সৈয়দ শামসুল হক ও আপনার যৌথ জীবন এবং দীর্ঘ জার্নির সমাপ্তি হয়েছে ছয় বছর হয়ে গেল। নিশ্চয় খুব মিস করেন তাঁকে। সৈয়দ হকবিহীন সময়গুলো কেমন কাটছে আপনার?
ব্যক্তিগতভাবে বলি, একটা দিনও তাঁকে ভুলিনি। কারণ, প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। তাঁর বই পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে, নতুন সংস্করণ হচ্ছে, বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে নিয়ে কাজ করছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে লেখা চাচ্ছে—এসব কাজে নিজেকেও জড়াতে হচ্ছে।
সম্প্রতি তাঁর ৩৫ খণ্ডের রচনাবলি বের হয়েছে, পুরো পাণ্ডুলিপি দেখে দিতে হয়েছে। সৈয়দ হক সশরীরে নেই, দেখতে দেখতে ছয়টা বছর কীভাবে যেন চলে গেল। জীবন তো একটা চলমান প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার ভেতর আমরা এখনো বর্তমান আছি, তিনি তাঁর কর্মগুণেই আমাদের মাঝে বর্তমান হয়ে আছেন, এক দিনের জন্যও অতীত হননি।
আপনাদের তো একসঙ্গে পথচলার শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। নিঃসন্দেহে দীর্ঘতম জার্নি। আপনাদের কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?
মূলত লেখার মাধ্যমে আমাদের পরিচয়। ‘সচিত্র সন্ধানী’ নামের মাসিক পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা পড়েছিলাম, ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’। লেখাটি আমার কাছে নতুন ও আধুনিক মনে হয়েছিল। পড়ার পর চিন্তা হলো, লেখকের সঙ্গে দেখা হলে তো ভালোই হয়। আমিও তখন লিখি, বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাপা হচ্ছে।
ফলে লেখকের সঙ্গে লেখকের দেখা-পরিচয় হতেই পারে। তারপর তাঁর ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলাম। মাসখানেক পর আমার হোস্টেলের চিঠির বাক্সে হলুদ খামে একটা চিঠি এসে হাজির! আরে, এত সুন্দর ইংরেজি হাতের লেখায় কে আমাকে চিঠি পাঠাল? লেখার কালিটিও ভীষণ সুন্দর! গাঢ় চায়নিজ ইঙ্ক দিয়ে মোটা করে ছবি আঁকার মতো করে আমার নামটি লেখা—আনোয়ারা বেগম চৌধুরী। চিঠি খুলে বিস্ময় আরও বাড়ল। প্রেরক সৈয়দ শামসুল হক, যাঁর লেখা পড়ে আবেগতাড়িত হয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তারপর কোনো উত্তর না পেয়ে ভুলেও গিয়েছিলাম। চিঠিটা কী যে সুন্দর ছিল!
তারপর কি একে অপরের মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়? সৈয়দ হকের চিঠি নিশ্চয় খুবই সাহিত্যমানসম্পন্ন ছিল?
মাঝে-মধ্যে আমরা একে অপরকে চিঠি লিখতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। চতুর্থ বর্ষে পড়ি। বিভিন্ন পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি করি।
সৈয়দ শামসুল হক তখনই নামকরা লেখক ও সিনেমাব্যক্তিত্ব। প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো পত্রিকায় নাম ওঠে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আমি তাঁকে কোনো দিন চোখে দেখিনি। কোনো পত্রিকাতেও তাঁর ছবি চোখে পড়েনি। ফলে তাঁকে দেখার একটা গোপন বাসনা ছিল মনে।
আপনাদের প্রথম দেখার স্মৃতি নিশ্চয় ভোলার নয়। প্রথম দেখার স্মৃতি পাঠকদের কি বলা যায়?
১৯৬৪ সালের দিকে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। একদিন বিকেলে পুরান ঢাকার একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল।
যখন তাঁকে প্রথম দেখলাম, তখন তাঁর চোখ দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম—এমন চকচকে বুদ্ধির ছটায় উদ্ভাসিত চোখ আমি জীবনে দেখিনি। আমার সঙ্গে প্রথম দিনের আলাপে তাঁর সে কী স্বতঃস্ফূর্ত বাক্যালাপ! যেন তিনি আমাকে বহুদিন ধরে চেনেন, বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে আমার পত্রালাপ। মেয়েদের খুব ভালো বুঝতেন, পটাতেও পারতেন। মেয়েদের পটাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। হা হা হা!
সামনা সামনি সৈয়দ হককে প্রথম দেখার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? প্রথম দেখাতেই কি প্রেমে পড়েছিলেন?
আরে নাহ! প্রথম দেখায় প্রেমে পড়িনি, তবে তিনি পড়েছিলেন, সেটা বুঝতে পারছিলাম।
তাঁকে দেখার পর মনটা দোনোমনা হয়ে ছিল। হ্যাঁ কি না, না কি হ্যাঁ অবস্থা আরকি। তিনি ছিলেন রোগা প্রকৃতির, তারপর চোখেও কম দেখতেন। ছিলেন চালচুলোহীন, বোহেমিয়ান মানুষ। জানো তো, তিনি ষোলো বছর বয়সে বাবার ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা হাতিয়ে মুম্বাই চলে গিয়েছিলেন বড়মাপের চলচ্চিত্রকার হবেন বলে। মোটামুটি একরোখা ছিলেন। তারপর দেশে ফিরলেও পড়াশোনা শেষ করেননি—তো, তাঁর সঙ্গে জড়ানো একটু কঠিন ছিল বৈকি। আগে ভাবতাম, আমাকে একজন চিকিৎসককে বিয়ে করতে হবে, নিদেনপক্ষে একজন প্রকৌশলী, মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠেছিল। আর আমার ভাগ্যে এমন একজন ক্যান্ডিডেট! এ তো চোখেই দেখে না, রোজগার করবে কী! ফলে প্রেমের শুরুতে আমার মধ্যে কিছুটা দ্বিধা ছিল। কিছুদিন পর সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব উবেও গিয়েছিল।
যত দূর জানি, বিয়ের ক্ষেত্রে আপনার পরিবারের অসম্মতি ছিল। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এই সাহসিকতার পেছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল?
তারুণ্যের একটা শক্তি আছে, যৌবনের একটা শক্তি আছে, আমি সেই শক্তির ওপর ভর করেই তাঁর সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে যে ভুল করিনি, এটা আমার সব সময়ই মনে হয়। বাবা-মা তো জানতেন না, বুঝতেন না তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের অমত ছিল। সৈয়দ হককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি ওই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম, বিয়েও করেছিলাম। আমি অসাধারণ একজন মানুষকেই বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবেছি, আমি যেহেতু ডাক্তার, সেহেতু দুবেলা খাওয়ার অভাব হবে না। নিজে উপার্জন করতে পারব, পরিবারের হালও ধরতে পারব। ফলে পরিবার প্রাথমিকভাবে রাজি না থাকলেও আমার সাহসিকতায় সবাই সম্মত হয়েছিল।
সৈয়দ শামসুল হকের স্ত্রী হিসেবে কোনো বিশেষ সুবিধা বা অসুবিধায় পড়তে হয়েছে? অনেকে বলেন, আপনার লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্তির পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল।
মানুষ কত কিছুই তো বলে আড়ালে-আবডালে! অনেক মেয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলেছেন, এমন লেখা আমরাও লিখতে পারি, যদি আমাদের সৈয়দ হকের মতো স্বামী পাশে থাকতেন। এটা যে কত বড় ভুল কথা! সৈয়দ হকের সঙ্গে বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমি লেখালেখি করি। তারপর যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তাম, তখন তো অনেক লিখেছি। বিয়ের পর এক ছাদের নিচে থাকলেও আমরা লেখক হিসেবে ছিলাম সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি শুনে অবাক হবে, আমরা একে অপরের পাণ্ডুলিপি পড়তাম না। লেখা বা বই প্রকাশ হওয়ার পর পড়তাম। লেখার ক্ষেত্রে তিনি কখনো আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। পুরস্কারের কথা বললে তো, আমার কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তাঁর ভূমিকা নেই। আমি তো অনেক পরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলাম, আমার ৭০ বছর বয়সে। অথচ সৈয়দ শামসুল হক ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি এত প্রভাবশালী লেখক ছিলেন যে আমি ৪০ বছরের মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার তদবির করাতে পারতাম। তা আমি করিনি। তিনি মারা যাওয়ার পর আমি একুশে পদক পেয়েছি। তখন তো আমার ধরাধরি করারও কেউ নেই। আমি মনে করি, আমি কষ্ট করে এসব অর্জন করেছি। এখন এসে আমি বুঝি যে সৈয়দ হকও সেটাই চেয়েছিলেন।
লেখক হিসেবে, স্বামী হিসেবে কীভাবে সৈয়দ হককে মূল্যায়ন করবেন? তাঁর লেখক সত্তা ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কি সাঁকোবন্ধন ছিল? নাকি দুটি সত্তা আলাদা ছিল?
লেখক সত্তা ও ব্যক্তিসত্তা অধিকাংশ সময় এক হয় না, কিছুটা ভিন্নতা হয়। সৈয়দ হকের দুটি সত্তার মধ্যেও কিছুটা ভিন্নতা ছিল। তাঁর লেখক সত্তাকে আমি শ্রদ্ধা করেছি সব সময়। লেখক হিসেবে তিনি কোন মাপের ছিলেন, সেটা আমার বলা ঠিক হবে না। লেখক হিসেবে তাঁর বিশালত্ব আমি ব্যাখ্যা করব না। পাশে থাকলেই একজন মানুষের সব বিষয়ে, সবকিছু মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। রবীন্দ্রনাথের আশপাশেও তো অনেকে ছিলেন। তাই বলে সবাই কি রবীন্দ্রনাথের বিশালত্বকে যথাযথ মূল্যায়ন বা ধারণ করতে পেরেছেন? না, পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে বলব, তিনি লেখক হিসেবে যত বড় ছিলেন, স্বামী হিসেবে তার চেয়েও বড় মাপের মানুষ ছিলেন। আমাকে কখনো অশ্রদ্ধা করেননি, অসম্মান করেননি। আমার যে একটি লেখক সত্তা আছে, সেটা তিনি কোনো দিনই কোনো দিক থেকে বাধাগ্রস্ত করেননি। তাঁর সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব বাধানোর চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। সেসব নাম বললে তোমরা অবাক হবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি, ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়নি। আমরা একে অপরকে কখনো প্রতিযোগী মনে করিনি, সহযোগী মনে করেছি। তোমাকে একটা কথা বলি, সৈয়দ হকের মুখে আমি কোনো দিন কোনো গালি শুনিনি। আমাকে তো গালি দেননি, কখনো কাউকে গালি দিতেও শুনিনি। তাহলে বোঝো, তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। সব মিলিয়ে আমাদের জার্নি ছিল সুখে-দুঃখে মিলিয়ে রোমাঞ্চকর ও সৃষ্টিশীল।
সৈয়দ শামসুল হক ও আপনার যৌথ জীবন এবং দীর্ঘ জার্নির সমাপ্তি হয়েছে ছয় বছর হয়ে গেল। নিশ্চয় খুব মিস করেন তাঁকে। সৈয়দ হকবিহীন সময়গুলো কেমন কাটছে আপনার?
ব্যক্তিগতভাবে বলি, একটা দিনও তাঁকে ভুলিনি। কারণ, প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। তাঁর বই পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে, নতুন সংস্করণ হচ্ছে, বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে নিয়ে কাজ করছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে লেখা চাচ্ছে—এসব কাজে নিজেকেও জড়াতে হচ্ছে।
সম্প্রতি তাঁর ৩৫ খণ্ডের রচনাবলি বের হয়েছে, পুরো পাণ্ডুলিপি দেখে দিতে হয়েছে। সৈয়দ হক সশরীরে নেই, দেখতে দেখতে ছয়টা বছর কীভাবে যেন চলে গেল। জীবন তো একটা চলমান প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার ভেতর আমরা এখনো বর্তমান আছি, তিনি তাঁর কর্মগুণেই আমাদের মাঝে বর্তমান হয়ে আছেন, এক দিনের জন্যও অতীত হননি।
আপনাদের তো একসঙ্গে পথচলার শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। নিঃসন্দেহে দীর্ঘতম জার্নি। আপনাদের কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?
মূলত লেখার মাধ্যমে আমাদের পরিচয়। ‘সচিত্র সন্ধানী’ নামের মাসিক পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা পড়েছিলাম, ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’। লেখাটি আমার কাছে নতুন ও আধুনিক মনে হয়েছিল। পড়ার পর চিন্তা হলো, লেখকের সঙ্গে দেখা হলে তো ভালোই হয়। আমিও তখন লিখি, বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাপা হচ্ছে।
ফলে লেখকের সঙ্গে লেখকের দেখা-পরিচয় হতেই পারে। তারপর তাঁর ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলাম। মাসখানেক পর আমার হোস্টেলের চিঠির বাক্সে হলুদ খামে একটা চিঠি এসে হাজির! আরে, এত সুন্দর ইংরেজি হাতের লেখায় কে আমাকে চিঠি পাঠাল? লেখার কালিটিও ভীষণ সুন্দর! গাঢ় চায়নিজ ইঙ্ক দিয়ে মোটা করে ছবি আঁকার মতো করে আমার নামটি লেখা—আনোয়ারা বেগম চৌধুরী। চিঠি খুলে বিস্ময় আরও বাড়ল। প্রেরক সৈয়দ শামসুল হক, যাঁর লেখা পড়ে আবেগতাড়িত হয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তারপর কোনো উত্তর না পেয়ে ভুলেও গিয়েছিলাম। চিঠিটা কী যে সুন্দর ছিল!
তারপর কি একে অপরের মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়? সৈয়দ হকের চিঠি নিশ্চয় খুবই সাহিত্যমানসম্পন্ন ছিল?
মাঝে-মধ্যে আমরা একে অপরকে চিঠি লিখতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। চতুর্থ বর্ষে পড়ি। বিভিন্ন পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি করি।
সৈয়দ শামসুল হক তখনই নামকরা লেখক ও সিনেমাব্যক্তিত্ব। প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো পত্রিকায় নাম ওঠে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আমি তাঁকে কোনো দিন চোখে দেখিনি। কোনো পত্রিকাতেও তাঁর ছবি চোখে পড়েনি। ফলে তাঁকে দেখার একটা গোপন বাসনা ছিল মনে।
আপনাদের প্রথম দেখার স্মৃতি নিশ্চয় ভোলার নয়। প্রথম দেখার স্মৃতি পাঠকদের কি বলা যায়?
১৯৬৪ সালের দিকে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। একদিন বিকেলে পুরান ঢাকার একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল।
যখন তাঁকে প্রথম দেখলাম, তখন তাঁর চোখ দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম—এমন চকচকে বুদ্ধির ছটায় উদ্ভাসিত চোখ আমি জীবনে দেখিনি। আমার সঙ্গে প্রথম দিনের আলাপে তাঁর সে কী স্বতঃস্ফূর্ত বাক্যালাপ! যেন তিনি আমাকে বহুদিন ধরে চেনেন, বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে আমার পত্রালাপ। মেয়েদের খুব ভালো বুঝতেন, পটাতেও পারতেন। মেয়েদের পটাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। হা হা হা!
সামনা সামনি সৈয়দ হককে প্রথম দেখার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? প্রথম দেখাতেই কি প্রেমে পড়েছিলেন?
আরে নাহ! প্রথম দেখায় প্রেমে পড়িনি, তবে তিনি পড়েছিলেন, সেটা বুঝতে পারছিলাম।
তাঁকে দেখার পর মনটা দোনোমনা হয়ে ছিল। হ্যাঁ কি না, না কি হ্যাঁ অবস্থা আরকি। তিনি ছিলেন রোগা প্রকৃতির, তারপর চোখেও কম দেখতেন। ছিলেন চালচুলোহীন, বোহেমিয়ান মানুষ। জানো তো, তিনি ষোলো বছর বয়সে বাবার ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা হাতিয়ে মুম্বাই চলে গিয়েছিলেন বড়মাপের চলচ্চিত্রকার হবেন বলে। মোটামুটি একরোখা ছিলেন। তারপর দেশে ফিরলেও পড়াশোনা শেষ করেননি—তো, তাঁর সঙ্গে জড়ানো একটু কঠিন ছিল বৈকি। আগে ভাবতাম, আমাকে একজন চিকিৎসককে বিয়ে করতে হবে, নিদেনপক্ষে একজন প্রকৌশলী, মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠেছিল। আর আমার ভাগ্যে এমন একজন ক্যান্ডিডেট! এ তো চোখেই দেখে না, রোজগার করবে কী! ফলে প্রেমের শুরুতে আমার মধ্যে কিছুটা দ্বিধা ছিল। কিছুদিন পর সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব উবেও গিয়েছিল।
যত দূর জানি, বিয়ের ক্ষেত্রে আপনার পরিবারের অসম্মতি ছিল। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এই সাহসিকতার পেছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল?
