বিভুরঞ্জন সরকার
২৫ এপ্রিল সকালে ১৫ দিনের বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়েছেন। তিনি প্রথমে জাপান, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং শেষে যুক্তরাজ্যে যাবেন। এই সফরে যাওয়ার আগের দিন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নিয়ে ‘ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের’ নীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের আগে আকস্মিকভাবে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ রূপরেখা ঘোষণাকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, ভৌগোলিক বাস্তবতায় ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশ্ব রাজনীতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশকে কাছে বা পাশে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্নমুখী তৎপরতা চালালেও বাংলাদেশ কারও প্রতি ঝুঁকে পড়ার নীতি না নিয়ে যে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে—তা প্রশংসাযোগ্য।
তবে জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তো ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে, তার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। আর সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাঁবেদারি করে; পদলেহন করে।’ ভোটের আগে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রকাশ্য তৎপরতা যখন দৃশ্যমান, তখন প্রধানমন্ত্রী কেন আমেরিকা নিয়ে কড়া কথা বললেন, তা নিয়ে কৌতূহল দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক।
একবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকায় যখন প্রথমবার যাই, সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সাথে আমার মিটিং হয়েছিল। বলেছিলাম, আমি একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সে দেশটি হচ্ছে গভর্মেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল। আমি বলেছিলাম, আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। এটা যখন পার হয়ে যায়, তখন কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিকটেটরকে সমর্থন দিচ্ছেন, আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকেও আমি বলি যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের সবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ, তারা যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারেন, পাল্টাতে পারেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো তো আরও বেশি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অ্যারাব স্প্রিং (আরব বসন্ত), ডেমোক্রেসি বলে বলে, সমস্ত ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্যাঁচে পড়ে গেছেন। যত দিন ইসলামিক কান্ট্রিগুলোর ওপর চলছিল, তত দিন কিছু হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে এখন সারা বিশ্বই আজকে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে গেছে, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় অস্ত্র নিয়ে স্কুলে ঢুকে যায়। বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করছে। শিক্ষকদের হত্যা করছে। শপিং মলে ঢুকে যাচ্ছে। হত্যা করছে। ক্লাবে যাচ্ছে সেখানে হত্যা করছে—এটা প্রতিনিয়ত, প্রতিদিনেরই ব্যাপার। কোনো না কোনো রাজ্যে অনবরত এই ঘটনা ঘটছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ আগস্টে যারা হত্যা করেছে, সেই খুনি রাশেদ (রাশেদ চৌধুরী) আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সেখানে যত প্রেসিডেন্ট এসেছে, সকলের কাছে আমি আবেদন করেছি। আইনগতভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আমরা ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি যে এই খুনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাকে আপনারা আশ্রয় দেবেন না। শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী, মন্ত্রীর হত্যাকারী। এটা মানবতা লঙ্ঘনকারী। এদেরকে আপনারা আশ্রয় দিয়েন না। ফেরত দেন। কই তারা তো তাকে ফেরত দিচ্ছে না। খুনিদেরকে লালন-পালন করেই রেখে দিচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে রাগ-ক্ষোভের মিশেল থাকলেও তিনি একেবারে যুক্তিহীন বা আবেগনির্ভর কথা বলেছেন, সেটা কেউ বলতে পারবেন না। নির্বাচনের আগে কয়েকটি ইস্যু সামনে এনে আমেরিকা যখন বাংলাদেশকে চাপে রেখে সুবিধা নিতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশটি সম্পর্কে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে হিম্মতের পরিচয় দিয়েছেন নাকি ঝুঁকি নিয়েছেন, সে প্রশ্নও উঠছে।
তবে ‘আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে’ বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাঁর সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে আপত্তি আছে কারও কারও। তাঁদের যুক্তি—আমেরিকা চাইলেই সব কিছু ওলট-পালট করে দিতে পারে না, তার বড় প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি, তাদের সপ্তম নৌবহরের ভয়ও কাজ করেনি।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় অনেক দেশে সরকার পরিবর্তনের নজিরও আছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরও শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে এক দেশকে গ্যাস দিতে রাজি না হওয়ায়; যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাঁর দলের হার হয়েছে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ভিন্নতর ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কেউ বলতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাতেই যদি সব হয়ে যায়, তাহলে তো প্রশ্ন আসবে যে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে ধারাবাহিকভাবে এত উন্নয়ন করার পরও কি তা আগামী নির্বাচনে কোনো কাজে না আসতে পারে বলে শেখ হাসিনা মনে করছেন? শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই কি সবকিছু ওলট-পালট হওয়া নির্ভর করবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে, যেখানে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যও যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব কখন থাকে না? আমরা জানি, তেমন পরিস্থিতি হয় সেনাশাসনে। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো পদক্ষেপে সহায়তা করবে, তেমন কোনো তথ্য কি সরকারপ্রধানের কাছে আছে? কোনো কিছু আঁচ না করে থাকলে প্রধানমন্ত্রী এমন ইঙ্গিতবহ কথা বলবেনই-বা কেন? সেনাশাসন ছাড়া গণতন্ত্রের অস্তিত্ব হরণকারী কেমন সরকার হতে পারে? সেটা কি আবার সেনানির্দেশিত এক/এগারো সরকারের মতো কিছু? তেমন কোনো আভাস কি আছে? আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে বা থাকে তার চেয়ে ঢের বেশি তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকাই স্বাভাবিক।
‘নির্বাচন’ ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ কোনো শক্তি বা দেশের প্রভাবে সরকার গঠনের চেষ্টা হলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন হবে। আমাদের ভোটের দুবর্লতা থেকে থাকতে পারে, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ না হতে পারে, রাতের ভোটের অপবাদ থাকতে পারে, ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটের সমালোচনা হতে পারে, ২০১৪ সালের বিনা ভোটে ১৫৩ আসনে নির্বাচিত হওয়ার বদনাম থাকতে পারে, কিন্তু তারপরও তো ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর’ মতো আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নির্বাচনের ধারায়ই চলছি। প্রধানমন্ত্রীর সংশয় অনুযায়ী সেটাও কি চলে যাবে?
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে কেউ ভাবতে পারেন যে আমাদের দেশের জনগণের ভোটে কখনো সরকার পরিবর্তন হয় না, যা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়! প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি তত্ত্বাবধায়ক আমলের নির্বাচনগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় সরকার পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে? যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, তখনো যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়, যখন বিএনপি এসেছে তখনো যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়?
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণের নানামুখী তৎপরতা যেমন চলবে, তেমনি দেশের বাইরে থেকেও নানা ধরনের তৎপরতা চলাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। নির্বাচনে ‘বিদেশি প্রভাবের’ বিষয়টি আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার প্রভাব খাটানোর কথা কি শোনা যায়নি? দীর্ঘ সময় ধরে সরকার চালিয়ে অভিজ্ঞতা কম হয়নি শেখ হাসিনার। তাঁকে বিএনপি এক কথায় নাকচ করে দিলেও বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি এখন আর হেলাফেলার অবস্থানে নেই। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি নিয়ে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তাঁদের অতীতের কোনো গণনা ফলেছিল, তা কি কেউ বলতে পারেন? নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে আগাম কথা না বলে বরং দেখতে থাকা ভালো যে আগামী কয় মাসে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। শেখ হাসিনা তিন দেশ সফর করে দেশে ফিরুন, পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন শেষ হোক, বিএনপির ঈদের পরের আন্দোলন শুরু হোক—তারপর না হয় রাজনৈতিক গণকদের শরণাপন্ন হওয়া যাবে।
‘সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে কয়েক বছর ধরে কৌশলের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। আমেরিকা-চীন-ভারত-রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ সব দেশেরই আলাদা আলাদা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। বৃহৎ শক্তির নোংরা প্রতিযোগিতার মধ্যেও বাংলাদেশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল নিয়ে যে রূপরেখা দিয়েছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। যা দেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির কার্যকর উপকরণ হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
২৫ এপ্রিল সকালে ১৫ দিনের বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়েছেন। তিনি প্রথমে জাপান, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং শেষে যুক্তরাজ্যে যাবেন। এই সফরে যাওয়ার আগের দিন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নিয়ে ‘ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের’ নীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের আগে আকস্মিকভাবে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ রূপরেখা ঘোষণাকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, ভৌগোলিক বাস্তবতায় ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশ্ব রাজনীতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশকে কাছে বা পাশে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্নমুখী তৎপরতা চালালেও বাংলাদেশ কারও প্রতি ঝুঁকে পড়ার নীতি না নিয়ে যে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে—তা প্রশংসাযোগ্য।
তবে জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তো ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে, তার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। আর সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাঁবেদারি করে; পদলেহন করে।’ ভোটের আগে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রকাশ্য তৎপরতা যখন দৃশ্যমান, তখন প্রধানমন্ত্রী কেন আমেরিকা নিয়ে কড়া কথা বললেন, তা নিয়ে কৌতূহল দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক।
একবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকায় যখন প্রথমবার যাই, সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সাথে আমার মিটিং হয়েছিল। বলেছিলাম, আমি একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সে দেশটি হচ্ছে গভর্মেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল। আমি বলেছিলাম, আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। এটা যখন পার হয়ে যায়, তখন কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিকটেটরকে সমর্থন দিচ্ছেন, আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকেও আমি বলি যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের সবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ, তারা যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারেন, পাল্টাতে পারেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো তো আরও বেশি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অ্যারাব স্প্রিং (আরব বসন্ত), ডেমোক্রেসি বলে বলে, সমস্ত ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্যাঁচে পড়ে গেছেন। যত দিন ইসলামিক কান্ট্রিগুলোর ওপর চলছিল, তত দিন কিছু হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে এখন সারা বিশ্বই আজকে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে গেছে, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় অস্ত্র নিয়ে স্কুলে ঢুকে যায়। বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করছে। শিক্ষকদের হত্যা করছে। শপিং মলে ঢুকে যাচ্ছে। হত্যা করছে। ক্লাবে যাচ্ছে সেখানে হত্যা করছে—এটা প্রতিনিয়ত, প্রতিদিনেরই ব্যাপার। কোনো না কোনো রাজ্যে অনবরত এই ঘটনা ঘটছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ আগস্টে যারা হত্যা করেছে, সেই খুনি রাশেদ (রাশেদ চৌধুরী) আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সেখানে যত প্রেসিডেন্ট এসেছে, সকলের কাছে আমি আবেদন করেছি। আইনগতভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আমরা ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি যে এই খুনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাকে আপনারা আশ্রয় দেবেন না। শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী, মন্ত্রীর হত্যাকারী। এটা মানবতা লঙ্ঘনকারী। এদেরকে আপনারা আশ্রয় দিয়েন না। ফেরত দেন। কই তারা তো তাকে ফেরত দিচ্ছে না। খুনিদেরকে লালন-পালন করেই রেখে দিচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে রাগ-ক্ষোভের মিশেল থাকলেও তিনি একেবারে যুক্তিহীন বা আবেগনির্ভর কথা বলেছেন, সেটা কেউ বলতে পারবেন না। নির্বাচনের আগে কয়েকটি ইস্যু সামনে এনে আমেরিকা যখন বাংলাদেশকে চাপে রেখে সুবিধা নিতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশটি সম্পর্কে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে হিম্মতের পরিচয় দিয়েছেন নাকি ঝুঁকি নিয়েছেন, সে প্রশ্নও উঠছে।
তবে ‘আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে’ বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাঁর সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে আপত্তি আছে কারও কারও। তাঁদের যুক্তি—আমেরিকা চাইলেই সব কিছু ওলট-পালট করে দিতে পারে না, তার বড় প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি, তাদের সপ্তম নৌবহরের ভয়ও কাজ করেনি।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় অনেক দেশে সরকার পরিবর্তনের নজিরও আছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরও শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে এক দেশকে গ্যাস দিতে রাজি না হওয়ায়; যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাঁর দলের হার হয়েছে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ভিন্নতর ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কেউ বলতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাতেই যদি সব হয়ে যায়, তাহলে তো প্রশ্ন আসবে যে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে ধারাবাহিকভাবে এত উন্নয়ন করার পরও কি তা আগামী নির্বাচনে কোনো কাজে না আসতে পারে বলে শেখ হাসিনা মনে করছেন? শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই কি সবকিছু ওলট-পালট হওয়া নির্ভর করবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে, যেখানে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যও যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব কখন থাকে না? আমরা জানি, তেমন পরিস্থিতি হয় সেনাশাসনে। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো পদক্ষেপে সহায়তা করবে, তেমন কোনো তথ্য কি সরকারপ্রধানের কাছে আছে? কোনো কিছু আঁচ না করে থাকলে প্রধানমন্ত্রী এমন ইঙ্গিতবহ কথা বলবেনই-বা কেন? সেনাশাসন ছাড়া গণতন্ত্রের অস্তিত্ব হরণকারী কেমন সরকার হতে পারে? সেটা কি আবার সেনানির্দেশিত এক/এগারো সরকারের মতো কিছু? তেমন কোনো আভাস কি আছে? আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে বা থাকে তার চেয়ে ঢের বেশি তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকাই স্বাভাবিক।
‘নির্বাচন’ ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ কোনো শক্তি বা দেশের প্রভাবে সরকার গঠনের চেষ্টা হলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন হবে। আমাদের ভোটের দুবর্লতা থেকে থাকতে পারে, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ না হতে পারে, রাতের ভোটের অপবাদ থাকতে পারে, ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটের সমালোচনা হতে পারে, ২০১৪ সালের বিনা ভোটে ১৫৩ আসনে নির্বাচিত হওয়ার বদনাম থাকতে পারে, কিন্তু তারপরও তো ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর’ মতো আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নির্বাচনের ধারায়ই চলছি। প্রধানমন্ত্রীর সংশয় অনুযায়ী সেটাও কি চলে যাবে?
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে কেউ ভাবতে পারেন যে আমাদের দেশের জনগণের ভোটে কখনো সরকার পরিবর্তন হয় না, যা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়! প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি তত্ত্বাবধায়ক আমলের নির্বাচনগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় সরকার পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে? যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, তখনো যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়, যখন বিএনপি এসেছে তখনো যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়?
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণের নানামুখী তৎপরতা যেমন চলবে, তেমনি দেশের বাইরে থেকেও নানা ধরনের তৎপরতা চলাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। নির্বাচনে ‘বিদেশি প্রভাবের’ বিষয়টি আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার প্রভাব খাটানোর কথা কি শোনা যায়নি? দীর্ঘ সময় ধরে সরকার চালিয়ে অভিজ্ঞতা কম হয়নি শেখ হাসিনার। তাঁকে বিএনপি এক কথায় নাকচ করে দিলেও বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি এখন আর হেলাফেলার অবস্থানে নেই। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি নিয়ে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তাঁদের অতীতের কোনো গণনা ফলেছিল, তা কি কেউ বলতে পারেন? নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে আগাম কথা না বলে বরং দেখতে থাকা ভালো যে আগামী কয় মাসে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। শেখ হাসিনা তিন দেশ সফর করে দেশে ফিরুন, পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন শেষ হোক, বিএনপির ঈদের পরের আন্দোলন শুরু হোক—তারপর না হয় রাজনৈতিক গণকদের শরণাপন্ন হওয়া যাবে।
‘সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে কয়েক বছর ধরে কৌশলের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। আমেরিকা-চীন-ভারত-রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ সব দেশেরই আলাদা আলাদা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। বৃহৎ শক্তির নোংরা প্রতিযোগিতার মধ্যেও বাংলাদেশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল নিয়ে যে রূপরেখা দিয়েছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। যা দেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির কার্যকর উপকরণ হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
৮ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
৮ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
৮ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
৮ ঘণ্টা আগে