দুই কলেজের অধ্যক্ষ জাহিদুলের তুঘলকিকাণ্ড, বহিষ্কারের পর তদন্ত কমিটি গঠন

­যশোর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০: ৪৬
যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জাহিদুল ও তাঁর স্ত্রী নাসরীন পারভীন তানিয়া। ছবি: সংগৃহীত

যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি করার অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ১৪ বছর ধরে কর্মস্থলে না গিয়ে একই সঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে বেতন ভাতা উত্তোলন করেছেন। স্ত্রীকে হিসাব সহকারী পদে নিয়োগ দিয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে ঘরে বসে বেতন তুলেছেন।

স্বামী-স্ত্রীর অনিয়ম দুর্নীতির পথ সহজ করতে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পালাক্রমে সভাপতি পদে বসিয়েছেন বোন ও ভগ্নিপতিকে। তাঁরাই অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলামের দুর্নীতির সহযোগী হিসেবেই থেকেছেন।

সম্প্রতি তাঁদের দুর্নীতির বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলামকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আর অবস্থা বেগতিক দেখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘মডেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের’ অধ্যক্ষ পদ থেকে সরে গেছেন তিনি।

লিখিত অভিযোগে জানা যায়, ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজটির অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলাম। তিনি একই সঙ্গে ২০১০ সাল থেকে মডেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই প্রতিষ্ঠানে ১৪ বছর ধরে নিয়মিত কর্মরত থাকলেও যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজে যান না। কিন্তু মাস শেষে দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই বেতন ভাতা উত্তোলন করেন। যা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ এর স্পষ্ট লঙ্ঘন।

এমপিও নীতিমালার ১১/১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারী একই সঙ্গে একাধিক কোনো পদে/চাকরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না।’

বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের হাত করে বহাল তবিয়তে চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন অধ্যক্ষ জাহিদুল। শুধুই নিজেই অসম্ভবকে সম্ভব করেননি। ২০১০ সালে স্ত্রী নাসরিন পারভীন তানিয়াকে হিসাব সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনিও হেঁটেছেন স্বামীর পথেই। ২০২৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সাড়ে ১৩ বছর কর্মস্থলে না গিয়েও তুলেছেন নিয়মিত বেতন-ভাতা।

অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলাম নিজের অনিয়ম, দুর্নীতি ঢাকতে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বোন জাহিদা ইদ্রিস ও ভগ্নিপতি আরাফাত ইদ্রিসকে পর্যায়ক্রমে পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে বসিয়েছেন। কলেজে না এসেও বছরের পর বছর বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা, সরকারি অংশের বেতন, বিল ও আনুষঙ্গিক বিল দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৬ অক্টোবর অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা)। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দায়িত্ব দেন কলেজের সিনিয়র শিক্ষক ডিএম তবিবর রহমানকে। অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজ। ছবি: আজকের পত্রিকা
যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজ। ছবি: আজকের পত্রিকা

এরপর অভিযোগের প্রমাণ লোপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জাহিদুল ইসলাম। গত ১২ নভেম্বর ভোর ৫টা ৪৫ দিকে কলেজে প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় ও গোপনীয় কাগজপত্র ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে গেছেন বলে থানায় জিডি করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

ম্যানেজমেন্ট কলেজের একাধিক শিক্ষক জানান, এমপিওভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে তিনি শিক্ষকতা ও দায়িত্ব পালন করেন মডেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। ২০১০ সালের পর থেকে তিনি নিয়মিত এমপিওভুক্ত কলেজে আসেন। কলেজের প্রধান নিয়মিত কর্মস্থলে না আসায় কলেজটির কার্যক্রম খুঁড়িয়ে চলছে। কলেজের উন্নয়ন ফান্ড নেই। অভ্যন্তরীণ কোনো কমিটি নেই। স্বামী অধ্যক্ষ ও স্ত্রী হিসাব সহকারী হওয়ায় ঘরে বসে তারা ইচ্ছামতো খরচের বিল উত্তোলন করেন। কলেজের বোন ও ভগ্নিপতি কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর্যায়ক্রমে সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলাম অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কলেজের হিসাব সহকারী ও অধ্যক্ষ জাহিদুলের স্ত্রী নাসরীন পারভীন তানিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কলেজের শিক্ষকেরা ষড়যন্ত্র করছেন। আমরা স্বামী-স্ত্রী নিয়মিত কলেজে যাই। হাজিরা খাতায় সাক্ষরও করা আছে।’

এ বিষয়ে যশোর টেকনিক্যাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে সহকর্মীরাই। আমি নিয়মিত কর্মস্থলে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি মডেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আমাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। আমি সেখানকার অধ্যক্ষ নই, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে আছি। এ জন্য সেখানে যাতায়াত আছে।’

মডেল পলিটেকনিক্যাল কলেজের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগজপত্রে তার সাক্ষর ও অধ্যক্ষ উল্লেখ করা রয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য ওসব উল্লেখ করা হয়েছিল।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত