সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
সকালের নাশতা খাওয়ার সময়ও মুখে রুচি ফিরল না। বরাবরের মতো আমি জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করলাম আর ভুবন পারল না। সারা দিন ধরে ওঁকে বলতে লাগলাম পিয়ালকে ফোন দিতে। সমবয়সী কেউ এসে দেখা করলে অন্তত মনটা একটু ভালো হয়। পিয়াল সাহা আমাদের ব্যাচমেট। বারো-চৌদ্দ বছরে ওর চেহারাটা ভুলে গিয়েছিলাম। নামটা পর্যন্ত মনে ছিল না। কিন্তু যেদিন গ্যাংটক থেকে লাচুং যাব, সেদিন হঠাৎ করেই ফোন দিয়েছিল ভুবনকে। ফেসবুকে ভুবনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ভুবন ফেসবুকে চেক-ইন দেওয়ায় পিয়াল নিজে থেকে ফোন করে জানিয়েছিল সে গ্যাংটকে আছে। পরে লাচুংয়ে রওনা দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে এসে দেখা করে গিয়েছিল। আমাদের কিছু ডলার ভাঙানোর দরকার ছিল। ছেলেটা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রুপি দিয়ে ডলার নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘আরও টাকা লাগলে আমাকে বলিস। ছোটখাটো ব্যবসা আছে আমার শিলিগুড়িতে। মন্দ কামাই না।’ এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই নাকি শিলিগুড়িতে এসে বসবাস শুরু করেছে পিয়াল। সেখানে নিজের ভালোই পরিচিতি আছে তার। এক বন্ধুকে গ্যাংটক পর্যন্ত বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ভুবনকে বলছিল, ‘আরে, তুই এখানে বেড়াবি, আমাকে আগে বলবি না? বন্ধু হয়ে এতটুকু উপকার কি করতে পারব না? তোদের সব ব্যবস্থা অল্প খরচে করে দিতাম।’ ভুবন লজ্জায় শুধু বলল, ‘সরি দোস্ত, একদম মাথায় ছিল না তুই যে এখানে।’ পিয়াল বারবার করে বলে দিয়েছিল যেকোনো সমস্যা হলে ওকে জানাতে। তাই ওকে ফোন দেওয়ার জন্য ভুবনকে খোঁচাচ্ছিলাম। অচেনা জায়গায় বড্ড অসহায় লাগছিল আমার। সেই সঙ্গে ভুবনের অবস্থার অবনতি আমাকে আরও বেশি কাবু করে দিচ্ছিল। আমি মনের জোরে সুস্থ থেকে ওর সেবা করার চেষ্টা করছিলাম। আমার জ্বর সেদিন চলে গিয়েছিল। ভুবনের অবস্থা খারাপ। শেষমেশ পিয়ালকে ফোন দিল ভুবন। পিয়াল জানাল কাজের অনেক চাপ, কিন্তু শেষ করে আসবে যত রাতই হোক। আমাকে আমার সহকর্মী দেবারতি দিদি ফোন দিলেন। ‘তোমরা এত অসুস্থ আগে জানাওনি কেন? আহারে, আমি মুম্বাই থেকে এত দূর আসতেও পারছি না।’ আফসোস করছিলেন তিনি। আমি তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম প্রার্থনা করতে।
দুপুরে সৌরভ ভাইয়েরা চলে যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছিলেন। আমরা কিছুই খেতে পারছিলাম না বলে সৌরভ ভাই লেক্সাস বিস্কুটের বড় একটা প্যাকেট আর আলুর বিস্কুটের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, রীতিমতো জোর করে। সঙ্গে সেই সুন্দর বোতলটায় পানি ভরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে গেলেন। পানিটা দুজনে মিলেই খেয়েছিলাম। বোতলে অর্ধেক পানি রয়ে গিয়েছিল। সেটা আবার বাংলাদেশে বয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
