জাহীদ রেজা নূর
সলিম শেখের মন ভালো নেই। একটু আগে যে ঘটনাটা ঘটে গেছে, সেটার ভার নিতে পারছে না সে।
পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ের ল্যাম্পপোস্টটার নিচে প্রতিদিন ছালা পেতে বসে সলিম শেখ।
জুতা সারাইয়ের যন্ত্রপাতি রাখে আরেকটা ছালার ওপর। মাথার ওপর একটা বিবর্ণ ছাতা ছায়া দেয়। ওটা পেছন দিকে দড়ি দিয়ে কী এক উপায়ে বেঁধে রাখা হয়।
সলিম শেখের বয়স হয়েছে। কেউ বলে সত্তর, কেউ বলে আশি। তবে আশির কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, যুদ্ধের ডাক এসেছিল যখন, তখন সে ছিল বিবাহিত।
সত্তর সালের এক প্রবল শীতের রাতে রোকেয়াকে ঘরে এনেছিল সলিম। সে সময় ওর পেশিতে প্রবল টান। শরীর নাড়ালেই পেশি ফুলে ওঠে। সেই পেশির দড়িতে ভরা হাত দিয়ে যখন হাল চাষ করত সে, তখন আশপাশের পুরুষেরা এসে হাঁ করে দেখত—কত গভীরে চলে যাচ্ছে লাঙলের ফলা! খেতের অনেক দূরে কলার ঝোপে লুকিয়ে মেয়েরাও তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তারিফ করত সে শরীরের। কখনো গায়ের গেঞ্জিটা খুলে ঘর্মাক্ত শরীরে যদি হাল চাষ করত সলিম, তখন পাড়ার পড়ালেখা জানা কেউ কেউ ফিসফিস করে বলত, ‘এ তো একেবারে মোহাম্মদ আলী ক্লে।’
যারা বুঝত না, তাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিত, কার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সলিমের। বক্সিংয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী। ওর আগে নাম ছিল ক্লে। এখন মোহাম্মদ আলী। এ কথা বলার পর ক্লের আলী হয়ে ওঠার গল্পটাও শুনিয়ে দিত।
সলিমের একটা নেশা ছিল। জুতো সারাইয়ের নেশা। অবসর সময়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেঁড়া স্যান্ডেল বা জুতো খুঁজত সে। সারাই করে দিত। সেটা নেশাই ছিল। বিনিময়ে কোনো পয়সা কড়ি নিত না।
মেয়েরা ওকে চাইত। কিন্তু পাশের পাড়ার রোকেয়ার প্রতি ছিল সলিমের টান। বাবা-মাকে রোকেয়ার কথা বলায় কেউ আর আপত্তি করেনি। রোকেয়াকে নিয়ে সংসার ছিল সুখের। সোনাদানা না থাকলেও খেতে ছিল ফসল। সেই ফসল সোনাদানার দুঃখ ভুলিয়ে দিত। টাকাপয়সাওয়ালা হয়নি বটে, কিন্তু দুইবেলা তো ভাত জুটছে, তাতেই খুশি ছিল ওরা।
কিন্তু পরের বছর লাগল যুদ্ধ। এর আগে তো ছিল নির্বাচন। ওদের গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে শহরের টাউন হলে এসেছিলেন সেই জাদুকর।
লম্বা মহিরুহের মতো দেহ তাঁর। তিনি তাঁর ভরাট কণ্ঠে দেশের মানুষের অধিকারের কথা বললেন। সলিম শেখ তার শরীরের শিরায় শিরায় যেন তাঁকে অনুভব করল।
গ্রামে ফিরে এসে সলিম শেখ বলল, ‘আমি শেখ সাহেবরে দেখিসি। তাঁর কথা শুনিসি!’
চাচাতো ভাই রহমত শেখ সলিমের চেয়ে চার বছরের বড়। তার পক্ষপাতিত্ব জামায়াতে ইসলামীর দিকে। মওদুদী তার মা-বাপ। সে মুখ ঝাপটে উঠল। ‘দেশটারে ভাইঙ্গে ফেলবে এই শ্যাখের পো। সেটা দেখতি পাচ্ছিস না?’
সলিম শেখের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। বলে, ‘দেশের আছেটা কী যে ভাঙবে? সব তো খেয়ে নিল পাঞ্জাবিরা! ইয়াহিয়া তো ভোট দিছে। জিতা নাও। তারপর কথা কইও। সারা দেশ চায় শ্যাখ সাহেবরে, আর তুমি কও উল্টা কথা!’
রহমত শেখ বলে, ‘শ্যাখ সাহেব খালি বক্তৃতাই দিতে পারে! তাঁর কথা শুনলে পাকিস্তান ভাইঙ্গে যাবে।’
রহমত শেখের কথা অবশ্য মিথ্যে ছিল না। দেশটা সত্যিই ভেঙে গেল। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা দেওয়া হলো না, তখন কী থেকে কী হলো, বেঁধে গেল যুদ্ধ। সলিম শেখ রোকেয়াকে বলল, ‘দেশ বাঁচাতি চললাম। তোমরা টিকে থাকার চেষ্টা কইরো।’
এরপর রহমত শেখ রাজাকার হলো। গ্রামের জীবিত তরুণদের কতল করল, জীবিত তরুণীদের তুলে দিল পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। জ্বালিয়ে দিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি।
ঘরছাড়া করল সে বাড়িগুলোয় বসবাসকারীদের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ল রহমত শেখ। ওর হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধারা ওকে নিয়ে এল বটতলায়। একজন বলল, ‘হারামজাদারে এখনই কতল করো।’
অন্যজন বলল, ‘দাঁড়াও, সলিম ভাই আইসে নিক। তিনিই বিচার করবেন।’
সলিম শেখকে দেখে তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রহমত শেখ। বলল, ‘সলিম, আমাকে বাঁচা। সারা জীবন তোর গোলাম হয়ে থাকব, আমারে বাঁচা।’
মায়া হলো সলিম শেখের। আত্মীয় তো! কী করে এ রকম শান্তির সময় কাউকে মেরে ফেলা যায়। সলিম কিছু বলার আগে কমান্ডারই বললেন, ‘সলিম, ওকে মাফ করে দাও।
শুধু চোখে চোখে রেখো!’
যাক! রহমত শেখের ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত আর নিতে হলো না।
সোজা থানায় গিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে ধানি জমিতে কীভাবে চাষ করা যায়, সে কথাই ভাবতে লাগল সলিম।
এরপর আবার কী থেকে কী হয়ে গেল। সলিমের বাবার ধরা পড়ল ক্যানসার। জমিগুলো বিক্রি করা হলো বাবাকে বাঁচানোর জন্য। কিনে নিল রহমত। বাঁচল না বাবা। সে শোকে মায়ের হলো হার্ট অ্যাটাক। এবার বসতবাড়িটাও বন্ধক রাখা হলো। বন্ধকের টাকা দিল কে? রহমত।
সবকিছু বদলে গেল গ্রামের। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার সবাই রহমত শেখের ন্যাওটা হয়ে গেল। সবাই যখন ভোল পাল্টে ফেলেছে, তখন সেই ভোল পাল্টানো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গেল সলিম। বলল, ‘ওই হারামজাদারে তো আমরা বাঁচালাম। ওর পিছে পিছে আমরা ঘুরব ক্যান?’
মুক্তিযোদ্ধারা চোখ নামিয়ে নিয়ে রহমত শেখের বাড়িতে গিয়ে হুঁকায় দম দিতে লাগল। রাজাকারের পাল ওদের ওপর কালো মেঘ হয়ে ভাসতে থাকল।
শেষে যখন সবকিছু হারিয়ে ফেলল সলিম, তখন ওর বউ রোকেয়া বলল, ‘এখন আমি এখানে কী করে থাকি! এই দ্যাশে থাকলি শরীর বেইচে খাতি হবে। আমি বাপের বাড়ি গিলাম। অবস্থা ফিরলে আমাকে ডাইকে আইনো।’
রোকেয়ার প্রস্থান পথের দিকে তাকিয়ে থাকে সলিম। তারপর তাকায় তার আঙুলে থাকা বিয়ের আংটির দিকে। না বলা অনেক কথা যেন শূন্য হাওয়ায় ঘুরতে থাকে।
কিছুই যখন করার নেই, তখন পেট বাঁচানোর জন্য মুচির কাজ বেছে নিল সলিম। আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা ছিল না ওর। যেটুকু টাকা ছিল, তা দিয়ে জুতো সারাইয়ের সরঞ্জাম কিনল। তারপর একদিন কাউকে কিছু না বলে চলে এল পাঁচ মাইল দূরের শহরে, যে শহরে একদিন শেখ সাহেব বক্তৃতা করেছিলেন। তিন রাস্তার মোড়ে বসে শুরু হলো মুচি সলিমের জীবনযাপন। সঙ্গে থাকল শুধু সোনার আংটি, যেটা সে গড়িয়েছিল বিয়ের সময়। সুখস্মৃতি বলতে শুধু এটাই। আঙুল থেকে খুলে বাক্সের ভেতরে কাপড়ের নিচে সেটা রেখে দেয়।
রহমত শেখ শহরে এসে একদিন দেখে ছোট ভাই সলিম এখানে মুচি হয়ে বসে আছে। কী যে আনন্দ হয় তার! পান একটা মুখে দিয়ে সলিমের সামনে এসে বাটার জুতোটা খুলে সামনে রাখে। তারপর হাসতে হাসতে বলে, ‘তুই কল্লি যুদ্ধ, আর জিতলাম আমি! নে, কয়টা টাকা পাবি। আমার জুতোটা একটু পালিশ করে দে তো!’
সলিম চকিতে রহমত শেখের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর সরোসে রহমতের জুতো জোড়া ছুড়ে ফেলে রাস্তায়। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘রাজাকারের জুতা পালিশ করার জন্য সলিম শেখের জন্ম হয় নাই!’
একটু কেঁপে ওঠে রহমত শেখ। তারপর সাপের মতো হিসহিস করে বলে, ‘রাজাকারের জুতো পালিশ কল্লি কি মুক্তিযোদ্ধার জাত যায়? তোরে একদিন আমার জুতো পালিশ কত্তি হবে, এই বলে দিলাম।’
এই ঘটনার পর অনেকবার জুতো নিয়ে সলিমের সামনে দাঁড়িয়েছে রহমত। সলিম প্রতিবারই ওর জুতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। রহমতের মনে হয়েছে, সলিমকে হারিয়েও যেন হারানো যাচ্ছে না। ওর মনে জমে ওঠে ক্রোধ। যে করেই হোক, রহমতের জুতো পালিশ করাতেই হবে সলিমকে দিয়ে!
ভেবে ভেবে রহমত একটা উপায় বের করে। একদিন সলিমের অচেনা এক লোক এক জোড়া জুতো এনে রাখে সলিমের সামনে। বলে, ‘মিয়া, পালিশ কইরে দাও।’
সরল মনে সলিম সে জুতো পালিশ করে দেয়। তারপর যখন অপরাহ্ণের ছায়া এসে দুপুরের রোদকে ম্লান করে দিচ্ছে, তখন রহমত শেখের হাসি মুখ দেখতে পায় সলিম।
রহমত এসে বলে, ‘কী রে মুক্তিযোদ্ধা! তুই নাকি আমার জুতো পালিশ করবি না! এই যে দ্যাখ! আমার পায়ে তোর পালিশ করা জুতো!’
এরপর হাসতে হাসতেই তিন রাস্তার মোড়ের রিন্টু টি স্টলে গিয়ে বসে রহমত শেখ। ওর হাসিটা সলিম শেখের বুকের মধ্যে এসে বাজে। একটু আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা একেবারেই মেনে নিতে পারছে না সলিম।
হঠাৎ ওর বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। কী করা যায়, সে কথা ভাবতে থাকে সলিম। তারপর বাক্সের ভেতরে কাপড়ের নিচে সযত্নে রাখা বিয়ের আংটিটা বের করে। ছুটে যায় পাশে থাকা ছক্কু মিয়া জুয়েলার্সে। আংটিটা বিক্রির ইচ্ছে জানায়। ছক্কু মিয়া সেটা দেখে যে দর বলে, তা আংটির আসল দামের চেয়েও কম। কিন্তু দামাদামি করে না সলিম।
টাকাটা পকেটে পুরে বাটার দোকানে ঢোকে। রহমতের জুতোর সাইজটা মনে আছে ওর। বাটা থেকে সে রকম এক জোড়া জুতো কিনে নেয়। তারপর মুদিদোকান থেকে একটা দেশলাই কেনে। হনহন করে রিন্টু টি স্টলে ঢুকে পড়ে। ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায় রহমত শেখ। কোনো কথা না বলে রহমত শেখের পা থেকে জোর করে জুতো জোড়া খুলে নেয় সলিম। ওর বৃদ্ধ শরীরে যেন পেশিবহুল হাতের শিরা-উপশিরাগুলো কাঁপতে থাকে। রহমত শেখ ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। জুতো জোড়া তিন রাস্তার মোড়ে রেখে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সলিম শেখ। তারপর নতুন জুতোর বাক্সটা ছুড়ে দেয় রহমতের দিকে। গলা সরু করে বলে, ‘আর কোনো দিন আমার সামনে জুতো নিয়ে আসলি জুতো পুড়াব না, পুড়বে অন্য কিছু!’
সলিম শেখের মন ভালো নেই। একটু আগে যে ঘটনাটা ঘটে গেছে, সেটার ভার নিতে পারছে না সে।
পাড়ার তিন রাস্তার মোড়ের ল্যাম্পপোস্টটার নিচে প্রতিদিন ছালা পেতে বসে সলিম শেখ।
জুতা সারাইয়ের যন্ত্রপাতি রাখে আরেকটা ছালার ওপর। মাথার ওপর একটা বিবর্ণ ছাতা ছায়া দেয়। ওটা পেছন দিকে দড়ি দিয়ে কী এক উপায়ে বেঁধে রাখা হয়।
সলিম শেখের বয়স হয়েছে। কেউ বলে সত্তর, কেউ বলে আশি। তবে আশির কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, যুদ্ধের ডাক এসেছিল যখন, তখন সে ছিল বিবাহিত।
সত্তর সালের এক প্রবল শীতের রাতে রোকেয়াকে ঘরে এনেছিল সলিম। সে সময় ওর পেশিতে প্রবল টান। শরীর নাড়ালেই পেশি ফুলে ওঠে। সেই পেশির দড়িতে ভরা হাত দিয়ে যখন হাল চাষ করত সে, তখন আশপাশের পুরুষেরা এসে হাঁ করে দেখত—কত গভীরে চলে যাচ্ছে লাঙলের ফলা! খেতের অনেক দূরে কলার ঝোপে লুকিয়ে মেয়েরাও তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তারিফ করত সে শরীরের। কখনো গায়ের গেঞ্জিটা খুলে ঘর্মাক্ত শরীরে যদি হাল চাষ করত সলিম, তখন পাড়ার পড়ালেখা জানা কেউ কেউ ফিসফিস করে বলত, ‘এ তো একেবারে মোহাম্মদ আলী ক্লে।’
যারা বুঝত না, তাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিত, কার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সলিমের। বক্সিংয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী। ওর আগে নাম ছিল ক্লে। এখন মোহাম্মদ আলী। এ কথা বলার পর ক্লের আলী হয়ে ওঠার গল্পটাও শুনিয়ে দিত।
সলিমের একটা নেশা ছিল। জুতো সারাইয়ের নেশা। অবসর সময়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেঁড়া স্যান্ডেল বা জুতো খুঁজত সে। সারাই করে দিত। সেটা নেশাই ছিল। বিনিময়ে কোনো পয়সা কড়ি নিত না।
মেয়েরা ওকে চাইত। কিন্তু পাশের পাড়ার রোকেয়ার প্রতি ছিল সলিমের টান। বাবা-মাকে রোকেয়ার কথা বলায় কেউ আর আপত্তি করেনি। রোকেয়াকে নিয়ে সংসার ছিল সুখের। সোনাদানা না থাকলেও খেতে ছিল ফসল। সেই ফসল সোনাদানার দুঃখ ভুলিয়ে দিত। টাকাপয়সাওয়ালা হয়নি বটে, কিন্তু দুইবেলা তো ভাত জুটছে, তাতেই খুশি ছিল ওরা।
কিন্তু পরের বছর লাগল যুদ্ধ। এর আগে তো ছিল নির্বাচন। ওদের গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে শহরের টাউন হলে এসেছিলেন সেই জাদুকর।
লম্বা মহিরুহের মতো দেহ তাঁর। তিনি তাঁর ভরাট কণ্ঠে দেশের মানুষের অধিকারের কথা বললেন। সলিম শেখ তার শরীরের শিরায় শিরায় যেন তাঁকে অনুভব করল।
গ্রামে ফিরে এসে সলিম শেখ বলল, ‘আমি শেখ সাহেবরে দেখিসি। তাঁর কথা শুনিসি!’
চাচাতো ভাই রহমত শেখ সলিমের চেয়ে চার বছরের বড়। তার পক্ষপাতিত্ব জামায়াতে ইসলামীর দিকে। মওদুদী তার মা-বাপ। সে মুখ ঝাপটে উঠল। ‘দেশটারে ভাইঙ্গে ফেলবে এই শ্যাখের পো। সেটা দেখতি পাচ্ছিস না?’
সলিম শেখের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। বলে, ‘দেশের আছেটা কী যে ভাঙবে? সব তো খেয়ে নিল পাঞ্জাবিরা! ইয়াহিয়া তো ভোট দিছে। জিতা নাও। তারপর কথা কইও। সারা দেশ চায় শ্যাখ সাহেবরে, আর তুমি কও উল্টা কথা!’
রহমত শেখ বলে, ‘শ্যাখ সাহেব খালি বক্তৃতাই দিতে পারে! তাঁর কথা শুনলে পাকিস্তান ভাইঙ্গে যাবে।’
রহমত শেখের কথা অবশ্য মিথ্যে ছিল না। দেশটা সত্যিই ভেঙে গেল। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা দেওয়া হলো না, তখন কী থেকে কী হলো, বেঁধে গেল যুদ্ধ। সলিম শেখ রোকেয়াকে বলল, ‘দেশ বাঁচাতি চললাম। তোমরা টিকে থাকার চেষ্টা কইরো।’
এরপর রহমত শেখ রাজাকার হলো। গ্রামের জীবিত তরুণদের কতল করল, জীবিত তরুণীদের তুলে দিল পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। জ্বালিয়ে দিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি।
ঘরছাড়া করল সে বাড়িগুলোয় বসবাসকারীদের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ল রহমত শেখ। ওর হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধারা ওকে নিয়ে এল বটতলায়। একজন বলল, ‘হারামজাদারে এখনই কতল করো।’
অন্যজন বলল, ‘দাঁড়াও, সলিম ভাই আইসে নিক। তিনিই বিচার করবেন।’
সলিম শেখকে দেখে তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রহমত শেখ। বলল, ‘সলিম, আমাকে বাঁচা। সারা জীবন তোর গোলাম হয়ে থাকব, আমারে বাঁচা।’
মায়া হলো সলিম শেখের। আত্মীয় তো! কী করে এ রকম শান্তির সময় কাউকে মেরে ফেলা যায়। সলিম কিছু বলার আগে কমান্ডারই বললেন, ‘সলিম, ওকে মাফ করে দাও।
শুধু চোখে চোখে রেখো!’
যাক! রহমত শেখের ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত আর নিতে হলো না।
সোজা থানায় গিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে ধানি জমিতে কীভাবে চাষ করা যায়, সে কথাই ভাবতে লাগল সলিম।
এরপর আবার কী থেকে কী হয়ে গেল। সলিমের বাবার ধরা পড়ল ক্যানসার। জমিগুলো বিক্রি করা হলো বাবাকে বাঁচানোর জন্য। কিনে নিল রহমত। বাঁচল না বাবা। সে শোকে মায়ের হলো হার্ট অ্যাটাক। এবার বসতবাড়িটাও বন্ধক রাখা হলো। বন্ধকের টাকা দিল কে? রহমত।
সবকিছু বদলে গেল গ্রামের। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার সবাই রহমত শেখের ন্যাওটা হয়ে গেল। সবাই যখন ভোল পাল্টে ফেলেছে, তখন সেই ভোল পাল্টানো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গেল সলিম। বলল, ‘ওই হারামজাদারে তো আমরা বাঁচালাম। ওর পিছে পিছে আমরা ঘুরব ক্যান?’
মুক্তিযোদ্ধারা চোখ নামিয়ে নিয়ে রহমত শেখের বাড়িতে গিয়ে হুঁকায় দম দিতে লাগল। রাজাকারের পাল ওদের ওপর কালো মেঘ হয়ে ভাসতে থাকল।
শেষে যখন সবকিছু হারিয়ে ফেলল সলিম, তখন ওর বউ রোকেয়া বলল, ‘এখন আমি এখানে কী করে থাকি! এই দ্যাশে থাকলি শরীর বেইচে খাতি হবে। আমি বাপের বাড়ি গিলাম। অবস্থা ফিরলে আমাকে ডাইকে আইনো।’
রোকেয়ার প্রস্থান পথের দিকে তাকিয়ে থাকে সলিম। তারপর তাকায় তার আঙুলে থাকা বিয়ের আংটির দিকে। না বলা অনেক কথা যেন শূন্য হাওয়ায় ঘুরতে থাকে।
কিছুই যখন করার নেই, তখন পেট বাঁচানোর জন্য মুচির কাজ বেছে নিল সলিম। আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা ছিল না ওর। যেটুকু টাকা ছিল, তা দিয়ে জুতো সারাইয়ের সরঞ্জাম কিনল। তারপর একদিন কাউকে কিছু না বলে চলে এল পাঁচ মাইল দূরের শহরে, যে শহরে একদিন শেখ সাহেব বক্তৃতা করেছিলেন। তিন রাস্তার মোড়ে বসে শুরু হলো মুচি সলিমের জীবনযাপন। সঙ্গে থাকল শুধু সোনার আংটি, যেটা সে গড়িয়েছিল বিয়ের সময়। সুখস্মৃতি বলতে শুধু এটাই। আঙুল থেকে খুলে বাক্সের ভেতরে কাপড়ের নিচে সেটা রেখে দেয়।
রহমত শেখ শহরে এসে একদিন দেখে ছোট ভাই সলিম এখানে মুচি হয়ে বসে আছে। কী যে আনন্দ হয় তার! পান একটা মুখে দিয়ে সলিমের সামনে এসে বাটার জুতোটা খুলে সামনে রাখে। তারপর হাসতে হাসতে বলে, ‘তুই কল্লি যুদ্ধ, আর জিতলাম আমি! নে, কয়টা টাকা পাবি। আমার জুতোটা একটু পালিশ করে দে তো!’
সলিম চকিতে রহমত শেখের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর সরোসে রহমতের জুতো জোড়া ছুড়ে ফেলে রাস্তায়। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘রাজাকারের জুতা পালিশ করার জন্য সলিম শেখের জন্ম হয় নাই!’
একটু কেঁপে ওঠে রহমত শেখ। তারপর সাপের মতো হিসহিস করে বলে, ‘রাজাকারের জুতো পালিশ কল্লি কি মুক্তিযোদ্ধার জাত যায়? তোরে একদিন আমার জুতো পালিশ কত্তি হবে, এই বলে দিলাম।’
এই ঘটনার পর অনেকবার জুতো নিয়ে সলিমের সামনে দাঁড়িয়েছে রহমত। সলিম প্রতিবারই ওর জুতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। রহমতের মনে হয়েছে, সলিমকে হারিয়েও যেন হারানো যাচ্ছে না। ওর মনে জমে ওঠে ক্রোধ। যে করেই হোক, রহমতের জুতো পালিশ করাতেই হবে সলিমকে দিয়ে!
ভেবে ভেবে রহমত একটা উপায় বের করে। একদিন সলিমের অচেনা এক লোক এক জোড়া জুতো এনে রাখে সলিমের সামনে। বলে, ‘মিয়া, পালিশ কইরে দাও।’
সরল মনে সলিম সে জুতো পালিশ করে দেয়। তারপর যখন অপরাহ্ণের ছায়া এসে দুপুরের রোদকে ম্লান করে দিচ্ছে, তখন রহমত শেখের হাসি মুখ দেখতে পায় সলিম।
রহমত এসে বলে, ‘কী রে মুক্তিযোদ্ধা! তুই নাকি আমার জুতো পালিশ করবি না! এই যে দ্যাখ! আমার পায়ে তোর পালিশ করা জুতো!’
এরপর হাসতে হাসতেই তিন রাস্তার মোড়ের রিন্টু টি স্টলে গিয়ে বসে রহমত শেখ। ওর হাসিটা সলিম শেখের বুকের মধ্যে এসে বাজে। একটু আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা একেবারেই মেনে নিতে পারছে না সলিম।
হঠাৎ ওর বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। কী করা যায়, সে কথা ভাবতে থাকে সলিম। তারপর বাক্সের ভেতরে কাপড়ের নিচে সযত্নে রাখা বিয়ের আংটিটা বের করে। ছুটে যায় পাশে থাকা ছক্কু মিয়া জুয়েলার্সে। আংটিটা বিক্রির ইচ্ছে জানায়। ছক্কু মিয়া সেটা দেখে যে দর বলে, তা আংটির আসল দামের চেয়েও কম। কিন্তু দামাদামি করে না সলিম।
টাকাটা পকেটে পুরে বাটার দোকানে ঢোকে। রহমতের জুতোর সাইজটা মনে আছে ওর। বাটা থেকে সে রকম এক জোড়া জুতো কিনে নেয়। তারপর মুদিদোকান থেকে একটা দেশলাই কেনে। হনহন করে রিন্টু টি স্টলে ঢুকে পড়ে। ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায় রহমত শেখ। কোনো কথা না বলে রহমত শেখের পা থেকে জোর করে জুতো জোড়া খুলে নেয় সলিম। ওর বৃদ্ধ শরীরে যেন পেশিবহুল হাতের শিরা-উপশিরাগুলো কাঁপতে থাকে। রহমত শেখ ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। জুতো জোড়া তিন রাস্তার মোড়ে রেখে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সলিম শেখ। তারপর নতুন জুতোর বাক্সটা ছুড়ে দেয় রহমতের দিকে। গলা সরু করে বলে, ‘আর কোনো দিন আমার সামনে জুতো নিয়ে আসলি জুতো পুড়াব না, পুড়বে অন্য কিছু!’
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