ইজাজুল হক, ঢাকা
ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মাহবুব মুর্শিদ। দেশের অসংখ্য তরুণ ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর গুরু ও প্রশিক্ষক। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজ করছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। তিন শতাধিক নান্দনিক ক্যালিগ্রাফির স্রষ্টা তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম দৃষ্টি কেড়েছে বিদেশি শিল্পবোদ্ধাদেরও। বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের সান্নিধ্য-ধন্য এই শিল্পী একসময় চিত্রকলার নানা শাখায় কাজ করেছেন; উপভোগ করেছেন রঙের ভুবন। বর্তমানে ক্যালিগ্রাফিই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। এই শিল্পকে একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন—সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।
মাহবুব মুর্শিদের জন্ম যশোরে, ১৯৬১ সালে। পড়াশোনা করেছেন যশোরেই। শৈশবেই তাঁর শিল্পসত্তার বিকাশ ঘটে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালে বিভিন্ন বিষয়ে আঁকাআঁকি করতেন। অঙ্কন ক্লাসে দশে-দশ পাওয়া তাঁর জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলোতে দলছুট দিন কাটাতেন। রংতুলি তাঁকে ভীষণ টানত। যশোর শহরের আর্টের দোকানগুলোতে আনমনে ঘুরতেন। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠা পেইন্টিংগুলোতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। মনে মনে একজন শিল্পগুরুর সন্ধান করতেন।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন সন্ধান পান বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের। সুলতান তখন যশোর শহরের একটি পুরোনো হোস্টেলে আর্ট শেখাতেন, যেখানে ছোট-বড় অনেকেই অংশ নিতেন। পরে ‘চারুপীঠ’ নামে শিশুদের একটি আর্ট শেখার স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মাহবুব তাঁর কাছে যান এবং শিল্প দীক্ষা গ্রহণ করেন। সুলতানের সঙ্গে সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘একদিন খোঁজ পেলাম বিশ্ববরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতানের। দেখতে গেলাম তাঁকে। খুব ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। অনেকেই তাঁর সামনে বসে আছেন। তিনি ছবি আঁকছেন। তাঁর বেশভূষা আমার খুব পছন্দ হলো। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা আমাকে মুগ্ধ করল। সারা দিন তাঁর আঁকাআঁকি দেখলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি এসে তাঁর মতো আঁকার চেষ্টা করলাম। এভাবেই শুরু। এরপর প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম। তিনি নড়াইলে চলে যাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্য নিতাম। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তাঁর আশীর্বাদেই থেকেছি।’
মাহবুব জানান, সেই দিনগুলোতে যশোর কেন্দ্রীয় পাঠাগারের এক চিত্র প্রদর্শনীতে এস এম সুলতান, মোস্তফা আজীজ, খন্দকার বদরুল ইসলাম নান্নু, মাহবুব জামাল শামীমসহ দেশসেরা শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর তিনটি চিত্রকর্ম স্থান পায়। তিন চিত্রের একটি ছিল এস এম সুলতানের পোর্ট্রেট। তিনি তা দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন এবং তাঁকে উৎসাহ-আশীর্বাদ দেন।
গত শতকের ৯০-এর দশকে যশোর শহরে ক্রমেই পরিচিত হয়ে ওঠেন তরুণ শিল্পী মাহবুব। একসময়ের আগ্রহের জায়গা আঁকাআঁকিই সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠে তাঁর আয়-রোজগারের প্রধান অবলম্বন। প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট শপ ‘অঙ্কন’। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। দশ-বারোজন শাগরেদ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। সে সময় প্রচুর ব্যানার, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, ছবি ও পোর্ট্রেট আঁকতেন। মাঝেমধ্যে ক্যালিগ্রাফিও করতেন।
ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে তাঁর পরিচিতি আরও আগে। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে ইরান-ইরাকের কয়েকটি শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকায় তিনি সর্বপ্রথম ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা পান। পত্রিকাগুলো নিয়মিত সংগ্রহ করতেন এবং সেখানে থাকা ক্যালিগ্রাফিগুলোর অনুশীলন করতেন। ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার সুযোগ না পেলেও এভাবে নিজ প্রচেষ্টায় তিনি শিল্পটি ভালোভাবে রপ্ত করেন। ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফির প্রতি আলাদা দুর্বলতা তৈরি হতে থাকে। ২০০০ সালে ঢাকার একটি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তা আরও বেগবান হয়।
এরপর ক্যালিগ্রাফার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে তাঁর বেশি দিন সময় লাগেনি। একের পর এক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে নিজের শিল্পকর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এখন পর্যন্ত ২০টির বেশি জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, তেহরান, লাহোর ও রাজস্থানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ক্যালিগ্রাফি উপস্থাপনের সুযোগ। ২০১১ সালে ক্যালিগ্রাফির জন্য সর্বপ্রথম বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পান। ২১টি দেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত ইরানের তেহরানের এই প্রদর্শনীতে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালে ভারতের আজমির শরিফ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত আরেক প্রদর্শনীতেও বিশেষভাবে সম্মানিত হন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ভারতের রাজস্থানের ‘জয়পুর আর্ট সামিট’-এ একমাত্র ক্যালিগ্রাফার হিসেবে বিশেষ পুরস্কার পান। তাঁর ক্যালিগ্রাফি সংরক্ষিত আছে জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশ-বিদেশের অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে।
বর্তমানে শিল্পী মাহবুব মুর্শিদ ক্যালিগ্রাফির বাইরে অন্য কোনো কাজ করেন না। ‘গালা’ ও ‘এমএম আর্ট ফাউন্ডেশন’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাঁর ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের প্রধান মাধ্যম ক্যানভাসে এক্রিলিক কালার ও ওয়াটার কালার। এ ছাড়া তিনি মাটির টেরাকোটা, টাইলসের ম্যুরাল, বাঁশের চাটাই এবং মাটির পটারিতেও ক্যালিগ্রাফি করেন।
চাহিদার কারণে তাঁর বেশির ভাগ ক্যালিগ্রাফির ভাষা আরবি এবং কোরআনের আয়াত হলেও প্রায় অর্ধশত দৃষ্টিনন্দন বাংলা ক্যালিগ্রাফিও করেছেন তিনি। ‘সুলুস’ লিখনশৈলীতে বেশির ভাগ কাজ করেছেন; তবে ‘সুনবুলি’ লিখনশৈলীও তাঁর পছন্দের তালিকায় রয়েছে। রঙের ব্যাপারে বরাবরই সচেতন তিনি। তাঁর ক্যালিগ্রাফিতে আধুনিক চিত্রশিল্পের নান্দনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুব বলেন, ‘যেকোনো পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে রং নির্বাচন মুখ্য বিষয়। রং যদি সঠিকভাবে নির্বাচন করা না হয়, তাহলে পেইন্টিং খুব বেশি দৃষ্টিনন্দন ও অর্থবহ হয় না। আর আমাদের দেশের মানুষ আধুনিক চিত্রশিল্প দেখে অভ্যস্ত। আপনি যদি এই বিশাল দর্শক শ্রেণিকে নতুন একটা শিল্পের সঙ্গে পরিচিত করাতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেই আধুনিক শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ফলে মানুষ আপনার শিল্পকে সাদরে গ্রহণ করবে।’
তাঁর ক্যালিগ্রাফির শিল্পমান মূল্যায়ন করে ক্যালিগ্রাফি-গবেষক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ মানসুর তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ‘সমকালীন ইসলামি ক্যালিগ্রাফি: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’-এ লিখেছেন, ‘মাহবুব মুর্শিদ উলম্ব-অনুভূমিক রেখা অঙ্কনে ক্যালিগ্রাফি নির্মাণ করেছেন। লিখনশিল্পের সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা তাঁর শিল্পকর্মে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। …তাঁর শিল্পকর্মে ক্যালিগ্রাফির অর্থ ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন; তা বিমূর্ত ঢঙে করতে প্রয়াস চালান তিনি। তাঁর ক্যালিগ্রাফি উজ্জ্বল রং ব্যবহারে উদ্ভাসিত। …তা ছাড়া তিনি বাংলাদেশের ফুল, লতা-পাতার সমাহারে ক্যালিগ্রাফির মধ্যে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণার প্রয়াস পেয়েছেন।’
মাহবুব মুর্শিদের স্বপ্ন, ক্যালিগ্রাফিকে তিনি একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কারণ তিনি মনে করেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থাকার কারণে এটিকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন। তাই তিনি মূলধারার শিল্পশৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্যালিগ্রাফিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এ লক্ষ্যেই তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর দাবি, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি চর্চা সত্তরের দশক থেকে শুরু হলেও গত পঞ্চাশ বছরে যে কাজটি কেউ করতে পারেননি, তা তিনি মাত্র চার বছরে করতে পেরেছেন এবং ক্যালিগ্রাফিকে স্বতন্ত্র শিল্পধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের সংগঠিত করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্ট গিল্ড’। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করেছেন বাণিজ্যিকভাবে ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ কর্মশালা। এ পর্যন্ত তিনি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ১৭টি কর্মশালা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। বিভিন্ন পেশা ও বয়সের ২ হাজারের বেশি প্রশিক্ষণার্থী কর্মশালাগুলোতে অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর কাছ থেকে ক্যালিগ্রাফির পাঠ গ্রহণ করে অনেকেই বর্তমানে সফলতার সঙ্গে এ শিল্পের চর্চা করছেন এবং নিজেদের সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন।
ক্যালিগ্রাফির বাজার কেমন এবং বাংলাদেশে এই শিল্পের সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার খুবই আশাব্যঞ্জক। শুধু প্রয়োজন মানসম্মত কাজ ও ব্যাপক প্রচার। এই শিল্প একদিকে যেমন আধুনিক শিল্পের চাহিদা মেটাতে সক্ষম, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করতে পারে।’ নিজের ক্যালিগ্রাফির বাজারমূল্যের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিটি ক্যালিগ্রাফি ১০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।’
তিনি মনে করেন, এই পেশা খুবই সম্মানজনক। এর মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তবে সেই স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নবীনদের কর্তব্য হলো, শিল্পটিকে নিখুঁতভাবে শেখা এবং সৃজনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অধিকতর যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা।
ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মাহবুব মুর্শিদ। দেশের অসংখ্য তরুণ ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর গুরু ও প্রশিক্ষক। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজ করছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। তিন শতাধিক নান্দনিক ক্যালিগ্রাফির স্রষ্টা তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম দৃষ্টি কেড়েছে বিদেশি শিল্পবোদ্ধাদেরও। বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের সান্নিধ্য-ধন্য এই শিল্পী একসময় চিত্রকলার নানা শাখায় কাজ করেছেন; উপভোগ করেছেন রঙের ভুবন। বর্তমানে ক্যালিগ্রাফিই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। এই শিল্পকে একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন—সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।
মাহবুব মুর্শিদের জন্ম যশোরে, ১৯৬১ সালে। পড়াশোনা করেছেন যশোরেই। শৈশবেই তাঁর শিল্পসত্তার বিকাশ ঘটে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালে বিভিন্ন বিষয়ে আঁকাআঁকি করতেন। অঙ্কন ক্লাসে দশে-দশ পাওয়া তাঁর জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলোতে দলছুট দিন কাটাতেন। রংতুলি তাঁকে ভীষণ টানত। যশোর শহরের আর্টের দোকানগুলোতে আনমনে ঘুরতেন। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠা পেইন্টিংগুলোতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। মনে মনে একজন শিল্পগুরুর সন্ধান করতেন।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন সন্ধান পান বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের। সুলতান তখন যশোর শহরের একটি পুরোনো হোস্টেলে আর্ট শেখাতেন, যেখানে ছোট-বড় অনেকেই অংশ নিতেন। পরে ‘চারুপীঠ’ নামে শিশুদের একটি আর্ট শেখার স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মাহবুব তাঁর কাছে যান এবং শিল্প দীক্ষা গ্রহণ করেন। সুলতানের সঙ্গে সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘একদিন খোঁজ পেলাম বিশ্ববরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতানের। দেখতে গেলাম তাঁকে। খুব ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। অনেকেই তাঁর সামনে বসে আছেন। তিনি ছবি আঁকছেন। তাঁর বেশভূষা আমার খুব পছন্দ হলো। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা আমাকে মুগ্ধ করল। সারা দিন তাঁর আঁকাআঁকি দেখলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি এসে তাঁর মতো আঁকার চেষ্টা করলাম। এভাবেই শুরু। এরপর প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম। তিনি নড়াইলে চলে যাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্য নিতাম। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তাঁর আশীর্বাদেই থেকেছি।’