সকালের দিকে একবার মিলন ভাই দেখা করে খোঁজ নিয়ে গিয়েছিলেন। দুপুরের পর আবার এসেছিলেন অমরদাকে সঙ্গে নিয়ে। অমরদা খুব দুঃখ প্রকাশ করছিলেন সময়মতো খোঁজ নিতে পারছিলেন না বলে। আবার গেলে যেন তাঁকে ফোন করি, সে কথাও বললেন। কথায় কথায় জানালেন, তিনি আসলে আমাদের বাংলাদেশেরই নাগরিক। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতের বাসিন্দা। এখন নাকি ভারতেরও নাগরিকত্ব আছে। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর যেমন মায়া আছে, আছে অভিমানও কিছুটা। কেন এই অভিমান? অমরদা বলছিলেন, ‘আমার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। আমি চাকরি করতাম গ্রামীণ ফোনে। বেশ ভালোই সংসার চলছিল আমাদের। একদিন আমার স্ত্রীর পানি ভেঙে গেল। সঙ্গে প্রচুর রক্ত যাচ্ছিল। বিশ্বাস করেন, আমি এত রক্ত আগে দেখি নাই। দুই হাতে স্ত্রীকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ছুটলাম হাসপাতাল যাব বলে। সিঁড়ির গায়ে রক্ত গড়াচ্ছিল। আমি অসহায়ের মতো নামছিলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছিল, কারণ তখন আমার স্ত্রীর শরীর অনেক ভারী হয়ে গিয়েছিল। ওঁকে নিয়ে ঠিকমতো চলতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল পৌঁছালে চিকিৎসকেরা জানালেন মা অথবা বাচ্চা যেকোনো একজনকে বাঁচাতে হবে। এসব তো সিনেমায় দেখতাম রে ভাই। আমি বললাম, আমার বাচ্চার দরকার নাই। আমার স্ত্রীকে বাঁচান। আমার স্ত্রী বেঁচে যায়। কিন্তু তাঁদের কিছু ভুল চিকিৎসার কারণে পরে আবারও আমার স্ত্রীকে অনেক অসুস্থ হয়ে যেতে হয়। তাই অভিমান করে দেশ, চাকরি ছেড়ে চলে আসি ভারতে। এখানে এসে স্ত্রীর চিকিৎসা করালাম। এবার সেটা সঠিক হলো। ডাক্তাররাও ভালো। আমি এদিকে এসে শুরু করলাম ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ। কাজটা আমি আনন্দ নিয়ে করি। খারাপ লাগে না। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। একেক জন একেক রকম। কিন্তু কেউ খুব অপমান করলেও সহ্য করে থাকি। আমাদের সহ্য করে থাকতে হয়। এ কাজে রেগে গেলে হেরে যেতে হবে। বিনয়ী হতে হয়। এখন আমার একটা মেয়ে আছে। সুখেই আছি। জীবন মন্দ না।’ বলতে বলতে অমরদার চোখ ভিজে আসছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তিনি বাংলাদেশকে খুব মনে করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু ওই যে অভিমান। দেশে তাঁর আত্মীয়স্বজন আছে। সময় পেলে বেড়াতে যান।
অমরদার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। ভুবন অনুরোধ করল, ‘দাদা আমাকে একটু আনারসের জুস এনে দেবেন, যদি কিছু মনে না করেন! আমরা তো বাইরে যেতে পারছি না।’ অমরদা খুশি হয়ে বললেন, ‘কেন দেব না? জ্বরের মুখে আনারস তো খুব ভালো। আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।’ বলে তিনি বের হয়ে গেলেন। দুই লিটারের পানির বোতলে আনারসের জুস নিয়ে দুলতে দুলতে ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পর। এতগুলো! কে খেয়ে শেষ করবে? আর এই রাতটাই তো হাতে আছে আমাদের। পরদিন দেশে ফিরে যাব। কিন্তু অমরদা বারবার বলছিলেন, ‘ভাই, আপনারা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত দয়া করে যাবেন না। আপনার শরীর তো বেশি খারাপ।’ কিন্তু ভুবন নাছোড়বান্দা। পারলে সেদিনই ফিরে আসে। ওর এক কথা, ‘দেশে গেলেই সুস্থ হয়ে যাব।’ সময় আর শরীরের চিন্তা করে আমরা বিমানযাত্রার খোঁজ খবর নিলাম। কিন্তু নাহ, বিমানে ভ্রমণের মতো বাজেট আমাদের ছিল না। কারণ আমাদের প্রস্তুতি ছিল বাসে ভ্রমণ করার। সেদিন ফিরে আসার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। অমরদা খোঁজ করে দিয়েছিলেন।
