সন্ধ্যার পর থেকে নিদারুণ অস্থিরতায় ভুগছি। কেন এমন লাগছে বুঝতে পারছি না। বারান্দায় বসে মোবাইল সেটের বাটন টিপছিলাম আনমনে। কোনো অজানা কারণে বুকের ভেতরে একটা গুমোট যন্ত্রণা আমাকে অস্থির করে তুলছে। সেই অস্থিরতা যেন আমার চারপাশেও ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরের অস্থিরতা কি মনের ভেতরে চাপ সৃষ্টি করছে, নাকি মনের অস্থিরতা বাইরেটাকে অস্থির করে তুলেছে, ঠিক বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে সন্ধ্যার কালচে আকাশে স্থির ঠান্ডা নক্ষত্রের দিকে নিশ্চল চোখে তাকিয়ে থাকলাম। কত দূর সেই সব নক্ষত্রের বাড়ি? কত দূর?
আমার মনোযোগ ফিরে আসে নৈঃশব্দ্যে জমাট বাঁধা আমাদের বাড়ির বাসার ভেতরে। ছেলেটা হয়তো ঘরে কিছু করছে কিন্তু এরপরও কেন ভয়ংকর নীরবতা! কেন এমন মধুর নিঃসঙ্গতা? হ্যাঁ, মধুরই তো। ইদানীং নিঃসঙ্গতাকেও দারুণভাবে উপভোগ করি। অফিসের কাজে জামিল ঢাকার বাইরে গেলে আমার রাজ্যে আমি নিঃসঙ্গ সম্রাজ্ঞী। নিজের ভেতরে নিজেই থাকি। একাকিত্বে কেন প্রশান্তি অনুভব করি, ভেবে পাই না। কৈশোরের স্বপ্নে সাজানো আকাশটা কোথায় হারিয়ে গেল? কেন সংসারের চার দেয়ালে এভাবে বন্দী হয়ে গেলাম, আমি ভেবে পাই না। এটাই কি তাহলে নিয়তি?
মনের গুমোট ভাবটা ক্রমাগত দানা বাঁধছে এবং আমি আরও অস্থির হয়ে উঠছি। মনে হচ্ছে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলব, ভেবে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার মোবাইল সেটে রিং হলো। অজানা নম্বর দেখে লাইন কেটে দিলাম। অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। অনেকে ফোন থেকে বদমায়েশি কথা বলে। বদমায়েশে ভরে গেছে দেশটা।
আবার রিং হলো। কল রিসিভ করব কি না, আমি দ্বিধাগ্রস্ত, তারপর অন্যমনস্কভাবেই এবার ধরলাম।
—হ্যালো, কে বলছেন?
—আমি... (একটু আমতা-আমতা করছে) আবির। আপনি কি তামান্না?
—হ্যাঁ, আমি তামান্না। কিন্তু আপনি কে?
—আমি আবির হাসান, আপনার দূর সম্পর্কের এক ফুফাতো ভাই। আপনাদের গ্রামের বাড়ি মুকুন্দপুর, ভোলা। আমি কি ঠিক বলেছি?
—হ্যাঁ। ঠিকই তো বলেছেন কিন্তু আপনি...?
—আপনার বাবার নাম আহমেদ সুলতান কাদেরী।
—হ্যাঁ। আচ্ছা...আপনি দেখছি সবই চিনেন কিন্তু...
—কিন্তু...আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না, এই তো?
—সত্য কথা বললে, হ্যাঁ, আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। একটু বিস্তারিত বলুন। অনেক দিন হয়তো দেখা নেই, কথা নেই।
—আমার বাবার নাম জায়েদ হাসান। আমার নাম আবির হাসান। আমি ছেলেবেলায় আপনাদের বাসায় অনেকবার গিয়েছি।
আবির হাসান নামটি শোনার পর আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। আবিরও না। মনে হলো সহস্র বছরের অনুসন্ধানের পর কাঙ্ক্ষিত ফসিল পেয়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। আবিরও কি তাই? এভাবে কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল বিমূঢ় ঘোরের মধ্যে। আমি হতবিহ্বল। অজানা শিহরণ অথবা রোমাঞ্চ অথবা কষ্টের দহন কিছু একটা আমার করোটিতে তুমুল ঝড় তুলল। ঝড়ের তাণ্ডব থামতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর আবার স্তব্ধতার ভেতর থেকে উচ্চারিত হলো,
—আমাকে চিনতে পারছেন না?
—হ্যাঁ। পেরেছি। সেই যে কবে থেকে তোমাকে খুঁজছি আর তোমার দেখা পাইনি। এভাবে কোথায় কোন সাগরের ঝিনুকের পেটে লুকিয়েছিলে আবির? আমি তুমি করে বলে ফেললাম, কিছু মনে করো না আবির।
—না, কিছু মনে করিনি। আমিও ভাবছিলাম তুমি যদি আমাকে আগের মতোই বলতে, তাহলে ভালো লাগত। খুব ভালো লাগত। সত্যি...খুব ভালো লাগছে তামান্না। খু... উ... ব।
—কী করছ? কোথায় আছ? কেমন আছ?
—কীভাবে তোমাকে বলব বুঝতে পারছি না। ঢাকায় থাকি। জনবহুল দমবদ্ধ বসবাস অযোগ্য এক শহরে। তুমি?
—কুষ্টিয়াতেই। ঢাকায় স্যাটেলড হয়েছ?
—হ্যাঁ।
কী বলব, কিছুই ভাবতে পারছি না আমি। বুকের শব্দপাখিরা হঠাৎ কোথায় যেন উড়ে গেল। কেবল মনে হচ্ছে ডানা ঝাপটানোর শব্দ। নিজেকে মনে হলো সহস্র বছরের ফসিল, যার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন নেই। এমন নির্জীবতা কেন, তা বোঝার জন্য যখন নিজের মধ্যে ডুবে বুঁদ হয়ে পড়ে রইলাম, তখন আবিরের কথা শুনে সংবিৎ ফিরে পেলাম।
—কথা বলছ না কেন তামান্না?
—ও! হ্যাঁ। এত দিন কোথায় ছিলে? একটি বার খোঁজখবর না নিয়ে থাকতে পারলে?
—কীভাবে খোঁজখবর নেব বলো? বড়রা সুযোগ না দিলে ছোটরা পারে না। বেহায়াপনা হয়।
—তত্ত্বকথা। তোমার কথা সব সময় ঠিক নয়। বড়-ছোট কোনো কথা নয়, ছেলেদের যোগাযোগ রাখা যতটা সহজ, মেয়েদের পক্ষে ততটা সহজ নয়। বলো, সত্যি বলিনি?
—হয়তো সত্যি, হয়তো না। আমি সংশয়বাদী মানুষ। তখন দুজনের দুটি ধারা ছিল। হয়তো অবিমৃশ্যকারী ধারা। তেল আর জলের ধারা।
—তুমি আগের মতোই আছ। পুরোনো ছাঁচেই কথা বলছ। একটুও বদলাওনি।
অনেকটা সময় আমরা দুজনের কেউ কোনো কথা বলতে পারিনি। আমার বুকের ভেতরটা বরফের মতো জমে গেছে। জানি না আবিরেরও সে রকম কিছু হয়েছে কি না। হাজারো কথার ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। কোনটা বলব? কোন কথাটা বলা উচিত? কোন কথাটা আগে বলব? এত দিন পর তার কথা শুনেই এলোমেলো হয়ে গেছি। ভাবছি, আবিরের কথা এত ভালো লাগে কেন? জীবনের একেক সময় একেক কথা জরুরি হয়ে পড়ে।
—কী করছ আবির?
—একটা আর্ট ফার্ম দিয়েছি। ছবি আঁকি। আগামী মাসের ১০ তারিখ আমার একটা এক্সিবিশন আছে। তুমি আসবে, এ জন্যই তোমাকে ফোন করা।
—আমার ফোন নম্বর কোথায় পেলে?
—রুহি খালার কাছ থেকে।
—তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ। আমি ছোটবেলায় ভাবতাম তুমি একদিন অনেক বড় হবে। তোমার বুদ্ধিদীপ্ত চোখেই আমি দেখতে পেতাম, তুমি অনেক বড় মাপের মানুষ। হয়তো আমার স্বপ্নেই তুমি বড় হয়েছ।
—এভাবে বলো না তামান্না। তবে তোমাদের মতো বড় হওয়ার এক স্বপ্নে তাড়িত হতাম আমি। সে অর্থে হয়তো তোমার স্বপ্নেই আমি এতটা পথ এসেছি। আমার সামনে আরও অনেক পথ...অনেক পথ হাঁটতে হবে। তুমি একদিন ফ্রস্টের কথা বলেছিলে, মনে আছে?
— The woods are lovely, dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.
—তোমার কথাগুলো আমার কানে এখনো বাজে।
—মনে হচ্ছে তুমি ঝিনুকের গর্ভে লুকিয়ে গিয়ে মুক্তোই হয়েছ। খুবই ভালো লাগছে ভাবতে। কিন্তু এই ভালো লাগাটা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারছি না আবির। জীবন কি আশ্চর্য, তাই না?
—হ্যাঁ...তাই...। জানো তামান্না, তোমার কথা আমার প্রতিদিনই মনে হতো। বলা যায় প্রতিদিনই, নিভৃত ক্ষণে। কিন্তু আমি সাহস পেতাম না তোমার সঙ্গে দেখা করতে। পাছে তুমি কী ভাবো? তোমার আব্বু, আম্মু তারাই বা কী ভাবেন? তোমরা এত বড়লোক ছিলে যে তোমাদের বাড়ির দিকে তাকালে আমার চোখ ঝলসে যেত। তখন মনে মনে ভাবতাম, তোমাদের মতো যদি কোনো দিন হতে পারতাম!
—তুমি তো আমাদের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছ। জানো আবির, আমিও তোমাকে মনে মনে খুঁজতাম। যখন স্কুলে যেতাম, তখন মনে মনে ভাবতাম, তোমাকে যদি কোথাও দেখতে পেতাম। ছোট্ট শহর কুষ্টিয়া। সেই শহরে গাড়ি দিয়ে যেতাম। সামান্য পথ, পাঁচ মিনিটেই পথ শেষ। পথ কিংবা সময় দীর্ঘ হলে হয়তো কোনো দিন পেয়েও যেতাম। নানান কাজে নিশ্চয়ই তুমি কুষ্টিয়া আসতে, তাই না?
—হ্যাঁ। অনেক সময় কাজ ছাড়াও যেতাম। তোমাকে পথে পথে খুঁজতাম। কোনো দিন তোমাকে দেখিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর তোমাদের বাড়িতে যেতে সাহস হতো না। কী অছিলায় যাব? বছরান্তে হিসাব করেছি, তুমি এই ক্লাসে উঠেছ, আগামী বছর এই ক্লাসে উঠবে। যখন কলেজে পা রেখেছ—একদিন মনে মনে ভাবলাম, কলেজে তো আর বাধা নেই। তোমার সঙ্গে একবার দেখা করি। কিন্তু পরে জানলাম তুমি মেয়েদের কলেজে পড়ো। সেখানে গিয়ে কীভাবে তোমার সঙ্গে দেখা করি, বলো?
—তুমি আসতে পারতে। জানো, আমি ছেলে হলে ঠিকই তোমাকে খুঁজে বের করতাম।
—সব চেয়ে বড় কথা কী ছিল জানো?
—কী করে জানব?
—বড় কথা ছিল, তোমার সঙ্গে দেখা করে আমি কী বলব? সে রকম কোনো কথা বলার ভাষা ও অছিলা পাইনি বলেও যাওয়া হয়নি। তারপর সত্য কথাটা যদি কেউ শুনত, এক হতদরিদ্র পিতার এক ছেলের মনের ভেতরে তোমাকে দেখার এমন বাসনা, তাহলে মানুষে কী ভাবত, বলো? তোমার আব্বা-আম্মুই বা কী ভাবতেন? অকৃতজ্ঞ মানুষের দলে আমাকে ভিড়াতেন। তাই না?
—তা নিরেট সত্য। তোমাকে কেউ হয়তো সহ্যই করত না। তবে আমার মনে হতো তোমার ভেতরে তেজের নেভা আগুন আছে। তুমি একদিন অনেক বড় হবে। তুমি যখন বাগানে বসে ছবি আঁকতে, তখন আমি তোমাকে দেখতে পেতাম বড় মানুষের দলে। এই সব উচ্ছন্নে যাওয়া তথাকথিত ধনী মানুষের চেয়ে তুমি অনেক ওপরের এক মানুষ।
আবির কোনো কথা বলছে না। টেলিফোনে ভারী বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। আমিও কথা বলতে পারছি না। মন ও মননে এমন অসাড়তা আমি আর কোনো দিন অনুভব করিনি। দম বন্ধ হয়ে আসা এক গুমোট বদ্ধ ঘরে যেন আটকা পড়লাম। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। জানালা লাগোয়া বকুলগাছ থেকে টপ টপ করে পাতা ঝরছে। শুধু ভাবছি, দিনে দিনে আমি কেমন করে তার কাছে হেরে গিয়েছিলাম। এ কি পরাজয় নাকি ঈর্ষা? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আজ। ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার বিভেদের হিংস্রতা, নাকি আমার বাবা-মা কর্তৃক আরোপিত হতদরিদ্রদের থেকে দূরে থাকার অনপনেয় নির্দেশ, নাকি বস্তুর দ্বান্দ্বিকতা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আবিরের কথা শুনে আমার পুঁজিবাদ আশীর্বাদপুষ্ট ঠুনকো আভিজাত্যকে এই মুহূর্তে ঘৃণা হচ্ছে। একজন মানুষের জীবনে বড় হওয়া কোনো বিষয় নয়, যদি তার মধ্যে তেজ থাকে, আকাঙ্ক্ষা থাকে। মৌলিকতা আর তেজহীন মানুষের প্রাচুর্য থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। ওই মানুষ আর জড় বস্তুর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
—হঠাৎ নীরব হয়ে গেলে কেন? কথা বলো তামান্না। নাকি বিরক্ত হচ্ছ?
—না...না...বিরক্ত হব কেন? এত বছরের জমানো কথা...কোনটা রেখে কোনটা বলি বলো...তাই একটু এলোমেলো লাগছে।
—তোমার দেওয়া পেনসিল ও রাবারটা এখনো আমি যত্ন করে রেখেছি।
—সত্যি বলছ?
—হ্যাঁ। আমার টেবিলে সব সময় থাকে। এই তো আমার সামনেই চকচক করছে। সেদিন আমার মেয়েটা কামড়িয়ে একটু ভেঙে ফেলেছে। ও চকলেট ভেবে খেয়ে ফেলতে চেয়েছিল।
—এগুলো এখনো রেখেছ?
—হ্যাঁ। এগুলোই তো আমার আশীর্বাদ। তোমার পেনসিল দিয়েই আমি ছবি আঁকতে শুরু করেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো এত সুন্দর পেনসিলটা শেষ করে ফেলা ঠিক হবে না। সুন্দর জিনিস দিয়ে সুন্দর কিছু সৃষ্টি করতে হবে। তাই রেখে দিয়েছিলাম। তখন কী দিয়ে ছবি আঁকব, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। একটা পেনসিল কেনার সামর্থ্য তো আমাদের ছিল না, তুমি ভালো করেই জানো। তারপর কাঠ-কয়লা দিয়ে ছবি আঁকা শুরু করলাম। মাটির বেড়ায়, স্কুলের দেয়ালে, কলেজের দেয়ালে অনেক ছবি এঁকেছি। অনেক পোর্ট্রেট। আর তোমার দেওয়া পেনসিল ও রাবার! আমি এখনো রেখে দিয়েছি একটা সুন্দর ছবি আঁকব বলে। এত সুন্দর পেনসিল দিয়ে কি আলতু-ফালতু ছবি আঁকা যায়, বলো?
—আমিও রেখেছি যত্ন করে সেই বাবুই পাখির বাসাটা। আমার বিয়ের পর মাঝে মাঝে বদলির কারণে এখানে-সেখানে গেলেও আমি বাবুই পাখির বাসাটি সঙ্গে নিয়ে যাই। আমার বাসা সাজানোর সময় এই বাবুইয়ের বাসাটিও থাকে। কত মানুষে যে নিয়ে যেতে চেয়েছে...! এটা কি কাউকে দেওয়া যায়! এত সুন্দর জিনিস একবার হাতছাড়া হলে জীবনে আর ফিরে পাবো, বলো?
অকস্মাৎ আবার নিরেট নীরবতা। আমার বুকের ভেতরটা এক প্রকার কান্নায় ভেসে যাচ্ছে। চোখ দুটি কেন ঝাপসা হয়ে গেল আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি না এখন আর কী বলব? বাবুই পাখির বাসাটি আমার ছোট ছেলেটা একটু নষ্ট করে ফেলেছে। আমি কেন তাকে বলব? সব কথা কি তাকে বলা উচিত?
—তোমার সঙ্গে আমার কবার দেখা হয়েছিল মনে আছে, তামান্না?
—আমার মনে নেই। তবে তোমাকে নিয়ে আমাদের বাগানবাড়িতে খেলতাম, তুমি গাছে চড়ে আমাকে জলপাই পেড়ে দিতে, অর্কিড পেড়ে দিতে...তা মনে আছে। তুমি খুবই সাহসী ছিলে। তোমার সাহস দেখে আমি তাজ্জব হয়ে যেতাম।
—তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে আটবার। আব্বার সঙ্গে যেতাম তোমাদের বাসায়। মামি আমাকে তোমার বড় ভাইয়ের পুরোনো শার্ট দিতেন পরার জন্য। আব্বাকে টাকা দিতেন চলার জন্য। আব্বা খুব খুশি হতো, তোমার আম্মু-আব্বুকে আশীর্বাদ করত প্রাণভরে।
—এসব কথা বলো না আবির। তুমি শুধু বলো অর্কিডের কথা, জলপাইয়ের কথা...। আর বলো বাবুই পাখির বাসাটির কথা। সেদিন তোমার জামার নিচে লুকিয়ে এই বাবুই পাখির বাসাটি আমার জন্য এনেছিলে, তাই না? তারপর এক বিকেলে তুমি আমাকে আমাদের বারান্দায় নীরবে ডেকে নিয়ে এটা দেবে কি দেবে না এমন ইতস্তত করে এক সময় দিয়ে দিলে। আমি যে এতটা খুশি হব, তা তুমি ভাবতেই পারনি। তারপর...খুশিতে তোমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল, তাই না? তখন তুমি ফাইভে পড়তে, আমি ফোরে...তাই না?
আবির আর কোনো কথা বলেনি। মনে হলো দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পড়ছে সেল ফোনের সেটে। আমার বুকেও অজস্র ঢেউ আছড়ে পড়ছে। একবার ভাবছিলাম, আবিরকে বলি আমার বাসায় বেড়িয়ে যেতে। তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হয়। আমি বলতে পারলাম না। কারণ, ও একদিন বলেছিল, ধনীরা গরিবদের বাড়িতে বেড়াতে যায় না। ওদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে যায় না। ওরা শুধু অন্যদের বাড়িতে যায়। আজকে যদি আবির সে রকম কিছু ভেবে বসে, তাহলে এই লজ্জা রাখব কোথায়?
এক সময় লাইন কেটে গেল। আমি শত চেষ্টা করেও আর কানেকশন পাইনি। মানুষ জীবনে সবকিছু পায় না জানি। সব সময় কাঙ্ক্ষিত কানেকশন পায় না। কিন্তু আমি অনেক কিছুই পেয়ে গেছি। আবির এখনো আমার দেওয়া পেনসিল ও রাবারটি রেখে দিয়েছে একটি ভালো ছবি আঁকার প্রত্যাশায়...এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার জীবনে আর কী হতে পারে? হঠাৎ মনে হলো, দক্ষিণ মেরুর শব্দহীন কোনো এক অজানা গহ্বরে আমি প্রবেশ করলাম। সেখানে কতক্ষণ ছিলাম, আমার জানা নেই। আমার সমস্ত বিমূঢ়তা কাটিয়ে সংবিৎ ফিরে পেলাম যখন অপু এসে বলল, ‘আম্মু তোমার চোখে পানি কেন?’