জাল দলিলে বনভূমির মালিক সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০৯: ০৬

সরকারি নথিতে জায়গাটি উপকূলীয় বন বিভাগের। প্রায় ছয় দশক আগে নারকেলবাগান করার শর্তে জায়গাটি ২৫ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। কিন্তু ইজারার শর্ত ভেঙে সেখানে শুরু হয় চিংড়ি ও লবণ চাষ। একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী বন্দোবস্তের চেষ্টাও করা হয়। এ নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ আদালত ইজারা বাতিলের রায় দেন।

কিন্তু বেদখল হওয়া সেই জমি রায়ের আট বছর আগেই ফের বেদখল হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের এক বছর আগেই জাল দলিলে তা বিক্রি হয় সালমান এফ রহমানের ছেলের কাছে।

অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ প্রভাব খাটিয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের ২০০ একর জমি ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর দখল করেন। প্রায় ২ কোটি টাকার বাইন ও কেওড়াগাছ কেটে ফের শুরু হয় চিংড়িঘের ও লবণ চাষ। এর আগে জমিটি ছিল ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের দখলে। মাঝে অবশ্য উপকূলীয় বন বিভাগ কিছুদিনের জন্য জায়গার নিয়ন্ত্রণ পেয়েছিল। সে সময় ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজায় সাগরতীরের ওই জমিতে ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিভিন্ন ধাপে ম্যানগ্রোভ বাগান তৈরি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, হারুনুর রশীদ জমিটি দখল করার পর ২০০৯ সালেই বাঁশখালী থানায় মামলা হয়। এ নিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই চিংড়ি ও লবণ চাষ চলতে থাকে। এর জেরে ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগ বাঁশখালী থানায় আবার মামলা করে।

২০১৬ সালের ১১ নভেম্বরে জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে ৯৯ একর জমি বিক্রি করে দেন ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরা। ওই দলিলে ৯ জনের স্বাক্ষর রয়েছে। ক্রেতার নাম রয়েছে এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেডের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান, বাবার নাম সালমান এফ রহমান। বিক্রেতা হিসেবে নাম রয়েছে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশনের হাফেজা বেগমের। এ-সংক্রান্ত জমির দলির আজকের পত্রিকার হাতে রয়েছে।

এভাবে জাল দলিলে উপকূলীয় বন বিভাগের জমি বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টি পরে আদালতে ধরা পড়ে। আইনি লড়াইয়ে উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন ওই জমি ফিরে পেলেও এখনো দখলমুক্ত করতে পারেনি।

এ ব্যাপারে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বন বিভাগের ওই জায়গায় আমাদের পক্ষে হাইকোর্টের রায় আছে। লোক নিয়ে মারামারি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। উচ্ছেদ অভিযান আমাদের কাজ নয়। উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। চিঠির জবাব আমরা এখনো পাইনি।’

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজার খাস খতিয়ানভুক্ত ৯০ একর জমি নারকেলবাগান করার শর্তে ১৯৬৬ সালে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ২৫ বছরের জন্য ইজারা নেয় ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন।

শীষ মোহাম্মদ ও বশির আহমদকে এই ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু নারকেলবাগান না করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ওই জমি লবণ চাষ, চিংড়িঘের এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করায় জেলা প্রশাসন ১৯৬৭ সালে ইজারা বাতিল করে। এর বিরুদ্ধে ইজারাগ্রহীতারা ভূমি আপিল বোর্ডে যান। বোর্ড নারকেলবাগান করার নির্দেশ দিয়ে ইজারা বহাল রাখেন। এরপর ইজারা দেওয়া ও বাতিল নিয়ে বিভিন্ন সময় আইনি লড়াই চলতে থাকে। এর মধ্যেই ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে জমির স্থায়ী বন্দোবস্তের খতিয়ান তৈরি করে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে ১৯৮৭ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়।

ভূমি মন্ত্রণালয় পরের বছর বিভাগীয় কমিশনারকে এক চিঠিতে জমির ইজারা বাতিল এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন বিভাগে অভিযোগ করার নির্দেশনা দেয়। আইনি লড়াইয়ের নানা ধাপ পেরিয়ে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ইজারা চুক্তি বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্র বলেছে, আপিল বিভাগের আদেশ কার্যকর করার জন্য ২০১৮ সালের ১১ মার্চ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ৯৯ একর জমি পুনরুদ্ধারের অনুরোধ জানানো হয়। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জমির বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানানোর জন্য একটি চিঠি বাঁশখালীর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) পাঠানো হয়। তবে আজ পর্যন্ত সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এদিকে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর জমি দখলমুক্ত করতে উদ্যোগী হয় উপকূলীয় বন বিভাগ। ২৬ আগস্ট ওই জমি দখলমুক্ত ঘোষণা করে লাল পতাকা ওড়ায় বন বিভাগ। কিন্তু সেখানে বন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকা অবস্থায়ই পতাকা ছিঁড়ে ফেলেন ছনুয়া ইউপির চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগত হেফাজুল করিম, মফিজুল করিম ও শাহাদাত করিম নামের তিন ব্যক্তি।অভিযোগ প্রসঙ্গে জানার জন্য ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম হারুনুর রশীদকে কল করা হলে তাঁর মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন তিনি।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, বেদখল থাকা বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশনা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, ‘জেলা প্রশাসনে নতুন যোগ দিয়েছি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, ‘আগের প্রশাসন কেন ‍উচ্ছেদ করেনি, তা বলতে পারব না। যত বড় প্রভাবশালী হোক, আমরা সালমান এফ রহমানের দখলে থাকা অবৈধ জমিগুলো উদ্ধার করব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত