রাকিব হাসান
সিআর-৭ ফ্রি-কিক নিচ্ছে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে ডান পাশ থেকে। কিকের আগে তার সেই ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে মন্দ লাগে না। এ দিকে, আমার ঠোঁটে সিগারেট অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। রোনালদোর ফ্রি-কিক বেপথু হয়নি। রক্ষণভাগে থাকা প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে বলটা কেমন যেন নেচে উঠল। বারের ঠিক কোনা দিয়ে পর্তুগিজ সেনার লেখা ঠিকানায় পৌঁছে গেল বলটি। রোনালদোরা ১-০ তে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে কে যেন ‘গোল’ বলে খানিক শব্দও করল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের দেশে এমন নিখুঁত ফুটবল কবে হবে!
গোল্ডলিফে শেষ টানটা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে কটা বাজে দেখলাম। এক কাপ চা হলে ভালো হয়। টেলিভিশনে চোখ রেখেই দোকানিকে বললাম, ‘মামা, দুধ বাড়ায়া ছোট করে একটা চা দাও।’
লঞ্চ ছাড়বে রাত ঠিক ১২টা ৩০। কাঁধের ব্যাগ খানিক পরপর ঝুলে যাচ্ছে। বেচারা মনে হয় আমার কাঁধে ঝুলে আরাম পাচ্ছে না! ঠিক তোমার মতো। হাতে সময় এখনো ঘণ্টাখানেক। ঘাটের ভেতর আরও পরে ঢুকব বলে মনস্থির করলাম। ততক্ষণ কী করা যায় ভাবছি। এত রাত; সদরঘাট এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক ঘোরার উপায় নেই। দেশের অবস্থা বেহাল। ছিনতাইকারী না ধরলেও পুলিশের খপ্পরে পড়া নিশ্চিত!
দোকানের বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খেলা লাইভ নাকি পুরোনো। দোকানি খদ্দর বিদায় করতে গিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে ভুলে গেছে হয়তো! আবার দারুণ ফুটবলপ্রেমীও হতে পারে। ব্যাপারটা এই পরিবেশের সাথে যায় না আসলে। কলকাতা সিনেমার কোনো গান কিংবা বেবি ডল হলে জমত। চারদিকের হাজার হাজার ওয়াটের বাতিগুলো পরিবেশে একটা উৎসব ভাব এনেছে।
ইতিউতি দেখতেই ১৮-২০, আবার ২১-২২ বছরও হতে পারে। এখনকার মেয়েদের বয়স ঠাওর করা কঠিন হ্যাপার কাজ। জিনস আর টিশার্টে বেশ লাগছে মেয়েটাকে। কে জানে? কাছে গেলে দেখা যাবে, ভালো লাগা উবে গেছে কিংবা গলার স্বর শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে! অগত্যা টিভিতেই তাকালাম। খেলা অনেকটা শেষের দিকে। রোনালদোর দল আরও এক গোল দিল বোধয়।
দোকানি ঠিকঠাক চা করে সামনে রেখেছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে পাশ করে দাঁড়িয়ে। বেশ আঁটসাঁট টিশার্টে তার শারীরিক অস্তিত্ব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। ওইদিকে এর-ওর নজরও পড়ছে। মেয়েটিও সেটা খেয়াল করছে বলে মনে হলো। তবে সে নির্লিপ্ত। হয়তো ভাবছে ক্ষতি কী? বাসন্তী বাতাসে তার কাঁধ পর্যন্ত নামা অবাধ্য খোলা চুলগুলো শুকনো খড়ের মতো উড়ছে। একটু পরপর সেগুলো ঠিক করছে সে। আর এমন ভাব করছে, পারলে দু–চার কথা শুনিয়ে দেয় যেন! গালে হালকা মেকআপের কারুকাজ তাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটে গোলাপি রঙের ম্যাট লিপস্টিক, আর গাঢ় কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে ডাগর করার সফল চেষ্টা। বেশ গোছালো।
তার টিশার্টে ঠিক বুকের ওপর কী যেন লেখা। শেষের শব্দটি দেখতে পাচ্ছি পাশ থেকে, ‘এট মি’। কী হতে পারে পুরো বাক্যটি! ‘ডোন্ট লুক এট মি’, ‘লুক এট মি’ নাকি অন্য কিছু। কিছুক্ষণ ফিল ইন দ্য গ্যাপ পূরণের খেলা খেললাম।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কী একা...? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? লঞ্চে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ইয়ে মানে...আমিও একা। লঞ্চে একা জার্নি করা বিরক্তিকর। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি। আমার সঙ্গ খারাপ লাগবে না, গ্যারান্টি।’ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই বুকের ভেতর পালপিটেশন বেড়ে গেছে।
হা. . হা...নিজের মনেই হেসে ফেললাম। এতটা বেহায়া কী হওয়া যায়!
এসব ভাবনা যখন মস্তিষ্কের এ গলি ও গলি ছুটছে, তখনই নজর পড়ল বাঁ পাশে থাকা আরেক রমণীর দিকে। ভাগ্যদেবী শুধু মুখ তুলেই আমার দিকে তাকায়নি; একেবারে কোলে নিয়ে বসেছে বোধয়। তা না হলে আমার মতো এহেন অভাগার বাঁ-ডানে দুই সুন্দরী। এ যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি দশা! আচ্ছা, দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম যেন। সুন্দরের সংজ্ঞাই বা কী? স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে পারেননি। ‘মুই কী হনুরে!’
তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম জন; মানে জিনস আর টিশার্ট পরা তরুণীর মধ্যে আবিষ্কার করার কিছু নেই। অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে তার পোশাকের কারণে শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ রহস্য তৈরি করেছে। কেমন যেন ঢেউ খেলে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। আর সাঁতার প্রিয় কেউ এমন শান্ত ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে আরাম পাবেন নিশ্চিত! তার অবস্থা এমন যেন, মধ্যবিত্ত ঘরে মেজবান আসা উপলক্ষে বিছানায় অনেক দিন পর বের করা বালিশের কভার, চাদর। টি-টেবিলে ভাঁজ না ভাঙা টেবিলক্লথ, দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা ম্যারাডোনার কোনো ছবি ঝোলানো। অন্যপাশে দেয়াল ঘড়িটা তার কাজ করে যাচ্ছে টিকটিক করে। ক্যালেন্ডারের পাতাও ঠিকভাবে ওলটানো। দেখেই বোঝা যায় সব পরিকল্পনা মতো সাজিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় জন; যার পরনে হালকা কচু পাতা রঙের শিফন শাড়ি। বেশ খানিকটা অগোছালো। আঁচলে প্লিট করা নেই, উঁচু বুকের ওপর এমনি ফেলে রাখা হয়েছে। চওড়া কাঁধ আর বেশ খানিকটা খোলা পিঠ বেয়ে চুলের বেনীটাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শাড়ির বুননে লুকিয়ে থাকা কোমরের খাঁজে হালকা মেদ আর উঁকি মারা তকতকে পেট তাকে আরও যেন নরম তুলতুলে করে তুলেছে। চোখ পড়তেই যেন ছুঁতে মন চায়।
বড়লোকের ড্রয়িং রুমের মতো সবই আছে। ইতালিয়ান ফিটিংস, দেয়ালে দামি পেইন্টিং, দামি সোফা, শুধু অতিথি আসবে বলে গোছানোর সময় পায়নি কেউ। কিংবা ফাঁকিবাজ কাজের লোকের কাছে যে অতিথি আসবেন, তার কোনো দামই নেই।
কী নেই মেয়েটির মাঝে? খোলা পিঠ, চওড়া কাঁধ, উঁচু বুক, ভারী নিতম্ব, গাছপাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। সবই আছে, আমি কবি-সাহিত্যিক হলে আরও ভালো বলতে পারতাম হয়তো। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশ খানিকটা পরিশ্রম করতে হবে। অথবা জহুরির চোখ লাগবে। শরীর বেয়ে তার মুখে উঠলাম। ওর চোখ আমার চোখ একটু কথা বলে নিল যেন। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝলাম না। চোখ দু’টি; আহা...ঠিক যেন চৈত্রের ভোরে বাঁধানো দিঘির শান্ত পানি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডুব মারি।
একটু স্মৃতিমেদুর হলাম; এই চোখই সব শেষ করল আমার।
একই অফিসে যখন ছিলাম তখন তোমার চোখ আর আমার চোখ সারা বেলাই গুটুরগুটুর আলাপ করত। একদিন লিফটের ভেতর তুমি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলে। পরে ফোন দেবে আমি ভাবিনি।
কোনো এক রাতে তুমি ফোন দিয়েছিলে এবং আমাদের সারা রাত কথা হয় সেদিন। আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তোমারই তিন-চারটা নম্বর। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেল। হাত ধরে সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি। কখনো ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা, কখনো দুই পা-ই ছিল ভরসা। কখনো নীলক্ষেতের ঘুপচি দোকান, কখনো আবার শহরের দামি কোনো রেস্তোরাঁ। আমার এই রুগ্ণ কাঁধে মাথা রেখে কত বিকেল পার করেছ তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটাতে আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট রুম ছাড়াও আশ্রয় নিতে এর ওর বাসায়। পোষা বিড়াল ছানার মতো তোমায় কোলে নিয়ে রাত পার করে দিয়েছি কত। তুমি ঘুমাতে আর আমি তোমার বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখতাম। মাঝেমধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া তোমার শরীরের নেশা ধরা গন্ধে মাদকের স্বাদ নিতে নিতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত পোহালে তোমার শুকনো ঠোঁটের ছোঁয়ায় অদ্ভুত রকমের ভালো লাগায় কেঁপে উঠতাম। আর জেগে উঠে তোমাকে আবিষ্কারের কঠোর পরিশ্রম। প্রথম প্রহরের সেই শারীরিক ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের শব্দ আমার ঝাঁপিতে নেই, সত্যি বলছি।
চা শেষ। আরেকটা সিগারেট দরকার। শরীর এত নিকোটিন চাইছে কেন বুঝতে পারছি না। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নেয় না। তার মানে আমি পুরোপুরি ফিট! ‘এটাই শেষ। লঞ্চে উঠে আর দুইটা খাব।’ মনে মনে আরেকটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। মানুষ আসলে যা পারবে না সেটা করার জন্যই প্রতিজ্ঞা করে। যেটা পারবে কিংবা হওয়ার সেটা এমনিতেই হয়।
সেদিন গুলশান-১–এর ১১৬ নম্বর রোডের শেষ মাথায় তুমিসহ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমি সিগারেট ধরাতেই তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘হঠাৎ গোল্ডলিফ কেন?’ বলেছিলাম, ‘১৬ টাকার সিগারেটে পোষায় না।’ চা-সিগারেট শেষ করে তোমার গালে আলতো ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘এতটুকু কমেনি আমার ভালোবাসা।’ তুমি তখন কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না। সেটা সম্ভব না।’ মনে হয় নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলে। যেটা পরে তুমি রাখতে পারবে না কিংবা রাখবে না বলে নিশ্চিতভাবেই জানতে।
লঞ্চ ঢেকুর তুলছে। আমার মনে হচ্ছে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। দোকানির কাছ থেকে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একেবারে ঠিক সময়ে ছেড়েছে লঞ্চ। ভেতরেই টিকিটের ব্যবস্থা। নামার সময় কাটলেও নাকি চলে। রিস্ক নিতে চাইলাম না। ১০০ টাকায় পুরো লঞ্চ কিনে নিলাম! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই লঞ্চ শেষ কোথায় ভিড়বে?’ সেই লোক খুব গুছিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, ‘আপনে কই যাইবেন?’
সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এখন দেখা করতে চাও না কেন?’ তুমি বলছিলে, ‘এত দেখা করে কী হবে!’
লঞ্চ নদীর বুকে ভাসতে শুরু করেছে। ঘাট ছেড়ে এসেছে ২০-২৫ মিনিট হলো। তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ প্রায় পৌনে চার মাস।
প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করার একটা জেদ কাজ করে ইদানীং। দেখা না হলে মাথা ভার হয়ে আসে, এরপর আধ কপালী মাথাব্যথা শুরু হয়। খুবই অসহ্য। তুমি বিরক্ত হও বুঝি। তবু যাই; না গিয়ে উপায় আছে? তুমি-ই বলেছিলে, ‘আমি কোথায় হারাব? তুমি তো আমার সব চেনো। গিয়ে নিয়ে আসবে।’
তোমার সামনে যাই। ‘কেন চলে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলে বল, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগে না।’ যুক্তিসংগত কথা। ভালো না লাগলে আর কী করা। মানুষ তো আর রোবট না যে, সুইচ ঘুরিয়ে দিলাম আর ভালো লাগা শুরু হলো। আচ্ছা; একইভাবে সুইচ ঘুরিয়ে খারাপ লাগানোও তো সম্ভব না! দুইটার একটারও ব্যবস্থা নাই। তা হলে আমি দ্বিতীয়টি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতাম অন্তত।
সেদিন আবার বললে, ‘তোমার সাথে আমার অ্যাডজাস্ট হয় না।’
কী যে বল না তুমি! আমি তো আর কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্ট না। তুমিও পেনড্রাইভ কিংবা ক্যাবল না যে অ্যাডজাস্ট হতে হবে। এত দিন যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে।’ উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এত দিন কোথায় ছিলাম? আমি এত দিন ছিলাম না। তুমি জোর করেছ। তাই-ই ছিলাম।’ তোমার পাল্টা জবাব ছিল এটা।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে এত দিন তুমি আমাকে ভালোবাসনি! তোমার সবকিছু; আমাকে দেওয়া কথা, দেখানো স্বপ্ন ধোঁকা ছিল! ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা? অভিমান ভাঙাতে আমার গালে প্রজাপতি চুমু এঁকে দেওয়া, বিদায় বেলায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফরাসি চুমু; এসব, সব মিথ্যা, অভিনয়, ধোঁকা!’
তোমার এসব কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য সব যেন থেমে গিয়েছিল সেদিন। বোমি আসছিল, সামনের সবকিছু হলুদ মনে হয়েছিল। সেসব তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমিও বুঝতে চাওনি।
চশমার গ্লাসগুলো মুছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখন জোর করি তাহলে থাকবে? তুমিতো বলেছিলে চলে গেলে তোমাকে যাতে যেতে না দিই।’ ‘সেটা আর সম্ভব নয়। আমি মরে গেলেও তোমাকে আপন করতে পারব না। তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা তো অনেক দূরের কথা।’ কথাগুলো যখন বলছিলে তোমাকে অনেকটা ডিটারমাইন্ড দেখলাম তখন।
ব্যাপারটা এমন যেন, তোমার মন চাইল, দরকার ছিল তুমি থাকলে এখন মন চাইল কিংবা দরকার শেষ চলে গেলে। মানে, ‘আপনা বুঝ, লাল তরমুজ!’ এখন তোমার লক্ষ্য দেখেশুনে পয়সা ওয়ালা, সফল (তোমার ভাষ্যমতে) কারও সাথে বাকি জীবন পার করা। সেটা কথা প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেও ছিলে। সেদিন ভেবেছিলাম ঠাট্টা। এখন মনে হচ্ছে না সেটাই সত্য।
আচ্ছা তাহলে আমি কী ছিলাম? আমার সাজানো মাঠে খেললে তাহলে? এই এখন কিংবা ভবিষ্যতে ভালো খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ এই মাঠে! ঠিকঠাক কোন পিচে কত গতিতে বল করবে, কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সেই বল টার্ন করাবে কিংবা কোন বল ফ্রন্ট ফুটে খেলবে নাকি ব্যাকফুটে খেলবে এসব? আমাকে দিয়ে তুমি নেট প্র্যাকটিস করেছ তাহলে! আসলে মাধবীলতারা উপন্যাসেই থাকে, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে সমাধান?’ ‘হয় তুমি মরে যাও। অথবা আমাকে মেরে ফেল।’ সাফ জবাব দিয়েছিলে তুমি। ‘তোমাকে মারা সম্ভব হবে না। আর নিজে মরব এতটা সাহস আমার নেই।’ আমি আত্মসমর্পণের চেষ্টা করেছিলাম।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের গা থেকে এক-দুই ফোঁটা করে আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোয় নদীর পানি ভিজে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে লঞ্চ সাঁতরাচ্ছে। আচ্ছা, কত লঞ্চতো ডুবে যায়। কত মানুষ তো মরে ভেসে ওঠে। অনেকের তো লাশও মেলে না। স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যায় যে, তারা অপেক্ষা করছে। ‘অপেক্ষা’ কঠিন এক জিনিস। তুমি কী অপেক্ষা করবে, আমার প্রাণহীন শরীরের জন্য? যার অর্ধেকটা কিংবা কোনো অংশ নদীর তলে থাকা কোনো প্রাণী খাবলে নেবে কিংবা পচে যাবে। হয়তো আমার পুরো শরীরটিই পচে দুর্গন্ধ বের হবে। তুমি কী সত্যি দেখতে আসবে আমার পচে, গলে গন্ধ বের হওয়া সেই শরীর? নাকি তোমার তরতাজাটাই চাই?
জোছনায় ভিজে ভিজে লঞ্চ কষ্টের নিশ্বাস ফেলছে। আমি তাকিয়ে জোছনা ভেজা নদীর পানিতে। জলদানবের কষ্ট আর আমার কষ্ট মিলেমিশে একাকার। দুজনেই জোছনা ভেজা পানিতে সাঁতরাচ্ছি।
কে যেন বলেছিল, ‘মানুষে মেশিনে এত মিল, কালে কালে ক্ষয়ে যায়।’
আচ্ছা, ওই তরুণীদের দেখছি না যে? তারা কী এই লঞ্চে উঠেছে? নাকি ঠিকানা পেয়ে গেছে, আজ রাতের জন্য?
সিআর-৭ ফ্রি-কিক নিচ্ছে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে ডান পাশ থেকে। কিকের আগে তার সেই ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে মন্দ লাগে না। এ দিকে, আমার ঠোঁটে সিগারেট অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। রোনালদোর ফ্রি-কিক বেপথু হয়নি। রক্ষণভাগে থাকা প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে বলটা কেমন যেন নেচে উঠল। বারের ঠিক কোনা দিয়ে পর্তুগিজ সেনার লেখা ঠিকানায় পৌঁছে গেল বলটি। রোনালদোরা ১-০ তে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে কে যেন ‘গোল’ বলে খানিক শব্দও করল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের দেশে এমন নিখুঁত ফুটবল কবে হবে!
গোল্ডলিফে শেষ টানটা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে কটা বাজে দেখলাম। এক কাপ চা হলে ভালো হয়। টেলিভিশনে চোখ রেখেই দোকানিকে বললাম, ‘মামা, দুধ বাড়ায়া ছোট করে একটা চা দাও।’
লঞ্চ ছাড়বে রাত ঠিক ১২টা ৩০। কাঁধের ব্যাগ খানিক পরপর ঝুলে যাচ্ছে। বেচারা মনে হয় আমার কাঁধে ঝুলে আরাম পাচ্ছে না! ঠিক তোমার মতো। হাতে সময় এখনো ঘণ্টাখানেক। ঘাটের ভেতর আরও পরে ঢুকব বলে মনস্থির করলাম। ততক্ষণ কী করা যায় ভাবছি। এত রাত; সদরঘাট এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক ঘোরার উপায় নেই। দেশের অবস্থা বেহাল। ছিনতাইকারী না ধরলেও পুলিশের খপ্পরে পড়া নিশ্চিত!
দোকানের বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খেলা লাইভ নাকি পুরোনো। দোকানি খদ্দর বিদায় করতে গিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে ভুলে গেছে হয়তো! আবার দারুণ ফুটবলপ্রেমীও হতে পারে। ব্যাপারটা এই পরিবেশের সাথে যায় না আসলে। কলকাতা সিনেমার কোনো গান কিংবা বেবি ডল হলে জমত। চারদিকের হাজার হাজার ওয়াটের বাতিগুলো পরিবেশে একটা উৎসব ভাব এনেছে।
ইতিউতি দেখতেই ১৮-২০, আবার ২১-২২ বছরও হতে পারে। এখনকার মেয়েদের বয়স ঠাওর করা কঠিন হ্যাপার কাজ। জিনস আর টিশার্টে বেশ লাগছে মেয়েটাকে। কে জানে? কাছে গেলে দেখা যাবে, ভালো লাগা উবে গেছে কিংবা গলার স্বর শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে! অগত্যা টিভিতেই তাকালাম। খেলা অনেকটা শেষের দিকে। রোনালদোর দল আরও এক গোল দিল বোধয়।
দোকানি ঠিকঠাক চা করে সামনে রেখেছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে পাশ করে দাঁড়িয়ে। বেশ আঁটসাঁট টিশার্টে তার শারীরিক অস্তিত্ব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। ওইদিকে এর-ওর নজরও পড়ছে। মেয়েটিও সেটা খেয়াল করছে বলে মনে হলো। তবে সে নির্লিপ্ত। হয়তো ভাবছে ক্ষতি কী? বাসন্তী বাতাসে তার কাঁধ পর্যন্ত নামা অবাধ্য খোলা চুলগুলো শুকনো খড়ের মতো উড়ছে। একটু পরপর সেগুলো ঠিক করছে সে। আর এমন ভাব করছে, পারলে দু–চার কথা শুনিয়ে দেয় যেন! গালে হালকা মেকআপের কারুকাজ তাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটে গোলাপি রঙের ম্যাট লিপস্টিক, আর গাঢ় কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে ডাগর করার সফল চেষ্টা। বেশ গোছালো।
তার টিশার্টে ঠিক বুকের ওপর কী যেন লেখা। শেষের শব্দটি দেখতে পাচ্ছি পাশ থেকে, ‘এট মি’। কী হতে পারে পুরো বাক্যটি! ‘ডোন্ট লুক এট মি’, ‘লুক এট মি’ নাকি অন্য কিছু। কিছুক্ষণ ফিল ইন দ্য গ্যাপ পূরণের খেলা খেললাম।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কী একা...? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? লঞ্চে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ইয়ে মানে...আমিও একা। লঞ্চে একা জার্নি করা বিরক্তিকর। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি। আমার সঙ্গ খারাপ লাগবে না, গ্যারান্টি।’ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই বুকের ভেতর পালপিটেশন বেড়ে গেছে।
হা. . হা...নিজের মনেই হেসে ফেললাম। এতটা বেহায়া কী হওয়া যায়!
এসব ভাবনা যখন মস্তিষ্কের এ গলি ও গলি ছুটছে, তখনই নজর পড়ল বাঁ পাশে থাকা আরেক রমণীর দিকে। ভাগ্যদেবী শুধু মুখ তুলেই আমার দিকে তাকায়নি; একেবারে কোলে নিয়ে বসেছে বোধয়। তা না হলে আমার মতো এহেন অভাগার বাঁ-ডানে দুই সুন্দরী। এ যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি দশা! আচ্ছা, দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম যেন। সুন্দরের সংজ্ঞাই বা কী? স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে পারেননি। ‘মুই কী হনুরে!’
তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম জন; মানে জিনস আর টিশার্ট পরা তরুণীর মধ্যে আবিষ্কার করার কিছু নেই। অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে তার পোশাকের কারণে শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ রহস্য তৈরি করেছে। কেমন যেন ঢেউ খেলে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। আর সাঁতার প্রিয় কেউ এমন শান্ত ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে আরাম পাবেন নিশ্চিত! তার অবস্থা এমন যেন, মধ্যবিত্ত ঘরে মেজবান আসা উপলক্ষে বিছানায় অনেক দিন পর বের করা বালিশের কভার, চাদর। টি-টেবিলে ভাঁজ না ভাঙা টেবিলক্লথ, দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা ম্যারাডোনার কোনো ছবি ঝোলানো। অন্যপাশে দেয়াল ঘড়িটা তার কাজ করে যাচ্ছে টিকটিক করে। ক্যালেন্ডারের পাতাও ঠিকভাবে ওলটানো। দেখেই বোঝা যায় সব পরিকল্পনা মতো সাজিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় জন; যার পরনে হালকা কচু পাতা রঙের শিফন শাড়ি। বেশ খানিকটা অগোছালো। আঁচলে প্লিট করা নেই, উঁচু বুকের ওপর এমনি ফেলে রাখা হয়েছে। চওড়া কাঁধ আর বেশ খানিকটা খোলা পিঠ বেয়ে চুলের বেনীটাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শাড়ির বুননে লুকিয়ে থাকা কোমরের খাঁজে হালকা মেদ আর উঁকি মারা তকতকে পেট তাকে আরও যেন নরম তুলতুলে করে তুলেছে। চোখ পড়তেই যেন ছুঁতে মন চায়।
বড়লোকের ড্রয়িং রুমের মতো সবই আছে। ইতালিয়ান ফিটিংস, দেয়ালে দামি পেইন্টিং, দামি সোফা, শুধু অতিথি আসবে বলে গোছানোর সময় পায়নি কেউ। কিংবা ফাঁকিবাজ কাজের লোকের কাছে যে অতিথি আসবেন, তার কোনো দামই নেই।
কী নেই মেয়েটির মাঝে? খোলা পিঠ, চওড়া কাঁধ, উঁচু বুক, ভারী নিতম্ব, গাছপাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। সবই আছে, আমি কবি-সাহিত্যিক হলে আরও ভালো বলতে পারতাম হয়তো। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশ খানিকটা পরিশ্রম করতে হবে। অথবা জহুরির চোখ লাগবে। শরীর বেয়ে তার মুখে উঠলাম। ওর চোখ আমার চোখ একটু কথা বলে নিল যেন। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝলাম না। চোখ দু’টি; আহা...ঠিক যেন চৈত্রের ভোরে বাঁধানো দিঘির শান্ত পানি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডুব মারি।
একটু স্মৃতিমেদুর হলাম; এই চোখই সব শেষ করল আমার।
একই অফিসে যখন ছিলাম তখন তোমার চোখ আর আমার চোখ সারা বেলাই গুটুরগুটুর আলাপ করত। একদিন লিফটের ভেতর তুমি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলে। পরে ফোন দেবে আমি ভাবিনি।
কোনো এক রাতে তুমি ফোন দিয়েছিলে এবং আমাদের সারা রাত কথা হয় সেদিন। আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তোমারই তিন-চারটা নম্বর। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেল। হাত ধরে সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি। কখনো ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা, কখনো দুই পা-ই ছিল ভরসা। কখনো নীলক্ষেতের ঘুপচি দোকান, কখনো আবার শহরের দামি কোনো রেস্তোরাঁ। আমার এই রুগ্ণ কাঁধে মাথা রেখে কত বিকেল পার করেছ তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটাতে আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট রুম ছাড়াও আশ্রয় নিতে এর ওর বাসায়। পোষা বিড়াল ছানার মতো তোমায় কোলে নিয়ে রাত পার করে দিয়েছি কত। তুমি ঘুমাতে আর আমি তোমার বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখতাম। মাঝেমধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া তোমার শরীরের নেশা ধরা গন্ধে মাদকের স্বাদ নিতে নিতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত পোহালে তোমার শুকনো ঠোঁটের ছোঁয়ায় অদ্ভুত রকমের ভালো লাগায় কেঁপে উঠতাম। আর জেগে উঠে তোমাকে আবিষ্কারের কঠোর পরিশ্রম। প্রথম প্রহরের সেই শারীরিক ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের শব্দ আমার ঝাঁপিতে নেই, সত্যি বলছি।
চা শেষ। আরেকটা সিগারেট দরকার। শরীর এত নিকোটিন চাইছে কেন বুঝতে পারছি না। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নেয় না। তার মানে আমি পুরোপুরি ফিট! ‘এটাই শেষ। লঞ্চে উঠে আর দুইটা খাব।’ মনে মনে আরেকটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। মানুষ আসলে যা পারবে না সেটা করার জন্যই প্রতিজ্ঞা করে। যেটা পারবে কিংবা হওয়ার সেটা এমনিতেই হয়।
সেদিন গুলশান-১–এর ১১৬ নম্বর রোডের শেষ মাথায় তুমিসহ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমি সিগারেট ধরাতেই তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘হঠাৎ গোল্ডলিফ কেন?’ বলেছিলাম, ‘১৬ টাকার সিগারেটে পোষায় না।’ চা-সিগারেট শেষ করে তোমার গালে আলতো ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘এতটুকু কমেনি আমার ভালোবাসা।’ তুমি তখন কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না। সেটা সম্ভব না।’ মনে হয় নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলে। যেটা পরে তুমি রাখতে পারবে না কিংবা রাখবে না বলে নিশ্চিতভাবেই জানতে।
লঞ্চ ঢেকুর তুলছে। আমার মনে হচ্ছে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। দোকানির কাছ থেকে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একেবারে ঠিক সময়ে ছেড়েছে লঞ্চ। ভেতরেই টিকিটের ব্যবস্থা। নামার সময় কাটলেও নাকি চলে। রিস্ক নিতে চাইলাম না। ১০০ টাকায় পুরো লঞ্চ কিনে নিলাম! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই লঞ্চ শেষ কোথায় ভিড়বে?’ সেই লোক খুব গুছিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, ‘আপনে কই যাইবেন?’
সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এখন দেখা করতে চাও না কেন?’ তুমি বলছিলে, ‘এত দেখা করে কী হবে!’
লঞ্চ নদীর বুকে ভাসতে শুরু করেছে। ঘাট ছেড়ে এসেছে ২০-২৫ মিনিট হলো। তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ প্রায় পৌনে চার মাস।
প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করার একটা জেদ কাজ করে ইদানীং। দেখা না হলে মাথা ভার হয়ে আসে, এরপর আধ কপালী মাথাব্যথা শুরু হয়। খুবই অসহ্য। তুমি বিরক্ত হও বুঝি। তবু যাই; না গিয়ে উপায় আছে? তুমি-ই বলেছিলে, ‘আমি কোথায় হারাব? তুমি তো আমার সব চেনো। গিয়ে নিয়ে আসবে।’
তোমার সামনে যাই। ‘কেন চলে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলে বল, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগে না।’ যুক্তিসংগত কথা। ভালো না লাগলে আর কী করা। মানুষ তো আর রোবট না যে, সুইচ ঘুরিয়ে দিলাম আর ভালো লাগা শুরু হলো। আচ্ছা; একইভাবে সুইচ ঘুরিয়ে খারাপ লাগানোও তো সম্ভব না! দুইটার একটারও ব্যবস্থা নাই। তা হলে আমি দ্বিতীয়টি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতাম অন্তত।
সেদিন আবার বললে, ‘তোমার সাথে আমার অ্যাডজাস্ট হয় না।’
কী যে বল না তুমি! আমি তো আর কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্ট না। তুমিও পেনড্রাইভ কিংবা ক্যাবল না যে অ্যাডজাস্ট হতে হবে। এত দিন যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে।’ উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এত দিন কোথায় ছিলাম? আমি এত দিন ছিলাম না। তুমি জোর করেছ। তাই-ই ছিলাম।’ তোমার পাল্টা জবাব ছিল এটা।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে এত দিন তুমি আমাকে ভালোবাসনি! তোমার সবকিছু; আমাকে দেওয়া কথা, দেখানো স্বপ্ন ধোঁকা ছিল! ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা? অভিমান ভাঙাতে আমার গালে প্রজাপতি চুমু এঁকে দেওয়া, বিদায় বেলায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফরাসি চুমু; এসব, সব মিথ্যা, অভিনয়, ধোঁকা!’
তোমার এসব কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য সব যেন থেমে গিয়েছিল সেদিন। বোমি আসছিল, সামনের সবকিছু হলুদ মনে হয়েছিল। সেসব তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমিও বুঝতে চাওনি।
চশমার গ্লাসগুলো মুছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখন জোর করি তাহলে থাকবে? তুমিতো বলেছিলে চলে গেলে তোমাকে যাতে যেতে না দিই।’ ‘সেটা আর সম্ভব নয়। আমি মরে গেলেও তোমাকে আপন করতে পারব না। তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা তো অনেক দূরের কথা।’ কথাগুলো যখন বলছিলে তোমাকে অনেকটা ডিটারমাইন্ড দেখলাম তখন।
ব্যাপারটা এমন যেন, তোমার মন চাইল, দরকার ছিল তুমি থাকলে এখন মন চাইল কিংবা দরকার শেষ চলে গেলে। মানে, ‘আপনা বুঝ, লাল তরমুজ!’ এখন তোমার লক্ষ্য দেখেশুনে পয়সা ওয়ালা, সফল (তোমার ভাষ্যমতে) কারও সাথে বাকি জীবন পার করা। সেটা কথা প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেও ছিলে। সেদিন ভেবেছিলাম ঠাট্টা। এখন মনে হচ্ছে না সেটাই সত্য।
আচ্ছা তাহলে আমি কী ছিলাম? আমার সাজানো মাঠে খেললে তাহলে? এই এখন কিংবা ভবিষ্যতে ভালো খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ এই মাঠে! ঠিকঠাক কোন পিচে কত গতিতে বল করবে, কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সেই বল টার্ন করাবে কিংবা কোন বল ফ্রন্ট ফুটে খেলবে নাকি ব্যাকফুটে খেলবে এসব? আমাকে দিয়ে তুমি নেট প্র্যাকটিস করেছ তাহলে! আসলে মাধবীলতারা উপন্যাসেই থাকে, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে সমাধান?’ ‘হয় তুমি মরে যাও। অথবা আমাকে মেরে ফেল।’ সাফ জবাব দিয়েছিলে তুমি। ‘তোমাকে মারা সম্ভব হবে না। আর নিজে মরব এতটা সাহস আমার নেই।’ আমি আত্মসমর্পণের চেষ্টা করেছিলাম।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের গা থেকে এক-দুই ফোঁটা করে আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোয় নদীর পানি ভিজে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে লঞ্চ সাঁতরাচ্ছে। আচ্ছা, কত লঞ্চতো ডুবে যায়। কত মানুষ তো মরে ভেসে ওঠে। অনেকের তো লাশও মেলে না। স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যায় যে, তারা অপেক্ষা করছে। ‘অপেক্ষা’ কঠিন এক জিনিস। তুমি কী অপেক্ষা করবে, আমার প্রাণহীন শরীরের জন্য? যার অর্ধেকটা কিংবা কোনো অংশ নদীর তলে থাকা কোনো প্রাণী খাবলে নেবে কিংবা পচে যাবে। হয়তো আমার পুরো শরীরটিই পচে দুর্গন্ধ বের হবে। তুমি কী সত্যি দেখতে আসবে আমার পচে, গলে গন্ধ বের হওয়া সেই শরীর? নাকি তোমার তরতাজাটাই চাই?
জোছনায় ভিজে ভিজে লঞ্চ কষ্টের নিশ্বাস ফেলছে। আমি তাকিয়ে জোছনা ভেজা নদীর পানিতে। জলদানবের কষ্ট আর আমার কষ্ট মিলেমিশে একাকার। দুজনেই জোছনা ভেজা পানিতে সাঁতরাচ্ছি।
কে যেন বলেছিল, ‘মানুষে মেশিনে এত মিল, কালে কালে ক্ষয়ে যায়।’
আচ্ছা, ওই তরুণীদের দেখছি না যে? তারা কী এই লঞ্চে উঠেছে? নাকি ঠিকানা পেয়ে গেছে, আজ রাতের জন্য?
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