মহামারির গল্প

লীনা দিলরুবা
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২১, ০৯: ৩০

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান এলাকায় মানবদেহে একটি নতুন (নভেল) করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রথম আলামত পাওয়ার পর এ ভাইরাস অকল্পনীয় দ্রুততায় মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০-এর মার্চ মাসে এটিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে।

পৃথিবীতে মহামারির ইতিহাস নতুন নয়। প্লেগের কারণে প্রথম যে মহামারি দেখা দিয়েছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল জাস্টিনিয়ানের প্লেগ (৫৪১-৫৪২ খ্রিস্টাব্দ)। বিশ্বজুড়ে এতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ মারা যায়।

ব্ল্যাক ডেথ (১৩৪৬-১৩৫৩) মহামারিতে ২০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। এর কারণও ছিল বিউবোনিক প্লেগ। ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত 
এই রোগে বিপর্যস্ত হয় ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া।

এইচআইভি এইডস মহামারিতে (সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায় ২০০৫-২০১২) মৃত্যু হয়েছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের। ১৯৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোয় এটি প্রথম ধরা পড়ে। ১৯৮১ থেকে এ পর্যন্ত প্রচুরসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে এটি সত্যিকার অর্থে একটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে।

ফ্লু মহামারিতে (১৯৬৮) মৃত্যু হয়েছিল ১০ লাখ মানুষের। এর কারণ ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা। ক্যাটাগরি-টু শ্রেণির এই মহামারিকে হংকং ফ্লু বলেও অভিহিত 
করা হয়।

কলেরা মহামারিতে (১৯১০-১১) প্রায় ৮ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। এর উৎপত্তি হয়েছিল ভারতে। এরপর এটি মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

ওপরের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, যুগে যুগে মহামারিগুলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে যেমন ব্যাহত করেছে, তেমনি এই মহামারিগুলো সব সময়ই ছিল হন্তারকের ভূমিকায়। প্রায় দুই বছর ধরে চলমান করোনা মহামারির বীভৎস কাণ্ডকারখানা আর হত্যাযজ্ঞ মানুষের শুভবুদ্ধি, সুস্থ চিন্তার গতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। আত্মসন্তুষ্টি, আয়েশি মানুষগুলো হতাশা আর ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত আজ, ছন্দহীন জীবনগুলো আবার কখন যুক্তিগ্রাহ্য জীবনের পটভূমিতে ফিরে যাবে—সেটি এখনো অনিশ্চিত।

 ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘কিং লিয়র’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অসংখ্য কালজয়ী নাটকের রচয়িতা শেক্‌সপিয়ারের সময়েও প্লেগে বিপর্যস্ত হয়েছিল পৃথিবী। তিনি তখন ‘তৃতীয় রিচার্ড’ নাটকের তৃতীয় অঙ্ক লিখছিলেন। লন্ডনে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে সব নাট্যশালা বন্ধ হয়ে গেল। নর্দমার আশপাশে ধেড়ে ইঁদুরের উৎপাতে মানুষের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। মঞ্চস্থ না হলে আর নাটক রচনা কেন! ‘তৃতীয় রিচার্ড’ লেখার কাজ থেমে গেল মাঝপথে। শেক্‌সপিয়ার শুরু করলেন কাব্য রচনার কাজ। কবিতার বিষয়বস্তু হলো ভেনাস ও রূপবান যুবক অ্যাডোনিস। কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে শহরের রাস্তায় বেরোতেন তিনি। প্লেগের সংক্রমণের চিহ্নগুলো দেখে মুষড়ে পড়তেন। ঘরে ফিরে ফের লেখার টেবিলে বসতেন এই বিশ্বাসে, তাঁকে কখনো প্লেগ আক্রমণ করবে না। শেষ পর্যন্ত প্লেগ অন্তর্হিত হয়, তৃতীয় রিচার্ড লেখার কাজও শেষ হয়। এ তো গেল শেক্‌সপিয়ারের বাস্তব গল্প। মহামারি নিয়ে পৃথিবীবিখ্যাত লেখকেরা যুগে যুগে ক্রিয়াশীল ছিলেন কল্পিত গল্প-উপন্যাস রচনায়। কাল পেরিয়ে এসব লেখাগুলো ফের পড়লে বিস্মিত হতে হয়—এসব লেখকের কল্পনাশক্তি দেখে।

আলবেয়ার কাম্যু তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘লা পেস্ত’ বা ‘দ্য প্লেগ’-এ ‘ওরান’ নামে মৃত্যুচিহ্নিত একটি অঞ্চলের গল্প বলেছেন, যেখানে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ অসহায়ভাবে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছিল। উপন্যাসে রিও নামের এক ডাক্তার যেন এই জনপদের মানুষের দুর্ভোগ দেখবে বলে ভাগ্যকে বরণ করে নিয়েছিল। প্রতিদিন তার কাছে আক্রান্ত রোগী আসছে। প্লেগ আক্রান্ত রোগীদের দেখে রিও শঙ্কিত, বিষণ্ণ। কুঁচকিতে ব্যথা, বমি আর প্রচণ্ড জ্বরে ভুগে একে একে ওরানের মানুষগুলো মৃত্যুকে বরণ করে। তাদের ফোলা গ্রন্থিগুলো যেন ফেটে পড়তে চায়। রিও গ্রন্থিগুলোকে ছুরি দিয়ে চিরে দেয়, রক্তমেশা পুঁজ ছিটকে পড়ে; কিন্তু আক্রান্ত মানুষগুলো তাতে রক্ষা পায় না। পূতিগন্ধময় পরিবেশে মৃত্যু হয় তাদের। হাসপাতালে জায়গা নেই। কবরস্থানে গোর দেওয়ার স্থান কমে যেতে লাগল। রোগীদের ইনজেকশন দেওয়ার সেরাম নেই। রিও আশঙ্কা করছিল, হয়তো শহরের অর্ধেক লোকই এই রোগে মরে যাবে।

কাম্যু উপন্যাসে প্লেগকে হাজির করেছিলেন নির্মমতা, অর্থহীনতা, মানুষের অসহায়ত্ব আর যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতা অনুসরণ করে কাম্যু যেন বলতে চেয়েছেন, যখনই মানুষ আত্মতুষ্টিতে নিবেদিত থাকে, তখনই প্লেগ আক্রমণ করে।

মহামারিকে উপজীব্য করে এডগার অ্যালান পো ১৯৪২ সালে গ্রাহাম ম্যাগাজিনে একটি গল্প লেখেন। গল্পটির নাম ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’।

সমালোচকদের মতে, গল্পটি পৃথিবীর প্রথম গথিক উপন্যাস হোরাস ওয়ালপোলের ‘দ্য ক্যাসল অব অট্রান্টা’র প্রভাবে লেখা। ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’ গল্পের পটভূমিকা একটি রাজ্য। যুবরাজ প্রসপ্যারো সে রাজ্যের অধিপতি। হঠাৎ করে সেখানে এক অদ্ভুত ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ে—‘তীব্র ব্যথা, তারপর মাথা ঘোরা, তারপর রন্ধ্রপথে প্রচুর রক্তপাত, তারপর বিলুপ্তি। ভিকটিমের শরীরে, বিশেষ করে মুখমণ্ডলে রক্তলাল ক্ষতচিহ্নগুলো আসলে কীটের অভিশাপ, যা তাকে মানুষের সব রকম সাহায্য আর সহানুভূতি পাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়।’ এভাবেই ছোটগল্পটিতে ভয়াবহ এই রোগের বর্ণনা করেছেন পো।

যখন রাজ্যের প্রায় অর্ধেক লোক মারা গেল, তখন প্রসপ্যারো তার পারিষদ, তাদের পরিবারসহ এক হাজার লোককে নিয়ে এক দুর্গে আশ্রয় নিলেন। সেখানে আমোদ-প্রমোদের কোনো কমতি রাখলেন না। পাঁচ-ছয় মাস পর, বাইরে মহামারি তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রসপ্যারো দুর্গের ভেতরে আমোদে আর উৎসবে সময় পার করছেন। এর মধ্যেই আয়োজন করলেন মুখে মুখোশ লাগিয়ে একটি নাচের অনুষ্ঠানের। সেই নাচের অনুষ্ঠানেই এক আগন্তুক মুখোশ পরে প্রসপ্যারোকে হত্যা করে। এরপর আগন্তুককে স্পর্শ করা মাত্র সেখানকার রোমান্টিক, কামনায় উদ্দীপ্ত মানুষগুলো একে একে মরে যেতে লাগল। এই জনপদে এরপর আর কোনো মানুষ থাকল না। মহামারির কাছে আত্মসমর্পণ করল সবাই।

 ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’ গল্পে পো দেখালেন, ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতার সৌধ বানিয়ে মানুষকে অবজ্ঞা করার প্রয়াস পায়; কিন্তু প্রকৃতি তাদের বেশি দিন এই মোহের মধ্যে রাখে না। হয়তো এটাই সত্য, ফ্যান্টাসির ওপর কোনো কিছু টিকতে পারে না। এই গল্পের বেদনাদায়ক পরিণতি এখানেই—যুবরাজের মৃত্যু কোনোভাবেই তার শক্ত দুর্গ ঠেকাতে পারেনি। বস্তুত, পরাবাস্তববাদী এই গল্প গতানুগতিক গল্পের বেড়াকে ডিঙিয়ে আমাদের দৃষ্টিকে বহুদূরে নিয়ে যায়। 

লেখক: সাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত