দাউদ হায়দার
কবিতা লেখেননি, কখনো মকশো করেছেন কি না, জিজ্ঞেস করলে হাসির মাত্রায় এমনই রহস্য, বোঝা দুষ্কর লেখা না-লেখা। ‘কবিতা ভালোবাসি, পড়ি। কবিতা-প্রেম স্কুল বয়স থেকেই।’ এমন প্যাঁচালো কথায় ঘিলু চক্কর দেয়, বুঝে নিই কবি না হয়েও মূলত কবি। ধ্যানজ্ঞান কতটা কবিতায়, স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর কিয়ৎ কাল পরেই।
প্রাবন্ধিক অশোক মিত্রের মতো কবিতা থেকে মিছিলে যাননি ভূঁইয়া ইকবাল; বরং উল্টো। কবিতাপাঠের আসরে উপস্থিত, কাব্যালোচনায় অংশী, কবিকুলের সঙ্গে সৌহার্দ্য, সঙ্গীও। অনুচ্চ কণ্ঠ, মৃদুভাষী, কথায় জোর স্থির বিশ্বাসে, ‘আবুল হাসানকে দিয়ে সংগ্রাম, বিপ্লব, রাজনৈতিক কবিতা রচনা অসম্ভব।’ শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে বলছিলেন একবার, উনসত্তরের (১৯৭৯) গণ-আন্দোলন তখন প্রায়-নিভন্ত। কিন্তু ভেতরে জ্বলন্ত, যেন তুষের আগুনে।
তখন ঝাঁকে ঝাঁকে কবি গজায়নি, উৎপাদিত হয়নি। যে কয়জন, আঙুলে গোনা। সেই সময়ের কথা বলছি। পরস্পর চেনা, মাঝে মাঝে দেখা। দলটল, এর-ওর পিঠ চাপড়ানো কালচার ছিল না। কবিতার আসরও বছরে সাকল্যে তিন-চারবার। বিশেষত তরুণদের। তরুণ বলতে বয়স ত্রিশ উত্তীর্ণ নয়।
সত্তরের গোড়ায় হোটেল শাহবাগে ফজল শাহাবুদ্দীন, শামসুর রাহমান আয়োজিত কবিতাপাঠের আয়োজন, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপিত। কনিষ্ঠ কবি আবুল হাসান। আমরা উত্তেজিত। হুমায়ুন কবিরের কিছু কবিতা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। গ্রন্থাকারে অমুদ্রিত। গোসসা করেছেন। অনিমন্ত্রিত। থাকেন আমাদের পাশের বাসায়, বললুম, চলুন। উত্তর: ‘না। আমাকে ডাকেনি।’ বুঝিয়ে দিতে চাইলেন ফেলনা নন তিনি। কবিতায় স্বতন্ত্র। কোভিদ অভিমান জেদ কাব্যোচিত। কুর্নিশযোগ্য।
শাহবাগ হোটেলের ব্যাঙ্কুয়েট হলে কবিতার আসর। হলভর্তি শ্রোতা বসেছি পেছনের সারিতে। পাশে ভূঁইয়া ইকবাল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে বললেন, কানে গুঁজে আছে এখনো, ‘আয়োজক ফজল ভাই, রাহমান ভাই; কিন্তু মূলে লায়লা সামাদ। তাঁর সঙ্গে ফজল ভাইয়ের বন্ধুতা। লায়লার স্বামী সামাদ সাহেব এই হোটেলের মালিক।’ অনুষ্ঠান শেষে দেখলুম, শামসুর রাহমান এবং আরও কয়েকজন (প্রত্যেকে কবি) ইকবালের সঙ্গে কথা বলছেন।
ইকবাল তরুণ কুলে শ্রদ্ধেয়, বয়স্ক মহলে স্নেহের। ছাত্রাবস্থায় প্রকাশ করেছেন কবিতাপত্র ‘পূর্বলেখ’। লিটল ম্যাগাজিন। কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধও আছে। লাইনোটাইপে ঝকঝকে ছাপা। মোটা কাগজ। সুদৃশ্য পত্রিকা। প্রথম সংখ্যায় আলী ইমামের কবিতা। আলী ইমাম কি পরে কাব্যচর্চায় ইতি টেনেছেন? বলতে অপারগ। ‘পূর্বলেখ’ নাম কেন রেখেছেন, ওর মুখেই শোনা। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘পূর্বমেঘ’। সম্পাদকতায় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ‘নামটি খুব পছন্দ, এ রকম নামই খুঁজছিলাম, কাব্যিক নাম। পেয়েও যাই, বিষ্ণুদের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম “পূর্বলেখ”।’
ভূঁইয়া ইকবালের সঙ্গে দেখা কলকাতায়। সম্ভবত খোঁজ করছিলেন তিনি, ঠিকানা জানেন না, হদিস পাবেন কী করে? গৌরদা (গৌরকিশোর ঘোষ। লেখক, সাংবাদিক) ফোন করেন এক সন্ধ্যায়, শুক্রবারে। বলেন, ‘রোববার দুপুরে আসবি একটার আগে।’ বুঝলুম, খাবারের নিমন্ত্রণ। মাসখানেক গৌরদার আস্তানায় (পাইকপাড়ার ফ্ল্যাট) যাওয়া হয়নি। নানা ধান্দায় ঘুরি। সময় কোথায়। আসলে অকৃতজ্ঞ। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কলকাতায়, গৌরকিশোর ঘোষের ফ্ল্যাটেই প্রথম আশ্রয়। অচেনা শহরে তিনিই উদ্ধারকর্তা, আশ্রয়দাতা।
সাড়ে ১২টার আগেই পৌঁছাই, বৌদির (শীলা ঘোষ। গৌরকিশোর ঘোষের স্ত্রী) মৃদু তিরস্কার, ‘ভুলে গেছ আমাদের?’ কিছুক্ষণ পরে ভূঁইয়া ইকবাল হাজির। বিস্ময় মানি। গৌরদা পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের দুজনের ঠোঁটে হাসি। ইকবাল খোলাসা করেন, ‘এগারো বছর পরে দেখা। গৌরদাকে বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে কীভাবে দেখা হতে পারে। গৌরদা বলেন, আচ্ছা তাই না, গৌরদা?’
কথায় কথায় জানা গেল, ভূঁইয়া ইকবাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর গবেষণা করবেন। স্কলারশিপ পেয়েছেন। বিষয় কী জিজ্ঞেস করিনি, নিজেও বলেননি।
মাঝে মাঝেই দেখা হয়। মাঝে মাঝে উধাও তিনি। কোথাও হদিস নেই। হঠাৎ হাজির (অন্নদাশঙ্কর রায়ের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ওখানেই থাকি)। চিঠি দেন বড় ভাইয়ের (জিয়া হায়দার)। প্যাকেট (পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন)। কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশে গেলে ভুলতেন না লিটল ম্যাগাজিন আনতে। উপহার দিয়ে ‘অনেক নতুন গল্পকার কবি ভালো লিখছেন’ বলতেন।
দেশভাগের কয়েক বছর আগে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাঁচ-ছয়জন বাঙালি মুসলিম, বয়সে তরুণ, মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন শুরু করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি নস্যাতে আলো প্রজ্বালনে শিখা গোষ্ঠীর প্রকাশ। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। ইকবাল বললেন, ‘গোষ্ঠীর অন্যতম আবুল ফজল পাকিস্তান জন্মের পর কায়েদে আজমকে (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ) নিয়ে নাটক লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার মন্ত্রী মুক্তবুদ্ধি নিয়ে এমনকি তাঁর লেখা?’ বলি, আত্মপীড়ন থেকেই বোধ হয় ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘মৃতের আত্মহত্যা’ লিখেছেন। গল্পটি তুমুল পঠিত, আলোচিত। জিয়া সরকার মহলেও আলোড়িত। ব্যাপক সাড়া। প্রসঙ্গ এড়িয়ে ইকবাল ‘এই গল্প নিয়ে পরিচয় পত্রিকায় একজন লিখেছিলেন, মুসলিম নামধারী। তার লেখা আগে এবং পরেও পড়িনি। লেখায় সমালোচনার সঙ্গে গল্পের অনুষঙ্গ ছিল। শুনেছি আবুল ফজল বিরক্ত হন।’
‘হতেই পারেন।’ বলে হেসে ফেলি। ‘আপনার হাসি রহস্যময়, নিশ্চয়ই ঘটনা আছে।’ রহস্য জানতে উদ্গ্রীব। কবুল করি ছদ্মনামে লিখেছিলুম। যেহেতু ছদ্মনাম, জানার কথা নয় তাঁর, কে আসল লেখক।
লেখা পড়ে আবুল ফজল দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন ‘পরিচয়’ সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চিঠি পড়েছি। চিঠি ছাপেননি যদিও। ইকবাল, ‘ওই চিঠি পাওয়া যাবে?’
‘বোধ হয় না আবুল ফজল, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই মৃত।’ জানতুম, ভূঁইয়া ইকবাল নামীদামি কবি-সাহিত্যিকের চিঠি সংগ্রাহক। ওর অনুরোধ, ‘আপনার দাদু (অন্নদাশঙ্কর রায়) বহু খ্যাতনামাকে চিঠি লিখেছেন, উত্তর পেয়েছেন নিশ্চয় শুনেছি। তিনি যাঁকে চিঠি লিখতেন, কপিও রাখতেন।’
বলি, ঠিকই শুনেছেন। লেখেন টাইপরাইটারে (বাংলা টাইপরাইটার ১৯২৯ সালে কেনা)। কার্বন পেপার ব্যবহার করেন। দাদুর কড়া নির্দেশ–তাঁর লেখা চিঠি এবং তাঁকে লেখা চিঠি তাঁর জীবিতকালে ছাপা যাবে না। এক রোববার সকালে হাজির, নটা বেজে গেছে। চা খেয়ে বাসনা খোলাসা করেন। সত্যজিৎ রায়কে দেখার সাধ। ফোন করলুম মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায়)। গেলুম ১০টার পরে। পরিচয় করিয়ে দিলুম। ‘পূর্বলেখ’ পত্রিকার গুণগান গাই। মানিকদা বললেন, ‘দেখিনি।’ ঢাকায় গিয়ে ডাকযোগে পাঠাবেন, ইকবাল জানান। তারপরেই আচমকা আবদার, ‘আপনি যদি প্রচ্ছদ এঁকে দেন খুশি হব।’
সত্যজিৎ রীতিমতো ভড়কে গেছেন। অতঃপর গম্ভীর স্বরে, ‘না।’ হয়তো আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানো যেত, ওই ‘না’র পরে বেমানান। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে বললাম, ‘এটা কী করলেন?’ কাঁচুমাচু মুখে উত্তর, ‘সরি, ঠিক হয়নি বলা। তবে ওনাকে দেখলাম, কথা বললাম, এটাও বড় পাওনা।’ ইকবালের মুখ দেখে কষ্ট হলো। চলুন, আরেক দিকপালের কাছে। একটি শর্ত, গিয়ে বলবেন না, সত্যজিতের বাড়ি থেকে আসছেন।
মৃণাল দা (মৃণাল সেন) সব সময়ই ঘরোয়া। আড্ডাবাজ পরিচিতজনের সঙ্গে। আড্ডার সময়ের হিসাব থাকে না। ঘণ্টাখানেক খোশগল্প, চা খাওয়া। ইকবাল মহাখুশি। আফসোস, ক্যামেরা নেই। দুজনের সঙ্গে ছবি না তোলার দুঃখ। রাস্তায় এসে বললেন, ‘আপনার মানিকদা চা খাওয়ার কথাও বলেননি!’
–বলতেন, প্রচ্ছদ আঁকার আবদারে মেজাজ বিগড়ে দিয়েছেন!’
ভূঁইয়া ইকবাল চলে গেলেন, স্মৃতি কুরে খাচ্ছে।
লেখক: কবি
কবিতা লেখেননি, কখনো মকশো করেছেন কি না, জিজ্ঞেস করলে হাসির মাত্রায় এমনই রহস্য, বোঝা দুষ্কর লেখা না-লেখা। ‘কবিতা ভালোবাসি, পড়ি। কবিতা-প্রেম স্কুল বয়স থেকেই।’ এমন প্যাঁচালো কথায় ঘিলু চক্কর দেয়, বুঝে নিই কবি না হয়েও মূলত কবি। ধ্যানজ্ঞান কতটা কবিতায়, স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর কিয়ৎ কাল পরেই।
প্রাবন্ধিক অশোক মিত্রের মতো কবিতা থেকে মিছিলে যাননি ভূঁইয়া ইকবাল; বরং উল্টো। কবিতাপাঠের আসরে উপস্থিত, কাব্যালোচনায় অংশী, কবিকুলের সঙ্গে সৌহার্দ্য, সঙ্গীও। অনুচ্চ কণ্ঠ, মৃদুভাষী, কথায় জোর স্থির বিশ্বাসে, ‘আবুল হাসানকে দিয়ে সংগ্রাম, বিপ্লব, রাজনৈতিক কবিতা রচনা অসম্ভব।’ শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে বলছিলেন একবার, উনসত্তরের (১৯৭৯) গণ-আন্দোলন তখন প্রায়-নিভন্ত। কিন্তু ভেতরে জ্বলন্ত, যেন তুষের আগুনে।
তখন ঝাঁকে ঝাঁকে কবি গজায়নি, উৎপাদিত হয়নি। যে কয়জন, আঙুলে গোনা। সেই সময়ের কথা বলছি। পরস্পর চেনা, মাঝে মাঝে দেখা। দলটল, এর-ওর পিঠ চাপড়ানো কালচার ছিল না। কবিতার আসরও বছরে সাকল্যে তিন-চারবার। বিশেষত তরুণদের। তরুণ বলতে বয়স ত্রিশ উত্তীর্ণ নয়।
সত্তরের গোড়ায় হোটেল শাহবাগে ফজল শাহাবুদ্দীন, শামসুর রাহমান আয়োজিত কবিতাপাঠের আয়োজন, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপিত। কনিষ্ঠ কবি আবুল হাসান। আমরা উত্তেজিত। হুমায়ুন কবিরের কিছু কবিতা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। গ্রন্থাকারে অমুদ্রিত। গোসসা করেছেন। অনিমন্ত্রিত। থাকেন আমাদের পাশের বাসায়, বললুম, চলুন। উত্তর: ‘না। আমাকে ডাকেনি।’ বুঝিয়ে দিতে চাইলেন ফেলনা নন তিনি। কবিতায় স্বতন্ত্র। কোভিদ অভিমান জেদ কাব্যোচিত। কুর্নিশযোগ্য।
শাহবাগ হোটেলের ব্যাঙ্কুয়েট হলে কবিতার আসর। হলভর্তি শ্রোতা বসেছি পেছনের সারিতে। পাশে ভূঁইয়া ইকবাল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে বললেন, কানে গুঁজে আছে এখনো, ‘আয়োজক ফজল ভাই, রাহমান ভাই; কিন্তু মূলে লায়লা সামাদ। তাঁর সঙ্গে ফজল ভাইয়ের বন্ধুতা। লায়লার স্বামী সামাদ সাহেব এই হোটেলের মালিক।’ অনুষ্ঠান শেষে দেখলুম, শামসুর রাহমান এবং আরও কয়েকজন (প্রত্যেকে কবি) ইকবালের সঙ্গে কথা বলছেন।
ইকবাল তরুণ কুলে শ্রদ্ধেয়, বয়স্ক মহলে স্নেহের। ছাত্রাবস্থায় প্রকাশ করেছেন কবিতাপত্র ‘পূর্বলেখ’। লিটল ম্যাগাজিন। কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধও আছে। লাইনোটাইপে ঝকঝকে ছাপা। মোটা কাগজ। সুদৃশ্য পত্রিকা। প্রথম সংখ্যায় আলী ইমামের কবিতা। আলী ইমাম কি পরে কাব্যচর্চায় ইতি টেনেছেন? বলতে অপারগ। ‘পূর্বলেখ’ নাম কেন রেখেছেন, ওর মুখেই শোনা। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘পূর্বমেঘ’। সম্পাদকতায় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ‘নামটি খুব পছন্দ, এ রকম নামই খুঁজছিলাম, কাব্যিক নাম। পেয়েও যাই, বিষ্ণুদের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম “পূর্বলেখ”।’
ভূঁইয়া ইকবালের সঙ্গে দেখা কলকাতায়। সম্ভবত খোঁজ করছিলেন তিনি, ঠিকানা জানেন না, হদিস পাবেন কী করে? গৌরদা (গৌরকিশোর ঘোষ। লেখক, সাংবাদিক) ফোন করেন এক সন্ধ্যায়, শুক্রবারে। বলেন, ‘রোববার দুপুরে আসবি একটার আগে।’ বুঝলুম, খাবারের নিমন্ত্রণ। মাসখানেক গৌরদার আস্তানায় (পাইকপাড়ার ফ্ল্যাট) যাওয়া হয়নি। নানা ধান্দায় ঘুরি। সময় কোথায়। আসলে অকৃতজ্ঞ। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কলকাতায়, গৌরকিশোর ঘোষের ফ্ল্যাটেই প্রথম আশ্রয়। অচেনা শহরে তিনিই উদ্ধারকর্তা, আশ্রয়দাতা।
সাড়ে ১২টার আগেই পৌঁছাই, বৌদির (শীলা ঘোষ। গৌরকিশোর ঘোষের স্ত্রী) মৃদু তিরস্কার, ‘ভুলে গেছ আমাদের?’ কিছুক্ষণ পরে ভূঁইয়া ইকবাল হাজির। বিস্ময় মানি। গৌরদা পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের দুজনের ঠোঁটে হাসি। ইকবাল খোলাসা করেন, ‘এগারো বছর পরে দেখা। গৌরদাকে বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে কীভাবে দেখা হতে পারে। গৌরদা বলেন, আচ্ছা তাই না, গৌরদা?’
কথায় কথায় জানা গেল, ভূঁইয়া ইকবাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর গবেষণা করবেন। স্কলারশিপ পেয়েছেন। বিষয় কী জিজ্ঞেস করিনি, নিজেও বলেননি।
মাঝে মাঝেই দেখা হয়। মাঝে মাঝে উধাও তিনি। কোথাও হদিস নেই। হঠাৎ হাজির (অন্নদাশঙ্কর রায়ের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ওখানেই থাকি)। চিঠি দেন বড় ভাইয়ের (জিয়া হায়দার)। প্যাকেট (পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন)। কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশে গেলে ভুলতেন না লিটল ম্যাগাজিন আনতে। উপহার দিয়ে ‘অনেক নতুন গল্পকার কবি ভালো লিখছেন’ বলতেন।
দেশভাগের কয়েক বছর আগে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাঁচ-ছয়জন বাঙালি মুসলিম, বয়সে তরুণ, মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন শুরু করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি নস্যাতে আলো প্রজ্বালনে শিখা গোষ্ঠীর প্রকাশ। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। ইকবাল বললেন, ‘গোষ্ঠীর অন্যতম আবুল ফজল পাকিস্তান জন্মের পর কায়েদে আজমকে (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ) নিয়ে নাটক লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার মন্ত্রী মুক্তবুদ্ধি নিয়ে এমনকি তাঁর লেখা?’ বলি, আত্মপীড়ন থেকেই বোধ হয় ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘মৃতের আত্মহত্যা’ লিখেছেন। গল্পটি তুমুল পঠিত, আলোচিত। জিয়া সরকার মহলেও আলোড়িত। ব্যাপক সাড়া। প্রসঙ্গ এড়িয়ে ইকবাল ‘এই গল্প নিয়ে পরিচয় পত্রিকায় একজন লিখেছিলেন, মুসলিম নামধারী। তার লেখা আগে এবং পরেও পড়িনি। লেখায় সমালোচনার সঙ্গে গল্পের অনুষঙ্গ ছিল। শুনেছি আবুল ফজল বিরক্ত হন।’
‘হতেই পারেন।’ বলে হেসে ফেলি। ‘আপনার হাসি রহস্যময়, নিশ্চয়ই ঘটনা আছে।’ রহস্য জানতে উদ্গ্রীব। কবুল করি ছদ্মনামে লিখেছিলুম। যেহেতু ছদ্মনাম, জানার কথা নয় তাঁর, কে আসল লেখক।
লেখা পড়ে আবুল ফজল দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন ‘পরিচয়’ সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চিঠি পড়েছি। চিঠি ছাপেননি যদিও। ইকবাল, ‘ওই চিঠি পাওয়া যাবে?’
‘বোধ হয় না আবুল ফজল, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই মৃত।’ জানতুম, ভূঁইয়া ইকবাল নামীদামি কবি-সাহিত্যিকের চিঠি সংগ্রাহক। ওর অনুরোধ, ‘আপনার দাদু (অন্নদাশঙ্কর রায়) বহু খ্যাতনামাকে চিঠি লিখেছেন, উত্তর পেয়েছেন নিশ্চয় শুনেছি। তিনি যাঁকে চিঠি লিখতেন, কপিও রাখতেন।’
বলি, ঠিকই শুনেছেন। লেখেন টাইপরাইটারে (বাংলা টাইপরাইটার ১৯২৯ সালে কেনা)। কার্বন পেপার ব্যবহার করেন। দাদুর কড়া নির্দেশ–তাঁর লেখা চিঠি এবং তাঁকে লেখা চিঠি তাঁর জীবিতকালে ছাপা যাবে না। এক রোববার সকালে হাজির, নটা বেজে গেছে। চা খেয়ে বাসনা খোলাসা করেন। সত্যজিৎ রায়কে দেখার সাধ। ফোন করলুম মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায়)। গেলুম ১০টার পরে। পরিচয় করিয়ে দিলুম। ‘পূর্বলেখ’ পত্রিকার গুণগান গাই। মানিকদা বললেন, ‘দেখিনি।’ ঢাকায় গিয়ে ডাকযোগে পাঠাবেন, ইকবাল জানান। তারপরেই আচমকা আবদার, ‘আপনি যদি প্রচ্ছদ এঁকে দেন খুশি হব।’
সত্যজিৎ রীতিমতো ভড়কে গেছেন। অতঃপর গম্ভীর স্বরে, ‘না।’ হয়তো আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানো যেত, ওই ‘না’র পরে বেমানান। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে বললাম, ‘এটা কী করলেন?’ কাঁচুমাচু মুখে উত্তর, ‘সরি, ঠিক হয়নি বলা। তবে ওনাকে দেখলাম, কথা বললাম, এটাও বড় পাওনা।’ ইকবালের মুখ দেখে কষ্ট হলো। চলুন, আরেক দিকপালের কাছে। একটি শর্ত, গিয়ে বলবেন না, সত্যজিতের বাড়ি থেকে আসছেন।
মৃণাল দা (মৃণাল সেন) সব সময়ই ঘরোয়া। আড্ডাবাজ পরিচিতজনের সঙ্গে। আড্ডার সময়ের হিসাব থাকে না। ঘণ্টাখানেক খোশগল্প, চা খাওয়া। ইকবাল মহাখুশি। আফসোস, ক্যামেরা নেই। দুজনের সঙ্গে ছবি না তোলার দুঃখ। রাস্তায় এসে বললেন, ‘আপনার মানিকদা চা খাওয়ার কথাও বলেননি!’
–বলতেন, প্রচ্ছদ আঁকার আবদারে মেজাজ বিগড়ে দিয়েছেন!’
ভূঁইয়া ইকবাল চলে গেলেন, স্মৃতি কুরে খাচ্ছে।
লেখক: কবি
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১ দিন আগে