শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
‘আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে। আমাদের মনে হয়, এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশি।’
প্রমথ চৌধুরীর বই পড়া প্রবন্ধের এ উদ্ধৃতিটি আমি ব্যবহার করেছিলাম ২০০৭ সালে, ‘ধনবাড়ী গণপাঠাগার স্থাপনে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। অবশেষে, ধনবাড়ীতে আমরা পাঠাগার নামক এক কামরার একটি স্থাপনা পেলাম এই ২০২১ সালে।
পাঠাগার ও গ্রন্থাগার শাব্দিকভাবে সমার্থক হলেও উৎসগত বিবেচনায় কিছুটা ভিন্ন। অবশ্য, এ দেশে গ্রন্থবিপণী বা বইয়ের দোকান বোঝাতেও ‘লাইব্রেরি’ শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় গ্রন্থাগার হলো ‘Biblioteca’ আর গ্রন্থবিপণী হলো ‘Libreria’. একইভাবে উৎস অনুসারে বলা যায়, গ্রন্থাগার মানে ‘বহু বই রাখার জায়গা’ আর পাঠাগার মানে হলো ‘বই পড়ার জায়গা’।
এ কথা স্বীকৃত যে, শুধু বই লেনদেনের তুলনায় একসঙ্গে বসে বই পড়া ও এরপর তা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা বেশি ফলপ্রসূ। কেননা, বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির মতে, ‘A book read by a thousand different people is a thousand different books. ’ তাই, মাত্র একটি বই পড়ে তাকে হাজার রকম দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ ঘটানোর মাধ্যমে হাজার গুণ কার্যকর করার সুযোগ আছে কেবল সম্মিলিত পড়া ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই।
এ ছাড়া এডগার ডেলের ‘কোন অব এক্সপেরিয়েন্স’ অনুযায়ী শুধু পড়ে শিখনফল অর্জিত হয় ১০ শতাংশ, যেখানে বলা ও পারস্পরিক আলোচনায় তা অর্জিত হতে পারে ৭০-৯০ শতাংশ। এভাবেই, ক্যাফেগুলোতে ইতিবাচক আড্ডা দিতে দিতে থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের সংঘর্ষে সিনথেসিস তৈরির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে খোদ ফরাসি সভ্যতা। তাই, গ্রন্থাগারের তুলনায় পাঠাগার বরাবরই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এ জন্যই সীমিত সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারে দিলারা দোলা আপুর সহযোগিতায় ৩০০–এর বেশি মানসম্মত বই নিয়ে ঢাকা-জামালপুর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বাঁশহাটিতে (খাদ্যগুদাম সংলগ্ন) গড়ে উঠেছে অভয়ারণ্য পাঠাগার। ৩০০ শুনে যদি মন দমে যায়, তবে বলি—জ্যাক স্নাইডার পরিচালিত ‘দ্য থ্রি হানড্রেড’ মুভির কথা, যেখানে থার্মোপাইলির যুদ্ধে মাত্র ৩০০ স্পার্টান যোদ্ধা রুখে দাঁড়ায় হাজার হাজার পারস্য সেনার বিরুদ্ধে। এ থেকেই বোঝা যায়, সংখ্যার তুলনায় মানে সমৃদ্ধ হওয়া উত্তম। তবে, সংখ্যাটি এখন আর ৩ অঙ্কে সীমাবদ্ধ নেই, বরং কালের পরিক্রমায় সবার সম্মিলিত সহায়তায় তা ৪ অঙ্কের সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।
পাঠাগারের কথা বলতে গেলে আগে অভয়ারণ্য সংগঠনের কথা বলতে হবে। আমাদের একটা অভয়ারণ্য Sanctuary আছে, যার যাত্রা শুরু ৬ মার্চ ২০১৫, প্রথম বৈঠক হয় ২৬ আগস্ট ২০১৫ তারিখে। আর আমরা সবাই এক একজন ‘মারমিডন’। মারমিডনদের কথা মনে আছে তো? ওই যে, হোমারের ইলিয়াডে যারা অন্যান্য গ্রিক বীরদের মধ্যে শক্তি ও কৌশলে অনন্যসাধারণ ছিল। তারা নিজেদের সিংহ হিসেবে চিহ্নিত করত। তারা জানত তাদের অমরত্ব আসবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, তাই তারা মৃত্যুকে ভয় পেত না বরং ভালোবেসে আলিঙ্গন করত।
আর আমার অবস্থান এই অসীম সুপ্ত শক্তি ও মেধাবীদের এক ছায়াতলে আনার চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে সময়ের প্রয়োজনে তাদের সংগঠক অ্যাকিলিসের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সে জানত ট্রয় যুদ্ধে তার মৃত্যু অনিবার্য, তবু সে সুখী জীবনযাপন ছেড়ে অমরত্বের আশায় ট্রয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অবশ্য মারমিডনদের সংগঠক একজন হলেও আমরা ছিলাম ৫ জন, অভয়ারণ্যের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পঞ্চপাণ্ডব। ঈশ্বর ও শয়তানের দ্বারা ভালো-মন্দের যে প্রাগৈতিহাসিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, আমরা তার বর্তমান সময়ের ভালো পক্ষের সৈনিক। তবে আমাদের অস্ত্র আদিকালের মতো অসি নয় বরং তার চেয়ে শক্তিশালী আধুনিক মসি। তাই এখানে পদাতিক বা অশ্বারোহী বলে যে ভাগাভাগি তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ভারতীয়, পারসি বা আরবীয় সংস্কৃতিতে রাজার মৃত্যু মানেই যুদ্ধের সমাপ্তি যা ভারত থেকে উদ্ভূত দাবা খেলায়ও বিদ্যমান। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি Art of Deligation–এ যা দেখা যায়, প্রাচীন গ্রিক বা রোমান সংস্কৃতিতে। যেখানে রাজা যুদ্ধের সময় প্রথমে একজন সৈনিক তারপর সেনাপতি। এমনকি রাজার সাধারণ সৈনিকদের চেয়ে আলাদা কোনো পোশাকও নেই। রাজা মারা গেলে তৎক্ষণাৎ তার পরবর্তী জন তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। ফলে নেতৃত্বের প্রবাহ এ ক্ষেত্রে অতীব জরুরি আর জয় বা পরাজয় সমগ্র জাতির, সমগ্র সাধারণ মানুষের।
যা হোক, ২১ আগস্ট ২০২১ সালে আমরা একটি জায়গার প্রতিশ্রুতি পাই ধনবাড়ীর মেয়র মো. মনিরুজ্জামান বকুলের কাছ থেকে। পরবর্তীতে তিল তিল করে সবার উপহারে ২২ সেপ্টেম্বর গড়ে ওঠে আমাদের স্বপ্নের অভয়ারণ্য পাঠাগারের কক্ষটি। বুদ্ধগয়ার কোনো এক অখ্যাত অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে ৪৯ দিনের ধ্যান শেষে এক বৈশাখী পূর্ণিমায় ৩৫ বছর বয়সী যুবরাজ সিদ্ধার্থ বোধিলাভ করে বুদ্ধ হয়ে কী অমৃত অনুভূতি পেয়েছিলেন, আমার জানা নেই। কিন্তু, স্কুল জীবনে দেখা, নিজ এলাকায় একটি গণপাঠাগারের স্বপ্নের সম্যকভাবে বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ায়, সেদিন মধ্যরাতে পাকুড় গাছের নিচে ঘরছাড়া চাঁদের আলোয় আমিও এক অবর্ণনীয় অদ্ভুত আনন্দে ভেসে গিয়েছিলাম। আনমনেই বলে ফেললাম পালি ভাষার আবেদন ‘সাঙ্ঘাম শরণংগচ্ছামি’।
কিন্তু আনন্দের পর বেদনার স্মৃতিও এসেছে। ৩১ মার্চ ২০২২ অভয়ারণ্য পাঠাগারের জন্য একটি কালো দিবস। সেদিন কে বা কারা অভয়ারণ্য পাঠাগারে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪১১ সালে পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের বইগুলো। মুসলিমদের প্রায় ৮০ হাজার বই পুড়িয়ে দেয় স্পেনের তৎকালীন খ্রিষ্টানেরা। সিরিয়া-ফিলিস্তিনের মুসলিমদের লাখ লাখ বই পুড়িয়ে দেয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা। এমনকি আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানের বাতিঘর রাজপাঠাগারটিও বাঁচেনি অগ্নিসংযোগের হাত থেকে।
কুখ্যাত মঙ্গল শাসক হালাকু খান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র ‘বায়তুল হিকমা’ ধ্বংস করায় মুসলিম তথা সমগ্র বিশ্ব কয়েকশ বছর অন্ধকারে ডুবে ছিল। বায়তুল হিকমাতে নাকি এত বইপুস্তক ও গবেষণাপত্র ছিল যে তা পোড়ানোয় আব্বাসীয় প্রাসাদ সংলগ্ন টাইগ্রিস নদীর পানি কালো হয়ে যায়। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনও এ কথা বলেছেন, ‘the fundamental source of conflict in this new world will not be primarily ideological or primarily economic. The great divisions among humankind and the dominating source of conflict will be cultural. ’।
জ্ঞানকে গলা টিপে ধরার এ রকম কাহিনির শিকার হলেও পরবর্তী সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষজন এ ঘটনার নিন্দাজ্ঞাপন করে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সবার প্রতি অভয়ারণ্য গোষ্ঠী কৃতজ্ঞ।
পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতোই আমরা আবার পৃথিবীতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করার তাড়নায় উঠে দাঁড়িয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ৪ মার্চ ইস্টিশন পাঠাগার কর্তৃক পাঠাগার আন্দোলনে অবদান রাখায় অভয়ারণ্য পাঠাগার অর্জন করে ইস্টিশন পাঠাগার সম্মাননা ২০২৩।
আপনিও শামিল হতে পারেন আমাদের এ বিপ্লবে, দেখে যেতে পারেন আমাদের এ অব্যাহত সংগ্রামের বর্তমান অবস্থা, নিয়ে যেতে পারেন এক স্বর্গসুখ। কারণ হোর্হে লুইস বোর্হেস বলেন, ‘I have always imagined that Paradise will be a kind of library. ’
শুরু করেছিলাম প্রমথ চৌধুরীর ‘বই পড়া’ দিয়ে। শেষও সেখান থেকেই করি। ‘আমার বিশ্বাস, শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’। তাই, নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করতে গ্রামের গৃহে গৃহে গড়ে উঠুক গণপাঠাগার।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য পাঠাগার, প্রভাষক (শিক্ষা), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রাজশাহী
‘আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে। আমাদের মনে হয়, এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশি।’
প্রমথ চৌধুরীর বই পড়া প্রবন্ধের এ উদ্ধৃতিটি আমি ব্যবহার করেছিলাম ২০০৭ সালে, ‘ধনবাড়ী গণপাঠাগার স্থাপনে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। অবশেষে, ধনবাড়ীতে আমরা পাঠাগার নামক এক কামরার একটি স্থাপনা পেলাম এই ২০২১ সালে।
পাঠাগার ও গ্রন্থাগার শাব্দিকভাবে সমার্থক হলেও উৎসগত বিবেচনায় কিছুটা ভিন্ন। অবশ্য, এ দেশে গ্রন্থবিপণী বা বইয়ের দোকান বোঝাতেও ‘লাইব্রেরি’ শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় গ্রন্থাগার হলো ‘Biblioteca’ আর গ্রন্থবিপণী হলো ‘Libreria’. একইভাবে উৎস অনুসারে বলা যায়, গ্রন্থাগার মানে ‘বহু বই রাখার জায়গা’ আর পাঠাগার মানে হলো ‘বই পড়ার জায়গা’।
এ কথা স্বীকৃত যে, শুধু বই লেনদেনের তুলনায় একসঙ্গে বসে বই পড়া ও এরপর তা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা বেশি ফলপ্রসূ। কেননা, বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির মতে, ‘A book read by a thousand different people is a thousand different books. ’ তাই, মাত্র একটি বই পড়ে তাকে হাজার রকম দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ ঘটানোর মাধ্যমে হাজার গুণ কার্যকর করার সুযোগ আছে কেবল সম্মিলিত পড়া ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই।
এ ছাড়া এডগার ডেলের ‘কোন অব এক্সপেরিয়েন্স’ অনুযায়ী শুধু পড়ে শিখনফল অর্জিত হয় ১০ শতাংশ, যেখানে বলা ও পারস্পরিক আলোচনায় তা অর্জিত হতে পারে ৭০-৯০ শতাংশ। এভাবেই, ক্যাফেগুলোতে ইতিবাচক আড্ডা দিতে দিতে থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের সংঘর্ষে সিনথেসিস তৈরির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে খোদ ফরাসি সভ্যতা। তাই, গ্রন্থাগারের তুলনায় পাঠাগার বরাবরই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এ জন্যই সীমিত সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারে দিলারা দোলা আপুর সহযোগিতায় ৩০০–এর বেশি মানসম্মত বই নিয়ে ঢাকা-জামালপুর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বাঁশহাটিতে (খাদ্যগুদাম সংলগ্ন) গড়ে উঠেছে অভয়ারণ্য পাঠাগার। ৩০০ শুনে যদি মন দমে যায়, তবে বলি—জ্যাক স্নাইডার পরিচালিত ‘দ্য থ্রি হানড্রেড’ মুভির কথা, যেখানে থার্মোপাইলির যুদ্ধে মাত্র ৩০০ স্পার্টান যোদ্ধা রুখে দাঁড়ায় হাজার হাজার পারস্য সেনার বিরুদ্ধে। এ থেকেই বোঝা যায়, সংখ্যার তুলনায় মানে সমৃদ্ধ হওয়া উত্তম। তবে, সংখ্যাটি এখন আর ৩ অঙ্কে সীমাবদ্ধ নেই, বরং কালের পরিক্রমায় সবার সম্মিলিত সহায়তায় তা ৪ অঙ্কের সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।
পাঠাগারের কথা বলতে গেলে আগে অভয়ারণ্য সংগঠনের কথা বলতে হবে। আমাদের একটা অভয়ারণ্য Sanctuary আছে, যার যাত্রা শুরু ৬ মার্চ ২০১৫, প্রথম বৈঠক হয় ২৬ আগস্ট ২০১৫ তারিখে। আর আমরা সবাই এক একজন ‘মারমিডন’। মারমিডনদের কথা মনে আছে তো? ওই যে, হোমারের ইলিয়াডে যারা অন্যান্য গ্রিক বীরদের মধ্যে শক্তি ও কৌশলে অনন্যসাধারণ ছিল। তারা নিজেদের সিংহ হিসেবে চিহ্নিত করত। তারা জানত তাদের অমরত্ব আসবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, তাই তারা মৃত্যুকে ভয় পেত না বরং ভালোবেসে আলিঙ্গন করত।
আর আমার অবস্থান এই অসীম সুপ্ত শক্তি ও মেধাবীদের এক ছায়াতলে আনার চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে সময়ের প্রয়োজনে তাদের সংগঠক অ্যাকিলিসের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সে জানত ট্রয় যুদ্ধে তার মৃত্যু অনিবার্য, তবু সে সুখী জীবনযাপন ছেড়ে অমরত্বের আশায় ট্রয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অবশ্য মারমিডনদের সংগঠক একজন হলেও আমরা ছিলাম ৫ জন, অভয়ারণ্যের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পঞ্চপাণ্ডব। ঈশ্বর ও শয়তানের দ্বারা ভালো-মন্দের যে প্রাগৈতিহাসিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, আমরা তার বর্তমান সময়ের ভালো পক্ষের সৈনিক। তবে আমাদের অস্ত্র আদিকালের মতো অসি নয় বরং তার চেয়ে শক্তিশালী আধুনিক মসি। তাই এখানে পদাতিক বা অশ্বারোহী বলে যে ভাগাভাগি তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ভারতীয়, পারসি বা আরবীয় সংস্কৃতিতে রাজার মৃত্যু মানেই যুদ্ধের সমাপ্তি যা ভারত থেকে উদ্ভূত দাবা খেলায়ও বিদ্যমান। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি Art of Deligation–এ যা দেখা যায়, প্রাচীন গ্রিক বা রোমান সংস্কৃতিতে। যেখানে রাজা যুদ্ধের সময় প্রথমে একজন সৈনিক তারপর সেনাপতি। এমনকি রাজার সাধারণ সৈনিকদের চেয়ে আলাদা কোনো পোশাকও নেই। রাজা মারা গেলে তৎক্ষণাৎ তার পরবর্তী জন তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। ফলে নেতৃত্বের প্রবাহ এ ক্ষেত্রে অতীব জরুরি আর জয় বা পরাজয় সমগ্র জাতির, সমগ্র সাধারণ মানুষের।
যা হোক, ২১ আগস্ট ২০২১ সালে আমরা একটি জায়গার প্রতিশ্রুতি পাই ধনবাড়ীর মেয়র মো. মনিরুজ্জামান বকুলের কাছ থেকে। পরবর্তীতে তিল তিল করে সবার উপহারে ২২ সেপ্টেম্বর গড়ে ওঠে আমাদের স্বপ্নের অভয়ারণ্য পাঠাগারের কক্ষটি। বুদ্ধগয়ার কোনো এক অখ্যাত অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে ৪৯ দিনের ধ্যান শেষে এক বৈশাখী পূর্ণিমায় ৩৫ বছর বয়সী যুবরাজ সিদ্ধার্থ বোধিলাভ করে বুদ্ধ হয়ে কী অমৃত অনুভূতি পেয়েছিলেন, আমার জানা নেই। কিন্তু, স্কুল জীবনে দেখা, নিজ এলাকায় একটি গণপাঠাগারের স্বপ্নের সম্যকভাবে বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ায়, সেদিন মধ্যরাতে পাকুড় গাছের নিচে ঘরছাড়া চাঁদের আলোয় আমিও এক অবর্ণনীয় অদ্ভুত আনন্দে ভেসে গিয়েছিলাম। আনমনেই বলে ফেললাম পালি ভাষার আবেদন ‘সাঙ্ঘাম শরণংগচ্ছামি’।
কিন্তু আনন্দের পর বেদনার স্মৃতিও এসেছে। ৩১ মার্চ ২০২২ অভয়ারণ্য পাঠাগারের জন্য একটি কালো দিবস। সেদিন কে বা কারা অভয়ারণ্য পাঠাগারে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪১১ সালে পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের বইগুলো। মুসলিমদের প্রায় ৮০ হাজার বই পুড়িয়ে দেয় স্পেনের তৎকালীন খ্রিষ্টানেরা। সিরিয়া-ফিলিস্তিনের মুসলিমদের লাখ লাখ বই পুড়িয়ে দেয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা। এমনকি আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানের বাতিঘর রাজপাঠাগারটিও বাঁচেনি অগ্নিসংযোগের হাত থেকে।
কুখ্যাত মঙ্গল শাসক হালাকু খান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র ‘বায়তুল হিকমা’ ধ্বংস করায় মুসলিম তথা সমগ্র বিশ্ব কয়েকশ বছর অন্ধকারে ডুবে ছিল। বায়তুল হিকমাতে নাকি এত বইপুস্তক ও গবেষণাপত্র ছিল যে তা পোড়ানোয় আব্বাসীয় প্রাসাদ সংলগ্ন টাইগ্রিস নদীর পানি কালো হয়ে যায়। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনও এ কথা বলেছেন, ‘the fundamental source of conflict in this new world will not be primarily ideological or primarily economic. The great divisions among humankind and the dominating source of conflict will be cultural. ’।
জ্ঞানকে গলা টিপে ধরার এ রকম কাহিনির শিকার হলেও পরবর্তী সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষজন এ ঘটনার নিন্দাজ্ঞাপন করে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সবার প্রতি অভয়ারণ্য গোষ্ঠী কৃতজ্ঞ।
পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতোই আমরা আবার পৃথিবীতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করার তাড়নায় উঠে দাঁড়িয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ৪ মার্চ ইস্টিশন পাঠাগার কর্তৃক পাঠাগার আন্দোলনে অবদান রাখায় অভয়ারণ্য পাঠাগার অর্জন করে ইস্টিশন পাঠাগার সম্মাননা ২০২৩।
আপনিও শামিল হতে পারেন আমাদের এ বিপ্লবে, দেখে যেতে পারেন আমাদের এ অব্যাহত সংগ্রামের বর্তমান অবস্থা, নিয়ে যেতে পারেন এক স্বর্গসুখ। কারণ হোর্হে লুইস বোর্হেস বলেন, ‘I have always imagined that Paradise will be a kind of library. ’
শুরু করেছিলাম প্রমথ চৌধুরীর ‘বই পড়া’ দিয়ে। শেষও সেখান থেকেই করি। ‘আমার বিশ্বাস, শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’। তাই, নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করতে গ্রামের গৃহে গৃহে গড়ে উঠুক গণপাঠাগার।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য পাঠাগার, প্রভাষক (শিক্ষা), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রাজশাহী
বারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
৮ ঘণ্টা আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৩ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৪ দিন আগেমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মুক্তির আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তিনি এম এন লারমা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ডাকনাম ছিল মঞ্জু। তাঁর নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ দিন আগে