আশান উজ জামান
অসীম সমুদ্র ছোটবেলায় ছিল আরও অসীম। তখন প্রায় সারা পৃথিবীই দখলে ছিল তার। মন চাইলেই সে ছুটে বেড়াত এ-মেরু থেকে সে-মেরু। কী অবাধ চঞ্চল আর উদ্দামই না ছিল সেই সব দিন! কিন্তু বয়স যত বাড়ল আর শরীরের তেজ যত কমল, ততই তাকে হটিয়ে দিয়ে মাথা তুলতে লাগল ডাঙা। ক্রমেই ছেদ পড়ল একচ্ছত্র আধিপত্যে তার।
টিকে থাকার লড়াই যদিও কম করেনি সমুদ্র, কিন্তু সময় নিষ্ঠুর বড়, পারতে দেয়নি তাকে। তবে সে হালও ছেড়ে দেয়নি একেবারে। যেখানে যতটুকু সম্ভব বাঁচিয়ে রেখেছে আশা। যেখানে যেখানে গভীরতা বেশি, ভালোবাসার গভীরতা, সেখানে সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রিয় সন্তান ছোট-বড় নদী।
যেখানে তা নেই, মাটির গহিন তলে, সেখানে সে জমিয়ে রেখেছে গোপন পানির মজুত। একেবারেই টিকতে না পেরে যেখান থেকে পালাতে হয়েছে তাকে, পানির অভাবে সেই সব জায়গায় জ্বলে গেছে মাটি; খরাপুষ্ট সেই সব এলাকা এখন বিরান মরুভূমি। সময় এগিয়েছে যত, আরও আরও এলাকা তত যোগ হয়েছে এই তালিকায়। দিকে দিকে শত্রুরাজত্ব সব। ওত পেতে আছে তারা, সুযোগ পেলেই গিলে নেবে। তা এভাবে শুকিয়ে যাওয়া আর লুকিয়ে থাকাই কি তবে ভবিতব্য তার? ডাঙার পেটে নিজের প্রায় সিকি ভাগ খুইয়ে ফেলা কারও সামনে এ-ই তো প্রশ্ন বড়। চিন্তায় ঘুম আসে না, এলেও তা ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে।
বাধ্য হয়েই সে সতর্ক করে দিয়েছে সন্তানদের। ঠিক করে দিয়েছে নদীরা কখন কত দূর যাবে, কখন আসবে। বলে দিয়েছে চলাচলের নিয়ম। ‘যত যা-ই হোক, চলতে ভুলো না বাছারা আমার, থেমে থেকো না। জানোই তো, থেমে থাকার পেটেই জেগে থাকে না-থাকার বীজ।’ নদীরাও পাড়াবেড়ানি খুব। কালো ধলো মোটা চিকন লম্বা বেঁটে সব নদীই তাই ঘুরে বেড়ায় ইচ্ছেমতো। দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায় বেয়াড়া ষাঁড়ের গতিতে। আর সীমা ছাড়িয়ে পাড় উপচে ভাসিয়ে দেয় চরাচর। একটু তারা যেন আলাভোলাও। সব ভুলে তারা মেতে থাকে নিজেদের খেয়ালে।
মায়ের কথা আর মনে থাকে না তাদের। মনে থাকে না যে থেমে থাকার পেটেই জেগে থাকে না-থাকার বীজ। ছুটে চলার হুঁশ তাই শিগ্গির হয় না। যখন হয়, তখন বেশ দেরি। এগোতে গিয়ে দেখে ফেরার পথে অগম্য বাঁধ কিংবা চর্বিজমা শিরার ভেতর গায়ের মতো জমে গেছে পলি। দূরবাসী সন্তানের এমন দুর্দশা দেখে ভীষণ কাঁদে সমুদ্র মা। জোয়ারে জোয়ারে সে পাগলের মতো ডাকে, ‘নড়ে ওঠো বাছারা, ছুটে চলো।’ দূর থেকে নদী শোনে মায়ের আকুতিভরা ডাক। নদী দেখে মায়ের উপচানো চোখ। কিন্তু হায়, চলার উপায় নেই।
চলতে না পেরে এভাবেই একসময় ঠিকানা ভোলে নদী; ভোলে তার শেকড় ও শক্তি। অলস পড়ে থাকে অথর্ব। থাকতে থাকতে আরও চর্বি জমে গায়। ঢেউ জাগে না আর, জাগে না স্রোত। শেষের গানের বিদায়ের সুর ভেসে আসছে বুঝতে পারলেই, সমুদ্র মায়ের মতোই, নিজের সন্তানদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয় সেও। কানে কানে বলে দেয়, ‘মায়ের নাম মুছে যেতে দিসনে বাছা, যে করেই হোক টিকে থাকিস। জগতে টিকে থাকার চেষ্টা করাই প্রকৃত ধর্ম।’ খালবিল আর হাওর-বাঁওড় অবশ্য মায়ের মতো না। তারা ভোলে না মায়ের কথা। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে নিজেদের মতো। নড়ে কম, সরে কম; শক্তি-সাহসও তো কম। দরকার পড়লেই মানুষ তাদের ভরাট করে ফেলে। নইলে মালিকানা বোনে, পুকুর বানায়, বেড়িবাঁধ দেয়। অথবা পড়ে থাকার ক্লেদ ও ব্যর্থতায় একসময় আপনাতেই বুজে আসে বুক। ঘর ওঠে সেখানে, চাষ জমে কিংবা মাথা তোলে ভবন বিশাল। বিশ্বাসই হতে চায় না এখানে জলের নহর ছিল অপার, ছিল স্রোতবতী অবিরাম ঢেউ।
একজন তবু মনে রাখে সব। বখে যাওয়া ছেড়ে যাওয়া মরে যাওয়া সন্তানকেও কি ভুলতে পারে মা? সমুদ্রও তাই শোক করে অবিরাম। তার কান্নার দমককে তোমরা জোয়ার বলো, কান্নাশেষের অবসন্নতাকে বলো ভাটা।
লেখক: শিক্ষক ও গল্পকার
অসীম সমুদ্র ছোটবেলায় ছিল আরও অসীম। তখন প্রায় সারা পৃথিবীই দখলে ছিল তার। মন চাইলেই সে ছুটে বেড়াত এ-মেরু থেকে সে-মেরু। কী অবাধ চঞ্চল আর উদ্দামই না ছিল সেই সব দিন! কিন্তু বয়স যত বাড়ল আর শরীরের তেজ যত কমল, ততই তাকে হটিয়ে দিয়ে মাথা তুলতে লাগল ডাঙা। ক্রমেই ছেদ পড়ল একচ্ছত্র আধিপত্যে তার।
টিকে থাকার লড়াই যদিও কম করেনি সমুদ্র, কিন্তু সময় নিষ্ঠুর বড়, পারতে দেয়নি তাকে। তবে সে হালও ছেড়ে দেয়নি একেবারে। যেখানে যতটুকু সম্ভব বাঁচিয়ে রেখেছে আশা। যেখানে যেখানে গভীরতা বেশি, ভালোবাসার গভীরতা, সেখানে সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রিয় সন্তান ছোট-বড় নদী।
যেখানে তা নেই, মাটির গহিন তলে, সেখানে সে জমিয়ে রেখেছে গোপন পানির মজুত। একেবারেই টিকতে না পেরে যেখান থেকে পালাতে হয়েছে তাকে, পানির অভাবে সেই সব জায়গায় জ্বলে গেছে মাটি; খরাপুষ্ট সেই সব এলাকা এখন বিরান মরুভূমি। সময় এগিয়েছে যত, আরও আরও এলাকা তত যোগ হয়েছে এই তালিকায়। দিকে দিকে শত্রুরাজত্ব সব। ওত পেতে আছে তারা, সুযোগ পেলেই গিলে নেবে। তা এভাবে শুকিয়ে যাওয়া আর লুকিয়ে থাকাই কি তবে ভবিতব্য তার? ডাঙার পেটে নিজের প্রায় সিকি ভাগ খুইয়ে ফেলা কারও সামনে এ-ই তো প্রশ্ন বড়। চিন্তায় ঘুম আসে না, এলেও তা ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে।
বাধ্য হয়েই সে সতর্ক করে দিয়েছে সন্তানদের। ঠিক করে দিয়েছে নদীরা কখন কত দূর যাবে, কখন আসবে। বলে দিয়েছে চলাচলের নিয়ম। ‘যত যা-ই হোক, চলতে ভুলো না বাছারা আমার, থেমে থেকো না। জানোই তো, থেমে থাকার পেটেই জেগে থাকে না-থাকার বীজ।’ নদীরাও পাড়াবেড়ানি খুব। কালো ধলো মোটা চিকন লম্বা বেঁটে সব নদীই তাই ঘুরে বেড়ায় ইচ্ছেমতো। দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায় বেয়াড়া ষাঁড়ের গতিতে। আর সীমা ছাড়িয়ে পাড় উপচে ভাসিয়ে দেয় চরাচর। একটু তারা যেন আলাভোলাও। সব ভুলে তারা মেতে থাকে নিজেদের খেয়ালে।
মায়ের কথা আর মনে থাকে না তাদের। মনে থাকে না যে থেমে থাকার পেটেই জেগে থাকে না-থাকার বীজ। ছুটে চলার হুঁশ তাই শিগ্গির হয় না। যখন হয়, তখন বেশ দেরি। এগোতে গিয়ে দেখে ফেরার পথে অগম্য বাঁধ কিংবা চর্বিজমা শিরার ভেতর গায়ের মতো জমে গেছে পলি। দূরবাসী সন্তানের এমন দুর্দশা দেখে ভীষণ কাঁদে সমুদ্র মা। জোয়ারে জোয়ারে সে পাগলের মতো ডাকে, ‘নড়ে ওঠো বাছারা, ছুটে চলো।’ দূর থেকে নদী শোনে মায়ের আকুতিভরা ডাক। নদী দেখে মায়ের উপচানো চোখ। কিন্তু হায়, চলার উপায় নেই।
চলতে না পেরে এভাবেই একসময় ঠিকানা ভোলে নদী; ভোলে তার শেকড় ও শক্তি। অলস পড়ে থাকে অথর্ব। থাকতে থাকতে আরও চর্বি জমে গায়। ঢেউ জাগে না আর, জাগে না স্রোত। শেষের গানের বিদায়ের সুর ভেসে আসছে বুঝতে পারলেই, সমুদ্র মায়ের মতোই, নিজের সন্তানদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয় সেও। কানে কানে বলে দেয়, ‘মায়ের নাম মুছে যেতে দিসনে বাছা, যে করেই হোক টিকে থাকিস। জগতে টিকে থাকার চেষ্টা করাই প্রকৃত ধর্ম।’ খালবিল আর হাওর-বাঁওড় অবশ্য মায়ের মতো না। তারা ভোলে না মায়ের কথা। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে নিজেদের মতো। নড়ে কম, সরে কম; শক্তি-সাহসও তো কম। দরকার পড়লেই মানুষ তাদের ভরাট করে ফেলে। নইলে মালিকানা বোনে, পুকুর বানায়, বেড়িবাঁধ দেয়। অথবা পড়ে থাকার ক্লেদ ও ব্যর্থতায় একসময় আপনাতেই বুজে আসে বুক। ঘর ওঠে সেখানে, চাষ জমে কিংবা মাথা তোলে ভবন বিশাল। বিশ্বাসই হতে চায় না এখানে জলের নহর ছিল অপার, ছিল স্রোতবতী অবিরাম ঢেউ।
একজন তবু মনে রাখে সব। বখে যাওয়া ছেড়ে যাওয়া মরে যাওয়া সন্তানকেও কি ভুলতে পারে মা? সমুদ্রও তাই শোক করে অবিরাম। তার কান্নার দমককে তোমরা জোয়ার বলো, কান্নাশেষের অবসন্নতাকে বলো ভাটা।
লেখক: শিক্ষক ও গল্পকার
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২১ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২১ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১ দিন আগে