মারুফ ইসলাম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় অস্বাভাবিক নীরব ছিলেন। তাঁর কোনো কথায় কিংবা কাজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশেষ স্থান পায়নি। এই নীরবতা কৌতূহলোদ্দীপক বিধায় তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। যেমন একবার দেশের একটি দৈনিকে কবি দাউদ হায়দার লেখেন:
‘সত্যজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে-স্বাধীনতায় অবদান রেখেছেন? কবে? কখন? কোথায়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতায় মিছিল, সভা কম হয়নি। বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কলাকুশলীর উদ্যোগে অন্তত কুড়িটি অনুষ্ঠান হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ অনুরোধ জানিয়েছেন ফোনে, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। মৃণাল সেন, চিন্মোহন সেহানবীশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, দেবেশ রায় জোট বেঁধে সত্যজিতের কাছে গেছেন, মিছিলে সভায় যোগ দেওয়ার জন্য। আইভরি টাওয়ার থেকে কবে নেমেছেন?’
বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি থেকে জানা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কবি অন্নদাশঙ্কর রায়, লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সত্যজিৎ রায়কে ফোনে অনুরোধ জানান। তাঁকে আনতে মৃণাল সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাসা অব্দি গিয়েছিলেন, কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে মিছিলে বা সভায় নিতে পারেননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে নানা কথা বললেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল...।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে তিনি শুধু ‘ইতিহাসের চাকা ঘুরে যাওয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।
পঁচাত্তর সালের আগে সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের দিনলিপি থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কথা পাওয়া গেলেও তা নিয়ে সত্যজিতের কোনো অনুভূতি বা মন্তব্য মেলে না। এক স্থানে বিজয়া লিখছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান একটি ছোট দেশ, যুদ্ধ বেধে গেছে, তারা সামলে উঠতে পারবে তো? এই যুদ্ধের সঙ্গে ভারত জড়িয়ে পড়েছে, এখন পশ্চিমবঙ্গের কী হবে?’ বিজয়া রায় এখানে চিন্তিত নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে, তারা কোনো বিপদের মুখে পড়বে কি না! একজন মা হিসেবে বিজয়া রায়ের এই অনুভূতি স্বাভাবিক। আরেক জায়গায় তিনি চিত্রগ্রাহক রঘুবীর সিংয়ের কথা বলেছেন। রঘু বাংলাদেশের শরণার্থীদের ছবি দেখাতে আসতেন সত্যজিৎকে। কিন্তু এসব ছবি দেখে সত্যজিৎ কী বলতেন বা তাঁর অনুভূতি কী হতো, তা আর জানা যায় না বিজয়ার লেখা থেকে। বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা ‘আমাদের কথা’ বইয়ে এসব কথার উল্লেখ রয়েছে।
এই বই মারফত জানা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে সত্যজিৎ ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির কাজ করছিলেন। সত্যজিৎ ও বিজয়ার জেমস বন্ড চলচ্চিত্র ‘ডক্টর নো’ কিংবা হিচককের ‘সাইকো’ দেখতে যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সত্যজিতের কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না।
সত্যজিতের এই বিস্ময়কর নীরবতার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? অনেকের ধারণা, সত্যজিৎ রায় ১৯৪৭-এর দেশভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। পূর্ব বাংলার মানুষ যখন এই ধর্মকেন্দ্রিক বিভাজনে উন্মাদনাসহযোগে যোগ দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিৎ আহত বোধ করেন। তাই পরে পূর্ব বাংলার তথা বাংলাদেশের মানুষ যখন পাঞ্জাবদের হাতে নির্যাতিত হন, তখন তিনি নীরবতা অবলম্বন করেন।
এ ছাড়া আরেকটি জোরালো যুক্তি হচ্ছে, সত্যজিৎ ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে বিশ্বাসী ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে বাংলাদেশ যখন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সংগত কারণে সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ফেলুদা নেপাল ও অন্যান্য দেশ ঘুরে বেড়ালেও কখনো বাংলাদেশে পা রাখে না।
বাংলাদেশের নানা ঐতিহ্য, স্বর্ণমুদ্রা ইত্যাদি লুটপাট হয়ে গেলেও সেদিকে একদম নজর ছিল না ফেলুদার। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সত্যজিতের ফেলুদা বাংলাদেশে আসেনি।
এসব উদাসীনতা সত্যজিতের ইচ্ছাকৃত বলে মনে করেন সমালোচকেরা। তাঁরা আরও মনে করেন, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলায় বিশ্বাসী ছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর কলকাতাপ্রেম ছিল প্রবাদতুল্য। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের আমন্ত্রণ পেলেও তিনি কলকাতা ছেড়ে যাননি। তিনি মনে করতেন, কলকাতা ছেড়ে গেলে তিনি তাঁর সৃজনশীলতার শক্তি খোয়াবেন।
১৯৭২ সালে পল্টনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যে আমি বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে, অন্য ভাষায় চিত্র রচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমি জানি, আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে ভাষা হলো বাংলা ভাষা, আমি জানি যে সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, আমি কূলকিনারা পাব না, শিল্পী হিসেবে আমি মনের জোর হারাব।’
বাংলাদেশ যেহেতু ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের জের ধরে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সুতরাং বাংলা ভাষার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলাদেশে চলে আসবে—এই নিরেট সত্য সত্যজিৎ আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর গোয়েন্দা উপন্যাসগুলোতে দেখা যায়, নায়ক ফেলুদা মগনলাল মেঘরাজদের হাত থেকে কলকাতার ঐতিহ্য রক্ষার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, ঐতিহ্য রক্ষার ভবিষ্যৎ যোদ্ধা তোপসেকেও নির্মাণ করেছেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঐতিহ্যসচেতন সত্যজিতের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ একধরনের আশঙ্কাই তৈরি করেছিল হয়তো। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, কলকাতার ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য কি ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হতে হবে, যে রকম বের হয়েছে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ? এই সমস্ত ভয়-ভাবনা সত্যজিৎকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নীরব রেখেছিল বলে ধারণা করা যায়।
তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা দু-একবার সত্যজিতের মনে উঁকি দিয়েছিল মর্মে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে লেখা তাঁর চিঠি একটি প্রমাণ। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে চলচ্চিত্র করার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, ১৯৭৫ সালে। উপন্যাসটি খসড়া আকারে, গল্প হিসেবে আগে ছাপা হয়েছিল কলকাতার তরুণ সাহিত্যিকদের পত্রিকা টেরোড্যাকটিলে। সেখানেই প্রথম সত্যজিৎ গল্পটি পড়েন। এই গল্পের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও ভাবেন তিনি। চিঠিতে সত্যজিৎ লিখেছেন:
“প্রিয় সেলিনা হোসেন
মাননীয়াসু,
আপনার চিঠি কিছুদিন হলো পেয়েছি। আমার নতুন ছবির কাজ এবং পুজোর লেখা নিয়ে একান্ত ব্যস্ত থাকায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল।
‘ট্যারোড্যাকটিল’ পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোটগল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল, তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয় এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি থাকায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্নে ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওখানকার অবস্থা ভালো নয়, কাজে নানারকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং, পরিকল্পনাটি স্থগিত থাকে।
এখন আমি আমার অন্য ছবির কাজে জড়িয়ে পড়েছি। কবে মুক্ত হব জানি না। এ অবস্থায় আপনাকেই বা কীভাবে গল্পটা ধরে রাখতে বলি তাও বুঝতে পারছি না। সংশয় হয় অন্য কারও হাতে পড়লে এমন চমৎকার গল্পটি হয়তো যথাযথভাবে চিত্রায়িত হবে না। সে বিষয় যদি (অপর পৃষ্ঠায় এরপর) আপনি নিজে পছন্দ করে কাউকে গল্পটা দিতে পারেন তাহলে আমার কিছু বলার থাকে না। এ ব্যাপারে আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন- এ আমার অনুরোধ।
আপনার সম্পাদিত পত্রিকার জন্য এর পর কোনো লেখা দিতে পারব বলে মনে হয় না। সন্দেশের লেখা এখনো লিখে উঠতে পারিনি।
আপনার গল্পটি উপন্যাসাকারে প্রকাশিত হলে পড়ার ইচ্ছে রইল।
নমস্কারান্তে ভবদীয়
সত্যজিৎ রায়
১৩ / ০৮ / ৭৫
(চিঠিটি নেওয়া হয়েছে ‘আলোকিত বাংলাদেশ’ পত্রিকার ৩০ মে ২০১৪ তারিখের সংখ্যা থেকে।)
এই চিঠিতে জানানোর পরও আশির দশকে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র করার কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি আর সেই ছবির কাজে হাত দেননি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সত্যজিতের অবস্থান প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক জন ডব্লিউ হুডের লেখা ‘বিয়ন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব অপু’ বইয়ে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন থেকেছেন, সেখানকার অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতাকে নিয়ে লেখালেখিও করেছেন। এই অস্ট্রেলীয় চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক বাংলাদেশি সাংবাদিক বিধান রিবেরুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎকে নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে গেছে এবং এতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে প্রামাণ্যচিত্র করা যায়, কাহিনিচিত্র নয়। আর এত বড় ঘটনাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ধরার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলেই কাজ করা হয়ে ওঠেনি সত্যজিতের।’
এটাই সত্যজিতের শৈল্পিক সততা। তিনি শিল্পের প্রতি যেমন সৎ ছিলেন, তেমনি সৎ ছিলেন তাঁর চিন্তা ও আবেগের প্রতি। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তিনি নীরব ছিলেন।
তথ্যঋণ: প্রবন্ধ সংগ্রহ, সত্যজিৎ রায়; আমাদের কথা, বিজয়া রায়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় অস্বাভাবিক নীরব ছিলেন। তাঁর কোনো কথায় কিংবা কাজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশেষ স্থান পায়নি। এই নীরবতা কৌতূহলোদ্দীপক বিধায় তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। যেমন একবার দেশের একটি দৈনিকে কবি দাউদ হায়দার লেখেন:
‘সত্যজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে-স্বাধীনতায় অবদান রেখেছেন? কবে? কখন? কোথায়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতায় মিছিল, সভা কম হয়নি। বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কলাকুশলীর উদ্যোগে অন্তত কুড়িটি অনুষ্ঠান হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ অনুরোধ জানিয়েছেন ফোনে, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। মৃণাল সেন, চিন্মোহন সেহানবীশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, দেবেশ রায় জোট বেঁধে সত্যজিতের কাছে গেছেন, মিছিলে সভায় যোগ দেওয়ার জন্য। আইভরি টাওয়ার থেকে কবে নেমেছেন?’
বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি থেকে জানা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কবি অন্নদাশঙ্কর রায়, লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সত্যজিৎ রায়কে ফোনে অনুরোধ জানান। তাঁকে আনতে মৃণাল সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাসা অব্দি গিয়েছিলেন, কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে মিছিলে বা সভায় নিতে পারেননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে নানা কথা বললেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল...।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে তিনি শুধু ‘ইতিহাসের চাকা ঘুরে যাওয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।
পঁচাত্তর সালের আগে সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের দিনলিপি থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কথা পাওয়া গেলেও তা নিয়ে সত্যজিতের কোনো অনুভূতি বা মন্তব্য মেলে না। এক স্থানে বিজয়া লিখছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান একটি ছোট দেশ, যুদ্ধ বেধে গেছে, তারা সামলে উঠতে পারবে তো? এই যুদ্ধের সঙ্গে ভারত জড়িয়ে পড়েছে, এখন পশ্চিমবঙ্গের কী হবে?’ বিজয়া রায় এখানে চিন্তিত নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে, তারা কোনো বিপদের মুখে পড়বে কি না! একজন মা হিসেবে বিজয়া রায়ের এই অনুভূতি স্বাভাবিক। আরেক জায়গায় তিনি চিত্রগ্রাহক রঘুবীর সিংয়ের কথা বলেছেন। রঘু বাংলাদেশের শরণার্থীদের ছবি দেখাতে আসতেন সত্যজিৎকে। কিন্তু এসব ছবি দেখে সত্যজিৎ কী বলতেন বা তাঁর অনুভূতি কী হতো, তা আর জানা যায় না বিজয়ার লেখা থেকে। বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা ‘আমাদের কথা’ বইয়ে এসব কথার উল্লেখ রয়েছে।
এই বই মারফত জানা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে সত্যজিৎ ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির কাজ করছিলেন। সত্যজিৎ ও বিজয়ার জেমস বন্ড চলচ্চিত্র ‘ডক্টর নো’ কিংবা হিচককের ‘সাইকো’ দেখতে যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সত্যজিতের কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না।
সত্যজিতের এই বিস্ময়কর নীরবতার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? অনেকের ধারণা, সত্যজিৎ রায় ১৯৪৭-এর দেশভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। পূর্ব বাংলার মানুষ যখন এই ধর্মকেন্দ্রিক বিভাজনে উন্মাদনাসহযোগে যোগ দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিৎ আহত বোধ করেন। তাই পরে পূর্ব বাংলার তথা বাংলাদেশের মানুষ যখন পাঞ্জাবদের হাতে নির্যাতিত হন, তখন তিনি নীরবতা অবলম্বন করেন।
এ ছাড়া আরেকটি জোরালো যুক্তি হচ্ছে, সত্যজিৎ ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে বিশ্বাসী ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে বাংলাদেশ যখন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সংগত কারণে সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ফেলুদা নেপাল ও অন্যান্য দেশ ঘুরে বেড়ালেও কখনো বাংলাদেশে পা রাখে না।
বাংলাদেশের নানা ঐতিহ্য, স্বর্ণমুদ্রা ইত্যাদি লুটপাট হয়ে গেলেও সেদিকে একদম নজর ছিল না ফেলুদার। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সত্যজিতের ফেলুদা বাংলাদেশে আসেনি।
এসব উদাসীনতা সত্যজিতের ইচ্ছাকৃত বলে মনে করেন সমালোচকেরা। তাঁরা আরও মনে করেন, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলায় বিশ্বাসী ছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর কলকাতাপ্রেম ছিল প্রবাদতুল্য। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের আমন্ত্রণ পেলেও তিনি কলকাতা ছেড়ে যাননি। তিনি মনে করতেন, কলকাতা ছেড়ে গেলে তিনি তাঁর সৃজনশীলতার শক্তি খোয়াবেন।
১৯৭২ সালে পল্টনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যে আমি বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে, অন্য ভাষায় চিত্র রচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমি জানি, আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে ভাষা হলো বাংলা ভাষা, আমি জানি যে সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, আমি কূলকিনারা পাব না, শিল্পী হিসেবে আমি মনের জোর হারাব।’
বাংলাদেশ যেহেতু ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের জের ধরে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সুতরাং বাংলা ভাষার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলাদেশে চলে আসবে—এই নিরেট সত্য সত্যজিৎ আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর গোয়েন্দা উপন্যাসগুলোতে দেখা যায়, নায়ক ফেলুদা মগনলাল মেঘরাজদের হাত থেকে কলকাতার ঐতিহ্য রক্ষার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, ঐতিহ্য রক্ষার ভবিষ্যৎ যোদ্ধা তোপসেকেও নির্মাণ করেছেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঐতিহ্যসচেতন সত্যজিতের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ একধরনের আশঙ্কাই তৈরি করেছিল হয়তো। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, কলকাতার ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য কি ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হতে হবে, যে রকম বের হয়েছে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ? এই সমস্ত ভয়-ভাবনা সত্যজিৎকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নীরব রেখেছিল বলে ধারণা করা যায়।
তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা দু-একবার সত্যজিতের মনে উঁকি দিয়েছিল মর্মে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে লেখা তাঁর চিঠি একটি প্রমাণ। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে চলচ্চিত্র করার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, ১৯৭৫ সালে। উপন্যাসটি খসড়া আকারে, গল্প হিসেবে আগে ছাপা হয়েছিল কলকাতার তরুণ সাহিত্যিকদের পত্রিকা টেরোড্যাকটিলে। সেখানেই প্রথম সত্যজিৎ গল্পটি পড়েন। এই গল্পের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও ভাবেন তিনি। চিঠিতে সত্যজিৎ লিখেছেন:
“প্রিয় সেলিনা হোসেন
মাননীয়াসু,
আপনার চিঠি কিছুদিন হলো পেয়েছি। আমার নতুন ছবির কাজ এবং পুজোর লেখা নিয়ে একান্ত ব্যস্ত থাকায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল।
‘ট্যারোড্যাকটিল’ পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোটগল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল, তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয় এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি থাকায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্নে ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওখানকার অবস্থা ভালো নয়, কাজে নানারকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং, পরিকল্পনাটি স্থগিত থাকে।
এখন আমি আমার অন্য ছবির কাজে জড়িয়ে পড়েছি। কবে মুক্ত হব জানি না। এ অবস্থায় আপনাকেই বা কীভাবে গল্পটা ধরে রাখতে বলি তাও বুঝতে পারছি না। সংশয় হয় অন্য কারও হাতে পড়লে এমন চমৎকার গল্পটি হয়তো যথাযথভাবে চিত্রায়িত হবে না। সে বিষয় যদি (অপর পৃষ্ঠায় এরপর) আপনি নিজে পছন্দ করে কাউকে গল্পটা দিতে পারেন তাহলে আমার কিছু বলার থাকে না। এ ব্যাপারে আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন- এ আমার অনুরোধ।
আপনার সম্পাদিত পত্রিকার জন্য এর পর কোনো লেখা দিতে পারব বলে মনে হয় না। সন্দেশের লেখা এখনো লিখে উঠতে পারিনি।
আপনার গল্পটি উপন্যাসাকারে প্রকাশিত হলে পড়ার ইচ্ছে রইল।
নমস্কারান্তে ভবদীয়
সত্যজিৎ রায়
১৩ / ০৮ / ৭৫
(চিঠিটি নেওয়া হয়েছে ‘আলোকিত বাংলাদেশ’ পত্রিকার ৩০ মে ২০১৪ তারিখের সংখ্যা থেকে।)
এই চিঠিতে জানানোর পরও আশির দশকে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র করার কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি আর সেই ছবির কাজে হাত দেননি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সত্যজিতের অবস্থান প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক জন ডব্লিউ হুডের লেখা ‘বিয়ন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব অপু’ বইয়ে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন থেকেছেন, সেখানকার অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতাকে নিয়ে লেখালেখিও করেছেন। এই অস্ট্রেলীয় চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক বাংলাদেশি সাংবাদিক বিধান রিবেরুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎকে নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে গেছে এবং এতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে প্রামাণ্যচিত্র করা যায়, কাহিনিচিত্র নয়। আর এত বড় ঘটনাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ধরার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলেই কাজ করা হয়ে ওঠেনি সত্যজিতের।’
এটাই সত্যজিতের শৈল্পিক সততা। তিনি শিল্পের প্রতি যেমন সৎ ছিলেন, তেমনি সৎ ছিলেন তাঁর চিন্তা ও আবেগের প্রতি। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তিনি নীরব ছিলেন।
তথ্যঋণ: প্রবন্ধ সংগ্রহ, সত্যজিৎ রায়; আমাদের কথা, বিজয়া রায়
বারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
৫ ঘণ্টা আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৩ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৪ দিন আগেমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মুক্তির আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তিনি এম এন লারমা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ডাকনাম ছিল মঞ্জু। তাঁর নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ দিন আগে