তারুণ্যের একটা শক্তি আছে, যৌবনের একটা শক্তি আছে, আমি সেই শক্তির ওপর ভর করেই তাঁর সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে যে ভুল করিনি, এটা আমার সব সময়ই মনে হয়। বাবা-মা তো জানতেন না, বুঝতেন না তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের অমত ছিল। সৈয়দ হককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি ওই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম, বিয়েও করেছিলাম। আমি অসাধারণ একজন মানুষকেই বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবেছি, আমি যেহেতু ডাক্তার, সেহেতু দুবেলা খাওয়ার অভাব হবে না। নিজে উপার্জন করতে পারব, পরিবারের হালও ধরতে পারব। ফলে পরিবার প্রাথমিকভাবে রাজি না থাকলেও আমার সাহসিকতায় সবাই সম্মত হয়েছিল।
সৈয়দ শামসুল হকের স্ত্রী হিসেবে কোনো বিশেষ সুবিধা বা অসুবিধায় পড়তে হয়েছে? অনেকে বলেন, আপনার লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্তির পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল।
মানুষ কত কিছুই তো বলে আড়ালে-আবডালে! অনেক মেয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলেছেন, এমন লেখা আমরাও লিখতে পারি, যদি আমাদের সৈয়দ হকের মতো স্বামী পাশে থাকতেন। এটা যে কত বড় ভুল কথা! সৈয়দ হকের সঙ্গে বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমি লেখালেখি করি। তারপর যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তাম, তখন তো অনেক লিখেছি। বিয়ের পর এক ছাদের নিচে থাকলেও আমরা লেখক হিসেবে ছিলাম সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি শুনে অবাক হবে, আমরা একে অপরের পাণ্ডুলিপি পড়তাম না। লেখা বা বই প্রকাশ হওয়ার পর পড়তাম। লেখার ক্ষেত্রে তিনি কখনো আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। পুরস্কারের কথা বললে তো, আমার কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তাঁর ভূমিকা নেই। আমি তো অনেক পরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলাম, আমার ৭০ বছর বয়সে। অথচ সৈয়দ শামসুল হক ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি এত প্রভাবশালী লেখক ছিলেন যে আমি ৪০ বছরের মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার তদবির করাতে পারতাম। তা আমি করিনি। তিনি মারা যাওয়ার পর আমি একুশে পদক পেয়েছি। তখন তো আমার ধরাধরি করারও কেউ নেই। আমি মনে করি, আমি কষ্ট করে এসব অর্জন করেছি। এখন এসে আমি বুঝি যে সৈয়দ হকও সেটাই চেয়েছিলেন।
লেখক হিসেবে, স্বামী হিসেবে কীভাবে সৈয়দ হককে মূল্যায়ন করবেন? তাঁর লেখক সত্তা ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কি সাঁকোবন্ধন ছিল? নাকি দুটি সত্তা আলাদা ছিল?
লেখক সত্তা ও ব্যক্তিসত্তা অধিকাংশ সময় এক হয় না, কিছুটা ভিন্নতা হয়। সৈয়দ হকের দুটি সত্তার মধ্যেও কিছুটা ভিন্নতা ছিল। তাঁর লেখক সত্তাকে আমি শ্রদ্ধা করেছি সব সময়। লেখক হিসেবে তিনি কোন মাপের ছিলেন, সেটা আমার বলা ঠিক হবে না। লেখক হিসেবে তাঁর বিশালত্ব আমি ব্যাখ্যা করব না। পাশে থাকলেই একজন মানুষের সব বিষয়ে, সবকিছু মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। রবীন্দ্রনাথের আশপাশেও তো অনেকে ছিলেন। তাই বলে সবাই কি রবীন্দ্রনাথের বিশালত্বকে যথাযথ মূল্যায়ন বা ধারণ করতে পেরেছেন? না, পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে বলব, তিনি লেখক হিসেবে যত বড় ছিলেন, স্বামী হিসেবে তার চেয়েও বড় মাপের মানুষ ছিলেন। আমাকে কখনো অশ্রদ্ধা করেননি, অসম্মান করেননি। আমার যে একটি লেখক সত্তা আছে, সেটা তিনি কোনো দিনই কোনো দিক থেকে বাধাগ্রস্ত করেননি। তাঁর সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব বাধানোর চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। সেসব নাম বললে তোমরা অবাক হবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি, ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়নি। আমরা একে অপরকে কখনো প্রতিযোগী মনে করিনি, সহযোগী মনে করেছি। তোমাকে একটা কথা বলি, সৈয়দ হকের মুখে আমি কোনো দিন কোনো গালি শুনিনি। আমাকে তো গালি দেননি, কখনো কাউকে গালি দিতেও শুনিনি। তাহলে বোঝো, তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। সব মিলিয়ে আমাদের জার্নি ছিল সুখে-দুঃখে মিলিয়ে রোমাঞ্চকর ও সৃষ্টিশীল।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