ফজলুল কবির
তাঁদের কেউ হয়তো যাচ্ছিলেন প্রিয়জনের কাছে, কেউ কর্মস্থলে, কেউ-বা চিকিৎসা বা অন্য কোনো তাগিদে। আবার কেউ হয়তো বেরিয়েছিলেন সপরিবারে রাজধানী শহর ঘুরে আসতে। ঢাকায় বা নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়বাড়ি থেকে কয়টা দিন ঘুরে হয়তো কারও ফেরার কথা ছিল, সাথে নিয়ে আনন্দ-সুর। কিন্তু শেষে কী সুর নিয়ে ফিরলেন তাঁরা? তাঁদের কেউ একা ছিলেন। কারও সঙ্গে ছিল স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা। একেকজন একেক ভাবনায় হয়তো মগ্ন ছিলেন। অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তিতে কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। স্বপ্নও কি দেখছিলেন কেউ কেউ? মাঝে ঘটে যাওয়া দুঃস্বপ্নের চাপে তাঁরা কি কেউ মনে করতে পারবেন সেই স্বপ্নের কথা?
কুষ্টিয়ার প্রাগপুর থেকে ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসটি ছেড়েছিল। বাসটি অন্য কোনো পরিবহনেরও হতে পারত। সেই বাস সিরাজগঞ্জের কাছে এসে তিন দফায় যাত্রী তোলে। এমন কত পরিবহনই তো রাস্তা থেকে যাত্রী তোলে। বাসে থাকা যাত্রীরা এর প্রতিবাদও করেন। চালক বা তাঁর সহকারী তা কানে তোলেন না। এ নিয়ে বাহাস হয়, কখনো কখনো খুব বাজে রকম হয়। কিন্তু উভয় পক্ষ একটা সময় থেমে যায়। নতুন যাত্রীকে মেনে নেয়, মেনে নেয় মাঝপথে থেমে থেমে চলার ভবিতব্য। এ এক ধরনের সমঝোতা। এ সমঝোতার গোড়ায় আছে বাস মালিক থেকে বাস-চালক বা অন্য কর্মীদের নির্দিষ্ট হারে বেতন না পাওয়ার বাস্তবতা, আছে তাদের স্বল্প আয়, আছে কম ভাড়ায় দীর্ঘযাত্রার হিসাব-নিকাশ কত কী। কিন্তু সব হিসাব উল্টে দিল গত মঙ্গলবার মধ্যরাত।
ওই মাঝরাতে ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসে ওঠা সেই যাত্রীরা আসলে ছিল ডাকাত। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। পুরো বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা মধ্যরাতে তিন ঘণ্টা এ পথ-ও পথ ঘুরেছে। ডাকাত হলে এমন প্রভাব, এমন নিয়ন্ত্রণ দেখায়, দেখিয়েছে আগেও অনেকে। পুরো বাসের অন্য যাত্রীদের কেউ কেউ মারধরের শিকার হয়েছে, কেউ গালি খেয়েছে। তাদের হুমকি-ধমকিতে কারও হয়তো গলা শুকিয়ে গেছে। পুরুষ যাত্রীদের চোখ বেঁধে ফেলার পর, হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলার পর, তারা অসহায় বোধ করেছে। সব সাধারণ ও নারী ও পুরুষ যাত্রীদের নিশ্চয় অবিশ্বাসের মতো লেগেছে। ভয়ে কারও হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে হয়তো। যে যার বিশ্বাসমতো সৃষ্টিকর্তাকে হয়তো ডেকেছে বা ডাকেনি। কারও বুকে হয়তো চাপা ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। কিন্তু অক্ষম ক্রোধে হাত-বাঁধা যাত্রীরা নিজের আঙুলটিও কামড়াতে পারেননি।
যার মনে যে প্রতিক্রিয়াই হোক, ডাকাতেরা তাদের কাউকেই ছাড়েনি। তাদের কাছে থাকা সবকিছুই তারা কেড়ে নিয়েছে। এ তো ডাকাতেরা করবেই। এটা করার জন্যই তারা উঠেছিল। কিন্তু সেই মেয়েটি? তাকে কেন বাড়তি যন্ত্রণা নিতে হলো? তাকে কেন এমন ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হলো?
না, তিনি তেমন কিছু করেননি। তাঁর কাছ থেকে ডাকাতেরা বিভিন্ন জিনিস কেড়ে নিতে চাইলে তিনি তর্ক করেন। ডাকাতদের চোখে এটাই ছিল তাঁর বড় অপরাধ। এই অপরাধের সাজা হিসেবে তাঁকে ছয়জন ধর্ষণ করেছিল। হ্যাঁ, ছয়জন; সেই চলন্ত বাসে, মধ্যরাতে।
বাসে আরও নারী ছিল। তাঁদের ধর্ষণ করা না হলেও যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার ওই নারী তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, আরেকজন নারীর ওপরও চড়াও হয়েছিল ডাকাতেরা। জানা গেছে, কয়েক নারীকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তারা।
কোনো পুরুষের ওপর দিয়ে কিন্তু মারধরের বাইরে যৌন নিপীড়নের ধকল যায়নি। তর্কের খেসারত হিসেবে পুরুষকে মার খেতে হয়েছে ডাকাতদের হাতে।
আচ্ছা কেউ কাউকে মারে কেন? শারীরিকভাবে নিজের প্রভাব অন্যের ওপর বিস্তার করার জন্যই তো। অন্যকে অধস্তন দেখাতে, শিকারযোগ্য দেখাতেই কিন্তু মারধর করা হয়। পুরুষ যাত্রীদের মারধর করে ডাকাতেরা সেই বার্তা দিতে পেরেছে। নারীদের ক্ষেত্রে কেন বাড়তি যৌন নিপীড়নের বিষয়টি এল তবে? নারীকে মারধর করলেও তো সে ব্যথা পায় পুরুষের মতোই। শিকারযোগ্য বা শারীরিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি তো তাহলে সমাধা হয়েই যায়। ধর্ষণ কেন তবে? গলায় ধরে থাকা ছুরিটি বা কাঁচিটি চালিয়ে দিলে পুরুষটি যদি মারা যায়, নারীটিও মারা যাবে। নারীর জন্য তবে বাড়তি ওই ধর্ষণ বরাদ্দ হলো কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিক মনোজগৎ গঠনের উপাদানগুলোর হদিস। এই একটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে দেশের প্রতিটি কোনা থেকে, প্রতিটি দিন একের পর এক নারী নির্যাতন, তাদের হেনস্তার নতুন নতুন উপায়ের হদিস মেলার কার্যকারণ। এই এক প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে বাধ্য। এই এক প্রশ্ন আমাদের আবার নিয়ে যেতে বাধ্য রূপার কাছে, যে রূপা বাড়ি ফিরছিল, যে রূপা শিক্ষক হতে চেয়েছিল, যে রূপা কারও কিছু কেড়ে নয় নিজ শ্রমে বেঁচেছিল। সেই রূপাকে আজকের আলোচিত মধুপুরেরই পাঁচলাইশ এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে। মনে পড়ে কি?
ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের সেই বাসটিতে আবার যাই, আবার নামি পথে। সেই বাসটিতে ছিল শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষ। সেই বাসটিতে করে হেকমত আলী তাঁর স্ত্রী জেসমিন, দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরা ছোট ছোট। একজন ছিল জেসমিনের কোলে, অন্যজন জেসমিনের মায়ের (হেকমত আলীর শাশুড়ি) কোলে। তাদের কি দুটি সন্তানই ছেলে, নাকি দুটিই মেয়ে, নাকি একটি শিশু ছেলে, অন্যটি মেয়ে। সে খবর নেওয়া হয়নি। বাসটিতে নিশ্চয়ই উভয় ধরনের শিশুই ছিল, যেমনটা থাকে দূরপাল্লার একেকটি যাত্রীবাহী পরিবহনে।
এই শিশুদের চোখ বাঁধা হয়নি। এই শিশুরা সবটা দেখেছে। কত বড় হয়েছিল তখন তাদের চোখ? এই শিশুরা সব শুনেছে, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি গর্জন, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস। এই শিশুরা চোখের সামনে এক নারীর আর্তনাদকে চাপা পড়তে দেখেছে, দেখেছে কী করে তাঁর ওপর একদল পুরুষ নির্যাতন চালায়। এই শিশুরা সবটা দেখেছে, আর নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করেছে নিশ্চয়।
কী ব্যাখ্যা করেছে তারা? মেয়ে শিশুরা কি নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে যে, এভাবে তর্ক করতে নেই। কথা বললেই তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা হবে। তখন আগেই হাত-পা বাঁধা, মুখ বাঁধা এমনকি চোখ বাঁধা বাকিদের করার কিছুই থাকবে না। এই একই কথা হয়তো ছেলে শিশুরাও বুঝেছে নিজেদের মতো করেই। তারা এটা বুঝে নেয়নি তো যে, নারীর তর্কের অধিকার নেই, তর্কপ্রবণ নারী নির্যাতনযোগ্য কিংবা নারীর ওপর শারীরিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হলো ধর্ষণ? আচ্ছা এই বাসের যাত্রীদেরই কি কেবল হাত-মুখ ও চোখ বাঁধা? নাকি আমাদের সবার, এই সমাজের সবার এই হাত-মুখ ও চোখ বাঁধা আজ, এই সময়ে?
সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন এই নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট বেরোচ্ছে। ওই বাসটিতে ঠিক কী ঘটেছিল, তার অনুসন্ধান চলছে। সাধারণ মানুষ নানা কথা বলছে নিজেদের মতো করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে হতাশা-ক্ষোভ নানা কিছু উগরে দিচ্ছে মানুষ। পুলিশ অপরাধীদের খুঁজতে অভিযান চালাচ্ছে। তদন্ত চলছে নিজের নিয়মে। এরই মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। কোনো কোনো সংগঠন বা অধিকারকর্মী হয়তো দেশে ক্রমবর্ধমান ডাকাতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে এর সঙ্গে অর্থনীতির লেখচিত্রগুলোর সম্পর্ক মিলিয়ে নিতে কাজে নামছেন, সরকারকে সতর্ক করছেন, কেউ হয়তো দেশে ধর্ষণের ধরন ও সংখ্যা দুইই বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কেউ হয়তো গণপরিবহনের যাত্রীদের অতীত নিরাপত্তা-বোধের কথা সামনে এনে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। একেকজন একেকটি বিষয়কে সামনে আনছেন, যার প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ।
আর এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা যেন অনাদিকাল থেকে কথা বলে চলেছি। ধর্ষণের খতিয়ান নিয়ে যে বা যারা বসে আছে, তারা যেন সেই কোন যুগ থেকে এভাবেই বসে আছে। এই দেশে খুন, রাহাজানি নিয়ে একদল সচেতন লোক যেন সেই কবে থেকে একই ভাষায় একইভাবে সতর্ক করে চলেছে। অর্থনীতি, সমাজ ইত্যাদির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আমরা যেন কোন সুদূর অতীত থেকে একই কথা বলে চলেছি। আর আমাদের সঙ্গে সেই কবে থেকে একই ঘটনাই ঘটে চলেছে। আমাদের মাথাপিছু আয় যেভাবে দায় হয়ে ওঠে, আমাদের রসুইয়ে কাঁচামাল যে হারে কমে, আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যয় যে হারে বাড়ে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতার গল্প যেভাবে গলার কাঁটা হয়ে ফিরে আসে, ঠিক সেভাবেই যেন একই গতিতে একই হারে আমাদের হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয়, লুট করা হয়। আর আমরা একই কথা বলতে থাকি, যে কথার পুনরাবৃত্তির চক্র আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। আমাদের চোখ, কান, হাত, পা, মুখ কিছুই আর মুক্ত নেই। আমাদের ছকে বাঁধা প্রতিক্রিয়া আমাদের বন্দী করে ফেলেছে। আর আমাদের চোখের সামনেই আমাদের পথগুলো পর্যন্ত লুট হয়ে গেছে। পথগুলো আর আমাদের নেই।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
তাঁদের কেউ হয়তো যাচ্ছিলেন প্রিয়জনের কাছে, কেউ কর্মস্থলে, কেউ-বা চিকিৎসা বা অন্য কোনো তাগিদে। আবার কেউ হয়তো বেরিয়েছিলেন সপরিবারে রাজধানী শহর ঘুরে আসতে। ঢাকায় বা নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়বাড়ি থেকে কয়টা দিন ঘুরে হয়তো কারও ফেরার কথা ছিল, সাথে নিয়ে আনন্দ-সুর। কিন্তু শেষে কী সুর নিয়ে ফিরলেন তাঁরা? তাঁদের কেউ একা ছিলেন। কারও সঙ্গে ছিল স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা। একেকজন একেক ভাবনায় হয়তো মগ্ন ছিলেন। অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তিতে কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। স্বপ্নও কি দেখছিলেন কেউ কেউ? মাঝে ঘটে যাওয়া দুঃস্বপ্নের চাপে তাঁরা কি কেউ মনে করতে পারবেন সেই স্বপ্নের কথা?
কুষ্টিয়ার প্রাগপুর থেকে ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসটি ছেড়েছিল। বাসটি অন্য কোনো পরিবহনেরও হতে পারত। সেই বাস সিরাজগঞ্জের কাছে এসে তিন দফায় যাত্রী তোলে। এমন কত পরিবহনই তো রাস্তা থেকে যাত্রী তোলে। বাসে থাকা যাত্রীরা এর প্রতিবাদও করেন। চালক বা তাঁর সহকারী তা কানে তোলেন না। এ নিয়ে বাহাস হয়, কখনো কখনো খুব বাজে রকম হয়। কিন্তু উভয় পক্ষ একটা সময় থেমে যায়। নতুন যাত্রীকে মেনে নেয়, মেনে নেয় মাঝপথে থেমে থেমে চলার ভবিতব্য। এ এক ধরনের সমঝোতা। এ সমঝোতার গোড়ায় আছে বাস মালিক থেকে বাস-চালক বা অন্য কর্মীদের নির্দিষ্ট হারে বেতন না পাওয়ার বাস্তবতা, আছে তাদের স্বল্প আয়, আছে কম ভাড়ায় দীর্ঘযাত্রার হিসাব-নিকাশ কত কী। কিন্তু সব হিসাব উল্টে দিল গত মঙ্গলবার মধ্যরাত।
ওই মাঝরাতে ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসে ওঠা সেই যাত্রীরা আসলে ছিল ডাকাত। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। পুরো বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা মধ্যরাতে তিন ঘণ্টা এ পথ-ও পথ ঘুরেছে। ডাকাত হলে এমন প্রভাব, এমন নিয়ন্ত্রণ দেখায়, দেখিয়েছে আগেও অনেকে। পুরো বাসের অন্য যাত্রীদের কেউ কেউ মারধরের শিকার হয়েছে, কেউ গালি খেয়েছে। তাদের হুমকি-ধমকিতে কারও হয়তো গলা শুকিয়ে গেছে। পুরুষ যাত্রীদের চোখ বেঁধে ফেলার পর, হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলার পর, তারা অসহায় বোধ করেছে। সব সাধারণ ও নারী ও পুরুষ যাত্রীদের নিশ্চয় অবিশ্বাসের মতো লেগেছে। ভয়ে কারও হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে হয়তো। যে যার বিশ্বাসমতো সৃষ্টিকর্তাকে হয়তো ডেকেছে বা ডাকেনি। কারও বুকে হয়তো চাপা ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। কিন্তু অক্ষম ক্রোধে হাত-বাঁধা যাত্রীরা নিজের আঙুলটিও কামড়াতে পারেননি।
যার মনে যে প্রতিক্রিয়াই হোক, ডাকাতেরা তাদের কাউকেই ছাড়েনি। তাদের কাছে থাকা সবকিছুই তারা কেড়ে নিয়েছে। এ তো ডাকাতেরা করবেই। এটা করার জন্যই তারা উঠেছিল। কিন্তু সেই মেয়েটি? তাকে কেন বাড়তি যন্ত্রণা নিতে হলো? তাকে কেন এমন ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হলো?
না, তিনি তেমন কিছু করেননি। তাঁর কাছ থেকে ডাকাতেরা বিভিন্ন জিনিস কেড়ে নিতে চাইলে তিনি তর্ক করেন। ডাকাতদের চোখে এটাই ছিল তাঁর বড় অপরাধ। এই অপরাধের সাজা হিসেবে তাঁকে ছয়জন ধর্ষণ করেছিল। হ্যাঁ, ছয়জন; সেই চলন্ত বাসে, মধ্যরাতে।
বাসে আরও নারী ছিল। তাঁদের ধর্ষণ করা না হলেও যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার ওই নারী তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, আরেকজন নারীর ওপরও চড়াও হয়েছিল ডাকাতেরা। জানা গেছে, কয়েক নারীকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তারা।
কোনো পুরুষের ওপর দিয়ে কিন্তু মারধরের বাইরে যৌন নিপীড়নের ধকল যায়নি। তর্কের খেসারত হিসেবে পুরুষকে মার খেতে হয়েছে ডাকাতদের হাতে।
আচ্ছা কেউ কাউকে মারে কেন? শারীরিকভাবে নিজের প্রভাব অন্যের ওপর বিস্তার করার জন্যই তো। অন্যকে অধস্তন দেখাতে, শিকারযোগ্য দেখাতেই কিন্তু মারধর করা হয়। পুরুষ যাত্রীদের মারধর করে ডাকাতেরা সেই বার্তা দিতে পেরেছে। নারীদের ক্ষেত্রে কেন বাড়তি যৌন নিপীড়নের বিষয়টি এল তবে? নারীকে মারধর করলেও তো সে ব্যথা পায় পুরুষের মতোই। শিকারযোগ্য বা শারীরিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি তো তাহলে সমাধা হয়েই যায়। ধর্ষণ কেন তবে? গলায় ধরে থাকা ছুরিটি বা কাঁচিটি চালিয়ে দিলে পুরুষটি যদি মারা যায়, নারীটিও মারা যাবে। নারীর জন্য তবে বাড়তি ওই ধর্ষণ বরাদ্দ হলো কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিক মনোজগৎ গঠনের উপাদানগুলোর হদিস। এই একটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে দেশের প্রতিটি কোনা থেকে, প্রতিটি দিন একের পর এক নারী নির্যাতন, তাদের হেনস্তার নতুন নতুন উপায়ের হদিস মেলার কার্যকারণ। এই এক প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে বাধ্য। এই এক প্রশ্ন আমাদের আবার নিয়ে যেতে বাধ্য রূপার কাছে, যে রূপা বাড়ি ফিরছিল, যে রূপা শিক্ষক হতে চেয়েছিল, যে রূপা কারও কিছু কেড়ে নয় নিজ শ্রমে বেঁচেছিল। সেই রূপাকে আজকের আলোচিত মধুপুরেরই পাঁচলাইশ এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে। মনে পড়ে কি?
ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের সেই বাসটিতে আবার যাই, আবার নামি পথে। সেই বাসটিতে ছিল শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষ। সেই বাসটিতে করে হেকমত আলী তাঁর স্ত্রী জেসমিন, দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরা ছোট ছোট। একজন ছিল জেসমিনের কোলে, অন্যজন জেসমিনের মায়ের (হেকমত আলীর শাশুড়ি) কোলে। তাদের কি দুটি সন্তানই ছেলে, নাকি দুটিই মেয়ে, নাকি একটি শিশু ছেলে, অন্যটি মেয়ে। সে খবর নেওয়া হয়নি। বাসটিতে নিশ্চয়ই উভয় ধরনের শিশুই ছিল, যেমনটা থাকে দূরপাল্লার একেকটি যাত্রীবাহী পরিবহনে।
এই শিশুদের চোখ বাঁধা হয়নি। এই শিশুরা সবটা দেখেছে। কত বড় হয়েছিল তখন তাদের চোখ? এই শিশুরা সব শুনেছে, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি গর্জন, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস। এই শিশুরা চোখের সামনে এক নারীর আর্তনাদকে চাপা পড়তে দেখেছে, দেখেছে কী করে তাঁর ওপর একদল পুরুষ নির্যাতন চালায়। এই শিশুরা সবটা দেখেছে, আর নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করেছে নিশ্চয়।
কী ব্যাখ্যা করেছে তারা? মেয়ে শিশুরা কি নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে যে, এভাবে তর্ক করতে নেই। কথা বললেই তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা হবে। তখন আগেই হাত-পা বাঁধা, মুখ বাঁধা এমনকি চোখ বাঁধা বাকিদের করার কিছুই থাকবে না। এই একই কথা হয়তো ছেলে শিশুরাও বুঝেছে নিজেদের মতো করেই। তারা এটা বুঝে নেয়নি তো যে, নারীর তর্কের অধিকার নেই, তর্কপ্রবণ নারী নির্যাতনযোগ্য কিংবা নারীর ওপর শারীরিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হলো ধর্ষণ? আচ্ছা এই বাসের যাত্রীদেরই কি কেবল হাত-মুখ ও চোখ বাঁধা? নাকি আমাদের সবার, এই সমাজের সবার এই হাত-মুখ ও চোখ বাঁধা আজ, এই সময়ে?
সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন এই নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট বেরোচ্ছে। ওই বাসটিতে ঠিক কী ঘটেছিল, তার অনুসন্ধান চলছে। সাধারণ মানুষ নানা কথা বলছে নিজেদের মতো করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে হতাশা-ক্ষোভ নানা কিছু উগরে দিচ্ছে মানুষ। পুলিশ অপরাধীদের খুঁজতে অভিযান চালাচ্ছে। তদন্ত চলছে নিজের নিয়মে। এরই মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। কোনো কোনো সংগঠন বা অধিকারকর্মী হয়তো দেশে ক্রমবর্ধমান ডাকাতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে এর সঙ্গে অর্থনীতির লেখচিত্রগুলোর সম্পর্ক মিলিয়ে নিতে কাজে নামছেন, সরকারকে সতর্ক করছেন, কেউ হয়তো দেশে ধর্ষণের ধরন ও সংখ্যা দুইই বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কেউ হয়তো গণপরিবহনের যাত্রীদের অতীত নিরাপত্তা-বোধের কথা সামনে এনে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। একেকজন একেকটি বিষয়কে সামনে আনছেন, যার প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ।
আর এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা যেন অনাদিকাল থেকে কথা বলে চলেছি। ধর্ষণের খতিয়ান নিয়ে যে বা যারা বসে আছে, তারা যেন সেই কোন যুগ থেকে এভাবেই বসে আছে। এই দেশে খুন, রাহাজানি নিয়ে একদল সচেতন লোক যেন সেই কবে থেকে একই ভাষায় একইভাবে সতর্ক করে চলেছে। অর্থনীতি, সমাজ ইত্যাদির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আমরা যেন কোন সুদূর অতীত থেকে একই কথা বলে চলেছি। আর আমাদের সঙ্গে সেই কবে থেকে একই ঘটনাই ঘটে চলেছে। আমাদের মাথাপিছু আয় যেভাবে দায় হয়ে ওঠে, আমাদের রসুইয়ে কাঁচামাল যে হারে কমে, আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যয় যে হারে বাড়ে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতার গল্প যেভাবে গলার কাঁটা হয়ে ফিরে আসে, ঠিক সেভাবেই যেন একই গতিতে একই হারে আমাদের হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয়, লুট করা হয়। আর আমরা একই কথা বলতে থাকি, যে কথার পুনরাবৃত্তির চক্র আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। আমাদের চোখ, কান, হাত, পা, মুখ কিছুই আর মুক্ত নেই। আমাদের ছকে বাঁধা প্রতিক্রিয়া আমাদের বন্দী করে ফেলেছে। আর আমাদের চোখের সামনেই আমাদের পথগুলো পর্যন্ত লুট হয়ে গেছে। পথগুলো আর আমাদের নেই।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১৫ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১৫ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১৫ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১৫ ঘণ্টা আগে