ফজলুল কবির
প্রাসাদের সুইমিংপুলে তো রাজ-রাজড়াদেরই জলকেলি করার কথা। রাজার যুগ আর নেই, কিন্তু রাজার মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরা তো আছেন। ফলে তাঁরাই ‘বাধ্য হয়ে’ এই জলকেলির ভার নেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় আজ এ কী হলো? প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ভেতরে সুইমিংপুলে তো রাজকীয় কাউকে দেখা গেল না। যাদের দেখা মিলল, তাঁরা সাধারণ এবং সংখ্যায় অনেক। তবে রাজা, থুড়ি প্রেসিডেন্ট কোথায়? পলাতক।
ফুঁসে ওঠা জনতার সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েও মসনদ আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রাসাদটি আগলে রাখতে পারেননি। তিনি পালিয়েছেন। দেশটির ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, স্থানটি অজ্ঞাত হলেও নিরাপদেই আছেন—এটা নিশ্চিত।
এত দিন এই প্রবল জনস্রোত আটকে রাখা হয়েছিল কারফিউ জারি করে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তা জারিই ছিল। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সমাজনেতাসহ নানা পক্ষের কাছে থেকে আসা হুমকিতে শেষ পর্যন্ত সেই কারফিউ তুলে নিতে হয়েছে পুলিশ প্রধানকে। তুলে না নিলে তাঁকেই হয়তো আক্রান্ত হতে হতো। বিশৃঙ্খলার বোনা বীজকে রক্ষা করে করে তিনি যে অস্থিরতা নামের মহিরুহের বেড়ে ওঠায় সহায়ক হয়েছেন, তাতেই তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিজের এখতিয়ার ও বিশ্বাস হারিয়েছেন। জনতাকে ফাটকে ভরার ভয় দেখানো সেই লোকই আটক হওয়ার ভয় পেয়ে সুড়সুড় করে সোজা পথে এলেন। এবং কারফিউ তুলে নিলেন। অবশ্য, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কারফিউ থাকলেও কিছু হতো না। এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। কারণ, জনতা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। কলম্বোর দরজা খোলার সব আয়োজন তারা আগেই সম্পন্ন করেছিল।
কথা হলো কেন আবার এত খেপল শ্রীলঙ্কার মানুষ? প্রধানমন্ত্রী তো গেছেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। একটু তো সময় দিতে হবে। কিন্তু ক্ষুধার্ত ও কোণঠাসা মানুষ কবে কোথায় এই সময়ের অপেক্ষা করেছে? করেনি, কখনোই করেনি। তারা অপেক্ষা করে, করতেই থাকে। তারা সহনশীল। পেটে পাথর বেঁধে হলেও মুখ বুঁজে থাকে একটা সময়। কিন্তু তারপরও যখন কোনো আলোর আভা পাওয়া যায় না, তখন তারা ঝড় তোলে। অন্ধকারকে আরও গুমোট, আরও নৈরাশ্যে পুরে দিয়ে নতুন আলোর উৎসভূমি খুঁজতে নামে তারা। শ্রীলঙ্কায়ও তাই হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষ কি আরও কটা দিন মুখ বুজে থাকতে পারত না? উত্তর হলো, না। কারণ, তারা দেখেছে ক্ষুধা, জ্বালানি সংকট, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইত্যাদি শুধু তাদেরই সংকট। প্রেসিডেন্ট ভবনে যিনি আছেন মসনদ আঁকড়ে, তাঁর কাছে এগুলো যেন অস্তিত্বহীন। অথচ প্রতি সকালে উঠে তারা নাশতার টেবিলে পাচ্ছে আগের দিনের চেয়ে কম খাবার। প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অজগর-সারি আরও মোটা ও আরও লম্বা হচ্ছে। আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাদের পেট আরও একটু পিঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকা এই গাড়িচালকদের সেখানেই ঘুমাতে হয়েছে, এমনকি করতে হয়েছে পোশাক বদলও। শুরুতে একটু বিত্ত থাকা লোকেরা সঙ্গে খাবার নিয়ে আসত। কিন্তু খাবারের দাম বাড়তে থাকায় সেখানেও প্রাচুর্যে টান পড়ে। আর দরিদ্র লোকেরা যেখানে থাকে, সেখানে তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে গণ-খাবারের ব্যবস্থা। খাবার বলতে ভাত আর নারকেল। শ্রীলঙ্কায় এখন এমনকি ডালও হয়ে গেছে অভিজাত খাবার। কিন্তু মাছ তো থাকার কথা শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু নেই বললেই চলে। কারণ, মাছ সংগ্রহে সমুদ্রে যেতে হবে। আর সে জন্য চাই ডিজেল, যা ঢুকে গেছে ফিলিং স্টেশন ঘিরে তৈরি হওয়া অজগরের পেটে। এ এক দুঃসহ চক্র।
