গাজীপুরে ৫২ ঘণ্টা পর অবরোধ প্রত্যাহারের ১ ঘণ্টা পরই ফের অবরোধ

গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯: ৫০
গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকার একটি কারখানার শ্রমিকেরাও বেতনের জন্য বিক্ষোভ করছেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

দুই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুরের মালেকের বাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ফের অবরোধ করেছেন টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকেরা। এর আগে তাঁরা টানা ৫২ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন। পরে শ্রম সচিব এক মাসের বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিলে আজ সোমবার দুপুর ২টার পর অবরোধ তুলে নেন। কিন্তু ১ ঘণ্টা পরই ফের আন্দোলনে নামেন।

শ্রমিকেরা বলছেন, ‘আমরা আশ্বাস নয়, বেতন চাই। বেতন দিলেই অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে।’

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, ‘সচিবের আশ্বাসে দুপুর ২টার পর তাঁরা অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে যান চলাচল শুরু হয়। তবে বেলা সোয়া ৩টার দিকে তাঁরা ফের মহাসড়ক অবরোধ করেন।’

আজ দুপুর ১টায় আগামী রোববারের মধ্যে এক মাসের বেতন প্রদান করা হবে বলে আশ্বাস দেন শ্রম সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান। আশ্বাস পেয়ে অবরোধ তুলে নেন শ্রমিকেরা।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) নাজির আহমেদ বলেন, ‘শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে মোবাইলে বক্তব্য রাখেন। এ সময় গাজীপুর সদর উপজেলার ইউএনও, সেনাবাহিনী কর্মকর্তা, জিএমম এডিসি, শিল্প পুলিশ ও আন্দোলনকারী শ্রমিকেরা উপস্থিত ছিলেন। সরকার দায়িত্ব নিয়ে আগামী রোববারের মধ্যে ৬ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দেবে বলে আশ্বাস দেন শ্রম সচিব। শ্রমিকদের অন্যান্য দাবি ও পাওনা কীভাবে, কবে পরিশোধ করা হবে, তা আলোচনার জন্য শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। পর্যায়ক্রমে তাঁদের পাওনা পরিশোধ করা হবে বলে উল্লেখ করেন। পরে শ্রমিকেরা আলোচনা করে অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।’

টানা ৩ দিন সড়ক অবরোধ করে রাখায় মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারীরা যাত্রীরা। চালক, এলাকাবাসী ও সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন।

টানা ৩ দিন মহাসড়ক অবরোধের ফলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক একজন সহসভাপতি এবং বর্তমান দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে দৈনিক ১৩০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রায় ৩০ ভাগ রপ্তানি পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ মোট রপ্তানির প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য এই মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন করা হয়। শনিবার থেকে শুরু হওয়া অবরোধের ফলে মহাসড়কটি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য বিকল্প উপায়ে রপ্তানিকারকদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। এতে রপ্তানিকারকদের সময় বেশি ব্যয় হয়েছে এবং খরচ বেড়েছে। ধারণা করা যায়, দৈনিক মোট রপ্তানির ৪ ভাগের এক ভাগ রপ্তানি বিঘ্নিত হয়েছে। তাহলেও প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ক্ষতি হয়েছে। সেই হিসেবে গত ৩ দিনে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি বিঘ্নিত হয়েছে।’

ময়মনসিংহ থেকে চাঁদপুরগামী হায়দার নামে এক ট্রাক চালক বলেন, ‘দুই দিন ধরে সড়কে রয়েছি। কোথাও যেতে পারছি না, নড়তেও পারছি না।’

মাছ ব্যবসায়ী ফরিদ হোসেন গাজীপুরের মির্জাপুর এলাকা থেকে মাছ নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, রাতে রওনা হয়ে এখানে এসে আটকা পড়েছি। তিনি বলেন, ‘আমার ট্রাকে লক্ষাধিক টাকার মাছ রয়েছে। এগুলো এখনো জ্যাতা (জীবিত) আছে। এগুলো মরে গেলে পচে যাবে। সময়মতো এগুলো বিক্রি করতে না পারলে আমি ফকির হয়ে যাব।’

ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের চালক মুসলেম বলেন, ‘যাত্রীবাহী বাস থেকে যাত্রীরা নেমে গেছে দুদিন আগে কিন্তু বাস আগের স্থানেই রয়েছে। খুব বিরক্ত হয়ে গেছি ভাই। বড় গাড়ি তাই কোনোদিকে ঘোরাতে পারছি না। গাড়ি স্টার্ট দিলে শ্রমিকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে আসে।’

পুলিশ ও শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর মালেকের বাড়ি এলাকায় অবস্থিত টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের গত দুই মাসের বেতন বকেয়া আছে। শ্রমিকেরা দুই মাস ধরেই বেতন দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ কালক্ষেপণ করছে। ২৮ অক্টোবর শ্রমিকেরা আন্দোলন করলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করে। তখন পুলিশ জানায়, নভেম্বরের ৩ তারিখ বেতন পরিশোধ করা হবে। সেই দিন শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ৫ নভেম্বর আবার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ৭ তারিখ বেতন দেবে আশ্বাস দিলে শ্রমিকেরা ফিরে যান। ৭ তারিখ চলে গেলেও শ্রমিকেরা বেতন পাচ্ছেন না। তাছাড়া কারখানা বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ আছে। এসব কারণে শনিবার সকাল থেকে আবারও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা।

শ্রমিকনেতা ও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র শ্রমিক জনতার সংগঠক আরমান হোসাইন বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছি। তারা বলেছেন দুই মাস ধৈর্য ধরেছি আর না। আমাদের কথা হচ্ছে মহাসড়ক অবরোধ রাখায় যে ভোগান্তি হচ্ছে এটি দ্রুত সমাধান করা। আশুলিয়া আর গাজীপুর মিলে ৮-১০টা কারখানায় মূলত ঝামেলা দেখছি। তাদের পাওনাও খুব বেশি না। প্রয়োজনে ওই সকল মালিকদের কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও পাওনা পরিশোধ করুক। আজ আমরা আবারও শ্রমিকদের সঙ্গে বসব।’

সার্বিক বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন বলেন, ‘আমরা সব রকমভাবে চেষ্টা করছি, সমস্যাটির একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য। সে জন্য আমরা বিভিন্ন সংস্থা মিলে একসঙ্গে কাজ করছিলাম। শ্রম সচিব মহোদয় তারই অংশ হিসেবে শ্রমিক ভাইদের এক মাসের বেতন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শ্রমিকেরা প্রথমে মেনে নিলেও পরে আবার মহাসড়ক অবরোধ করেছে বলে শুনেছি। আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। পরবর্তী করণীয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত