জাহীদ রেজা নূর
এক প্যাকেট বেনসন সিগারেটের দাম কত? এক কেজি চালের দাম কত? চা-শ্রমিকদের মজুরি কত?
প্রথম প্রশ্নটি তাঁদের উদ্দেশে, যাঁরা ভাত খাওয়ার আগে-পরে নেশায় পড়ে সিগারেট খান। দ্বিতীয় প্রশ্নটি এ দেশের ভাতপ্রেমী মানুষের জন্য (কেউ যদি বার্গার অথবা পাস্তা পছন্দ করে থাকেন, কিংবা খেজুর, তবে তাঁরা এই প্রশ্ন থেকে অব্যাহতি পাবেন)। তৃতীয় প্রশ্নটি সবার জন্য, কারণ প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্টরা দিতে পারলেও তৃতীয় প্রশ্নটি উন্মুক্ত হওয়ায় যে কেউ উত্তর দেওয়ার আগে হোঁচট খাবেন। আদতেই চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হওয়ার আগে অনেকেই জানতেন না, ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি আর কিছুটা রেশনের বিনিময়ে চা-শ্রমিকেরা কাটিয়ে দেন তাঁদের জীবন।
চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলার আগে নিজ পর্যবেক্ষণের কিছু কথা বলে নিতে চাই। খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুরে জুট মিলগুলো গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত যেভাবে চলছিল, তা ব্রিটিশ রাজের বিলাসিতার কথাই মনে করিয়ে দিত। এরপর কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি না, জানি না। সে সময় পর্যন্ত পাটে লোকসান হচ্ছিল, কিন্তু কর্মকর্তাদের জীবনধারায় আভিজাত্যের কমতি ছিল না। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকবার খুলনার কয়েকটি পাটকল কারখানায় আতিথ্য গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তখন কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে বিশাল ব্যবধান আমি নিজের চোখে দেখেছি। কর্মকর্তারা আক্ষরিক অর্থেই থাকতেন রাজার হালে। কারখানার মধ্যে যে বাড়িগুলোতে তাঁরা থাকতেন, সেগুলোয় যে বিলাসব্যসন ছিল, সেটা কারখানার শ্রমিকেরা কেবল দূর থেকে দেখতে পেতেন। শ্রমিকেরা দল বেঁধে থাকতেন একেবারে বস্তিবাসীর মতো। যাঁদের শ্রমে তৈরি হতো পাটজাত দ্রব্য, তাঁদের জীবনযাত্রার মান ছিল অবর্ণনীয়।
চা-শ্রমিকদের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ পাটকলশ্রমিকদের কথা তুলে আনার কারণ আছে। সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছি। বাংলাদেশে পর্যটনের জন্য যে মোহনীয় অঞ্চলগুলো আছে, তার মধ্যে সিলেট অন্যতম। প্রথমবার যখন শ্রীমঙ্গলের ওপর দিয়ে মৌলভীবাজারের দিকে গিয়েছি, মনে হয়েছে এ রকম নয়নাভিরাম প্রকৃতি কি সত্যিই আমাদের দেশের? প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা যে কারও থেকে পিছিয়ে নেই, তার অন্যতম প্রমাণ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। সেখানেই কয়েকটি চা-বাগানে যাওয়ার সৌভাগ্য এবং চা-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তখনই কেবল বুঝতে পেরেছিলাম, পাটকলশ্রমিকদের চেয়েও অনেক অনেক মানবেতর জীবন যাপন করেন চা-শ্রমিকেরা। তাঁদের চেহারায় দারিদ্র্য যেন লেপ্টে আছে। পোশাকে-আশাকে, স্বাস্থ্যতে, চোখের ভাষায় একটা ক্লান্তি। প্রশ্ন করে জেনেছি, যে মজুরি তাঁরা পান, তা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব ব্যাপার। সন্তানসহ চারজনের সংসার হলে কোনো কোনো বেলা উপোস থাকা তাঁদের নিয়তি। তখন সিগারেট খেতাম। চা-শ্রমিকের হাতে একটা বেনসন সিগারেট ধরিয়ে দেওয়ায় তিনি অবাক হয়ে সেই সিগারেটের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন, তারপর কানে গুঁজে রেখেছেন। কোনো এক বেলায় পেটে খাবার জুটলে জুত করে খাবেন। মাংস খাওয়া হয় কি না, সে কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি এমনভাবে তাকিয়েছিলেন আমাদের দিকে যে আমরা বিব্রত হয়েছিলাম। যেন আমার প্রশ্নটি ছিল অন্য কোনো ভাষায়। তারপর তিনি যেন স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারলেন, বছরে দু-একবার কোনো উৎসবে কেউ মাংস দিলে খান। মাঝে মাঝে পুকুর বা খাল থেকে ছোট মাছ ধরে খান। দারুণ সুস্বাদু!
সম্পদ বণ্টনে অসাম্যের কথা শুধু মার্ক্স বলে গেছেন, এমন নয়। চোখ থাকলে আমরা আমাদের আশপাশেই সেই অসাম্য দেখতে পাই। এখনো শ্রমিক শোষণের সেই উপনিবেশীয় ধারা আমাদের দেশেই প্রবল প্রতাপে বহমান। চা-শ্রমিকদের দৈনিক আয়, রেশন ইত্যাদি যোগ করার পরও যে চিত্রটি প্রকাশিত হয়, সেটি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। যে শিল্প আমাদের জন্য এনে দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, সেই পোশাক তৈরির কারখানায় অংশ নেওয়া শ্রমিকের জীবন কতটা নাজুক, সে কথাও দেশবাসী জানে। ভাবার বিষয়, আমরা আসলে রপ্তানির জন্য ‘সেলাই-দিদিমণি’ হয়েছি শুধু। কাঁচামাল আসে বাইরে থেকে, আমাদের এখানে তৈরির কাজটা হয়, তারপর তা আবার চলে যায় ভিনদেশে। আমাদের কাজ শুধু ডিজাইন অনুযায়ী সেলাই করে দেওয়া। ভিনদেশের মানুষ আমাদের শ্রমিকদের তৈরি পোশাক পরেন। কিন্তু এই শিল্পের কাঁচামাল আমাদের এখানে তৈরি হবে, আমরাই বানাব, আমরাই রপ্তানি করব—এই অভিপ্রায় আমাদের জাগেনি কখনো। আমরা বিদেশি ক্রেতাদের মুখাপেক্ষী হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছি। চেয়েছি, বিদেশি কইয়ের তেলে কই ভাজতে। নিজের কই উৎপাদন করার ইচ্ছে আর জাগেনি আমাদের।
মুখে সাম্যের কথা বললেও শ্রেণিবিভাজিত সমাজে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন করার সময় আমরা বিদেশি শাসকদের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করেছি, কিন্তু আমরা আমাদের মগজে ধারণ করেছি উপনিবেশবাদ, চলায়-বলায় বেছে নিয়েছি উপনিবেশবাদ। আমাদের সরকারি অফিসে বড় কর্তার চেয়ারগুলোও হয় রাজকীয়, সেটা কি খেয়াল করেছেন? সাধারণ একটি কাজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যে ঢিলেমি লক্ষ করা যায়, ফাইল নাড়াতে হলে যে মেহনত করতে হয়, সেটা আসলে স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়। নিজেকে শাসক আর দেশবাসীকে তাদের প্রজা ভাবতে ভালোবাসেন আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে আরও বর্ণহীন চা-শ্রমিকদের অবস্থা কী হতে পারে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চা-শ্রমিকেরা যে মজুরি ও যে রেশন পান, তা যে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য অপ্রতুল, সে কথা জানে সবাই, কিন্তু মানে না। ১২০ টাকায় (বা ১৪৫ টাকা) এ যুগে কী হয়? এই চা-শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব যাঁদের ওপর, তাঁরা তাঁদের বাড়িতে কর্মরত পরিচারক বা পরিচারিকাকে কত টাকা বেতন দেন? তাঁদের সন্তানের জন্য মাসে কত টাকা ব্যয় হয়? তাঁদের মাসিক বাজার খরচ কত? যদি সিগারেটের নেশা থেকে থাকে, তাহলে এক প্যাকেট বেনসন, ফাইভ ফিফটি ফাইভ বা গোল্ড লিফ সিগারেটের দাম কত? দিনে কটা সিগারেট খান তাঁরা?
কথাগুলো বলা হলো শুধু চা-শ্রমিকের সঙ্গে অন্যদের জীবনযাত্রার দূরত্ব বোঝানোর জন্য এবং এ কথা বলার জন্য যে চা-শ্রমিকদের বিভীষিকাময় জীবনের বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই বলে আমরা মনে করতে পারি, এভাবেও এ রকম মজুরিতে জীবন চালিয়ে নেওয়া যায় নিশ্চয়ই। কেউ বলতে পারি, হাতে বেশি টাকা দেওয়া হলে নেশা করেই উড়িয়ে দেবে ওরা, তার চেয়ে কম টাকা দেওয়া ভালো। এ রকম কথার কোনো উত্তর হয় না। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হলে ন্যূনতম মানবিক হতে হবে। নইলে কথার তোড়ে হাতি-ঘোড়া মারা যাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে চা-শ্রমিকদের জীবনের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না।
রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। নিজের আনন্দের জন্য রানী পুড়িয়ে দেন গরিব মানুষের কুঁড়ে। রানীকে সাধারণ মানুষের পোশাক পরিয়ে রাজা বলেন, ‘এক প্রহরের লীলায় তোমার/যে ক’টি কুটির হল ছারখার/যত দিনে পার সে-ক’টি আবার/গড়ি দিতে হবে তোমারে...’। জীবনের মানে বুঝিয়ে দেওয়াটাই রয়েছে এই কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে। আমরা চা-শ্রমিকদের ভাগ্যনিয়ন্তা যাঁরা, তাঁদের বলতে পারি না যে একবার সেই জীবনযাপন করে দেখুন, বুঝতে পারবেন শ্রমিকদের মর্মবেদনা। কিন্তু এ কথা তো বলতে পারি, আপনারা অনায়াসে চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে যে নির্মম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন, তা মনুষ্যত্বের প্রতি অবমাননাকর।
কবে কখন চীন-ব্রিটেন সম্পর্ক খারাপ হলো, এ দেশে চা-বাগান গড়ে তোলা হলো, মালিনীছড়ার পথ ধরে বৃহত্তর সিলেটে শুরু হলো চায়ের জয়গান, অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোভ দেখিয়ে মানুষ এনে বাগানে শ্রমিক বানানো হলো, এসব খবর গুগল ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। সে আলোচনায় যাব না। শুধু বলব, আপনি যদি চা-শ্রমিকদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়েই থাকেন এবং সিগারেট হয়ে থাকে আপনার নেশা, তাহলে চা-শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণের আগে সিগারেটে টান দিয়েই নাহয় ভাবেন, এক প্যাকেট সিগারেটের পেছনে আপনার দৈনিক খরচ কত। আর যদি সিগারেটের নেশা না থাকে আপনার, তাহলে এক কেজি চাল কিনতে কত টাকা লাগে, তার সঙ্গে একটি পরিবারকে চালানোর জন্য ন্যূনতম খরচ কত, সে হিসাব কষে আপনি অন্যের ভাগ্য নির্ধারণ করতে বসুন। আপনার সুবিবেচিত সিদ্ধান্তই পাল্টে দিতে পারে চা-শ্রমিকদের জীবন।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এক প্যাকেট বেনসন সিগারেটের দাম কত? এক কেজি চালের দাম কত? চা-শ্রমিকদের মজুরি কত?
প্রথম প্রশ্নটি তাঁদের উদ্দেশে, যাঁরা ভাত খাওয়ার আগে-পরে নেশায় পড়ে সিগারেট খান। দ্বিতীয় প্রশ্নটি এ দেশের ভাতপ্রেমী মানুষের জন্য (কেউ যদি বার্গার অথবা পাস্তা পছন্দ করে থাকেন, কিংবা খেজুর, তবে তাঁরা এই প্রশ্ন থেকে অব্যাহতি পাবেন)। তৃতীয় প্রশ্নটি সবার জন্য, কারণ প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্টরা দিতে পারলেও তৃতীয় প্রশ্নটি উন্মুক্ত হওয়ায় যে কেউ উত্তর দেওয়ার আগে হোঁচট খাবেন। আদতেই চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হওয়ার আগে অনেকেই জানতেন না, ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি আর কিছুটা রেশনের বিনিময়ে চা-শ্রমিকেরা কাটিয়ে দেন তাঁদের জীবন।
চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলার আগে নিজ পর্যবেক্ষণের কিছু কথা বলে নিতে চাই। খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুরে জুট মিলগুলো গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত যেভাবে চলছিল, তা ব্রিটিশ রাজের বিলাসিতার কথাই মনে করিয়ে দিত। এরপর কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি না, জানি না। সে সময় পর্যন্ত পাটে লোকসান হচ্ছিল, কিন্তু কর্মকর্তাদের জীবনধারায় আভিজাত্যের কমতি ছিল না। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকবার খুলনার কয়েকটি পাটকল কারখানায় আতিথ্য গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তখন কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে বিশাল ব্যবধান আমি নিজের চোখে দেখেছি। কর্মকর্তারা আক্ষরিক অর্থেই থাকতেন রাজার হালে। কারখানার মধ্যে যে বাড়িগুলোতে তাঁরা থাকতেন, সেগুলোয় যে বিলাসব্যসন ছিল, সেটা কারখানার শ্রমিকেরা কেবল দূর থেকে দেখতে পেতেন। শ্রমিকেরা দল বেঁধে থাকতেন একেবারে বস্তিবাসীর মতো। যাঁদের শ্রমে তৈরি হতো পাটজাত দ্রব্য, তাঁদের জীবনযাত্রার মান ছিল অবর্ণনীয়।
চা-শ্রমিকদের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ পাটকলশ্রমিকদের কথা তুলে আনার কারণ আছে। সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছি। বাংলাদেশে পর্যটনের জন্য যে মোহনীয় অঞ্চলগুলো আছে, তার মধ্যে সিলেট অন্যতম। প্রথমবার যখন শ্রীমঙ্গলের ওপর দিয়ে মৌলভীবাজারের দিকে গিয়েছি, মনে হয়েছে এ রকম নয়নাভিরাম প্রকৃতি কি সত্যিই আমাদের দেশের? প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা যে কারও থেকে পিছিয়ে নেই, তার অন্যতম প্রমাণ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। সেখানেই কয়েকটি চা-বাগানে যাওয়ার সৌভাগ্য এবং চা-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তখনই কেবল বুঝতে পেরেছিলাম, পাটকলশ্রমিকদের চেয়েও অনেক অনেক মানবেতর জীবন যাপন করেন চা-শ্রমিকেরা। তাঁদের চেহারায় দারিদ্র্য যেন লেপ্টে আছে। পোশাকে-আশাকে, স্বাস্থ্যতে, চোখের ভাষায় একটা ক্লান্তি। প্রশ্ন করে জেনেছি, যে মজুরি তাঁরা পান, তা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব ব্যাপার। সন্তানসহ চারজনের সংসার হলে কোনো কোনো বেলা উপোস থাকা তাঁদের নিয়তি। তখন সিগারেট খেতাম। চা-শ্রমিকের হাতে একটা বেনসন সিগারেট ধরিয়ে দেওয়ায় তিনি অবাক হয়ে সেই সিগারেটের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন, তারপর কানে গুঁজে রেখেছেন। কোনো এক বেলায় পেটে খাবার জুটলে জুত করে খাবেন। মাংস খাওয়া হয় কি না, সে কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি এমনভাবে তাকিয়েছিলেন আমাদের দিকে যে আমরা বিব্রত হয়েছিলাম। যেন আমার প্রশ্নটি ছিল অন্য কোনো ভাষায়। তারপর তিনি যেন স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারলেন, বছরে দু-একবার কোনো উৎসবে কেউ মাংস দিলে খান। মাঝে মাঝে পুকুর বা খাল থেকে ছোট মাছ ধরে খান। দারুণ সুস্বাদু!
সম্পদ বণ্টনে অসাম্যের কথা শুধু মার্ক্স বলে গেছেন, এমন নয়। চোখ থাকলে আমরা আমাদের আশপাশেই সেই অসাম্য দেখতে পাই। এখনো শ্রমিক শোষণের সেই উপনিবেশীয় ধারা আমাদের দেশেই প্রবল প্রতাপে বহমান। চা-শ্রমিকদের দৈনিক আয়, রেশন ইত্যাদি যোগ করার পরও যে চিত্রটি প্রকাশিত হয়, সেটি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। যে শিল্প আমাদের জন্য এনে দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, সেই পোশাক তৈরির কারখানায় অংশ নেওয়া শ্রমিকের জীবন কতটা নাজুক, সে কথাও দেশবাসী জানে। ভাবার বিষয়, আমরা আসলে রপ্তানির জন্য ‘সেলাই-দিদিমণি’ হয়েছি শুধু। কাঁচামাল আসে বাইরে থেকে, আমাদের এখানে তৈরির কাজটা হয়, তারপর তা আবার চলে যায় ভিনদেশে। আমাদের কাজ শুধু ডিজাইন অনুযায়ী সেলাই করে দেওয়া। ভিনদেশের মানুষ আমাদের শ্রমিকদের তৈরি পোশাক পরেন। কিন্তু এই শিল্পের কাঁচামাল আমাদের এখানে তৈরি হবে, আমরাই বানাব, আমরাই রপ্তানি করব—এই অভিপ্রায় আমাদের জাগেনি কখনো। আমরা বিদেশি ক্রেতাদের মুখাপেক্ষী হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছি। চেয়েছি, বিদেশি কইয়ের তেলে কই ভাজতে। নিজের কই উৎপাদন করার ইচ্ছে আর জাগেনি আমাদের।
মুখে সাম্যের কথা বললেও শ্রেণিবিভাজিত সমাজে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন করার সময় আমরা বিদেশি শাসকদের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করেছি, কিন্তু আমরা আমাদের মগজে ধারণ করেছি উপনিবেশবাদ, চলায়-বলায় বেছে নিয়েছি উপনিবেশবাদ। আমাদের সরকারি অফিসে বড় কর্তার চেয়ারগুলোও হয় রাজকীয়, সেটা কি খেয়াল করেছেন? সাধারণ একটি কাজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যে ঢিলেমি লক্ষ করা যায়, ফাইল নাড়াতে হলে যে মেহনত করতে হয়, সেটা আসলে স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়। নিজেকে শাসক আর দেশবাসীকে তাদের প্রজা ভাবতে ভালোবাসেন আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে আরও বর্ণহীন চা-শ্রমিকদের অবস্থা কী হতে পারে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চা-শ্রমিকেরা যে মজুরি ও যে রেশন পান, তা যে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য অপ্রতুল, সে কথা জানে সবাই, কিন্তু মানে না। ১২০ টাকায় (বা ১৪৫ টাকা) এ যুগে কী হয়? এই চা-শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব যাঁদের ওপর, তাঁরা তাঁদের বাড়িতে কর্মরত পরিচারক বা পরিচারিকাকে কত টাকা বেতন দেন? তাঁদের সন্তানের জন্য মাসে কত টাকা ব্যয় হয়? তাঁদের মাসিক বাজার খরচ কত? যদি সিগারেটের নেশা থেকে থাকে, তাহলে এক প্যাকেট বেনসন, ফাইভ ফিফটি ফাইভ বা গোল্ড লিফ সিগারেটের দাম কত? দিনে কটা সিগারেট খান তাঁরা?
কথাগুলো বলা হলো শুধু চা-শ্রমিকের সঙ্গে অন্যদের জীবনযাত্রার দূরত্ব বোঝানোর জন্য এবং এ কথা বলার জন্য যে চা-শ্রমিকদের বিভীষিকাময় জীবনের বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই বলে আমরা মনে করতে পারি, এভাবেও এ রকম মজুরিতে জীবন চালিয়ে নেওয়া যায় নিশ্চয়ই। কেউ বলতে পারি, হাতে বেশি টাকা দেওয়া হলে নেশা করেই উড়িয়ে দেবে ওরা, তার চেয়ে কম টাকা দেওয়া ভালো। এ রকম কথার কোনো উত্তর হয় না। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হলে ন্যূনতম মানবিক হতে হবে। নইলে কথার তোড়ে হাতি-ঘোড়া মারা যাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে চা-শ্রমিকদের জীবনের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না।
রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। নিজের আনন্দের জন্য রানী পুড়িয়ে দেন গরিব মানুষের কুঁড়ে। রানীকে সাধারণ মানুষের পোশাক পরিয়ে রাজা বলেন, ‘এক প্রহরের লীলায় তোমার/যে ক’টি কুটির হল ছারখার/যত দিনে পার সে-ক’টি আবার/গড়ি দিতে হবে তোমারে...’। জীবনের মানে বুঝিয়ে দেওয়াটাই রয়েছে এই কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে। আমরা চা-শ্রমিকদের ভাগ্যনিয়ন্তা যাঁরা, তাঁদের বলতে পারি না যে একবার সেই জীবনযাপন করে দেখুন, বুঝতে পারবেন শ্রমিকদের মর্মবেদনা। কিন্তু এ কথা তো বলতে পারি, আপনারা অনায়াসে চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে যে নির্মম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন, তা মনুষ্যত্বের প্রতি অবমাননাকর।
কবে কখন চীন-ব্রিটেন সম্পর্ক খারাপ হলো, এ দেশে চা-বাগান গড়ে তোলা হলো, মালিনীছড়ার পথ ধরে বৃহত্তর সিলেটে শুরু হলো চায়ের জয়গান, অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোভ দেখিয়ে মানুষ এনে বাগানে শ্রমিক বানানো হলো, এসব খবর গুগল ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। সে আলোচনায় যাব না। শুধু বলব, আপনি যদি চা-শ্রমিকদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়েই থাকেন এবং সিগারেট হয়ে থাকে আপনার নেশা, তাহলে চা-শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণের আগে সিগারেটে টান দিয়েই নাহয় ভাবেন, এক প্যাকেট সিগারেটের পেছনে আপনার দৈনিক খরচ কত। আর যদি সিগারেটের নেশা না থাকে আপনার, তাহলে এক কেজি চাল কিনতে কত টাকা লাগে, তার সঙ্গে একটি পরিবারকে চালানোর জন্য ন্যূনতম খরচ কত, সে হিসাব কষে আপনি অন্যের ভাগ্য নির্ধারণ করতে বসুন। আপনার সুবিবেচিত সিদ্ধান্তই পাল্টে দিতে পারে চা-শ্রমিকদের জীবন।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১৪ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১৫ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১৫ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১৫ ঘণ্টা আগে