মামুনুর রশীদ
১২ আগস্ট উৎপল দত্তের নাটক ‘টিনের তলোয়ার’-এর ৫০ বছর পূর্তি হলো। নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ওই বছরই। সেই সময়ে নাটকটি এত জনপ্রিয় ছিল যে ব্যালকনির পেছনে দুটি টিকিট পেয়েছিলাম। আমি ও মুস্তাফা মনোয়ার নাটকটি দেখেছিলাম। সে সময় আমি মুস্তাফা মনোয়ারের নির্দেশনায় ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ নাটকের মহড়ার ব্যবস্থা করছিলাম। ‘টিনের তলোয়ার’ দেখার পর আমাদের মনে একটা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, যা রূপান্তরিত হয়েছিল প্রেরণায়। উৎপল দত্তের বাড়িতেও আমরা দেখা করেছিলাম। সেই থেকে একটা গভীর সম্পর্কও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
নাটকটি বাংলাদেশের অনেকেই দেখতে পারেননি, কিন্তু বহু মানুষ অডিও শুনেছেন। অডিওটিও খুব সার্থক হয়েছিল। ‘টিনের তলোয়ার’ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য ছিল, ‘বাংলা নাটকের উচ্চতা হচ্ছে এই নাটকটি’। উৎপল দত্তকে ‘টিনের তলোয়ার’ পর্যন্ত আসতে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। মুখ্য সংগ্রাম রাজনৈতিক। তিনি বাম ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রথম থেকেই। শেক্সপিয়ারের সমাজভাবনা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। শেক্সপিয়ার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে তাঁর কাজগুলো প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু দর্শক তেমন একটা আসেনি। প্রায় হতাশ এক পরিস্থিতিতে মাথায় এল ‘অঙ্গার’। কয়লাখনির শ্রমিকদের কাহিনি।
কী করে একদল শ্রমিককে খনির নিচে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল, সেই মর্মান্তিক গল্প। নাটকটির গল্প, সংলাপ, দৃশ্যায়ন, বিশেষ করে কীভাবে পানি উঠতে উঠতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে, সেই মুহূর্তগুলো শিহরিত করে। নাটকটির কাহিনি শুনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর সংগীত রচনা করলেন। তাপস সেন আলোকসম্পাতের অসাধারণ কৌশলে বিষয়গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন। নাটক দেখার জন্য দর্শকের রীতিমতো বাঁধ ভেঙে গেল। তারপর বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহ নিয়ে নাটক ‘কল্লোল’। এ নাটকে কংগ্রেস নেতাদের, বিশেষ করে বাপুজিকে নিয়ে সমালোচনা ছিল। নাটক হতে দেওয়া যায় না। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পর্যন্ত ছাপল না। শুধু ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া যেত। মিনার্ভা থিয়েটার লিজ নিয়ে চলছে ‘কল্লোল’। জনতার কাছে চলে গেল ‘কল্লোল’, স্লোগান দিতে শুরু করল দর্শক।
জনতার ‘কল্লোল’ চলবেই। এর মধ্যে উৎপল দত্তের কারাবরণ। মামলার বিষয়, নকশালদের তিনি কিউবান অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। তাঁর নাটক বন্ধ করার পাঁয়তারা। এত নিপীড়ন, কোর্টে হাজিরা, জীবিকার অন্বেষণ—এসবের মধ্যেও থেমে নেই উৎপল দত্ত। নকশালবাড়ির লড়াই চলছে। কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেছে। কে শত্রু কে মিত্র বোঝা মুশকিল। এর মধ্যেই লিখছেন ‘টিনের তলোয়ার’। নাটক লেখার পাশাপাশি বড় বড় লেখা চলছে। ‘টুওয়ার্ডস আ রেভল্যুশনারি থিয়েটার’ লিখেছেন।
‘শেক্সপিয়ারের সমাজভাবনা’, ‘গিরিশ মানস’ এসব লিখছেন। সার্বক্ষণিক কর্মচঞ্চল উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার’–এ ধরলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর পেশাদারি থিয়েটারকে, যেখানে ইংরেজ বেনিয়ান ঔপনিবেশিক পুলিশ আমলাদের নিপীড়নের মধ্যেই ছাইচাপা দেওয়া দেশপ্রেম কীভাবে জাগ্রত হয়, তারই এক মহাকাব্য। ‘টিনের তলোয়ার’ মঞ্চায়নের ছয় মাস পর বাংলাদেশে নতুন ধারার নিয়মিত নাট্যচর্চার শুরু। সেটি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত দ্রুত নাট্যচর্চা শুরু হয়ে তা আবার নাট্য আন্দোলনের সূচনা করে।
এক অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। উৎপল দত্ত, শোভা সেন, তাপস সেন এই সময়ে বাংলাদেশে আসেন। তখন আমাদের মঞ্চ নেই। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি—এসব জায়গায় নাটক মঞ্চস্থ হয়। অবশ্য ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল, আরও পরে মহিলা সমিতি মিলনায়তনও নাটক মঞ্চায়নের জন্য পাওয়া যায়। তত দিনে শত শত নাট্যকর্মী তৈরি হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিনয় হচ্ছে, যেখানেই একটু সুযোগ পাওয়া যায়। সত্তরের দশকজুড়ে এই অভিযাত্রা শেষে বেশ কিছু নাট্যকার–নির্দেশকের পদযাত্রা শোনা যায়। অভিনেতা-অভিনেত্রী, নেপথ্য কুশলীরাও উঠে দাঁড়িয়েছেন।
নাট্যমনস্ক দর্শকেরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়ে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে। মুষ্টিমেয় কিছু সামরিক অফিসারের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসন চলে ১৫ বছর। এই সময়ে সামরিক শাসকদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনের প্রথম কাতারে ছিলেন সংস্কৃতিকর্মীরা, যার মধ্যে নাট্যকর্মীরা হলেন অগ্রগামী শক্তি। এ সময়ে মঞ্চ ও পথনাটকে রাজনৈতিক থিয়েটার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মঞ্চের সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু পথনাটক সর্বত্র অভিনীত হতে পারে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে নাটকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে মুক্ত নাটকে। গ্রাম থিয়েটারও সংগঠিত হতে থাকে। কিন্তু মঞ্চেও সামরিক জান্তাবিরোধী নাটক অভিনীত হয় বিরামহীনভাবে। একসময় সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটে। কিন্তু রেখে যায় সাম্প্রদায়িকতা। বাবরি মসজিদ আর রামমন্দিরের মতো সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে আছেই।
প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাই নাট্যকর্মীদের ও মঞ্চনাটককে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতাহীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ে নাটকের লেখকদের নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হয়েছে। তার মধ্যে থেকেও আন্তর্জাতিক মানের নাটক দর্শকদের নাড়া দিয়েছে। মিডিয়ায় দ্রুত উল্লম্ফনকালে মঞ্চনাটক টিকে আছে এবং তার শিকড় ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। জাতীয় জীবনের অনেক বিস্মৃত ঘটনা বা ব্যক্তিকে ধরে রাখার কাজটি করে যাচ্ছেন নাট্যকর্মীরা। যেমন উৎপল দত্ত বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহ, ঊনবিংশ শতাব্দীর থিয়েটারের অন্তরে যে দেশপ্রেমকে ধরে রেখেছেন, তেমনি আমরাও আলফ্রেড সরেন হত্যা, নানকার বিদ্রোহ, ষাটের দশকের মফস্বলের থিয়েটার, হাজং বিদ্রোহ, কর্নেল তাহের খুন, বিদ্যাসাগর, নুরলদীন ও মুক্তিযুদ্ধকে লালন করেছি আমাদের নাটকে।
উৎপল দত্তের কর্মময় জীবনের একটি ক্ষুদ্র ও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ‘টিনের তলোয়ার’। এই সময়ে, অর্থাৎ ষাট ও সত্তরের দশকে কলকাতার থিয়েটারে আরও অনেক বড় বড় ঘটনা আছে। থিয়েটার শক্তি যে কত বড়, তার প্রমাণ পেয়েছে সারা দেশ। আমাদের দেশেও সত্তরের শেষ থেকে আজ পর্যন্ত খেয়ে না খেয়ে থিয়েটারের লোকেরা যে কালজয়ী কাজগুলো করে গেছেন, তা বর্ণনা করতে গেলে কাগজের পর কাগজ লেগে যাবে। এই প্রাণশক্তি কোথা থেকে আসে?
থিয়েটারের লোকেরা সমাজের মানুষ, পরিবর্তনশীল, রাজনৈতিক ব্যবস্থার তারা পর্যবেক্ষক এবং সব সময়ই তারা ভাবে, থিয়েটার তো পরিবর্তনে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু যখন দেখতে পায় তা হচ্ছে না, তখন নতুন করে লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে থাকে। এ জন্যই থিয়েটারে নতুন নতুন শক্তি এসে যুক্ত হয়। থিয়েটারের লোকদের মধ্যে হতাশা ও প্রেরণা নিত্যসঙ্গী। এই প্রেরণা থেকেই তাদের নিত্যনতুনের আবাহন। ‘টিনের তলোয়ার’-এর পঞ্চাশ বছর আর আমাদের সমাগত পঞ্চাশ বছরের সব সৈনিককে জানাই ‘টিনের তলোয়ার’-এর অভিবাদন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
১২ আগস্ট উৎপল দত্তের নাটক ‘টিনের তলোয়ার’-এর ৫০ বছর পূর্তি হলো। নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ওই বছরই। সেই সময়ে নাটকটি এত জনপ্রিয় ছিল যে ব্যালকনির পেছনে দুটি টিকিট পেয়েছিলাম। আমি ও মুস্তাফা মনোয়ার নাটকটি দেখেছিলাম। সে সময় আমি মুস্তাফা মনোয়ারের নির্দেশনায় ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ নাটকের মহড়ার ব্যবস্থা করছিলাম। ‘টিনের তলোয়ার’ দেখার পর আমাদের মনে একটা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, যা রূপান্তরিত হয়েছিল প্রেরণায়। উৎপল দত্তের বাড়িতেও আমরা দেখা করেছিলাম। সেই থেকে একটা গভীর সম্পর্কও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
নাটকটি বাংলাদেশের অনেকেই দেখতে পারেননি, কিন্তু বহু মানুষ অডিও শুনেছেন। অডিওটিও খুব সার্থক হয়েছিল। ‘টিনের তলোয়ার’ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য ছিল, ‘বাংলা নাটকের উচ্চতা হচ্ছে এই নাটকটি’। উৎপল দত্তকে ‘টিনের তলোয়ার’ পর্যন্ত আসতে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। মুখ্য সংগ্রাম রাজনৈতিক। তিনি বাম ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রথম থেকেই। শেক্সপিয়ারের সমাজভাবনা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। শেক্সপিয়ার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে তাঁর কাজগুলো প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু দর্শক তেমন একটা আসেনি। প্রায় হতাশ এক পরিস্থিতিতে মাথায় এল ‘অঙ্গার’। কয়লাখনির শ্রমিকদের কাহিনি।
কী করে একদল শ্রমিককে খনির নিচে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল, সেই মর্মান্তিক গল্প। নাটকটির গল্প, সংলাপ, দৃশ্যায়ন, বিশেষ করে কীভাবে পানি উঠতে উঠতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে, সেই মুহূর্তগুলো শিহরিত করে। নাটকটির কাহিনি শুনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর সংগীত রচনা করলেন। তাপস সেন আলোকসম্পাতের অসাধারণ কৌশলে বিষয়গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন। নাটক দেখার জন্য দর্শকের রীতিমতো বাঁধ ভেঙে গেল। তারপর বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহ নিয়ে নাটক ‘কল্লোল’। এ নাটকে কংগ্রেস নেতাদের, বিশেষ করে বাপুজিকে নিয়ে সমালোচনা ছিল। নাটক হতে দেওয়া যায় না। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পর্যন্ত ছাপল না। শুধু ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া যেত। মিনার্ভা থিয়েটার লিজ নিয়ে চলছে ‘কল্লোল’। জনতার কাছে চলে গেল ‘কল্লোল’, স্লোগান দিতে শুরু করল দর্শক।
জনতার ‘কল্লোল’ চলবেই। এর মধ্যে উৎপল দত্তের কারাবরণ। মামলার বিষয়, নকশালদের তিনি কিউবান অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। তাঁর নাটক বন্ধ করার পাঁয়তারা। এত নিপীড়ন, কোর্টে হাজিরা, জীবিকার অন্বেষণ—এসবের মধ্যেও থেমে নেই উৎপল দত্ত। নকশালবাড়ির লড়াই চলছে। কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেছে। কে শত্রু কে মিত্র বোঝা মুশকিল। এর মধ্যেই লিখছেন ‘টিনের তলোয়ার’। নাটক লেখার পাশাপাশি বড় বড় লেখা চলছে। ‘টুওয়ার্ডস আ রেভল্যুশনারি থিয়েটার’ লিখেছেন।
‘শেক্সপিয়ারের সমাজভাবনা’, ‘গিরিশ মানস’ এসব লিখছেন। সার্বক্ষণিক কর্মচঞ্চল উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার’–এ ধরলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর পেশাদারি থিয়েটারকে, যেখানে ইংরেজ বেনিয়ান ঔপনিবেশিক পুলিশ আমলাদের নিপীড়নের মধ্যেই ছাইচাপা দেওয়া দেশপ্রেম কীভাবে জাগ্রত হয়, তারই এক মহাকাব্য। ‘টিনের তলোয়ার’ মঞ্চায়নের ছয় মাস পর বাংলাদেশে নতুন ধারার নিয়মিত নাট্যচর্চার শুরু। সেটি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত দ্রুত নাট্যচর্চা শুরু হয়ে তা আবার নাট্য আন্দোলনের সূচনা করে।
এক অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। উৎপল দত্ত, শোভা সেন, তাপস সেন এই সময়ে বাংলাদেশে আসেন। তখন আমাদের মঞ্চ নেই। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি—এসব জায়গায় নাটক মঞ্চস্থ হয়। অবশ্য ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল, আরও পরে মহিলা সমিতি মিলনায়তনও নাটক মঞ্চায়নের জন্য পাওয়া যায়। তত দিনে শত শত নাট্যকর্মী তৈরি হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিনয় হচ্ছে, যেখানেই একটু সুযোগ পাওয়া যায়। সত্তরের দশকজুড়ে এই অভিযাত্রা শেষে বেশ কিছু নাট্যকার–নির্দেশকের পদযাত্রা শোনা যায়। অভিনেতা-অভিনেত্রী, নেপথ্য কুশলীরাও উঠে দাঁড়িয়েছেন।
নাট্যমনস্ক দর্শকেরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়ে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে। মুষ্টিমেয় কিছু সামরিক অফিসারের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসন চলে ১৫ বছর। এই সময়ে সামরিক শাসকদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনের প্রথম কাতারে ছিলেন সংস্কৃতিকর্মীরা, যার মধ্যে নাট্যকর্মীরা হলেন অগ্রগামী শক্তি। এ সময়ে মঞ্চ ও পথনাটকে রাজনৈতিক থিয়েটার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মঞ্চের সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু পথনাটক সর্বত্র অভিনীত হতে পারে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে নাটকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে মুক্ত নাটকে। গ্রাম থিয়েটারও সংগঠিত হতে থাকে। কিন্তু মঞ্চেও সামরিক জান্তাবিরোধী নাটক অভিনীত হয় বিরামহীনভাবে। একসময় সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটে। কিন্তু রেখে যায় সাম্প্রদায়িকতা। বাবরি মসজিদ আর রামমন্দিরের মতো সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে আছেই।
প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাই নাট্যকর্মীদের ও মঞ্চনাটককে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতাহীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ে নাটকের লেখকদের নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হয়েছে। তার মধ্যে থেকেও আন্তর্জাতিক মানের নাটক দর্শকদের নাড়া দিয়েছে। মিডিয়ায় দ্রুত উল্লম্ফনকালে মঞ্চনাটক টিকে আছে এবং তার শিকড় ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। জাতীয় জীবনের অনেক বিস্মৃত ঘটনা বা ব্যক্তিকে ধরে রাখার কাজটি করে যাচ্ছেন নাট্যকর্মীরা। যেমন উৎপল দত্ত বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহ, ঊনবিংশ শতাব্দীর থিয়েটারের অন্তরে যে দেশপ্রেমকে ধরে রেখেছেন, তেমনি আমরাও আলফ্রেড সরেন হত্যা, নানকার বিদ্রোহ, ষাটের দশকের মফস্বলের থিয়েটার, হাজং বিদ্রোহ, কর্নেল তাহের খুন, বিদ্যাসাগর, নুরলদীন ও মুক্তিযুদ্ধকে লালন করেছি আমাদের নাটকে।
উৎপল দত্তের কর্মময় জীবনের একটি ক্ষুদ্র ও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ‘টিনের তলোয়ার’। এই সময়ে, অর্থাৎ ষাট ও সত্তরের দশকে কলকাতার থিয়েটারে আরও অনেক বড় বড় ঘটনা আছে। থিয়েটার শক্তি যে কত বড়, তার প্রমাণ পেয়েছে সারা দেশ। আমাদের দেশেও সত্তরের শেষ থেকে আজ পর্যন্ত খেয়ে না খেয়ে থিয়েটারের লোকেরা যে কালজয়ী কাজগুলো করে গেছেন, তা বর্ণনা করতে গেলে কাগজের পর কাগজ লেগে যাবে। এই প্রাণশক্তি কোথা থেকে আসে?
থিয়েটারের লোকেরা সমাজের মানুষ, পরিবর্তনশীল, রাজনৈতিক ব্যবস্থার তারা পর্যবেক্ষক এবং সব সময়ই তারা ভাবে, থিয়েটার তো পরিবর্তনে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু যখন দেখতে পায় তা হচ্ছে না, তখন নতুন করে লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে থাকে। এ জন্যই থিয়েটারে নতুন নতুন শক্তি এসে যুক্ত হয়। থিয়েটারের লোকদের মধ্যে হতাশা ও প্রেরণা নিত্যসঙ্গী। এই প্রেরণা থেকেই তাদের নিত্যনতুনের আবাহন। ‘টিনের তলোয়ার’-এর পঞ্চাশ বছর আর আমাদের সমাগত পঞ্চাশ বছরের সব সৈনিককে জানাই ‘টিনের তলোয়ার’-এর অভিবাদন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৬ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৬ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৬ ঘণ্টা আগে