চট্টগ্রাম আদালতে দায়ের হওয়া একটি নালিশি মামলায় আসামি করা হয় এক মৃত ব্যক্তিকে। এরপর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোর তদন্ত প্রতিবেদনেও জীবিত হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাঁকে। এর প্রেক্ষিতে আদালত থেকে ওই মৃত ব্যক্তির নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপর ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতেও তৎপর হয় পুলিশ। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তারে? তিনি তো মামলার প্রায় সাড়ে তিন বছর আগেই মারা গেছেন। 

মৃত ওই ব্যক্তি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার মুছাপুর এলাকার মো. শাহজাহান। ঘটনাটি জানাজানি হলে তোলপাড় হয় সর্বত্র। সাত মাস তদন্তের পর মৃত মো. শাহজাহানকে জীবিত দেখিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা ওই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পরিদর্শক (প্রশাসন) কাজী এনায়েত কবীর। 

উল্লেখিত নালিশি মামলার বাদী সন্দ্বীপ উপজেলার আমেরিকা প্রবাসী মোহাম্মদ বাবুল মিয়া। 

আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত বছরের ২৩ মে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই নালিশি মামলা দায়ের করেছিলেন। ওই মামলায় তিনি মৃত ব্যক্তি মো. শাহজাহানসহ ১৬ জনকে বিবাদী করেন। মামলায় বাদীর স্বাক্ষর ও বিভিন্ন ডকুমেন্টে তার নাম ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় বিবাদীদের বিরুদ্ধে। 

নালিশি মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, বাদী বাবুল মিয়া ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করছেন। আসামিরা তাঁর নাম ব্যবহার ও সই জাল করে সিটি স্ক্যাপ প্ল্যানার্স কোম্পানি নামে ভুয়া কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি করেন। এরপর বেশ কয়েকটি অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেন। বিবাদীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি ক্রয়-বিক্রয় এবং জমিতে সুউচ্চ ইমারত নির্মাণের পরিকল্পনা কথা প্রচার করেন। ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপনও দেন। যাতে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়। এভাবে বিবাদীরা প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। 

এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় ফ্ল্যাট ক্রয়কারী এবং ঋণ দাতারা নালিশি মামলার বাদীসহ সংশ্লিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলা থেকে পরিত্রাণ পেতে ভুক্তভোগী আমেরিকা প্রবাসী বাদী হয়ে আদালতে জাল-জালিয়াতির মামলা দায়ের করেন। আদালত ওই মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে গত ২ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবীর। এতে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া সন্দ্বীপের মুসাপুর এলাকার ইকবাল হোছাইন ও খন্দকার শামীম আহমেদকে নামে দুজনকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয় মামলার দায় থেকে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তরা হলেন—সন্দ্বীপ উপজেলার মুছাপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে মো. আরাফাত (৪০), মৃত আব্দুল বাতেনের ছেলে মো. মোমেন (৪৭), মাস্টার শফিক উদ্দিনের ছেলে শিহাব উদ্দিন (৪৩), মো. ইসার ছেলে মো. নাজমুস সাকিব (৪০), মৃত ইয়াছিনের ছেলে মাহবুবুর রহমান (৪৫), এএসএম সুফিয়ানের ছেলে এএসএম রফিকুল ইসলাম (৪১), এসএম সাইফুল ইসলাম (৩৯), ইকরামুল কবিরের ছেলে মোহাররামুল কবির (৪৯), গোপাল চন্দ্র রায়ের ছেলে পীযূষ চন্দ্র রায় (৪০), জাহিদুল ইসলামের মেয়ে সুরাইয়া বেগম (৬১), মৃত মো. ইমরান সওদাগরের ছেলে মো. শাহজাহান (৮০), আবুল খায়েরের মেয়ে জেসমিন মান্নান (৫১), মো. শামসুল আলমের ছেলে শাহরিয়ার মাহমুদ (৩৯) ও রবিউল আলমের ছেলে রাশেদ হোছাইন (৩৫)।
 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের মধ্যে মৃত মো. শাহজাহানের নামও রয়েছে। ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিন বছর পর তাঁকে অভিযুক্ত করে পিবিআই। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সমালোচনার মুখে তদন্ত প্রতিবেদনে থাকা মৃত শাহজাহানকে অব্যাহতি দিতে গত ২০ মার্চ আদালতে আবেদন করেন কাজী এনায়েত কবীর। 

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী জানান, মামলায় উল্লিখিত ঘটনা চূড়ান্তভাবে যাচাই-বাছাই করার জন্য আদালত পিবিআইয়ের কাছে পাঠায়। সেই ঘটনা তদন্তে বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে পিবিআইয়ের সততা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও পেশাদারি থাকা জরুরি। এসবকে তোয়াক্কা না করে যদি পিবিআই তদন্ত পরিচালনা করে তাহলে সেটা সকলের জন্য দুঃখজনক। এখানে নালিশি মামলার বাদীও দায় এড়াতে পারেন না। 

এ বিষয়ে মৃত মো. শাহজাহানের ছেলে মো. শাহীন বলেন, ‘আব্বা মারা গেছেন প্রায় সাড়ে তিন বছর হয়েছে। মৃত বাবার নাম মামলার আরজিতে এবং তদন্ত প্রতিবেদনে আসায় আমরা হতবাক হয়েছি। একই সঙ্গে সামাজিকভাবে অনেক প্রশ্নেরও মুখোমুখি হয়েছি।’

একই বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবীর বলেন, ‘তদন্ত প্রক্রিয়ায় তথ্য আদান-প্রদানে গ্যাপ থাকার কারণে প্রতিবেদনে মৃত ব্যক্তির নাম এসেছে। আদালতে নালিশি মামলা করার সময় বাদীর নজরেও আসেনি বিষয়টি। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর আইন অনুযায়ী পুনরায় আমরা সম্পূরক প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছি। তাই এতে আইনের ব্যত্যয় হয়নি।’