এদিকে তীব্র গরম। বিদ্যুৎ নেই। বাজারে খাবারের অভাব। ওষুধ নেই। চিকিৎসা নেই। সব এতই উচ্চমূল্য যে, বাজারে যা আছে, তা কেনার সাধ্যও কারও নেই। ফলত ক্ষুধা। এই ক্ষুধা পেটে, চরম অনিশ্চয়তায় ভরা রাতে যখন গরমের হলকা শরীরকে স্যাঁতসেঁতে করে দেয়, যখন মাথার ওপর থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটিও আর চলার জ্বালানি পায় না, তখন ঘুম হয়ে ওঠে এক পুরাণের গল্প। শ্রীলঙ্কার মানুষ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ঘুমহীন থেকেছে।
যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। আজ যে রুটি তারা কিনেছে ৫ রুপিতে, দুদিন পরই তা হয়ে যাচ্ছে ১০। প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রীয় বিবৃতিতে তারা জানছে, ধৈর্য ধারণের কথা। বলা হচ্ছে, গভীর সংকটে আছে দেশ, একটু সেরে উঠতে দাও। কিন্তু জনতা কত দিন এই ধৈর্য ধরে থাকবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমা নেই। কোথাও বলা হচ্ছে না যে, এটুকু হলেই কাটিয়ে উঠব। জনতা বরং পাল্টা প্রশ্ন তুলছে—‘আগে কেন ভাবোনি বাপু? আমার টাকায় তোমাকে এত ফুটানি করতে কে বলেছিল?’
শ্রীলঙ্কায় এমন ক্ষোভ কি এবারই প্রথম? সেখানকার মানুষ কি প্রায়ই এমন ফুঁসে ওঠে? দুটি প্রশ্নেরই উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। শ্রীলঙ্কার মানুষ আর দশটা দেশের মতোই শান্তিপ্রিয়। হ্যাঁ,১৯৪৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতোই জাতিগত বিভাজনের অদৃষ্ট নিয়েই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এ অঞ্চলের কোনো দেশেই এই বীজ বুনে দিতে ভুল করেনি। এর জন্য জ্বলতেও হয়েছে দেশটিকে। সিংহলি-তামিল দ্বন্দ্ব ছিল তীব্র। এখনো হয়তো ভেতরে-ভেতরে আছে। থাকতেই পারে। কোনো ক্ষতই একেবারে সেরে ওঠে না। ২ কোটি ২০ জনসংখ্যার এই দেশও সেরে ওঠেনি। কিন্তু তারপরও তারা আজ, এই ৯ জুলাই ২০২২-এ এককাট্টা হয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে পড়তে পেরেছে। রাস্তায় নেমে কাঁধ মিলিয়ে বিক্ষোভ করেছে সেই ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে, যাদের একদিন তারাই বসিয়েছিল, দিয়েছিল সম্মানের আসন।
সেই সম্মানকে দুর্বলতা ভাবায়, চুপ করে থাকাকে মেরুদণ্ডহীনতা ভাবায় আজ এই জনতাই সেই রাজাপক্ষে পরিবারের শেষ সদস্যটিকেও ক্ষমতার আসন থেকে পালাতে বাধ্য করেছে, যে এমনকি এখনো পদত্যাগ করেনি। গৃহযুদ্ধে তামিলদের পরাজিত করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিল সিংহলিদের নয়নের মণি। অথচ আজ মাহিন্দাকে হটানোর কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর ভাই এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকে তারা বিতাড়িত করল। এই বিতাড়নের প্রেক্ষাপট আগেই বলা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার এই অবস্থার জন্য অর্থনৈতিক সংকট দায়ী, এটা সবাই জানে। সবাই জানে যে, এসব সংকটের পেছনে আছে বিবেচনাহীন বৈদেশিক ঋণ, অদূরদর্শী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী নানা ব্যয়বহুল প্রকল্প, আছে অপব্যয় এবং সর্বোপরি দুর্নীতি। প্রকল্পগুলো নেওয়ার সময় বলেছে, ‘ভালো হবে, দেখো!’ নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছে। রাজাপক্ষে সরকার শোনেনি। জনগণের কাছ থেকে সম্মতিও আদায় করেনি। বরং জনগণ দেখেছে নির্বাচন ব্যবস্থাকে কীভাবে দখলে নেওয়া হয়েছে। ফলে কোনো পন্থাতেই জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা হয়নি শ্রীলঙ্কায়। একপেশে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাই এখন যখন পর্যটনকে কেন্দ্র করে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তার পুরোটাকেই অর্থহীন দেখছে মানুষ। যখন দেখছে ক্ষুধা পেটে গরমে নির্ঘুম এপাশ-ওপাশ করাই তাদের একমাত্র নিয়তি, তখন তারা ফুঁসে উঠেছে। তারা প্রশ্ন করছে, ‘কেন তোমরা এমন করলে?’ এ প্রশ্ন তারা করবেই। কারণ, উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলো তো তাদের জিজ্ঞেস করে নেওয়া হয়নি, তবে দায় কেন শুধু তাদের কাঁধেই? এমন প্রশ্ন নিয়ে তারা ঢুকে পড়ছে গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রাসাদে, মাস কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া রনিল বিক্রমাসিংহের বাসভবনে।
বিশ্বের বহু দেশ এখন জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিপুল উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিনিয়োগ সত্ত্বেও বহু দেশেই শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। বহু দেশেই গরমে নাভিশ্বাস উঠছে মানুষের। ঘেমে-নেয়ে গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বহু দেশের মানুষ। তাদের চোখ ক্রমশই রক্তজবার মতো লাল হয়ে উঠছে। লাল চোখে প্রতিদিন বাজারে গিয়ে তারা কিনে আনছে আগের চেয়ে উচ্চমূল্যে খাবার। তারা ক্ষুধার্ত হয়ে উঠছে। সেই চোখে তারা দুর্নীতি ও ক্ষমতাধরদের বিলাসিতার গল্পগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। নতুন করে পড়ে নিচ্ছে। তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক হতে বলছেন। কে না জানে যত দরিদ্রই হোক, দেশগুলোর ক্ষমতাধরদের সুইমিংপুল ঠিকই সুনীল জলে পূর্ণ থাকে!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রাসাদের সুইমিংপুলে তো রাজ-রাজড়াদেরই জলকেলি করার কথা। রাজার যুগ আর নেই, কিন্তু রাজার মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরা তো আছেন। ফলে তাঁরাই ‘বাধ্য হয়ে’ এই জলকেলির ভার নেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় আজ এ কী হলো? প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ভেতরে সুইমিংপুলে তো রাজকীয় কাউকে দেখা গেল না। যাদের দেখা মিলল, তাঁরা সাধারণ এবং সংখ্যায় অনেক। তবে রাজা, থুড়ি প্রেসিডেন্ট কোথায়? পলাতক।
ফুঁসে ওঠা জনতার সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েও মসনদ আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রাসাদটি আগলে রাখতে পারেননি। তিনি পালিয়েছেন। দেশটির ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, স্থানটি অজ্ঞাত হলেও নিরাপদেই আছেন—এটা নিশ্চিত।
এত দিন এই প্রবল জনস্রোত আটকে রাখা হয়েছিল কারফিউ জারি করে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তা জারিই ছিল। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সমাজনেতাসহ নানা পক্ষের কাছে থেকে আসা হুমকিতে শেষ পর্যন্ত সেই কারফিউ তুলে নিতে হয়েছে পুলিশ প্রধানকে। তুলে না নিলে তাঁকেই হয়তো আক্রান্ত হতে হতো। বিশৃঙ্খলার বোনা বীজকে রক্ষা করে করে তিনি যে অস্থিরতা নামের মহিরুহের বেড়ে ওঠায় সহায়ক হয়েছেন, তাতেই তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিজের এখতিয়ার ও বিশ্বাস হারিয়েছেন। জনতাকে ফাটকে ভরার ভয় দেখানো সেই লোকই আটক হওয়ার ভয় পেয়ে সুড়সুড় করে সোজা পথে এলেন। এবং কারফিউ তুলে নিলেন। অবশ্য, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কারফিউ থাকলেও কিছু হতো না। এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। কারণ, জনতা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। কলম্বোর দরজা খোলার সব আয়োজন তারা আগেই সম্পন্ন করেছিল।
কথা হলো কেন আবার এত খেপল শ্রীলঙ্কার মানুষ? প্রধানমন্ত্রী তো গেছেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। একটু তো সময় দিতে হবে। কিন্তু ক্ষুধার্ত ও কোণঠাসা মানুষ কবে কোথায় এই সময়ের অপেক্ষা করেছে? করেনি, কখনোই করেনি। তারা অপেক্ষা করে, করতেই থাকে। তারা সহনশীল। পেটে পাথর বেঁধে হলেও মুখ বুঁজে থাকে একটা সময়। কিন্তু তারপরও যখন কোনো আলোর আভা পাওয়া যায় না, তখন তারা ঝড় তোলে। অন্ধকারকে আরও গুমোট, আরও নৈরাশ্যে পুরে দিয়ে নতুন আলোর উৎসভূমি খুঁজতে নামে তারা। শ্রীলঙ্কায়ও তাই হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষ কি আরও কটা দিন মুখ বুজে থাকতে পারত না? উত্তর হলো, না। কারণ, তারা দেখেছে ক্ষুধা, জ্বালানি সংকট, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইত্যাদি শুধু তাদেরই সংকট। প্রেসিডেন্ট ভবনে যিনি আছেন মসনদ আঁকড়ে, তাঁর কাছে এগুলো যেন অস্তিত্বহীন। অথচ প্রতি সকালে উঠে তারা নাশতার টেবিলে পাচ্ছে আগের দিনের চেয়ে কম খাবার। প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অজগর-সারি আরও মোটা ও আরও লম্বা হচ্ছে। আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাদের পেট আরও একটু পিঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকা এই গাড়িচালকদের সেখানেই ঘুমাতে হয়েছে, এমনকি করতে হয়েছে পোশাক বদলও। শুরুতে একটু বিত্ত থাকা লোকেরা সঙ্গে খাবার নিয়ে আসত। কিন্তু খাবারের দাম বাড়তে থাকায় সেখানেও প্রাচুর্যে টান পড়ে। আর দরিদ্র লোকেরা যেখানে থাকে, সেখানে তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে গণ-খাবারের ব্যবস্থা। খাবার বলতে ভাত আর নারকেল। শ্রীলঙ্কায় এখন এমনকি ডালও হয়ে গেছে অভিজাত খাবার। কিন্তু মাছ তো থাকার কথা শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু নেই বললেই চলে। কারণ, মাছ সংগ্রহে সমুদ্রে যেতে হবে। আর সে জন্য চাই ডিজেল, যা ঢুকে গেছে ফিলিং স্টেশন ঘিরে তৈরি হওয়া অজগরের পেটে। এ এক দুঃসহ চক্র।
এদিকে তীব্র গরম। বিদ্যুৎ নেই। বাজারে খাবারের অভাব। ওষুধ নেই। চিকিৎসা নেই। সব এতই উচ্চমূল্য যে, বাজারে যা আছে, তা কেনার সাধ্যও কারও নেই। ফলত ক্ষুধা। এই ক্ষুধা পেটে, চরম অনিশ্চয়তায় ভরা রাতে যখন গরমের হলকা শরীরকে স্যাঁতসেঁতে করে দেয়, যখন মাথার ওপর থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটিও আর চলার জ্বালানি পায় না, তখন ঘুম হয়ে ওঠে এক পুরাণের গল্প। শ্রীলঙ্কার মানুষ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ঘুমহীন থেকেছে।
যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। আজ যে রুটি তারা কিনেছে ৫ রুপিতে, দুদিন পরই তা হয়ে যাচ্ছে ১০। প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রীয় বিবৃতিতে তারা জানছে, ধৈর্য ধারণের কথা। বলা হচ্ছে, গভীর সংকটে আছে দেশ, একটু সেরে উঠতে দাও। কিন্তু জনতা কত দিন এই ধৈর্য ধরে থাকবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমা নেই। কোথাও বলা হচ্ছে না যে, এটুকু হলেই কাটিয়ে উঠব। জনতা বরং পাল্টা প্রশ্ন তুলছে—‘আগে কেন ভাবোনি বাপু? আমার টাকায় তোমাকে এত ফুটানি করতে কে বলেছিল?’
শ্রীলঙ্কায় এমন ক্ষোভ কি এবারই প্রথম? সেখানকার মানুষ কি প্রায়ই এমন ফুঁসে ওঠে? দুটি প্রশ্নেরই উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। শ্রীলঙ্কার মানুষ আর দশটা দেশের মতোই শান্তিপ্রিয়। হ্যাঁ,১৯৪৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতোই জাতিগত বিভাজনের অদৃষ্ট নিয়েই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এ অঞ্চলের কোনো দেশেই এই বীজ বুনে দিতে ভুল করেনি। এর জন্য জ্বলতেও হয়েছে দেশটিকে। সিংহলি-তামিল দ্বন্দ্ব ছিল তীব্র। এখনো হয়তো ভেতরে-ভেতরে আছে। থাকতেই পারে। কোনো ক্ষতই একেবারে সেরে ওঠে না। ২ কোটি ২০ জনসংখ্যার এই দেশও সেরে ওঠেনি। কিন্তু তারপরও তারা আজ, এই ৯ জুলাই ২০২২-এ এককাট্টা হয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে পড়তে পেরেছে। রাস্তায় নেমে কাঁধ মিলিয়ে বিক্ষোভ করেছে সেই ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে, যাদের একদিন তারাই বসিয়েছিল, দিয়েছিল সম্মানের আসন।
সেই সম্মানকে দুর্বলতা ভাবায়, চুপ করে থাকাকে মেরুদণ্ডহীনতা ভাবায় আজ এই জনতাই সেই রাজাপক্ষে পরিবারের শেষ সদস্যটিকেও ক্ষমতার আসন থেকে পালাতে বাধ্য করেছে, যে এমনকি এখনো পদত্যাগ করেনি। গৃহযুদ্ধে তামিলদের পরাজিত করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিল সিংহলিদের নয়নের মণি। অথচ আজ মাহিন্দাকে হটানোর কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর ভাই এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকে তারা বিতাড়িত করল। এই বিতাড়নের প্রেক্ষাপট আগেই বলা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার এই অবস্থার জন্য অর্থনৈতিক সংকট দায়ী, এটা সবাই জানে। সবাই জানে যে, এসব সংকটের পেছনে আছে বিবেচনাহীন বৈদেশিক ঋণ, অদূরদর্শী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী নানা ব্যয়বহুল প্রকল্প, আছে অপব্যয় এবং সর্বোপরি দুর্নীতি। প্রকল্পগুলো নেওয়ার সময় বলেছে, ‘ভালো হবে, দেখো!’ নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছে। রাজাপক্ষে সরকার শোনেনি। জনগণের কাছ থেকে সম্মতিও আদায় করেনি। বরং জনগণ দেখেছে নির্বাচন ব্যবস্থাকে কীভাবে দখলে নেওয়া হয়েছে। ফলে কোনো পন্থাতেই জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা হয়নি শ্রীলঙ্কায়। একপেশে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাই এখন যখন পর্যটনকে কেন্দ্র করে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তার পুরোটাকেই অর্থহীন দেখছে মানুষ। যখন দেখছে ক্ষুধা পেটে গরমে নির্ঘুম এপাশ-ওপাশ করাই তাদের একমাত্র নিয়তি, তখন তারা ফুঁসে উঠেছে। তারা প্রশ্ন করছে, ‘কেন তোমরা এমন করলে?’ এ প্রশ্ন তারা করবেই। কারণ, উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলো তো তাদের জিজ্ঞেস করে নেওয়া হয়নি, তবে দায় কেন শুধু তাদের কাঁধেই? এমন প্রশ্ন নিয়ে তারা ঢুকে পড়ছে গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রাসাদে, মাস কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া রনিল বিক্রমাসিংহের বাসভবনে।
বিশ্বের বহু দেশ এখন জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিপুল উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিনিয়োগ সত্ত্বেও বহু দেশেই শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। বহু দেশেই গরমে নাভিশ্বাস উঠছে মানুষের। ঘেমে-নেয়ে গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বহু দেশের মানুষ। তাদের চোখ ক্রমশই রক্তজবার মতো লাল হয়ে উঠছে। লাল চোখে প্রতিদিন বাজারে গিয়ে তারা কিনে আনছে আগের চেয়ে উচ্চমূল্যে খাবার। তারা ক্ষুধার্ত হয়ে উঠছে। সেই চোখে তারা দুর্নীতি ও ক্ষমতাধরদের বিলাসিতার গল্পগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। নতুন করে পড়ে নিচ্ছে। তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক হতে বলছেন। কে না জানে যত দরিদ্রই হোক, দেশগুলোর ক্ষমতাধরদের সুইমিংপুল ঠিকই সুনীল জলে পূর্ণ থাকে!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১৭ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১৭ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১৭ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১৭ ঘণ্টা আগে