রাত নামলেই নদের মাটি লুটের মচ্ছব

  • ট্রলার ও খননযন্ত্র নিয়ে এসে নদের তীরের মাটি লুট
  • অভিযোগ স্থানীয় যুবদলের নেতাদের বিরুদ্ধে
  • সরকার পতনের আগেও একইভাবে লুটের অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০: ১৩
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০: ৫০
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে অবৈধভাবে নদের তীর থেকে মাটি কাটার সময় দুটি ট্রলার ও একটি খননযন্ত্র জব্দ করে গ্রামবাসী। ছবি: আজকের পত্রিকা

কালাবদর নদের তীরের গ্রাম বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ জাঙ্গালিয়া। গভীর রাতে খননযন্ত্রের (এক্সকাভেটর) শব্দে গ্রামটির মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। প্রতিরাতে একদল লোক কয়েকটি ট্রলারে এসে এক্সকাভেটর দিয়ে নদের তীরের মাটি কেটে নিয়ে যায়। গ্রামবাসী ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।

তারা জানায়, মাটি কাটা চক্রের মূল হোতা হলেন যুবদলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা। চরের মাটি কেটে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তাঁরা বিক্রি করছেন। এতে ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদভাঙনের হুমকিতে পড়ছে গ্রাম।

মাটি লুটকারীদের প্রতিরোধে গ্রামবাসী জোট বেঁধে গত শুক্রবার রাতে দুটি ট্রলার ও একটি এক্সকাভেটর জব্দ করে। তাদের অভিযোগ, আটকে রাখা ট্রলার ও এক্সকাভেটর ছেড়ে দেওয়ার জন্য মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন নেতা চাপ দিচ্ছেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদের তীর ও চরের মাটি কেটে বিক্রি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মিজানুর রহমান গাজী ও একই ইউনিয়নের বাসিন্দা উত্তর জেলা যুবদলের সদস্য মুনতাসুর মামুন সোহাগ। তাঁদের পেছনে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা।

স্থানীয়দের কথা বলে জানা গেছে, ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত মাটি দক্ষিণাঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হয়। একটি চক্র রাতের আঁধারে নদের চর ও তীরের মাটি কেটে নিয়ে ঢাকায় সরবরাহ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন দলটির স্থানীয় নেতারা। কিন্তু সরকার পতনের পর বিএনপি ও যুবদলের নেতারা তা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।

জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানিয়েছে, ইউনিয়নের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত কালাবদর নদের তীরে দক্ষিণ জাঙ্গালিয়া গ্রাম। পাশের গ্রামটি হলো শ্রীপুর ইউনিয়নের চরবগী। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিরাতে এক্সকাভেটরসহ একাধিক ট্রলার এসে এই দুই গ্রামের চর থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।

রেজাউল করীম নামের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, প্রতিরাতে ২-৩টি ট্রলারে করে মাটি কাটার শ্রমিকেরা আসছেন। তাঁরা এক্সকাভেটরও সঙ্গে নিয়ে আসেন। সারা রাত মাটি কেটে ট্রলার ভর্তি করে ভোররাতে চলে যায়। গ্রামের লোকজন দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না।

জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর আমির আনিসুর রহমানও দক্ষিণ জাঙ্গালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বলেন, গভীর রাতে নদের তীরের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে একদল ব্যক্তি।

শ্রীপুর ইউনিয়নের গাফফার শেখ নামের একজন বলেন, শুক্রবার রাতে চরবগীতে মাটি কাটা শুরু করলে তিনটি ট্রলারে গ্রামবাসী গিয়ে তাঁদের বাধা দেয়। সেখান থেকে দুটি ট্রলার ও একটি এক্সকাভেটর জব্দ করে শ্রীপুর লঞ্চঘাটে এনে রেখেছে। সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গিয়াস উদ্দিন দিপেন, উত্তর জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সালাউদ্দিন পিকলু ও সদস্য মুনতাসুর মামুন সোহাগসহ কয়েকজন মোবাইল ফোনে কল দেন।

তবে উত্তর জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সালাউদ্দিন পিকলু এ বিষয়ে ফোনে কল দেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, দলের মধ্যে প্রতিপক্ষরা এসব মিথ্যা ছড়াচ্ছেন। মাটি কাটার সঙ্গে যুবদলের কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গিয়াস উদ্দিন দিপেনও আটক ট্রলার ছাড়াতে ফোন দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মাটি কাটার সঙ্গে যুবদলের কেউ জড়িত আছেন কি না, তা খোঁজখবর নিতে স্থানীয় নেতাদের বলেছি।’

অভিযুক্ত যুবদল নেতা মিজানুর রহমান গাজী ও মুনতাসুর মামুন সোহাগ বলেছেন, ‘আমরা এর সঙ্গে জড়িত না। তবে গ্রাম থেকে মাটি চুরি হচ্ছে, এটা ঠিক।’

ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শাহাব উদ্দিন আজাদ বলেন, ‘জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নটিই নদবেষ্টিত। ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়ার নদের কারণে গ্রামগুলো একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন। নদের তীর ও চরের মাটি কেটে ঢাকায় বিক্রির ব্যবসায় আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি দুই-তিনজন যুবদল নেতার লোকজন গভীর রাতে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে গ্রামের লোকজন আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মশিউর রহমান বলেন, গ্রামবাসীর হাতে জব্দ ট্রলার ও এক্সকাভেটর জিম্মায় নিয়ে মামলা করার জন্য থানার ওসিকে বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত