সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশ গুমট থাকলেও নির্বাচন ঘিরে অনেক কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে। অন্তত সংঘাতের বিষয়টি দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। এ লক্ষণ রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কোনোভাবেই শুভ নয়। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে বিরোধীপক্ষকে দমনের নামে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার চলছে।
ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার প্রচলিত রাজনীতি এই সমাজকে অস্থির করে তুলেছে এবং দিনে দিনে তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিক্রি নিয়ে আমরা সরকার এবং প্রশাসনের মধ্যে দুই ধরনের আচরণ লক্ষ করলাম। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কার্যালয় ধানমন্ডিতে এক নীতি আবার বিরোধী জোট বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আরেক নীতি। এই ধরনের ইঙ্গিত একটি নির্বাচনের জন্য কোনোভাবেই সহনশীল হতে পারে না। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নামের যে বহুল প্রচারিত কথাটি আছে, তা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, এখন তা রীতিমতো ফিকে
হয়ে আসছে।
নতুন জোট গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। নৌকা প্রতীক এবং ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে লড়াই আগেও ছিল; কিন্তু এতটা স্পষ্ট ছিল না, অতীতে বিএনপির নেতৃত্বে জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে যা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাতি এবং গাধার প্রতীক নিয়ে যে লড়াই, বাংলাদেশে এখন সেই ধরনের লড়াই হতে পারে। বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে আদর্শগত নীতির বিশেষ কোনো মূল্য থাকে না; তারা লড়াই করে কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। যারা একবার ক্ষমতায় যায়, তারা সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে চায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দুই পক্ষেরই শক্তির কেন্দ্রে থাকে ক্ষমতা। নতুন জোট গঠনের মধ্যে আদর্শহীনতার দ্বন্দ্ব আরও পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়। কারণ, কোনো জোটই বিশেষ কোনো আদর্শকে কেন্দ্র করে তৈরি না হয়ে তৈরি হচ্ছে ক্ষমতা লাভের অভিপ্রায়ে। বড় দুই দল একা পারবে না বলেই অন্যদের ডেকে নিচ্ছে; অন্যরাও সাড়া দিচ্ছে। কারণ, একা থাকলে তাদের কেউ পাত্তা দেবে না।
মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়। কামাল হোসেনদের রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ, যে দল বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। অথচ তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির মিলেছিলেন। আবার বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেও একপর্যায়ে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে দ্বিধা করেননি। কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল ছিলেন কিন্তু এখন তিনি আর নৌকায় নেই, ধানের শীষের কাছকাছি চলে গেছেন। বুর্জোয়া রাজনীতি অন্তঃসারশূন্য। জোট দুটির মধ্যে সেটাই লক্ষ করছি আমরা। রাজনীতির নতুন মেরুকরণে দল বা ব্যক্তিবিশেষের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। এই দ্বন্দ্ব জনগণের জন্য খারাপ নয়, কারণ বুর্জোয়া শক্তি কখনো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে না। আর জনগণ এখন বিকল্প খুঁজছে। বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হলে বিকল্প খোঁজা সহজ হবে।
কথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শক্তি থেকে কোনো বিকল্প আসবে না। বিকল্প আসতে হবে বাম গণতান্ত্রিক ধারা থেকে। বাম শক্তি থেকে যদি কোনো জোট বা বিকল্প গড়ে ওঠে, তবেই জনগণের আশা জাগবে। এই সংকট পুঁজিবাদের। জনগণের মধ্য থেকে এই সংকট তৈরি করা হয়নি। জনগণ রাজনীতি বোঝেন, তারা ভোট দিতে চান। বুর্জোয়া রাজনীতি জনগণকে দমিয়ে রাখে। পুঁজিবাদের সংকটের কারণেই আদর্শবাদী রাজনীতি হুমকির মুখে।
পুঁজির শক্তির কাছে জনগণ হতাশ। জনগণ কেন বিকল্প পথের সন্ধান পায়নি, বা বাম বিকল্প শক্তি কেন জনগণের ঐক্য ধারণ করতে পারেনি, তার ঐতিহাসিক কারণ আছে। হঠাৎ করে আজকের পরিস্থিতি দাঁড়ায়নি। আবার হঠাৎ করেই বিকল্প শক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুর্জোয়া সংগঠনগুলো নিজেরা নিজেরা লড়াই করলেও তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নই ছিল, এবারের নির্বাচনে সেটা আরও বৃদ্ধি পাবে। রাজনীতির নতুন মেরুকরণে বিকল্প শক্তি প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আদর্শহীন রাজনীতি কখনো স্থায়ী হতে পারে না। তারা জোট গড়ছে সত্য, তবে ভাঙনের লক্ষণও কিন্তু অস্পষ্ট নয়। আমরা ভাঙা-গড়ার রাজনীতি তো দেখতেই পাচ্ছি। আমরা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যেই আছি। রাজনীতির মেরুকরণে সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। ক্ষমতা, পুঁজি এখন শতকরা ১০ জনের হাতে। বাকি ৯০ জন হতাশার সাগরে। তারা ক্ষমতার বাইরে। এই চিত্র গোটা বিশ্বের। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যারা, তারা ওই ১০ জনের প্রতিনিধিত্বই করে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বঞ্চিত, শোষিত শতকরা ৯০ জন মানুষ আজও সংগঠিত হতে পারেনি। এ কারণেই আমেরিকার নির্বাচনেও যে ফল, বাংলাদেশের নির্বাচনেও সেই একই ফল। এমন ভোটের আয়োজন সংকটকে আরও উন্মোচিত করে দেয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, সামাজিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন সমাজের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা সবাই আঁচ করতে পারছি। একজন খেতমজুরও বলতে পারছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী! জোর করে যেমন উন্নয়ন করা যায় না, তেমনি ক্ষমতাতেও থাকা যায় না। সমস্যা হচ্ছে পরিবর্তন হয় বটে, তবে তা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের ভূমিকা রাখতে পারে না।
সমাধান তাই বুর্জোয়ারা দেবে না। দেবে সমাজ-পরিবর্তনকারী বামপন্থীরাই। বাম শক্তি অসমর্থ হচ্ছে বলেই তো বুর্জোয়া রাজনীতি লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই এখন লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে বিকল্প শক্তি হতে পারে বাম রাজনীতিই। বাঙালির জীবনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধ এখনো পূর্ণতা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লবের এবং সে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষম্য দূর করার। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার। কিন্তু সেটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পদদলিত করেছে বুর্জোয়ারা। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। যদিও ঐতিহাসিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন বামপন্থীরা। জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সমাজ-পরিবর্তনের যে চেতনা ধারণ করে, তা বামপন্থীদেরই চেতনা। জনগণের সেই চেতনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্পন্ন করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের বিষয়টি ঐতিহাসিক, নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদীরাই দিয়েছে কিন্তু সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি, এটিই বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার মধ্যেই আমরা ক্ষমতার লড়াই দেখছি। এই লড়াইয়ে যারাই বিজয়ী হোক না কেন, তারা জনগণের পক্ষের শক্তি হবে না। এদের বিজয়ে জনগণ হেরে যায়। সমাজের বিদ্যমান পুঁজিবাদীর চরিত্রের কারণেই জনগণের এই হেরে যাওয়া। এর একটি ভালো দিক হচ্ছে, পুঁজির শাসকের প্রতি মানুষের তিক্ততা তীব্র হচ্ছে। আরেকটি ভালো দিক, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে এই দুর্দিনেও বামশক্তি প্রস্তুত হতে পারেনি। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য যে চেষ্টা, সেটাও আমরা বামপন্থীদের মধ্যে লক্ষ করছি না। তারা রাষ্ট্রের চরিত্র উন্মোচন করতে পারছে না। পুঁজিবাদীরা যে শুধু নামে বা পোশাকে ভিন্ন এবং কাজে অভিন্ন—এটি জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারছে না।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামাজিক মালিকানার যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা হয়নি বলেই আজ রাজনীতির সংকট তীব্র। নামে ভিন্ন হলেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ধারার শাসনব্যবস্থা একই রকমের আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এই তিন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন আগের চেয়েও অধিক আমলাতান্ত্রিক।
উপলব্ধি হচ্ছে মানুষ পরিবর্তন চায়। জনগণের সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে জনগণের শক্তিকেই সামনে আসতে হবে। যাঁরা সমাজ নিয়ে ভাবেন, তাঁদের বড় অংশ এখন বুর্জোয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সুশীলরাও বড় ভূমিকা রাখছে। টিকে থাকার নীতি অবলম্বন করে সুশীলরাও আজ জনগণ থেকে অনেক দূরে। সুতরাং সমাজ পরিবর্তনে সুশীলরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে—এই বাস্তবতা আর নেই। এ কারণে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের সেই শক্তির নামই বামশক্তি। কিন্তু সেই বিকল্প শক্তিও এখন আমাদের দেশের রাজনীতিতে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এই বাস্তবতায় নতুন জোট গণতন্ত্র মঞ্চ কাকে কতটুকু আশার আলো দেখাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশ গুমট থাকলেও নির্বাচন ঘিরে অনেক কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে। অন্তত সংঘাতের বিষয়টি দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। এ লক্ষণ রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কোনোভাবেই শুভ নয়। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে বিরোধীপক্ষকে দমনের নামে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার চলছে।
ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার প্রচলিত রাজনীতি এই সমাজকে অস্থির করে তুলেছে এবং দিনে দিনে তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিক্রি নিয়ে আমরা সরকার এবং প্রশাসনের মধ্যে দুই ধরনের আচরণ লক্ষ করলাম। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কার্যালয় ধানমন্ডিতে এক নীতি আবার বিরোধী জোট বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আরেক নীতি। এই ধরনের ইঙ্গিত একটি নির্বাচনের জন্য কোনোভাবেই সহনশীল হতে পারে না। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নামের যে বহুল প্রচারিত কথাটি আছে, তা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, এখন তা রীতিমতো ফিকে
হয়ে আসছে।
নতুন জোট গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। নৌকা প্রতীক এবং ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে লড়াই আগেও ছিল; কিন্তু এতটা স্পষ্ট ছিল না, অতীতে বিএনপির নেতৃত্বে জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে যা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাতি এবং গাধার প্রতীক নিয়ে যে লড়াই, বাংলাদেশে এখন সেই ধরনের লড়াই হতে পারে। বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে আদর্শগত নীতির বিশেষ কোনো মূল্য থাকে না; তারা লড়াই করে কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। যারা একবার ক্ষমতায় যায়, তারা সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে চায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দুই পক্ষেরই শক্তির কেন্দ্রে থাকে ক্ষমতা। নতুন জোট গঠনের মধ্যে আদর্শহীনতার দ্বন্দ্ব আরও পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়। কারণ, কোনো জোটই বিশেষ কোনো আদর্শকে কেন্দ্র করে তৈরি না হয়ে তৈরি হচ্ছে ক্ষমতা লাভের অভিপ্রায়ে। বড় দুই দল একা পারবে না বলেই অন্যদের ডেকে নিচ্ছে; অন্যরাও সাড়া দিচ্ছে। কারণ, একা থাকলে তাদের কেউ পাত্তা দেবে না।
মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়। কামাল হোসেনদের রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ, যে দল বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। অথচ তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির মিলেছিলেন। আবার বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেও একপর্যায়ে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে দ্বিধা করেননি। কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল ছিলেন কিন্তু এখন তিনি আর নৌকায় নেই, ধানের শীষের কাছকাছি চলে গেছেন। বুর্জোয়া রাজনীতি অন্তঃসারশূন্য। জোট দুটির মধ্যে সেটাই লক্ষ করছি আমরা। রাজনীতির নতুন মেরুকরণে দল বা ব্যক্তিবিশেষের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। এই দ্বন্দ্ব জনগণের জন্য খারাপ নয়, কারণ বুর্জোয়া শক্তি কখনো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে না। আর জনগণ এখন বিকল্প খুঁজছে। বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হলে বিকল্প খোঁজা সহজ হবে।
কথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শক্তি থেকে কোনো বিকল্প আসবে না। বিকল্প আসতে হবে বাম গণতান্ত্রিক ধারা থেকে। বাম শক্তি থেকে যদি কোনো জোট বা বিকল্প গড়ে ওঠে, তবেই জনগণের আশা জাগবে। এই সংকট পুঁজিবাদের। জনগণের মধ্য থেকে এই সংকট তৈরি করা হয়নি। জনগণ রাজনীতি বোঝেন, তারা ভোট দিতে চান। বুর্জোয়া রাজনীতি জনগণকে দমিয়ে রাখে। পুঁজিবাদের সংকটের কারণেই আদর্শবাদী রাজনীতি হুমকির মুখে।
পুঁজির শক্তির কাছে জনগণ হতাশ। জনগণ কেন বিকল্প পথের সন্ধান পায়নি, বা বাম বিকল্প শক্তি কেন জনগণের ঐক্য ধারণ করতে পারেনি, তার ঐতিহাসিক কারণ আছে। হঠাৎ করে আজকের পরিস্থিতি দাঁড়ায়নি। আবার হঠাৎ করেই বিকল্প শক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুর্জোয়া সংগঠনগুলো নিজেরা নিজেরা লড়াই করলেও তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নই ছিল, এবারের নির্বাচনে সেটা আরও বৃদ্ধি পাবে। রাজনীতির নতুন মেরুকরণে বিকল্প শক্তি প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আদর্শহীন রাজনীতি কখনো স্থায়ী হতে পারে না। তারা জোট গড়ছে সত্য, তবে ভাঙনের লক্ষণও কিন্তু অস্পষ্ট নয়। আমরা ভাঙা-গড়ার রাজনীতি তো দেখতেই পাচ্ছি। আমরা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যেই আছি। রাজনীতির মেরুকরণে সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। ক্ষমতা, পুঁজি এখন শতকরা ১০ জনের হাতে। বাকি ৯০ জন হতাশার সাগরে। তারা ক্ষমতার বাইরে। এই চিত্র গোটা বিশ্বের। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যারা, তারা ওই ১০ জনের প্রতিনিধিত্বই করে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বঞ্চিত, শোষিত শতকরা ৯০ জন মানুষ আজও সংগঠিত হতে পারেনি। এ কারণেই আমেরিকার নির্বাচনেও যে ফল, বাংলাদেশের নির্বাচনেও সেই একই ফল। এমন ভোটের আয়োজন সংকটকে আরও উন্মোচিত করে দেয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, সামাজিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন সমাজের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা সবাই আঁচ করতে পারছি। একজন খেতমজুরও বলতে পারছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী! জোর করে যেমন উন্নয়ন করা যায় না, তেমনি ক্ষমতাতেও থাকা যায় না। সমস্যা হচ্ছে পরিবর্তন হয় বটে, তবে তা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের ভূমিকা রাখতে পারে না।
সমাধান তাই বুর্জোয়ারা দেবে না। দেবে সমাজ-পরিবর্তনকারী বামপন্থীরাই। বাম শক্তি অসমর্থ হচ্ছে বলেই তো বুর্জোয়া রাজনীতি লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই এখন লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে বিকল্প শক্তি হতে পারে বাম রাজনীতিই। বাঙালির জীবনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধ এখনো পূর্ণতা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লবের এবং সে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষম্য দূর করার। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার। কিন্তু সেটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পদদলিত করেছে বুর্জোয়ারা। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। যদিও ঐতিহাসিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন বামপন্থীরা। জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সমাজ-পরিবর্তনের যে চেতনা ধারণ করে, তা বামপন্থীদেরই চেতনা। জনগণের সেই চেতনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্পন্ন করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের বিষয়টি ঐতিহাসিক, নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদীরাই দিয়েছে কিন্তু সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি, এটিই বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার মধ্যেই আমরা ক্ষমতার লড়াই দেখছি। এই লড়াইয়ে যারাই বিজয়ী হোক না কেন, তারা জনগণের পক্ষের শক্তি হবে না। এদের বিজয়ে জনগণ হেরে যায়। সমাজের বিদ্যমান পুঁজিবাদীর চরিত্রের কারণেই জনগণের এই হেরে যাওয়া। এর একটি ভালো দিক হচ্ছে, পুঁজির শাসকের প্রতি মানুষের তিক্ততা তীব্র হচ্ছে। আরেকটি ভালো দিক, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে এই দুর্দিনেও বামশক্তি প্রস্তুত হতে পারেনি। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য যে চেষ্টা, সেটাও আমরা বামপন্থীদের মধ্যে লক্ষ করছি না। তারা রাষ্ট্রের চরিত্র উন্মোচন করতে পারছে না। পুঁজিবাদীরা যে শুধু নামে বা পোশাকে ভিন্ন এবং কাজে অভিন্ন—এটি জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারছে না।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামাজিক মালিকানার যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা হয়নি বলেই আজ রাজনীতির সংকট তীব্র। নামে ভিন্ন হলেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ধারার শাসনব্যবস্থা একই রকমের আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এই তিন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন আগের চেয়েও অধিক আমলাতান্ত্রিক।
উপলব্ধি হচ্ছে মানুষ পরিবর্তন চায়। জনগণের সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে জনগণের শক্তিকেই সামনে আসতে হবে। যাঁরা সমাজ নিয়ে ভাবেন, তাঁদের বড় অংশ এখন বুর্জোয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সুশীলরাও বড় ভূমিকা রাখছে। টিকে থাকার নীতি অবলম্বন করে সুশীলরাও আজ জনগণ থেকে অনেক দূরে। সুতরাং সমাজ পরিবর্তনে সুশীলরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে—এই বাস্তবতা আর নেই। এ কারণে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের সেই শক্তির নামই বামশক্তি। কিন্তু সেই বিকল্প শক্তিও এখন আমাদের দেশের রাজনীতিতে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এই বাস্তবতায় নতুন জোট গণতন্ত্র মঞ্চ কাকে কতটুকু আশার আলো দেখাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১৪ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১৪ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১৪ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১৪ ঘণ্টা আগে