বিভুরঞ্জন সরকার
কত দিন থেকে তিনি আর টেলিফোন করেন না। আমার কোনো লেখা পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান না। বলেন না, চিনতে পারছেন, আমি মোজাফফর, কুঁড়েঘর। অথবা আমার নাম মোজাফফর আহমেদ নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি। হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক প্রবাদপ্রতিম নাম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ নিজেকে এভাবেই পরিচিত করতেন। তিনি কথা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে। কখনো থাকত প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালি।
তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কোপন্থী বলে পরিচিত)-ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের একটি বিশেষ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে একমাত্র তিনি জীবিত ছিলেন। অন্যদের মৃত্যু হয়েছে আরও আগে, বিভিন্ন সময়ে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৭৩ সালে ঢাকা আসার পর। আমি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে কখনো সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। কিন্তু তাঁর কথা শোনার জন্য মাঝেমধ্যে তাঁর কাকরাইলের বাসায় কিংবা তোপখানা রোডে ন্যাপ অফিসে গিয়েছি।
আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি, কমিউনিস্ট কর্মী—সেটা তিনি জানতেন। তারপরও আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখায় তিনি আমাকে একটু বাড়তি স্নেহ করতেন। বলতেন, তোমরা আমার অফিসের (তোপখানা রোড) সামনে দিয়া সিপিবি অফিসে (পুরানা পল্টন) যাও। এখানে নাইমা একটু জিরাইয়া, একটু চা-বিস্কুটও তো খাইয়া যাইতে পারো।
তিনি অনেক মজার মজার কথা বলতেন। জানতেনও অনেক কিছু। তাঁর কথা শুনতে ভালো লাগত বলে আমি তাঁর বাসায় বা অফিসে যেতাম দেখে তিনি খুশি হতেন। তিনি যখন জানতে পারেন কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের এলাকায় আমার বাড়ি, তখন বলতেন, তুমি তো আমার ডা. মালেকেরও এলাকার লোক। তাহলে সে-অফিস এ-অফিস মিলিয়ে যাতায়াত থাকলে দোষের কি!
বলা প্রয়োজন, ডা. আব্দুল মালেক ঠাকুরগাঁওয়ে ন্যাপের একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। আমাকে তিনিও খুব স্নেহ করতেন। তিনিই আমাকে ঢাকায় স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মালেক ভাই পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ঢাকা চলে আসেন এবং অধ্যাপক সাহেবের বাসায়ই তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। যদিও ঢাকায় পরিচয়, কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে আমি প্রথম দেখি ঠাকুরগাঁওয়ে। ১৯৭০ সালে ন্যাপের এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তিনি ঠাকুরগাঁও গিয়েছিলেন। ওই জনসভায় মতিয়া চৌধুরীকেও প্রথম দেখি এবং তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ ও উজ্জীবিত হই। মতিয়া চৌধুরীর ‘অগ্নিকন্যা’ নামের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলাম।
দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে আলো ছড়ানো অধ্যাপক মোজাফফর জীবনের শেষ কয়েক বছর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি অধ্যাপনা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে ঢাকা কলেজ এবং তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়িয়েছেন। রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই বছরের ছোট। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রীতিময়। অধ্যাপক মোজাফফর মাঝেমধ্যে রসিকতা করে বলতেন, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলে আমি তো জাতির চাচা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম, তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বড় অবদান রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক। ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীরও তিনি অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার যে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল, তার সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। জাতিসংঘেও তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। আত্মগোপনে থেকেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ন্যাপকে মনে করা হতো আওয়ামী লীগের পর বড় দল। বঙ্গবন্ধুর পরই বড় নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থান, তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের নীতি নেওয়ার কারণে ন্যাপ তার রমরমা অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটি প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ন্যাপ, প্রকারান্তরে অধ্যাপক মোজাফফর ব্যর্থ হয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ভেতরের খবর যাঁরা জানেন, তাঁদের হয়তো এটাও জানা আছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে অধ্যাপক মোজাফফরের ভিন্নমত ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, ন্যাপ হবে সমাজ প্রগতির ধারায় একটি ‘মাস’ পার্টি। সিপিবি ও ন্যাপের সমান্তরাল বেড়ে ওঠার পক্ষে তিনি ছিলেন না।
১৯৭৫ সালে রাজনীতির এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে এক দল—বাকশাল গঠন, বাকশালের কমিটিতে তাঁর নিজের ও দলের অবস্থানও তাঁকে হয়তো খুশি করতে পারেনি। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় বামপন্থীদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করা সম্ভব নয় বলেও হয়তো তিনি মনে করতেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম যে একটি বড় উপাদান হয়ে দেখা দেবে—এটা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ উপলব্ধি করেছিলেন। আর সে জন্য তিনি স্লোগান তুলেছিলেন ‘ধর্ম, কর্ম, গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্র’। তাঁর এই ধারণা তখন খুব প্রশংসিত হয়নি।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি ন্যাপ-সিপিবি ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
রাজনীতি, বিশেষত সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি একাধিক বই লিখেছেন। ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’ নামে একটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে কয়েক বছর আগে শেখ হাসিনার সরকার স্বাধীনতা পদক দিতে চেয়েছিল। তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। জীবনে লোভ মোহের কাছে পরাজিত না হয়ে সমাজতন্ত্র, তথা গরিব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের যে লক্ষ্য সামনে রেখে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে একচুলও দূরে সরেননি। আদর্শ ও নীতি আঁকড়ে থেকেছেন অবিচল। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রথম জীবনে শত্রুজ্ঞান করে এসেছেন, জীবন সায়াহ্নে এসেও সেই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানুষের শোষণমুক্তির স্বপ্ন একদিন না একদিন পূরণ হবে—এই বিশ্বাসে তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন।
আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। তাঁর মতো একজন মানুষ সংবাদপত্রে আমার লেখা পড়ে নিয়মিত টেলিফোন করে তাঁর মতামত জানাতেন। ভালো লাগলে বলতেন। খারাপ লাগলেও গোপন করতেন না। এমন উদার নিরহংকার, সরল-সহজ মানুষ আজকের রাজনীতিতে কোথায়?
মৃত্যু দিবসে তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
কত দিন থেকে তিনি আর টেলিফোন করেন না। আমার কোনো লেখা পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান না। বলেন না, চিনতে পারছেন, আমি মোজাফফর, কুঁড়েঘর। অথবা আমার নাম মোজাফফর আহমেদ নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি। হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক প্রবাদপ্রতিম নাম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ নিজেকে এভাবেই পরিচিত করতেন। তিনি কথা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে। কখনো থাকত প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালি।
তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কোপন্থী বলে পরিচিত)-ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের একটি বিশেষ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে একমাত্র তিনি জীবিত ছিলেন। অন্যদের মৃত্যু হয়েছে আরও আগে, বিভিন্ন সময়ে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৭৩ সালে ঢাকা আসার পর। আমি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে কখনো সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। কিন্তু তাঁর কথা শোনার জন্য মাঝেমধ্যে তাঁর কাকরাইলের বাসায় কিংবা তোপখানা রোডে ন্যাপ অফিসে গিয়েছি।
আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি, কমিউনিস্ট কর্মী—সেটা তিনি জানতেন। তারপরও আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখায় তিনি আমাকে একটু বাড়তি স্নেহ করতেন। বলতেন, তোমরা আমার অফিসের (তোপখানা রোড) সামনে দিয়া সিপিবি অফিসে (পুরানা পল্টন) যাও। এখানে নাইমা একটু জিরাইয়া, একটু চা-বিস্কুটও তো খাইয়া যাইতে পারো।
তিনি অনেক মজার মজার কথা বলতেন। জানতেনও অনেক কিছু। তাঁর কথা শুনতে ভালো লাগত বলে আমি তাঁর বাসায় বা অফিসে যেতাম দেখে তিনি খুশি হতেন। তিনি যখন জানতে পারেন কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের এলাকায় আমার বাড়ি, তখন বলতেন, তুমি তো আমার ডা. মালেকেরও এলাকার লোক। তাহলে সে-অফিস এ-অফিস মিলিয়ে যাতায়াত থাকলে দোষের কি!
বলা প্রয়োজন, ডা. আব্দুল মালেক ঠাকুরগাঁওয়ে ন্যাপের একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। আমাকে তিনিও খুব স্নেহ করতেন। তিনিই আমাকে ঢাকায় স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মালেক ভাই পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ঢাকা চলে আসেন এবং অধ্যাপক সাহেবের বাসায়ই তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। যদিও ঢাকায় পরিচয়, কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে আমি প্রথম দেখি ঠাকুরগাঁওয়ে। ১৯৭০ সালে ন্যাপের এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তিনি ঠাকুরগাঁও গিয়েছিলেন। ওই জনসভায় মতিয়া চৌধুরীকেও প্রথম দেখি এবং তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ ও উজ্জীবিত হই। মতিয়া চৌধুরীর ‘অগ্নিকন্যা’ নামের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলাম।
দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে আলো ছড়ানো অধ্যাপক মোজাফফর জীবনের শেষ কয়েক বছর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি অধ্যাপনা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে ঢাকা কলেজ এবং তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়িয়েছেন। রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই বছরের ছোট। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রীতিময়। অধ্যাপক মোজাফফর মাঝেমধ্যে রসিকতা করে বলতেন, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলে আমি তো জাতির চাচা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম, তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বড় অবদান রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক। ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীরও তিনি অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার যে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল, তার সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। জাতিসংঘেও তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। আত্মগোপনে থেকেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ন্যাপকে মনে করা হতো আওয়ামী লীগের পর বড় দল। বঙ্গবন্ধুর পরই বড় নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থান, তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের নীতি নেওয়ার কারণে ন্যাপ তার রমরমা অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটি প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ন্যাপ, প্রকারান্তরে অধ্যাপক মোজাফফর ব্যর্থ হয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ভেতরের খবর যাঁরা জানেন, তাঁদের হয়তো এটাও জানা আছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে অধ্যাপক মোজাফফরের ভিন্নমত ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, ন্যাপ হবে সমাজ প্রগতির ধারায় একটি ‘মাস’ পার্টি। সিপিবি ও ন্যাপের সমান্তরাল বেড়ে ওঠার পক্ষে তিনি ছিলেন না।
১৯৭৫ সালে রাজনীতির এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে এক দল—বাকশাল গঠন, বাকশালের কমিটিতে তাঁর নিজের ও দলের অবস্থানও তাঁকে হয়তো খুশি করতে পারেনি। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় বামপন্থীদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করা সম্ভব নয় বলেও হয়তো তিনি মনে করতেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম যে একটি বড় উপাদান হয়ে দেখা দেবে—এটা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ উপলব্ধি করেছিলেন। আর সে জন্য তিনি স্লোগান তুলেছিলেন ‘ধর্ম, কর্ম, গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্র’। তাঁর এই ধারণা তখন খুব প্রশংসিত হয়নি।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি ন্যাপ-সিপিবি ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
রাজনীতি, বিশেষত সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি একাধিক বই লিখেছেন। ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’ নামে একটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে কয়েক বছর আগে শেখ হাসিনার সরকার স্বাধীনতা পদক দিতে চেয়েছিল। তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। জীবনে লোভ মোহের কাছে পরাজিত না হয়ে সমাজতন্ত্র, তথা গরিব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের যে লক্ষ্য সামনে রেখে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে একচুলও দূরে সরেননি। আদর্শ ও নীতি আঁকড়ে থেকেছেন অবিচল। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রথম জীবনে শত্রুজ্ঞান করে এসেছেন, জীবন সায়াহ্নে এসেও সেই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানুষের শোষণমুক্তির স্বপ্ন একদিন না একদিন পূরণ হবে—এই বিশ্বাসে তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন।
আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। তাঁর মতো একজন মানুষ সংবাদপত্রে আমার লেখা পড়ে নিয়মিত টেলিফোন করে তাঁর মতামত জানাতেন। ভালো লাগলে বলতেন। খারাপ লাগলেও গোপন করতেন না। এমন উদার নিরহংকার, সরল-সহজ মানুষ আজকের রাজনীতিতে কোথায়?
মৃত্যু দিবসে তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৪ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৪ ঘণ্টা আগে