অমরদা চলে যাওয়ার কিছু সময় পর দেবারতি দিদির বড় ভাই ফোন দিলেন। জানতে চাইলেন আমরা কোন হোটেলের কত নম্বর কক্ষে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে কিংশুকদা চলেও এলেন। তিনি অজানা দেশের অচেনা মানুষ হয়েও খুব বিনয়ের সঙ্গে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। দেখা করতে গিয়েছেন। এমনকি পরদিন বাসে তুলে বিদায়ও জানিয়েছেন। সবচেয়ে বড় উপকার করেছেন সেদিন ভুবনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে। দাদা ওকে দেখেই বলছিলেন, ‘আপনার তো খুব বেশি খারাপ অবস্থা। ডাক্তার না দেখালেই নয়। এখানে নিচেই একটা ওষুধের দোকানে ডাক্তার বসেন। জরুরি অবস্থায় তাঁকে আগে দেখিয়ে নিন।’ ডাক্তার আসবেন সন্ধ্যার পর। ৭টার দিকে। ততক্ষণে কিংশুকদাকে চা খাওয়ালাম। বিস্কুট খেতে চাইলেন না। তবে সৌরভ ভাইয়ের দেওয়া লেক্সাস বিস্কুটের পুরো প্যাকেটটাই দাদাকে যাওয়ার সময় উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম। আসলে মাথায় ছিল না। উচিত ছিল তাঁর জন্য বাংলাদেশ থেকে কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাওয়া। কিংশুকদা কথায় কথায় বলছিলেন, ‘আপনাদের দেশের বিস্কুট তো খুব ভালো।’ তাই বিস্কুটের প্যাকেটটা দাদাকে দিয়ে দিলাম। দাদা গল্প করলেন তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে, স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে আর বোনকে নিয়ে। একদম যেন আমার ভাইয়ের মতো। খুব শ্রদ্ধা হলো। দেবারতি দিদিও আগে বলেছিলেন তাঁর দাদা তাঁকে কতটা ভালোবাসেন। পরিবারের সবাই যখন দিদির সাংবাদিকতায় লেখাপড়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তখন এই বড় ভাই তাঁর পাশে ছিলেন। সবাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে বোনকে ভর্তি করিয়েছিলেন সাংবাদিকতা বিষয়ে। বোন এখন অন্য দেশের স্বনামধন্য পত্রিকার সাংবাদিক। নিজ দেশের প্রতিনিধি। এই অর্জনে বড় ভাই যারপরনাই খুশি। কিংশুকদার কথা শুনতে শুনতে আমার নিজের বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ভাইয়াও তো সবাইকে রাজি করিয়ে আমার ইচ্ছামতো পড়াশোনা করিয়েছেন। নিজ সন্তানের মতো লালনপালন করেছেন। আমার চোখ ধরে আসছিল এসব কথা ভেবে।
৭টা বাজার আগেই কিংশুকদা নিচে নেমে গেলেন। বলে গেলেন, ‘ডাক্তার এলে আমি ফোন দিচ্ছি। আপনারা নিচে নেমে আসবেন তখন।’ কয়েক মিনিট পর দাদা ফোন দিয়ে জানালেন ডাক্তার চলে এসেছেন। ভুবন ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। হাঁটবে কী করে? আমি সেদিন ওর চেয়ে সুস্থ ছিলাম। ও আমার কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটেছিল। হোটেল থেকে বের হয়ে হাতের বাঁ দিকে কয়েক কদম হাঁটলেই ওই ওষুধের দোকান। কিংশুকদা পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। দোকানের ভেতরের দিকে ছোট্ট একটা খুপরি। সেখানে ছোট একটা টেবিল বিছিয়ে বসেছেন ডাক্তার। তাঁর উল্টো পাশে দুটো চেয়ার। কিংশুকদা বসতে চাইলেন না। দরজার দিকে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুটো চেয়ারে আমরা দুজনে বসলাম। ডাক্তার মশাইকে ভুবনের রোগের ইতিহাস বললাম। কী কী ওষুধ খাওয়া হয়েছে সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। জানার পর ভ্রু কুচকে বললেন, ‘ডায়াবেটিসের রোগীর এসব ওষুধে তো কাজ হবে না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সেটা আশা করি দ্রুত কাজ করবে।’ সত্যিই কাজ হয়েছিল। সেদিন রাতে আর পরদিন সকালে খাওয়ার পর ভুবন প্রায় সুস্থ হয়ে উঠছিল।
ওষুধ কেনা হয়ে গেলে কিংশুকদা সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা হোটেলে চলে গেলাম। আমি আমার দুর্বল দেহ আর শক্ত মন নিয়ে আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম ওই রাতে। খুব খুশি লাগছিল পরদিন বাড়ি ফিরব বলে। ভুবনের মতো আমারও মনে হচ্ছিল বাড়ি ফিরে গেলেই আমরা সুস্থ হয়ে যাব। এদিকে দেশে কাউকে জানাইনি আমাদের দুরবস্থার কথা। নইলে দুশ্চিন্তায় আধমরা হয়ে থাকবে সবাই!
বাড়ি যাওয়ার উত্তেজনায় রাতের বেশ খানিকটা সময় বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলাম। পরিকল্পনার অনেক কিছু বাকি ছিল। জুতা কেনা হলো না, গ্যাংটক ঘোরা হলো না, শিলিগুড়ি ঘোরা হলো না, বাবার জন্য দার্জিলিংয়ের গ্রিন টি কেনা হলো না। এসব আফসোস নিয়ে ফিরতে হবে ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
(চলবে)
আরও খবর পড়ুন:
সকালের নাশতা খাওয়ার সময়ও মুখে রুচি ফিরল না। বরাবরের মতো আমি জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করলাম আর ভুবন পারল না। সারা দিন ধরে ওঁকে বলতে লাগলাম পিয়ালকে ফোন দিতে। সমবয়সী কেউ এসে দেখা করলে অন্তত মনটা একটু ভালো হয়। পিয়াল সাহা আমাদের ব্যাচমেট। বারো-চৌদ্দ বছরে ওর চেহারাটা ভুলে গিয়েছিলাম। নামটা পর্যন্ত মনে ছিল না। কিন্তু যেদিন গ্যাংটক থেকে লাচুং যাব, সেদিন হঠাৎ করেই ফোন দিয়েছিল ভুবনকে। ফেসবুকে ভুবনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ভুবন ফেসবুকে চেক-ইন দেওয়ায় পিয়াল নিজে থেকে ফোন করে জানিয়েছিল সে গ্যাংটকে আছে। পরে লাচুংয়ে রওনা দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে এসে দেখা করে গিয়েছিল। আমাদের কিছু ডলার ভাঙানোর দরকার ছিল। ছেলেটা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রুপি দিয়ে ডলার নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘আরও টাকা লাগলে আমাকে বলিস। ছোটখাটো ব্যবসা আছে আমার শিলিগুড়িতে। মন্দ কামাই না।’ এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই নাকি শিলিগুড়িতে এসে বসবাস শুরু করেছে পিয়াল। সেখানে নিজের ভালোই পরিচিতি আছে তার। এক বন্ধুকে গ্যাংটক পর্যন্ত বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ভুবনকে বলছিল, ‘আরে, তুই এখানে বেড়াবি, আমাকে আগে বলবি না? বন্ধু হয়ে এতটুকু উপকার কি করতে পারব না? তোদের সব ব্যবস্থা অল্প খরচে করে দিতাম।’ ভুবন লজ্জায় শুধু বলল, ‘সরি দোস্ত, একদম মাথায় ছিল না তুই যে এখানে।’ পিয়াল বারবার করে বলে দিয়েছিল যেকোনো সমস্যা হলে ওকে জানাতে। তাই ওকে ফোন দেওয়ার জন্য ভুবনকে খোঁচাচ্ছিলাম। অচেনা জায়গায় বড্ড অসহায় লাগছিল আমার। সেই সঙ্গে ভুবনের অবস্থার অবনতি আমাকে আরও বেশি কাবু করে দিচ্ছিল। আমি মনের জোরে সুস্থ থেকে ওর সেবা করার চেষ্টা করছিলাম। আমার জ্বর সেদিন চলে গিয়েছিল। ভুবনের অবস্থা খারাপ। শেষমেশ পিয়ালকে ফোন দিল ভুবন। পিয়াল জানাল কাজের অনেক চাপ, কিন্তু শেষ করে আসবে যত রাতই হোক। আমাকে আমার সহকর্মী দেবারতি দিদি ফোন দিলেন। ‘তোমরা এত অসুস্থ আগে জানাওনি কেন? আহারে, আমি মুম্বাই থেকে এত দূর আসতেও পারছি না।’ আফসোস করছিলেন তিনি। আমি তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম প্রার্থনা করতে।
দুপুরে সৌরভ ভাইয়েরা চলে যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছিলেন। আমরা কিছুই খেতে পারছিলাম না বলে সৌরভ ভাই লেক্সাস বিস্কুটের বড় একটা প্যাকেট আর আলুর বিস্কুটের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, রীতিমতো জোর করে। সঙ্গে সেই সুন্দর বোতলটায় পানি ভরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে গেলেন। পানিটা দুজনে মিলেই খেয়েছিলাম। বোতলে অর্ধেক পানি রয়ে গিয়েছিল। সেটা আবার বাংলাদেশে বয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
সকালের দিকে একবার মিলন ভাই দেখা করে খোঁজ নিয়ে গিয়েছিলেন। দুপুরের পর আবার এসেছিলেন অমরদাকে সঙ্গে নিয়ে। অমরদা খুব দুঃখ প্রকাশ করছিলেন সময়মতো খোঁজ নিতে পারছিলেন না বলে। আবার গেলে যেন তাঁকে ফোন করি, সে কথাও বললেন। কথায় কথায় জানালেন, তিনি আসলে আমাদের বাংলাদেশেরই নাগরিক। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতের বাসিন্দা। এখন নাকি ভারতেরও নাগরিকত্ব আছে। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর যেমন মায়া আছে, আছে অভিমানও কিছুটা। কেন এই অভিমান? অমরদা বলছিলেন, ‘আমার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। আমি চাকরি করতাম গ্রামীণ ফোনে। বেশ ভালোই সংসার চলছিল আমাদের। একদিন আমার স্ত্রীর পানি ভেঙে গেল। সঙ্গে প্রচুর রক্ত যাচ্ছিল। বিশ্বাস করেন, আমি এত রক্ত আগে দেখি নাই। দুই হাতে স্ত্রীকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ছুটলাম হাসপাতাল যাব বলে। সিঁড়ির গায়ে রক্ত গড়াচ্ছিল। আমি অসহায়ের মতো নামছিলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছিল, কারণ তখন আমার স্ত্রীর শরীর অনেক ভারী হয়ে গিয়েছিল। ওঁকে নিয়ে ঠিকমতো চলতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল পৌঁছালে চিকিৎসকেরা জানালেন মা অথবা বাচ্চা যেকোনো একজনকে বাঁচাতে হবে। এসব তো সিনেমায় দেখতাম রে ভাই। আমি বললাম, আমার বাচ্চার দরকার নাই। আমার স্ত্রীকে বাঁচান। আমার স্ত্রী বেঁচে যায়। কিন্তু তাঁদের কিছু ভুল চিকিৎসার কারণে পরে আবারও আমার স্ত্রীকে অনেক অসুস্থ হয়ে যেতে হয়। তাই অভিমান করে দেশ, চাকরি ছেড়ে চলে আসি ভারতে। এখানে এসে স্ত্রীর চিকিৎসা করালাম। এবার সেটা সঠিক হলো। ডাক্তাররাও ভালো। আমি এদিকে এসে শুরু করলাম ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ। কাজটা আমি আনন্দ নিয়ে করি। খারাপ লাগে না। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। একেক জন একেক রকম। কিন্তু কেউ খুব অপমান করলেও সহ্য করে থাকি। আমাদের সহ্য করে থাকতে হয়। এ কাজে রেগে গেলে হেরে যেতে হবে। বিনয়ী হতে হয়। এখন আমার একটা মেয়ে আছে। সুখেই আছি। জীবন মন্দ না।’ বলতে বলতে অমরদার চোখ ভিজে আসছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তিনি বাংলাদেশকে খুব মনে করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু ওই যে অভিমান। দেশে তাঁর আত্মীয়স্বজন আছে। সময় পেলে বেড়াতে যান।
অমরদার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। ভুবন অনুরোধ করল, ‘দাদা আমাকে একটু আনারসের জুস এনে দেবেন, যদি কিছু মনে না করেন! আমরা তো বাইরে যেতে পারছি না।’ অমরদা খুশি হয়ে বললেন, ‘কেন দেব না? জ্বরের মুখে আনারস তো খুব ভালো। আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।’ বলে তিনি বের হয়ে গেলেন। দুই লিটারের পানির বোতলে আনারসের জুস নিয়ে দুলতে দুলতে ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পর। এতগুলো! কে খেয়ে শেষ করবে? আর এই রাতটাই তো হাতে আছে আমাদের। পরদিন দেশে ফিরে যাব। কিন্তু অমরদা বারবার বলছিলেন, ‘ভাই, আপনারা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত দয়া করে যাবেন না। আপনার শরীর তো বেশি খারাপ।’ কিন্তু ভুবন নাছোড়বান্দা। পারলে সেদিনই ফিরে আসে। ওর এক কথা, ‘দেশে গেলেই সুস্থ হয়ে যাব।’ সময় আর শরীরের চিন্তা করে আমরা বিমানযাত্রার খোঁজ খবর নিলাম। কিন্তু নাহ, বিমানে ভ্রমণের মতো বাজেট আমাদের ছিল না। কারণ আমাদের প্রস্তুতি ছিল বাসে ভ্রমণ করার। সেদিন ফিরে আসার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। অমরদা খোঁজ করে দিয়েছিলেন।
অমরদা চলে যাওয়ার কিছু সময় পর দেবারতি দিদির বড় ভাই ফোন দিলেন। জানতে চাইলেন আমরা কোন হোটেলের কত নম্বর কক্ষে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে কিংশুকদা চলেও এলেন। তিনি অজানা দেশের অচেনা মানুষ হয়েও খুব বিনয়ের সঙ্গে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। দেখা করতে গিয়েছেন। এমনকি পরদিন বাসে তুলে বিদায়ও জানিয়েছেন। সবচেয়ে বড় উপকার করেছেন সেদিন ভুবনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে। দাদা ওকে দেখেই বলছিলেন, ‘আপনার তো খুব বেশি খারাপ অবস্থা। ডাক্তার না দেখালেই নয়। এখানে নিচেই একটা ওষুধের দোকানে ডাক্তার বসেন। জরুরি অবস্থায় তাঁকে আগে দেখিয়ে নিন।’ ডাক্তার আসবেন সন্ধ্যার পর। ৭টার দিকে। ততক্ষণে কিংশুকদাকে চা খাওয়ালাম। বিস্কুট খেতে চাইলেন না। তবে সৌরভ ভাইয়ের দেওয়া লেক্সাস বিস্কুটের পুরো প্যাকেটটাই দাদাকে যাওয়ার সময় উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম। আসলে মাথায় ছিল না। উচিত ছিল তাঁর জন্য বাংলাদেশ থেকে কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাওয়া। কিংশুকদা কথায় কথায় বলছিলেন, ‘আপনাদের দেশের বিস্কুট তো খুব ভালো।’ তাই বিস্কুটের প্যাকেটটা দাদাকে দিয়ে দিলাম। দাদা গল্প করলেন তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে, স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে আর বোনকে নিয়ে। একদম যেন আমার ভাইয়ের মতো। খুব শ্রদ্ধা হলো। দেবারতি দিদিও আগে বলেছিলেন তাঁর দাদা তাঁকে কতটা ভালোবাসেন। পরিবারের সবাই যখন দিদির সাংবাদিকতায় লেখাপড়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তখন এই বড় ভাই তাঁর পাশে ছিলেন। সবাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে বোনকে ভর্তি করিয়েছিলেন সাংবাদিকতা বিষয়ে। বোন এখন অন্য দেশের স্বনামধন্য পত্রিকার সাংবাদিক। নিজ দেশের প্রতিনিধি। এই অর্জনে বড় ভাই যারপরনাই খুশি। কিংশুকদার কথা শুনতে শুনতে আমার নিজের বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ভাইয়াও তো সবাইকে রাজি করিয়ে আমার ইচ্ছামতো পড়াশোনা করিয়েছেন। নিজ সন্তানের মতো লালনপালন করেছেন। আমার চোখ ধরে আসছিল এসব কথা ভেবে।
৭টা বাজার আগেই কিংশুকদা নিচে নেমে গেলেন। বলে গেলেন, ‘ডাক্তার এলে আমি ফোন দিচ্ছি। আপনারা নিচে নেমে আসবেন তখন।’ কয়েক মিনিট পর দাদা ফোন দিয়ে জানালেন ডাক্তার চলে এসেছেন। ভুবন ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। হাঁটবে কী করে? আমি সেদিন ওর চেয়ে সুস্থ ছিলাম। ও আমার কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটেছিল। হোটেল থেকে বের হয়ে হাতের বাঁ দিকে কয়েক কদম হাঁটলেই ওই ওষুধের দোকান। কিংশুকদা পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। দোকানের ভেতরের দিকে ছোট্ট একটা খুপরি। সেখানে ছোট একটা টেবিল বিছিয়ে বসেছেন ডাক্তার। তাঁর উল্টো পাশে দুটো চেয়ার। কিংশুকদা বসতে চাইলেন না। দরজার দিকে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুটো চেয়ারে আমরা দুজনে বসলাম। ডাক্তার মশাইকে ভুবনের রোগের ইতিহাস বললাম। কী কী ওষুধ খাওয়া হয়েছে সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। জানার পর ভ্রু কুচকে বললেন, ‘ডায়াবেটিসের রোগীর এসব ওষুধে তো কাজ হবে না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সেটা আশা করি দ্রুত কাজ করবে।’ সত্যিই কাজ হয়েছিল। সেদিন রাতে আর পরদিন সকালে খাওয়ার পর ভুবন প্রায় সুস্থ হয়ে উঠছিল।
ওষুধ কেনা হয়ে গেলে কিংশুকদা সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা হোটেলে চলে গেলাম। আমি আমার দুর্বল দেহ আর শক্ত মন নিয়ে আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম ওই রাতে। খুব খুশি লাগছিল পরদিন বাড়ি ফিরব বলে। ভুবনের মতো আমারও মনে হচ্ছিল বাড়ি ফিরে গেলেই আমরা সুস্থ হয়ে যাব। এদিকে দেশে কাউকে জানাইনি আমাদের দুরবস্থার কথা। নইলে দুশ্চিন্তায় আধমরা হয়ে থাকবে সবাই!
বাড়ি যাওয়ার উত্তেজনায় রাতের বেশ খানিকটা সময় বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলাম। পরিকল্পনার অনেক কিছু বাকি ছিল। জুতা কেনা হলো না, গ্যাংটক ঘোরা হলো না, শিলিগুড়ি ঘোরা হলো না, বাবার জন্য দার্জিলিংয়ের গ্রিন টি কেনা হলো না। এসব আফসোস নিয়ে ফিরতে হবে ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
(চলবে)
আরও খবর পড়ুন:
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