মাহবুব জানান, সেই দিনগুলোতে যশোর কেন্দ্রীয় পাঠাগারের এক চিত্র প্রদর্শনীতে এস এম সুলতান, মোস্তফা আজীজ, খন্দকার বদরুল ইসলাম নান্নু, মাহবুব জামাল শামীমসহ দেশসেরা শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর তিনটি চিত্রকর্ম স্থান পায়। তিন চিত্রের একটি ছিল এস এম সুলতানের পোর্ট্রেট। তিনি তা দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন এবং তাঁকে উৎসাহ-আশীর্বাদ দেন।
গত শতকের ৯০-এর দশকে যশোর শহরে ক্রমেই পরিচিত হয়ে ওঠেন তরুণ শিল্পী মাহবুব। একসময়ের আগ্রহের জায়গা আঁকাআঁকিই সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠে তাঁর আয়-রোজগারের প্রধান অবলম্বন। প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট শপ ‘অঙ্কন’। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। দশ-বারোজন শাগরেদ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। সে সময় প্রচুর ব্যানার, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, ছবি ও পোর্ট্রেট আঁকতেন। মাঝেমধ্যে ক্যালিগ্রাফিও করতেন।
ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে তাঁর পরিচিতি আরও আগে। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে ইরান-ইরাকের কয়েকটি শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকায় তিনি সর্বপ্রথম ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা পান। পত্রিকাগুলো নিয়মিত সংগ্রহ করতেন এবং সেখানে থাকা ক্যালিগ্রাফিগুলোর অনুশীলন করতেন। ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার সুযোগ না পেলেও এভাবে নিজ প্রচেষ্টায় তিনি শিল্পটি ভালোভাবে রপ্ত করেন। ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফির প্রতি আলাদা দুর্বলতা তৈরি হতে থাকে। ২০০০ সালে ঢাকার একটি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তা আরও বেগবান হয়।
এরপর ক্যালিগ্রাফার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে তাঁর বেশি দিন সময় লাগেনি। একের পর এক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে নিজের শিল্পকর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এখন পর্যন্ত ২০টির বেশি জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, তেহরান, লাহোর ও রাজস্থানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ক্যালিগ্রাফি উপস্থাপনের সুযোগ। ২০১১ সালে ক্যালিগ্রাফির জন্য সর্বপ্রথম বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পান। ২১টি দেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত ইরানের তেহরানের এই প্রদর্শনীতে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালে ভারতের আজমির শরিফ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত আরেক প্রদর্শনীতেও বিশেষভাবে সম্মানিত হন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ভারতের রাজস্থানের ‘জয়পুর আর্ট সামিট’-এ একমাত্র ক্যালিগ্রাফার হিসেবে বিশেষ পুরস্কার পান। তাঁর ক্যালিগ্রাফি সংরক্ষিত আছে জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশ-বিদেশের অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে।
বর্তমানে শিল্পী মাহবুব মুর্শিদ ক্যালিগ্রাফির বাইরে অন্য কোনো কাজ করেন না। ‘গালা’ ও ‘এমএম আর্ট ফাউন্ডেশন’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাঁর ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের প্রধান মাধ্যম ক্যানভাসে এক্রিলিক কালার ও ওয়াটার কালার। এ ছাড়া তিনি মাটির টেরাকোটা, টাইলসের ম্যুরাল, বাঁশের চাটাই এবং মাটির পটারিতেও ক্যালিগ্রাফি করেন।
চাহিদার কারণে তাঁর বেশির ভাগ ক্যালিগ্রাফির ভাষা আরবি এবং কোরআনের আয়াত হলেও প্রায় অর্ধশত দৃষ্টিনন্দন বাংলা ক্যালিগ্রাফিও করেছেন তিনি। ‘সুলুস’ লিখনশৈলীতে বেশির ভাগ কাজ করেছেন; তবে ‘সুনবুলি’ লিখনশৈলীও তাঁর পছন্দের তালিকায় রয়েছে। রঙের ব্যাপারে বরাবরই সচেতন তিনি। তাঁর ক্যালিগ্রাফিতে আধুনিক চিত্রশিল্পের নান্দনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুব বলেন, ‘যেকোনো পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে রং নির্বাচন মুখ্য বিষয়। রং যদি সঠিকভাবে নির্বাচন করা না হয়, তাহলে পেইন্টিং খুব বেশি দৃষ্টিনন্দন ও অর্থবহ হয় না। আর আমাদের দেশের মানুষ আধুনিক চিত্রশিল্প দেখে অভ্যস্ত। আপনি যদি এই বিশাল দর্শক শ্রেণিকে নতুন একটা শিল্পের সঙ্গে পরিচিত করাতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেই আধুনিক শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ফলে মানুষ আপনার শিল্পকে সাদরে গ্রহণ করবে।’
তাঁর ক্যালিগ্রাফির শিল্পমান মূল্যায়ন করে ক্যালিগ্রাফি-গবেষক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ মানসুর তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ‘সমকালীন ইসলামি ক্যালিগ্রাফি: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’-এ লিখেছেন, ‘মাহবুব মুর্শিদ উলম্ব-অনুভূমিক রেখা অঙ্কনে ক্যালিগ্রাফি নির্মাণ করেছেন। লিখনশিল্পের সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা তাঁর শিল্পকর্মে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। …তাঁর শিল্পকর্মে ক্যালিগ্রাফির অর্থ ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন; তা বিমূর্ত ঢঙে করতে প্রয়াস চালান তিনি। তাঁর ক্যালিগ্রাফি উজ্জ্বল রং ব্যবহারে উদ্ভাসিত। …তা ছাড়া তিনি বাংলাদেশের ফুল, লতা-পাতার সমাহারে ক্যালিগ্রাফির মধ্যে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণার প্রয়াস পেয়েছেন।’
মাহবুব মুর্শিদের স্বপ্ন, ক্যালিগ্রাফিকে তিনি একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কারণ তিনি মনে করেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থাকার কারণে এটিকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন। তাই তিনি মূলধারার শিল্পশৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্যালিগ্রাফিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এ লক্ষ্যেই তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর দাবি, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি চর্চা সত্তরের দশক থেকে শুরু হলেও গত পঞ্চাশ বছরে যে কাজটি কেউ করতে পারেননি, তা তিনি মাত্র চার বছরে করতে পেরেছেন এবং ক্যালিগ্রাফিকে স্বতন্ত্র শিল্পধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের সংগঠিত করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্ট গিল্ড’। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করেছেন বাণিজ্যিকভাবে ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ কর্মশালা। এ পর্যন্ত তিনি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ১৭টি কর্মশালা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। বিভিন্ন পেশা ও বয়সের ২ হাজারের বেশি প্রশিক্ষণার্থী কর্মশালাগুলোতে অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর কাছ থেকে ক্যালিগ্রাফির পাঠ গ্রহণ করে অনেকেই বর্তমানে সফলতার সঙ্গে এ শিল্পের চর্চা করছেন এবং নিজেদের সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন।
ক্যালিগ্রাফির বাজার কেমন এবং বাংলাদেশে এই শিল্পের সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার খুবই আশাব্যঞ্জক। শুধু প্রয়োজন মানসম্মত কাজ ও ব্যাপক প্রচার। এই শিল্প একদিকে যেমন আধুনিক শিল্পের চাহিদা মেটাতে সক্ষম, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করতে পারে।’ নিজের ক্যালিগ্রাফির বাজারমূল্যের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিটি ক্যালিগ্রাফি ১০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।’
তিনি মনে করেন, এই পেশা খুবই সম্মানজনক। এর মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তবে সেই স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নবীনদের কর্তব্য হলো, শিল্পটিকে নিখুঁতভাবে শেখা এবং সৃজনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অধিকতর যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা।
বারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
৯ ঘণ্টা আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৩ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৪ দিন আগেমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মুক্তির আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তিনি এম এন লারমা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ডাকনাম ছিল মঞ্জু। তাঁর নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ দিন আগে