হাজার কোটি টাকার অবৈধ চালান, ঘুষের বিনিময়ে ওলটপালট অভিযোগপত্র

  • অভিযোগপত্রে রাখা, না রাখা নির্ধারণ করে দেন সিআইডির তৎকালীন প্রধান। 
  • ১৩ অবৈধ চালানের মধ্যে দুটিতে মামলা।
  • রিমান্ড ও জবানবন্দিতে নাম না বলতে ধমক।
সবুর শুভ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ১৮
ফাইল ছবি

২০২০ ও ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সিগারেটের ১৩টি অবৈধ ব্যান্ডরোলের চালান আসে। টাকার অঙ্কে এসব চালানের মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে কেবল দুটি চালানের ঘটনায় মামলা হয়। দুই চালানের একটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আরাফাত এন্টারপ্রাইজ এবং অপরটি বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ। এসব চালান জব্দের ঘটনায় বন্দর থানায় দুটি মামলা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমসের পক্ষ থেকে। তবে অভিযোগ উঠেছে, ‘উপরির’ বিনিময়ে ওলটপালট হয়ে যায় মামলার সবকিছু। অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয় মূল হোতাদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আরাফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক আরাফাত হোসেন ও বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের মালিক বাপ্পু বড়ুয়াকে এসব চালানের আমদানিকারক দেখানো হলেও বাস্তবে তাঁরা দুজনই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সবুর লিটনের কর্মচারী। নিজে আড়ালে থেকে কর্মচারীদের দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ব্যান্ডরোল আমদানির কাজটি করে গেছেন লিটন। অবৈধ এ কাজে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁরই ছোট ভাই যুবলীগের কর্মী আবদুল মান্নান খোকন।

দুই মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ এবং আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতেও কৌশলে লিটন ও মান্নানের নাম আসতে দেওয়া হয়নি। জানা গেছে, মামলার দায় থেকে তাঁদের বাদ দিতে সিআইডির তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া লিখিত নির্দেশনা দেন। ওই অফিস আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আরাফাত এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে করা মামলাটিতে। ২০২৩ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর ওই অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন। একই সঙ্গে অভিযোগপত্র দাখিল করে ছায়াকপি ৭ দিনের মধ্যে হেডকোয়ার্টার্সে পাঠাতে বলা হয় ওই নির্দেশনায়।

সিআইডির প্রধানের কথামতো লিটন ও মান্নানকে অভিযোগপত্রে না এনে আনা হয়েছে আমদানিকারক আরাফাত, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মধুমতি অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বাহারুল ইসলাম ও সিঅ্যান্ডএফের কাস্টমস সরকার সরোয়ার আলী এবং হায়দার এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. মেজবা উদ্দিন হায়দারের নাম। এর মধ্যে বাহারুলকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়।

বাহারুল বলেন, ‘সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদের সময় লিটন ও মান্নানের কথা বলতে চাইলে এসব নাম মুখে আনতে মানা আছে। এমন ধমক দেন।’ সিঅ্যান্ডএফ নেতা কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘আমদানি চালানের মধ্যে কী পণ্য আছে, তা জানার অধিকার সংরক্ষণ করে আমদানি ও রপ্তানিকারক। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এ ক্ষেত্রে জানার কথা নয়।’

জানা গেছে, আরাফাত এন্টারপ্রাইজের মামলায় দুই ভাইকে বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর। বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের মামলাটির তদন্ত সিআইডিতে এখনো চলছে।

অবৈধ এসব চালানের গন্তব্য ছিল দুই ভাইয়ের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তারা টোব্যাকো ও বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পানির কারখানা। বন্দর থানায় দায়ের করা উল্লিখিত দুই মামলার মধ্যে একটিতে জব্দ করা কাগজপত্র ও গাড়ির জিম্মা নেন মান্নান নিজে। জিম্মানামায় রয়েছে তাঁর স্বাক্ষরও। জিম্মানামায় খোকন তারা ইন্টারন্যাশনাল ও বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর মালপত্রের কথা উল্লেখ করেন। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান দুটিতে সবুরের সঙ্গে মালিকানায় রয়েছেন মান্নান। এরপরও আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে দুজনের কারও নাম নেই। রাজস্ব ফাঁকি দিতে দুই কর্মচারীকে আমদানিকারক বানানো হয়। কিন্তু দুই ভাইকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদই করেনি সিআইডি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মামলা দুটিতে দুই ভাইকে না জড়াতে কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। সিআইডির তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন কেটে দেন।

মামলার তদন্ত ও মনিটরিংয়ের বিষয়ে সিআইডি চট্টগ্রামের এসপি মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, ‘অভিযোগগুলো ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমের। এ কারণে ঢাকায় থেকে সরাসরি মনিটরিং হয়। এখানে আমাদের মনিটরিংয়ের বিষয় নেই।’

এ বিষয়ে জানতে দুবাইয়ে অবস্থান করা আবদুস সবুর লিটনের মোবাইলে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে হোয়াটসঅ্যাপে ব্যান্ডরোলের মামলায় ঘুরেফিরে আপনাদের নাম আসে কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার নাম আসুক, আমার বাপের নাম আসুক; তাতে আপনার সমস্যা কী। মামলা ২০টি হয়েছে আরও দুটি হবে। আপনার সমস্যা আছে?’ 

আরাফাত এন্টারপ্রাইজের মামলার অভিযোগপত্র প্রদানকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক (ঢাকা) মো. মেহেদী মাকসুদ বলেন, ‘আমি তদন্ত করে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছি।’ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশ অনুযায়ী চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জানেন না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত