শিশুশ্রমের মূল কারণ দরিদ্রতা নয়, অসচেতনতা: সংলাপে বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১: ০৬
‘শিশুশ্রম নিরসনে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা: বর্তমান বাস্তবতা ও আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশে আইনগতভাবে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও অসংখ্য শিশু শ্রমদানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। নির্যাতন বা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হতাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক শিশু দীর্ঘসময় ধরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে করে তুলনামূলকভাবে অনেক অল্প বয়সেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে তারা।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংলাপে বক্তাদের আলোচনায় দেশের অবহেলিত শিশুশ্রমিকদের এই বিপন্নতার কথা উঠে আসে। একশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) আয়োজিত এ সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘শিশুশ্রম নিরসনে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা: বর্তমান বাস্তবতা ও আমাদের প্রত্যাশা’।

সংলাপে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন এএসডির প্রকল্প সমন্বয়ক সৈয়দ শাহিনুর রহমান। তিনি এতে বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুসারে বাংলাদেশে ৫-১৭ বৎসর বয়সী কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৬৮ হাজার।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিরসনের লক্ষ্যে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। তা সত্বেও শিশুশ্রমের বিষয়টি এখনো সমস্যা হিসেবে বিরাজমান।

সৈয়দ শাহিনুর রহমান বলেন, শিশুশ্রমের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের (পিতা-মাতা, নিয়োগকারী ইত্যাদি) সচেতনতার অভাব, পারিবারিক দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি ছাড়াও বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিরসনের লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।

সংলাপের মূল নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম বিষয়ে আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) এর দুটি কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করেছে। এগুলো হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম সম্পর্কিত ১৮২ নম্বর কনভেনশন (২০০১ সাল) এবং শিশুদের কাজে প্রবেশের নূন্যতম বয়স বিষয়ক ১৩৮ নম্বর কনভেনশন (২০২২)। এর মাধ্যমে এদেশের সরকার বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও এর অবসান ঘটাতে জরুরিভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

বাংলাদেশের শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছর বয়সের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো ধরনের কাজেই নিয়োগ করা যাবে না এবং ১৮ বৎসর বয়সের নিচের কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা যাবে না। ২০১২ সালের মার্চ মাসে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০ গৃহীত হয়েছে। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটি তালিকা ঘোষণা করা হয়। এতে ৩৮টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তালিকাতে আরও ৫টি কাজ যুক্ত করে মোট ৪৩টি কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সংলাপে আলোচকেরা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কার্যকরভাবে প্রতিরোধ ও নিরসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে গণসচেতনতা সৃষ্টি। আমাদের অভিভাবকদের দায়িত্ব শিশুকে কাজে না পাঠিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠানো। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকও বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। তারপরও অনেক অভিভাবক সন্তানদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে যে কাজে পাঠাচ্ছেন তার পেছনে দরিদ্রতা থাকলেও তা প্রধান কারণ নয়। মূল কারণ অসচেতনতা। এই বাবা–মায়েরা শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সুফল সম্পর্কে জানেন না আস্থা রাখতে পারেন না।

আলোচকেরা অভিমত দেন শুধু আইন করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। মানুষ যদি সচেতন হয় তাহলেই সম্ভব শিশুশ্রম থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্ত করা। এ জন্য দেশের গণমাধ্যমে শিশু অধিকার ও শিশুশ্রম নিরসনের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। শুধু দিবস ভিত্তিক বা গুটিকয়েক সাড়া জাগানো ঘটনার সংবাদ প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নিয়মিত শিশু অধিকার এবং শিশুশ্রম নিরসন বিষয়ক অনুষ্ঠান, সংবাদ ও সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা দরকার।

সংলাপে সভাপতিত্ব করেন এর আয়োজক এএসডির নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারপার্সন শামসুন্নাহার জলী এবং আলোচনায় অংশ নেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল মজুমদার, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর প্রশিক্ষক জিলহাজ উদ্দিন নিপুন, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প কর্মকর্তা হালিমা বেগম, ডিআরইউর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য শাহনাজ পলি, এএসডির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইউ কে এম ফারহানা সুলতানা প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত