কোনো পুরোনো আসবাব কেনা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। পুরোনো আসবাব কেনার বিষয়টি যশোর ইনস্টিটিউটের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বেমানান।

খেলোয়াড় ভাড়া টাউন ক্লাবের

যশোর ইনস্টিটিউটের অন্যতম শাখা টাউন ক্লাব। প্রতিষ্ঠানটির এ বিভাগের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শহর, উপশহর ও গ্রামবাংলা থেকে নবীন ও অপরিচিত খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে যশোরসহ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত করানো। কিন্তু এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারছে না বিভাগটি। ইনস্টিটিউট ঘনিষ্ঠ অনেকের এমন অভিযোগ। তাঁদের দাবি, টাউন ক্লাব থেকে এখন আর কোনো খেলোয়াড় সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও টুর্নামেন্টে ক্লাবটি অংশ নিচ্ছে ঠিকই; তবে ওই সব খেলায় অংশগ্রহণকারী একজনও ক্লাবটির নিজস্ব খেলোয়াড় নয়। মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয়ে ভাড়া করা।

খ্যাতিমান ফুটবলার ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুজ্জামান বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে খুব নামকরা ছিল টাউন ক্লাব। দেশ স্বাধীনের পর সেই সুনাম ধরে রেখেছিল ক্লাবটি। যশোরের সেরা খেলোয়াড়েরা ক্লাবটিতে খেলত। কিন্তু ধীরে ধীরে এখন সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ক্লাবটি। একটা সময় শিশু চিত্তবিনোদনকেন্দ্র বাচ্চাদের জন্য খেলার আয়োজন করত; কিন্তু সে ধারাবাহিকতা এখন আর নেই।’

বেতনে অনিয়ম

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে সময়মতো বেতন পাচ্ছেন না ২৬ কর্মচারী। আগে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেওয়া হলেও এখন মাসের অর্ধেক পেরিয়ে যাচ্ছে। এতে সমস্যায় পড়ছেন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্বল্প আয়ের মানুষেরা। সাম্প্রতিক কয়েক মাস ধরে ২০ তারিখ পেরিয়ে গেলেও তাঁরা বেতন পাচ্ছেন না।

তাসে বরাদ্দ, বই কেনায় খরচ কম

১৮৫৪ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। তার বহু পরে ১৯২৮ সালে গঠন হয় করা যশোর ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানঘনিষ্ঠ সবার মধ্যে একটি কথার প্রচলন রয়েছে, যশোর পাবলিক লাইব্রেরিকে ঘিরেই মূলত ইনস্টিটিউটের জন্মলাভ ও বিকাশ। অথচ সেই লাইব্রেরিটি আজ অবহেলিত। প্রতিবছর টাউন ক্লাবে তাস কেনার জন্য নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বই কেনায় তার চেয়ে অনেক কম টাকা বরাদ্দ দেয় ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, টাউন ক্লাবে প্রতি মাসে ৩৬ প্যাকেট তাস কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

উপেক্ষিত জড়িত ব্যক্তিরা

যশোর ইনস্টিটিউট গঠনে যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি; তিনি হলেন রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে সংগঠনটির গোড়াপত্তন হয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানও তাঁর ভূসম্পত্তিজুড়ে। অথচ ইনস্টিটিউটে তিনিই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। জানা যায়, বহু ভাষাবিদ, ধর্মশাস্ত্রবিদ, শিক্ষক, আইনজীবী ও রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার উদ্যোগী হয়ে পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ আর্য থিয়েটার ও টাউন ক্লাবের সমন্বয়ে ১৯২৭ সালে পরিপূর্ণ একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এই উদ্যোগের ফলস্বরূপ ১৯২৮ সালে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি মাতৃস্থানীয় সংগঠন যশোর ইনস্টিটিউট আত্মপ্রকাশ করে। ছাত্র মৈত্রীর সাবেক নেতা আহাদ আলী মুন্না বলেন, ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন ও বিকাশে অবদান রাখা ব্যক্তিদের কারও কারও নামে পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠকক্ষ ও কর্নার রয়েছে। কিন্তু যিনি প্রতিষ্ঠানটি গড়লেন; তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি ও জিএসের (জেনারেল সেক্রেটারি) কক্ষে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ছাড়া কোনো স্মৃতিচিহ্ন চোখে পড়ে না। এমনকি তাঁর আবক্ষ মূর্তিটিও এমন এককোণে নির্মাণ করা হয়েছে যে; সেটি সচরাচর সেভাবে চোখে পড়ে না।’

ইনস্টিটিউটের যৌবন ফেরাতে কমিটি কাজ করছে বলে জানান সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু। তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে ইউএসএইড থেকে কোনো জিনিসপত্র কেনা হয়নি। টাউন ক্লাবে অনেক দিন খেলা হচ্ছে না। আন্তবিভাগ খেলাগুলোই চলমান। তাসখেলা হলেও বিগত ৩ বছরে প্রচুর বই কেনা হয়েছে। বিভিন্ন ভাড়াটে ভাড়া ঠিকমতো দেন না। তখন হয়তো ১৫-২০ তারিখ হয়ে যায়। আগে খরচ কম ছিল, এখন দ্বিগুণ বেড়েছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত