সেলিম জাহান
পয়লা বৈশাখ এসে গেছে। জানি, বাংলাদেশ এখন তৈরি হয়েছে নববর্ষকে বরণ করে নিতে। ঠিক পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের আনাচ-কানাচ রং আর রেখায় ভরে যায়। রং উঠে আসে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নেয় দেয়ালে, আলপনায়, প্রতিচিত্রে।
ঠিক পয়লা বৈশাখের আগের দিন আর্ট কলেজের ছেলে-মেয়েরা সারা রাত জেগে ঢাকার রাস্তায় আলপনা আঁকে, দেয়াল চিত্র শেষ করে নানান রঙের আর ঢংয়ের মুখোশ বানায়, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়ে পরদিন প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। উন্মাদনা, উৎসাহের জোয়ার দেখা যায় চারদিকে—আনন্দ, স্ফূর্তি আর উৎসবের আমেজ অনুভব করা যায় আকাশে-বাতাসে।
বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। মেলা বসে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে আসে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসে আকাশ-বাতাস।
এই চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির। ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি চলে গেছে, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ঐ পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখার আরও কত জায়গায়। যতবার বাস যেত, ততবারই একটি লাল ধুলোর ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপরে ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত। কিন্তু একদিন সেই লাল ধুলোর ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে।
এবং সেটা ওই পয়লা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরে ঐ পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সে জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশুরা, ঐ যে মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর খুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পয়লা বৈশাখে মানুষের হেঁটে চলার পায়ে-পায়ে যে মনুষ্যধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি।
বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারও হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতিবছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারও সঙ্গে। আমাদের দুজনের হাতে দেওয়া হতো একটি করে টাকা, পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুল দানা, কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা, অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়।
মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সব সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল—ঘোড়া, বর-বৌ, গরু, হাতি, পাখি কোনটা ছেড়ে কোনটা নেই। পোড়ামাটির ওপরে সুন্দর উজ্জ্বল রঙে চোখ-মুখ আঁকা ঐ সব পুতুলদের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, দুহাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নেই। কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক। তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাঁটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাঁদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো, হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল।
বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিদের উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো। রাতে ঘুমোনো হতো ঐ সব পুতুলদের বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটো ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনো ভুলব না। আর একবার আমার হাত থেকে আমার ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি।
সন্ধ্যের দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা, হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন মাখন কাকা আর হারাধন জেঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান ‘চিটাগং বস্ত্রালয়ে’, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণি মালিকেরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যত দূর মনে পড়ে বাবা একটা রুপোর টাকা প্রতীকী হিসেবে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন।
সেই সব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাঁদের কর্মচারীদের গরম গরম রসালো মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা ওটা খাবার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন যাতে সারা বছরটা ভালো যায়। খাবার শেষে পেতলের ঘটি-গেলাসে জল আসত, বাবা একটা পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণি মালিকেরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন।
কিন্তু সব সময়ে যা আমার দৃষ্টি কাড়ত, তা হচ্ছে ঐ হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকা-পয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পেতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত হিসেব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ঐ লাল খাতাটির ওপরে হাত বুলোতাম। লালসালুর ঐ খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত।
তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত, পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা ওঁদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে আর তার আভায় সিঁদুর রাঙা সিঁথি ও জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তাঁর গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তাঁর নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাঁকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’
আমি ওঁদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো, কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাঁদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দুধারে। আজ খুব ভোরে ঘুম চোখে দেখেছি, ওঁদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা এক ডুবে পার হয়ে ওপারের ছোট্ট আমগাছটা থেকে দুটো কচি আম তুলে আবার এক ডুবে ফিরে এসেছেন এ পাড়ের ঘাটে। আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসিমার তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কি রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেটপুজো সেরে এলি’?
আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম, মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ঐ আশীর্বাদ, ঐ মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে—শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারা বছর এবং সারা জীবনও বটে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ,জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
পয়লা বৈশাখ এসে গেছে। জানি, বাংলাদেশ এখন তৈরি হয়েছে নববর্ষকে বরণ করে নিতে। ঠিক পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের আনাচ-কানাচ রং আর রেখায় ভরে যায়। রং উঠে আসে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নেয় দেয়ালে, আলপনায়, প্রতিচিত্রে।
ঠিক পয়লা বৈশাখের আগের দিন আর্ট কলেজের ছেলে-মেয়েরা সারা রাত জেগে ঢাকার রাস্তায় আলপনা আঁকে, দেয়াল চিত্র শেষ করে নানান রঙের আর ঢংয়ের মুখোশ বানায়, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়ে পরদিন প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। উন্মাদনা, উৎসাহের জোয়ার দেখা যায় চারদিকে—আনন্দ, স্ফূর্তি আর উৎসবের আমেজ অনুভব করা যায় আকাশে-বাতাসে।
বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। মেলা বসে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে আসে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসে আকাশ-বাতাস।
এই চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির। ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি চলে গেছে, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ঐ পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখার আরও কত জায়গায়। যতবার বাস যেত, ততবারই একটি লাল ধুলোর ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপরে ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত। কিন্তু একদিন সেই লাল ধুলোর ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে।
এবং সেটা ওই পয়লা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরে ঐ পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সে জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশুরা, ঐ যে মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর খুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পয়লা বৈশাখে মানুষের হেঁটে চলার পায়ে-পায়ে যে মনুষ্যধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি।
বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারও হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতিবছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারও সঙ্গে। আমাদের দুজনের হাতে দেওয়া হতো একটি করে টাকা, পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুল দানা, কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা, অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়।
মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সব সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল—ঘোড়া, বর-বৌ, গরু, হাতি, পাখি কোনটা ছেড়ে কোনটা নেই। পোড়ামাটির ওপরে সুন্দর উজ্জ্বল রঙে চোখ-মুখ আঁকা ঐ সব পুতুলদের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, দুহাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নেই। কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক। তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাঁটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাঁদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো, হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল।
বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিদের উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো। রাতে ঘুমোনো হতো ঐ সব পুতুলদের বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটো ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনো ভুলব না। আর একবার আমার হাত থেকে আমার ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি।
সন্ধ্যের দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা, হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন মাখন কাকা আর হারাধন জেঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান ‘চিটাগং বস্ত্রালয়ে’, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণি মালিকেরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যত দূর মনে পড়ে বাবা একটা রুপোর টাকা প্রতীকী হিসেবে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন।
সেই সব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাঁদের কর্মচারীদের গরম গরম রসালো মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা ওটা খাবার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন যাতে সারা বছরটা ভালো যায়। খাবার শেষে পেতলের ঘটি-গেলাসে জল আসত, বাবা একটা পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণি মালিকেরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন।
কিন্তু সব সময়ে যা আমার দৃষ্টি কাড়ত, তা হচ্ছে ঐ হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকা-পয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পেতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত হিসেব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ঐ লাল খাতাটির ওপরে হাত বুলোতাম। লালসালুর ঐ খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত।
তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত, পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা ওঁদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে আর তার আভায় সিঁদুর রাঙা সিঁথি ও জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তাঁর গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তাঁর নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাঁকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’
আমি ওঁদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো, কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাঁদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দুধারে। আজ খুব ভোরে ঘুম চোখে দেখেছি, ওঁদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা এক ডুবে পার হয়ে ওপারের ছোট্ট আমগাছটা থেকে দুটো কচি আম তুলে আবার এক ডুবে ফিরে এসেছেন এ পাড়ের ঘাটে। আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসিমার তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কি রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেটপুজো সেরে এলি’?
আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম, মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ঐ আশীর্বাদ, ঐ মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে—শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারা বছর এবং সারা জীবনও বটে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ,জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
বারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
৮ ঘণ্টা আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৩ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৪ দিন আগেমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মুক্তির আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তিনি এম এন লারমা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ডাকনাম ছিল মঞ্জু। তাঁর নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ দিন আগে