বিভুরঞ্জন সরকার
ভেবেছিলাম পরীমণিকে নিয়ে কিছু লিখব না। তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাঁর অভিনীত কোনো সিনেমা দেখিনি। তবে তাঁর নাম শুনিনি বললে মিথ্যা বলা হবে। নানা সংগত-অসংগত কারণে পরীমণি যে ঢাকার চলচ্চিত্রজগতে আলোচিত নাম, তা আমার অজানা নয়। কবি নির্মলেন্দু গুণকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি অর্থসহায়তা করেছেন; এটা কবির লেখাতেই পড়েছি। তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু ভালো খবরের পাশাপাশি কিছু স্ক্যান্ডালের কথা কানে আসেনি তা-ও নয়। কিন্তু এসব কখনো আমার মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠেনি। দেশে কিংবা বিদেশে বিনোদনজগতে কেউ তারকা খ্যাতি পেয়েছেন, অথচ তাঁকে নিয়ে দু–একটি স্ক্যান্ডাল বা গসিপ রটেনি, তা কি কখনো হয়েছে?
গত কদিন ধরে পরীমণিকে নিয়ে যেসব ধুমধাড়াক্কা কাণ্ড চলছে, তাঁর প্রতি যে অন্যায়, অন্যায্য ও একপেশে আচরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা ঠিক বলে মনে না হওয়ায় কিছু না লিখে পারা গেল না। পরীমণি যদি আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাঁর অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আইনত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই যেভাবে তাঁর চরিত্রহননে মেতে ওঠার বিকৃত উল্লাস কারও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। পরীমণির চেয়ে আরও ভয়ংকর ও দাগি অপরাধী আমাদের দেশে আছে। তাদের কারও কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা না দেখিয়ে পরীমণিকে নাজেহাল করার বীরত্ব যাঁরা দেখাচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারা যায় না। একজনকে সামান্য কারণে ধরবেন আর দশজনকে বহুগুণ বড় কারণে ছাড়বেন, সেটা কেমন কথা? বলা হয়, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আইন প্রয়োগের দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও কি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারেন? খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হলে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। `দৃষ্টিকটু' ও `শ্রুতিকটু' বলে যে শব্দ দুটি আছে, তা কারও ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা ও পারঙ্গমতা নিয়ে বেশি আলোচনা বিপত্তি বাড়াতে পারে। তবে অনেক সাফল্যের সঙ্গে কিছু অসফলতার কলঙ্কচিহ্ন কি তাদের কপালে নেই? সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উন্মোচিত হলো না কেন এত বছরেও? কেন কুমিল্লার সেনানিবাস এলাকায় কলেজছাত্রী তনু হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে? আমাদের নানা কিছিমের অতি–উৎসাহী গণমাধ্যম পরীমণির চৌদ্দগুষ্টির হাঁড়ির খবর এখন বের করছে। তারা কেন সাগর-রুনি কিংবা তনু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে উৎসাহী হয় না?
পরীমণিকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের একটি এলিট বাহিনী র্যাব যেভাবে বিপুল শক্তি নিয়ে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়েছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পরীমণি বুঝি একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী বা জঙ্গি দলের অধিনায়ক। তাঁকে পাকড়াও করতে না পারলে বুঝি ওই রাতে দেশে বছর কয়েক আগের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মতো মারাত্মক কিছু ঘটে যেত! কিন্তু না। র্যাবের ‘সফল’ অভিযানে পরীমণির বাসা থেকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্র কিংবা বিস্ফোরক উদ্ধার করা যায়নি, কেউ হতাহতও হননি। পাওয়া গেছে কয়েক বোতল বিদেশি মদ এবং আরও কিছু খুচরা সামগ্রী, যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। লক্ষ-কোটি দর্শক দীর্ঘ সময় ধরে সেসব রগড় দেখে আমোদিত ও বিনোদিত হয়েছে। করোনাকালের বিষাদ আক্রান্ত সময়ে বিনা পয়সায় মজা দেখার এই ব্যবস্থা বাহবা পাওয়ার মতোই।
বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই র্যাবের অভিযান চালানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কি বিনা অনুমতিতে বাসায় বিদেশি মদ রাখা, না আরও কিছু? অমন মদের বোতল ঢাকা শহরে বহু বড়লোকের বাড়িতে পাওয়া যাবে। তাহলে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে মদ উদ্ধার করে জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখার মহান কর্তব্য পালন করতে দেখা যায় না কেন? বোট ক্লাব-কাণ্ডে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরীমণি মামলা করার আগে তাঁর কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে কেউ গোয়েন্দাগিরি করেনি কেন?
আরেকটি কথা প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, একজন পুরুষ তার ইচ্ছা পূরণের জন্য নারীকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করলে তার কোনো দোষ সমাজ দেখে না; কিন্তু একজন নারী তার ইচ্ছাপূরণের পথে হাঁটলে সমাজের গায়ে জ্বলুনি ধরে, ফোসকা পড়ে। কারণ, সামাজিক নিয়ম-নীতি, বিধিব্যবস্থা তো পুরুষেরই নির্মিত।
পরীমণিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। রিমান্ডে নাকি পরীমণি বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। কী তথ্য তাঁর কাছ থেকে এর মধ্যে পাওয়া গেছে, তা নিয়ে তদন্তকারীরা বিস্তারিত কিছু না বললেও তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে মুখরোচক গল্প ঠিকই ছড়ানো হচ্ছে। বিচারের আগে কারও চরিত্রহনন বেআইনি। এটা কি আমাদের আইনের রক্ষাকর্তারা জানেন না? যাঁরা আইন বিশেষজ্ঞ, তাঁরা বলছেন—পরীমণির ক্ষেত্রে আইনরক্ষকেরা সীমা অতিক্রম করেছেন। পরীমণি মিডিয়া ট্রায়ালেরও শিকার হয়েছেন।
দেশে নারী আন্দোলনের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো নারী ঘটনার শিকার বা অভিযুক্ত যাই হোন না কেন, এমনভাবে সংবাদ প্রচার ও শব্দ প্রয়োগ করা হয়, যাতে নারীর আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়। এই ঘটনাসমূহ নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। যখন গণমাধ্যমকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে নারী আন্দোলন বিশেষ ভূমিকা রাখছে, গণমাধ্যমও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময়ে সহযোগী ভূমিকা রেখে চলেছে, সেই সময়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো কোনো গণমাধ্যমের ভূমিকা নারীর মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করছে।’
পরীমণির সঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক নেতা, ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, পুলিশ ও বিত্তবান ব্যক্তির সম্পর্ক বা যোগাযোগের কথাও জানানো হচ্ছে। গণমাধ্যম এসব তথ্য গোগ্রাসে গিলছে। আরও দুজন মডেলকন্যা ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেপ্তার করেও তাঁদের ‘চরিত্র' সম্পর্কে রুচিহীন প্রচার চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই নারীরা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য আমাদের দেশের ধনী ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের সন্তানদের টোপ দিয়ে বিপথগামী করছে। ভাবখানা এমন যে, আমাদের দেশের ধনীর দুলালেরা এতই কচি খোকা যে, তাদের নাক টিপলে দুধ বেরোয়। তারা এতই সহজ–সরল সুবোধ বালক যে, ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানে না! এর আগে মোশারাত জাহান মুনিয়া নামের এক কলেজছাত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলায় আসামি করা হয়েছিল বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ায় আনভীরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে আইনকে কখনো কখনো চলতে দেখা যায় শক্তিধর বা প্রভাবশালী কারও অঙ্গুলি হেলনে। আইন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাকড়সার জালের মতো। ছোট পোকামাকড় আটকা পড়লেও বড়রা বেরিয়ে যায়। দেশে দুর্নীতি-অনিয়ম দেদার চলছে। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে কতজন। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কেনাকাটা করে গরিবের করের টাকা নয়–ছয় করে কেউ কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে, ব্যয় বাড়িয়ে রাষ্ট্রের কত অপচয় হচ্ছে। সংবাদপত্রে স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর বের হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। অথচ পরীমণির বিরুদ্ধে মশা মারতে কামান দেগে এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা দেখে মনে হয় এরপর দেশে আর কোনো অনিয়ম বা অনৈতিক কাজ কেউ করতে পারবে না।
এরশাদ আমলে এক মন্ত্রী সম্পর্কে ঢাকার রাস্তায় চিকা মারা হয়েছিল—‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। আমাদের বিত্তশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের পুত্রদের ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রে কালি মেখে দেওয়ার কাজটি নাকি কৌশলে সম্পন্ন করছেন বিনোদনজগতের কয়েকজন নারী। এদের রাতের রানিও বলা হচ্ছে। এর মধ্যে বড় রানি সাব্যস্ত করা হয়েছে সম্ভবত পরীমণিকে। রাজা ছাড়া যে রানি হয় না, এটা আমাদের আইন প্রয়োগকারী কর্তাদের বোঝাবে কে? রানিদের ধরতে জাল পেতে এত তৎপরতা চললেও রাজারা কেন জালের বাইরে? চেহারা বা লিঙ্গভেদে দোষী ধরলে তো ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের বরখেলাপ হয়।
বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে—মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার। লুটের ক্ষেত্রে ভান্ডারের দিকে কারও কারও শ্যেনদৃষ্টি থাকলেও মারের বেলায় নজর যায় ছোট্ট পক্ষী শাবকের দিকে। পরীমণির ক্ষেত্রে কি তাই দেখা যাচ্ছে না?
একসময় আমাদের দেশে গান শোনার জন্য ‘কলের গান' নামের একটি যন্ত্র ছিল। একটি হাতল ঘুরিয়ে বাক্সের মতো যন্ত্রটিতে দম দিয়ে রেকর্ড করা মিষ্টি সুরের গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করত। এখন কলের গানের প্রচলন নেই। গান শোনার আধুনিক কত যন্ত্র আমাদের নাগালের মধ্যেই আছে। তা ছাড়া নানা রকমের কল ও কাঠি এখন অনেক সহজলভ্য। কোথাকার কোন কল থেকে যে কখন কে কাঠি নেড়ে কোনটা নিয়ন্ত্রণ করে, তা অনেক সময় টেরও পাওয়া যায় না। পরীমণির পেছনে কোন কল থেকে কাঠি নাড়ানো হয়েছে, তা জানতে আরও কিছু সময় লাগবে।
স্ববিরোধী আচরণ করা আমাদের বৈশিষ্ট্য। আমরা দুর্বলের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবলকে মার্জনা করতে ওস্তাদ। আমরা হাটে হাঁড়ি ভাঙার ভয়ে বড় বড় অনিয়মকে ধামাচাপা দিই। মানুষের চোখে ধুলা দিতে তিলকে তাল করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। পরীমণির ঘটনায় কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হতে পারত; কিন্তু তা হবে না। কারণ, পরীমণিকে খাদের কিনারে যাঁরা ঠেলে এনেছেন, তাঁরা তাঁর পক্ষের শক্তির চেয়ে বেশি প্রবল হওয়ায় শক্তি পরীক্ষায় আপাতত হার মেনেছেন। তবে কল আবার অন্যদিকে কাঠি নাড়লে বিষয়টি উল্টেও যেতে পারে।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ভেবেছিলাম পরীমণিকে নিয়ে কিছু লিখব না। তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাঁর অভিনীত কোনো সিনেমা দেখিনি। তবে তাঁর নাম শুনিনি বললে মিথ্যা বলা হবে। নানা সংগত-অসংগত কারণে পরীমণি যে ঢাকার চলচ্চিত্রজগতে আলোচিত নাম, তা আমার অজানা নয়। কবি নির্মলেন্দু গুণকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি অর্থসহায়তা করেছেন; এটা কবির লেখাতেই পড়েছি। তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু ভালো খবরের পাশাপাশি কিছু স্ক্যান্ডালের কথা কানে আসেনি তা-ও নয়। কিন্তু এসব কখনো আমার মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠেনি। দেশে কিংবা বিদেশে বিনোদনজগতে কেউ তারকা খ্যাতি পেয়েছেন, অথচ তাঁকে নিয়ে দু–একটি স্ক্যান্ডাল বা গসিপ রটেনি, তা কি কখনো হয়েছে?
গত কদিন ধরে পরীমণিকে নিয়ে যেসব ধুমধাড়াক্কা কাণ্ড চলছে, তাঁর প্রতি যে অন্যায়, অন্যায্য ও একপেশে আচরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা ঠিক বলে মনে না হওয়ায় কিছু না লিখে পারা গেল না। পরীমণি যদি আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাঁর অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আইনত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই যেভাবে তাঁর চরিত্রহননে মেতে ওঠার বিকৃত উল্লাস কারও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। পরীমণির চেয়ে আরও ভয়ংকর ও দাগি অপরাধী আমাদের দেশে আছে। তাদের কারও কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা না দেখিয়ে পরীমণিকে নাজেহাল করার বীরত্ব যাঁরা দেখাচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারা যায় না। একজনকে সামান্য কারণে ধরবেন আর দশজনকে বহুগুণ বড় কারণে ছাড়বেন, সেটা কেমন কথা? বলা হয়, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আইন প্রয়োগের দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও কি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারেন? খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হলে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। `দৃষ্টিকটু' ও `শ্রুতিকটু' বলে যে শব্দ দুটি আছে, তা কারও ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা ও পারঙ্গমতা নিয়ে বেশি আলোচনা বিপত্তি বাড়াতে পারে। তবে অনেক সাফল্যের সঙ্গে কিছু অসফলতার কলঙ্কচিহ্ন কি তাদের কপালে নেই? সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উন্মোচিত হলো না কেন এত বছরেও? কেন কুমিল্লার সেনানিবাস এলাকায় কলেজছাত্রী তনু হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে? আমাদের নানা কিছিমের অতি–উৎসাহী গণমাধ্যম পরীমণির চৌদ্দগুষ্টির হাঁড়ির খবর এখন বের করছে। তারা কেন সাগর-রুনি কিংবা তনু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে উৎসাহী হয় না?
পরীমণিকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের একটি এলিট বাহিনী র্যাব যেভাবে বিপুল শক্তি নিয়ে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়েছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পরীমণি বুঝি একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী বা জঙ্গি দলের অধিনায়ক। তাঁকে পাকড়াও করতে না পারলে বুঝি ওই রাতে দেশে বছর কয়েক আগের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মতো মারাত্মক কিছু ঘটে যেত! কিন্তু না। র্যাবের ‘সফল’ অভিযানে পরীমণির বাসা থেকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্র কিংবা বিস্ফোরক উদ্ধার করা যায়নি, কেউ হতাহতও হননি। পাওয়া গেছে কয়েক বোতল বিদেশি মদ এবং আরও কিছু খুচরা সামগ্রী, যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। লক্ষ-কোটি দর্শক দীর্ঘ সময় ধরে সেসব রগড় দেখে আমোদিত ও বিনোদিত হয়েছে। করোনাকালের বিষাদ আক্রান্ত সময়ে বিনা পয়সায় মজা দেখার এই ব্যবস্থা বাহবা পাওয়ার মতোই।
বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই র্যাবের অভিযান চালানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কি বিনা অনুমতিতে বাসায় বিদেশি মদ রাখা, না আরও কিছু? অমন মদের বোতল ঢাকা শহরে বহু বড়লোকের বাড়িতে পাওয়া যাবে। তাহলে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে মদ উদ্ধার করে জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখার মহান কর্তব্য পালন করতে দেখা যায় না কেন? বোট ক্লাব-কাণ্ডে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরীমণি মামলা করার আগে তাঁর কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে কেউ গোয়েন্দাগিরি করেনি কেন?
আরেকটি কথা প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, একজন পুরুষ তার ইচ্ছা পূরণের জন্য নারীকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করলে তার কোনো দোষ সমাজ দেখে না; কিন্তু একজন নারী তার ইচ্ছাপূরণের পথে হাঁটলে সমাজের গায়ে জ্বলুনি ধরে, ফোসকা পড়ে। কারণ, সামাজিক নিয়ম-নীতি, বিধিব্যবস্থা তো পুরুষেরই নির্মিত।
পরীমণিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। রিমান্ডে নাকি পরীমণি বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। কী তথ্য তাঁর কাছ থেকে এর মধ্যে পাওয়া গেছে, তা নিয়ে তদন্তকারীরা বিস্তারিত কিছু না বললেও তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে মুখরোচক গল্প ঠিকই ছড়ানো হচ্ছে। বিচারের আগে কারও চরিত্রহনন বেআইনি। এটা কি আমাদের আইনের রক্ষাকর্তারা জানেন না? যাঁরা আইন বিশেষজ্ঞ, তাঁরা বলছেন—পরীমণির ক্ষেত্রে আইনরক্ষকেরা সীমা অতিক্রম করেছেন। পরীমণি মিডিয়া ট্রায়ালেরও শিকার হয়েছেন।
দেশে নারী আন্দোলনের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো নারী ঘটনার শিকার বা অভিযুক্ত যাই হোন না কেন, এমনভাবে সংবাদ প্রচার ও শব্দ প্রয়োগ করা হয়, যাতে নারীর আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়। এই ঘটনাসমূহ নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। যখন গণমাধ্যমকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে নারী আন্দোলন বিশেষ ভূমিকা রাখছে, গণমাধ্যমও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময়ে সহযোগী ভূমিকা রেখে চলেছে, সেই সময়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো কোনো গণমাধ্যমের ভূমিকা নারীর মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করছে।’
পরীমণির সঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক নেতা, ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, পুলিশ ও বিত্তবান ব্যক্তির সম্পর্ক বা যোগাযোগের কথাও জানানো হচ্ছে। গণমাধ্যম এসব তথ্য গোগ্রাসে গিলছে। আরও দুজন মডেলকন্যা ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেপ্তার করেও তাঁদের ‘চরিত্র' সম্পর্কে রুচিহীন প্রচার চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই নারীরা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য আমাদের দেশের ধনী ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের সন্তানদের টোপ দিয়ে বিপথগামী করছে। ভাবখানা এমন যে, আমাদের দেশের ধনীর দুলালেরা এতই কচি খোকা যে, তাদের নাক টিপলে দুধ বেরোয়। তারা এতই সহজ–সরল সুবোধ বালক যে, ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানে না! এর আগে মোশারাত জাহান মুনিয়া নামের এক কলেজছাত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলায় আসামি করা হয়েছিল বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ায় আনভীরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে আইনকে কখনো কখনো চলতে দেখা যায় শক্তিধর বা প্রভাবশালী কারও অঙ্গুলি হেলনে। আইন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাকড়সার জালের মতো। ছোট পোকামাকড় আটকা পড়লেও বড়রা বেরিয়ে যায়। দেশে দুর্নীতি-অনিয়ম দেদার চলছে। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে কতজন। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কেনাকাটা করে গরিবের করের টাকা নয়–ছয় করে কেউ কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে, ব্যয় বাড়িয়ে রাষ্ট্রের কত অপচয় হচ্ছে। সংবাদপত্রে স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর বের হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। অথচ পরীমণির বিরুদ্ধে মশা মারতে কামান দেগে এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা দেখে মনে হয় এরপর দেশে আর কোনো অনিয়ম বা অনৈতিক কাজ কেউ করতে পারবে না।
এরশাদ আমলে এক মন্ত্রী সম্পর্কে ঢাকার রাস্তায় চিকা মারা হয়েছিল—‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। আমাদের বিত্তশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের পুত্রদের ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রে কালি মেখে দেওয়ার কাজটি নাকি কৌশলে সম্পন্ন করছেন বিনোদনজগতের কয়েকজন নারী। এদের রাতের রানিও বলা হচ্ছে। এর মধ্যে বড় রানি সাব্যস্ত করা হয়েছে সম্ভবত পরীমণিকে। রাজা ছাড়া যে রানি হয় না, এটা আমাদের আইন প্রয়োগকারী কর্তাদের বোঝাবে কে? রানিদের ধরতে জাল পেতে এত তৎপরতা চললেও রাজারা কেন জালের বাইরে? চেহারা বা লিঙ্গভেদে দোষী ধরলে তো ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের বরখেলাপ হয়।
বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে—মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার। লুটের ক্ষেত্রে ভান্ডারের দিকে কারও কারও শ্যেনদৃষ্টি থাকলেও মারের বেলায় নজর যায় ছোট্ট পক্ষী শাবকের দিকে। পরীমণির ক্ষেত্রে কি তাই দেখা যাচ্ছে না?
একসময় আমাদের দেশে গান শোনার জন্য ‘কলের গান' নামের একটি যন্ত্র ছিল। একটি হাতল ঘুরিয়ে বাক্সের মতো যন্ত্রটিতে দম দিয়ে রেকর্ড করা মিষ্টি সুরের গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করত। এখন কলের গানের প্রচলন নেই। গান শোনার আধুনিক কত যন্ত্র আমাদের নাগালের মধ্যেই আছে। তা ছাড়া নানা রকমের কল ও কাঠি এখন অনেক সহজলভ্য। কোথাকার কোন কল থেকে যে কখন কে কাঠি নেড়ে কোনটা নিয়ন্ত্রণ করে, তা অনেক সময় টেরও পাওয়া যায় না। পরীমণির পেছনে কোন কল থেকে কাঠি নাড়ানো হয়েছে, তা জানতে আরও কিছু সময় লাগবে।
স্ববিরোধী আচরণ করা আমাদের বৈশিষ্ট্য। আমরা দুর্বলের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবলকে মার্জনা করতে ওস্তাদ। আমরা হাটে হাঁড়ি ভাঙার ভয়ে বড় বড় অনিয়মকে ধামাচাপা দিই। মানুষের চোখে ধুলা দিতে তিলকে তাল করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। পরীমণির ঘটনায় কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হতে পারত; কিন্তু তা হবে না। কারণ, পরীমণিকে খাদের কিনারে যাঁরা ঠেলে এনেছেন, তাঁরা তাঁর পক্ষের শক্তির চেয়ে বেশি প্রবল হওয়ায় শক্তি পরীক্ষায় আপাতত হার মেনেছেন। তবে কল আবার অন্যদিকে কাঠি নাড়লে বিষয়টি উল্টেও যেতে পারে।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৭ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৮ ঘণ্টা আগে