আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
নুহ নবীর আমলের প্লাবনের কথা ইতিহাসে নেই, উপকথায় আছে। ধর্মকথায়ও আছে। মুসা নবীর ভালো মানুষ নিয়ে নীলনদ পার হওয়ার কথাও আছে। নুহ নবীর (বাইবেলের নোয়াহ) আমলের প্লাবন ছিল বিশ্বপ্লাবন। ঈশ্বর নুহকে বলেছিলেন, ‘তুমি পৃথিবীর সব জীবজন্তুর এক জোড়া করে তোমার নৌকায় তোলো। এরা যেন সবাই ভালো স্বভাবের হয়। আমি এদের দিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ব।’ নুহ নবী ঈশ্বরের আদেশে তা-ই করেছিলেন। তারপরও পৃথিবীতে অসাধু মানুষ ও জীবজন্তুর সংখ্যা সাধুদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
উপকথাটি লিখলাম এ জন্য যে, নুহের আমলের বিশ্বপ্লাবনের পর কোভিড-১৯ বা করোনাই সম্ভবত দ্বিতীয় দুর্গতি, যা সারা বিশ্বের মানুষকে আক্রান্ত করেছে।
নুহের মতো ঈশ্বরের নবী কেউ এখন নেই। সুতরাং ঈশ্বর সম্ভবত করোনাকেই আদেশ করেছিলেন, সারা বিশ্বের অসাধু লোকদের প্রাণ হনন করে সাধু লোকদের বাঁচিয়ে রাখো। কিন্তু করোনা কি ঈশ্বরের সেই আদেশ শুনেছে? মাত্র তিন দিন আগে খবর শুনেছি, আমাদের গণসংগীতের শেষ রাজা ফকির আলমগীর করোনায় মারা গেছেন। সেই যে মানুষটি দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের মুক্তিদাতা নেলসন ম্যান্ডেলা ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গেয়েছিলেন, ‘কালো কালো মানুষের দেশে/নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি…।’
শুধু কি ফকির আলমগীর? আমি হিসাব করে দেখেছি, বাংলাদেশে করোনার আগমনের পর ড. আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী, ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর থেকে শুরু করে যে দু-ডজন বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন করোনায়, তাঁরা সবাই সৎ ও সাধু মানুষ ছিলেন। যে মানুষটি বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটিয়ে এখন প্রবল রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, তিনি বেঁচে আছেন। আর যে মানুষটি শেখ হাসিনার রাজত্বের প্রথম দিকে তাঁর ডান পাশে বসে সুপরামর্শ দিতেন, তিনি করোনা আসার আগেই মারা গেছেন। করোনায় সাধু-অসাধু, সাধারণ মানুষ মরছে লাখে লাখে। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর ঈশ্বর যখন দেখবেন, তাঁর মৃত্যু-উপত্যকায় বেঁচে থাকা কিছু মানুষ নিয়ে তাঁকে নতুন দুনিয়া গড়তে হবে এবং সেই বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যেও সৎ এবং সাধু লোকের সংখ্যা কম–তখন তিনি কী করবেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের করোনা হয়েছিল, সেরে উঠেছেন। বরিস জনসনের ভয়ানক করোনা হয়েছিল। তিনিও বেঁচে উঠেছেন। চীনের সি চিন পিং, চীনে করোনায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তিনি তা কাউকে জানতে দেননি। উত্তর কোরিয়ার কিম বলেছেন, তাঁর দেশে করোনা ঢোকেনি। ঢুকতে পারেনি। ঈশ্বর কি এদের নেতৃত্বে করোনা-পরবর্তী তাঁর নতুন দুনিয়া গঠন করবেন? সেই দুনিয়াটা কেমন হবে? আজ লিখতে বসে সেই কথাটাই ভাবছিলাম।
করোনা আজ না-হয় কাল যাবে। আজকের বাংলাদেশে যে ভয়াবহ মৃত্যুসংখ্যা, তা-ও একদিন কমবে; একেবারে কমবে না, মৌসুমি রোগ হিসেবে থেকে যাবে।
যক্ষ্মা-কলেরার মতো বছর বছর টিকা নিতে হবে। কথাটা বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা একটি আশার বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, করোনার আক্রমণক্ষমতা কমে আসছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পৃথিবী অনেকটাই এই রোগ থেকে মুক্ত হতে পারবে বলে তাঁরা আশা করছেন। কিন্তু এই করোনার গ্রাস থেকে মুক্ত হলেই ঈশ্বরের নতুন দুনিয়ায় কি শান্তি ফিরে আসবে? কারণ, আগেই বলেছি, করোনা সেভাবে অসাধু লোকদের শাস্তি দেয়নি। বাংলাদেশে তো বেছে বেছে বেশির ভাগ সাধু বুদ্ধিজীবীর প্রাণ হরণ করেছে।
এখন আফগানিস্তানে ‘মানুষ-করোনার’ পুনরাবির্ভাব হচ্ছে। তারা তালেবান। দীর্ঘ ৩০ বছর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে। তাতে নিরীহ নরনারী ও শিশু যত মারা গেছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও তত মানুষ মারা যায়নি। করোনায় মৃত মানুষের তবু একটা প্রাত্যহিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক যুদ্ধে মার্কিন সেনা এবং তালেবানদের হাতে কত লোক রোজ মারা গেছে, তার কোনো হিসাব জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে, পাকিস্তানে বিয়ে করতে এসে বর-কনেসহ ৬০০ লোকের এক পার্টি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আমেরিকা তার তেলের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যকে আবার ‘ওয়ার থিয়েটার’-এ পরিণত করতে চায়। পরিকল্পনাটা করে গিয়েছিলেন আগের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এখন সেটা বাস্তবায়ন করতে চান বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকায় একটা কথা আছে, দেশটিতে প্রেসিডেন্ট বদলায়, বৈদেশিক নীতি বদলায় না। অর্থাৎ ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের একই বৈদেশিক নীতি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি তাই জো বাইডেনও অনুসরণ করছেন। অভ্যন্তরীণ নীতিতে তিনি অবশ্য বড় পরিবর্তন এনেছেন।
ট্রাম্প ছিলেন আমেরিকার হিটলার। তিনি ফিলিস্তিনিদের চিরকালের জন্য ইসরায়েলের দাস করে রাখতে বড় বড় আরব দেশকে ঘুষ দিয়ে বশ্যতা মানিয়েছেন। অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে দেশটিতে তালেবানদের বর্বর শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে গেছেন। আফগানিস্তানে আফগান জনগণের নির্বাচিত নজিবুল্লার গণতান্ত্রিক সরকারকে সেনা হামলা চালিয়ে উৎখাতের পর আমেরিকা দেশটিকে কখনো স্বাধীনতা দেয়নি, গণতন্ত্রও দেয়নি। সেখানে একটার পর একটা তাঁবেদার সরকার বসিয়েছে।
প্রথম তাঁবেদার সরকার বসানোর জন্য পশ্চিমা সৈন্যদের অস্ত্রের পাহারায় আমেরিকা একটি প্রহসনের নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনের সাক্ষী হিসেবে কাবুলে ডেকে নিয়েছিল আমাদের ড. কামাল হোসেন সাহেবকে। সেই তাঁবেদার সরকার টেকেনি। বর্তমানে যে তাঁবেদার সরকার আছে, ট্রাম্পের চুক্তির ফলে, বাইডেনের নির্দেশে মার্কিন অবশিষ্ট সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করায় সেই সরকার বিপাকে। তালেবানরা এগিয়ে এসেছে কাবুলের উপকণ্ঠ পর্যন্ত।
যেসব জায়গা তারা দখল করছে, সেখানে শুরু করেছে বর্বর অত্যাচার। শিক্ষিত নারীদেরও ঘরে বন্দী করা হয়েছে। অভিভাবক ছাড়া মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লম্বা দাড়ি রাখাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তালেবানদের জন্য মার্কিন সরকার আর্থিক সাহায্য মঞ্জুর করায় এটা স্পষ্ট–বাইডেন সরকারও চায় আফগানিস্তানে এই জংলি, জঙ্গিরাজত্ব স্থাপিত হোক।
তা যদি হয়, তাহলে করোনার মতো এক জঙ্গি-ভাইরাস সারা বিশ্বে আবার ছড়িয়ে পড়বে। আফগানিস্তানে অতীতে তালেবান রাজত্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশসহ সারা উপমহাদেশের মানুষের জানা। আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা শুধু পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেনি, পাকিস্তানের মদদে বাংলাদেশে ঢুকেছে এবং বাংলাদেশে জিহাদি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এই জিহাদিস্টরা ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। মুক্তবুদ্ধির বহু তরুণ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তাদের বর্বরতায় তরুণ বুদ্ধিজীবীরা দেশত্যাগ শুরু করেছিল। বাংলাদেশে এই বুদ্ধিজীবীদের প্রথম হত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। তারপর স্বাধীনতা-উত্তরকালে শুরু করে জিহাদিস্টরা। শেখ হাসিনা সরকার জিহাদিদের দমন করার পর বাকি বুদ্ধিজীবী হত্যার কাজটি করছে করোনা। চতুর্থ দফায় আবার যদি আফগানিস্তান থেকে জিহাদি বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয়, তাহলে আবার শুরু হতে পারে ভয়াবহ সন্ত্রাস। নতুন মহামারি। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার অর্থ, সারা উপমহাদেশে অশান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করা। পাকিস্তানে নম নম করে যেটুকু গণতন্ত্র আছে, তা বিলুপ্ত হবে।
এমনিতেই পেশোয়ার পর্যন্ত তালেবান-রাজত্ব প্রসারিত হয়ে আছে, কাশ্মীরে আবার আগুন জ্বলবে। তালেবানরা চীনকে এখন বলছে বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলমানদের তারা সাহায্য দেবে না। সে প্রতিশ্রুতি তারা রাখবে না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন রূপ নেবে। বাংলাদেশ থেকে কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা ছিনিয়ে নিয়ে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যজুড়ে ‘ইসলামি স্টেট’ প্রতিষ্ঠার যে পুরোনো জামায়াতি পরিকল্পনা, তা আবার বাস্তবায়নের নতুন প্রয়াস শুরু হবে।
আমেরিকা জেনেশুনেই এই নিবু নিবু অগ্নিশলাকা আফগানিস্তানের বারুদে নিক্ষেপ করেছে। এই আগুন শুধু উপমহাদেশকে অশান্ত করবে না, ইউরোপকেও করবে। ইতিপূর্বে তালেবানদের মদদপুষ্ট জিহাদিরা ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ায় ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। আফগানিস্তানে তালেবান-রাজত্ব তৈরি হলে যে বিশাল মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র তালেবানদের হস্তগত হয়েছে, তা দিয়ে তারা বিশ্বময় ‘জিহাদ’ প্রমোট করার চেষ্টা চালাবে। এটা আমার অনুমান নয়, বর্তমান তালেবান নেতাদের কথাবার্তা থেকেই জানা যাচ্ছে। তালেবানদের প্রচারপত্র থেকেও এই আসন্ন বিপদবার্তা জানা যায়। ২৮ জুলাইয়েও বাংলাদেশে করোনায় যে মৃত্যুর খবর জেনেছি, তা আতঙ্কজনক। এই আতঙ্কের মধ্যে ভবিষ্যতের তালেবান-আতঙ্কের কথা তুলে আর পাঠকদের মন ভারাক্রান্ত করতে চাই না।
কিন্তু ভয় হয়, বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার শক্তি সম্প্রতি যেভাবে বেড়েছে, তা যদি তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা সরকার না করে এবং ভারতেও সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে উপমহাদেশ ভবিষ্যতে কোনো এক সময় করোনামুক্ত হলেও ঈশ্বর তাঁর নতুন বিশ্ব কীভাবে, কী ধরনের তৈরি করবেন–তা ভেবে পাই না।
শুধু করোনার শত শত মৃত্যুর আহাজারির মধ্যেও ঈশ্বরের সেই নতুন পৃথিবীর আশায় অপেক্ষায় রয়েছি।
লন্ডন, ২৮ জুলাই, বুধবার, ২০২১
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
নুহ নবীর আমলের প্লাবনের কথা ইতিহাসে নেই, উপকথায় আছে। ধর্মকথায়ও আছে। মুসা নবীর ভালো মানুষ নিয়ে নীলনদ পার হওয়ার কথাও আছে। নুহ নবীর (বাইবেলের নোয়াহ) আমলের প্লাবন ছিল বিশ্বপ্লাবন। ঈশ্বর নুহকে বলেছিলেন, ‘তুমি পৃথিবীর সব জীবজন্তুর এক জোড়া করে তোমার নৌকায় তোলো। এরা যেন সবাই ভালো স্বভাবের হয়। আমি এদের দিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ব।’ নুহ নবী ঈশ্বরের আদেশে তা-ই করেছিলেন। তারপরও পৃথিবীতে অসাধু মানুষ ও জীবজন্তুর সংখ্যা সাধুদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
উপকথাটি লিখলাম এ জন্য যে, নুহের আমলের বিশ্বপ্লাবনের পর কোভিড-১৯ বা করোনাই সম্ভবত দ্বিতীয় দুর্গতি, যা সারা বিশ্বের মানুষকে আক্রান্ত করেছে।
নুহের মতো ঈশ্বরের নবী কেউ এখন নেই। সুতরাং ঈশ্বর সম্ভবত করোনাকেই আদেশ করেছিলেন, সারা বিশ্বের অসাধু লোকদের প্রাণ হনন করে সাধু লোকদের বাঁচিয়ে রাখো। কিন্তু করোনা কি ঈশ্বরের সেই আদেশ শুনেছে? মাত্র তিন দিন আগে খবর শুনেছি, আমাদের গণসংগীতের শেষ রাজা ফকির আলমগীর করোনায় মারা গেছেন। সেই যে মানুষটি দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের মুক্তিদাতা নেলসন ম্যান্ডেলা ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গেয়েছিলেন, ‘কালো কালো মানুষের দেশে/নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি…।’
শুধু কি ফকির আলমগীর? আমি হিসাব করে দেখেছি, বাংলাদেশে করোনার আগমনের পর ড. আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী, ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর থেকে শুরু করে যে দু-ডজন বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন করোনায়, তাঁরা সবাই সৎ ও সাধু মানুষ ছিলেন। যে মানুষটি বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটিয়ে এখন প্রবল রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, তিনি বেঁচে আছেন। আর যে মানুষটি শেখ হাসিনার রাজত্বের প্রথম দিকে তাঁর ডান পাশে বসে সুপরামর্শ দিতেন, তিনি করোনা আসার আগেই মারা গেছেন। করোনায় সাধু-অসাধু, সাধারণ মানুষ মরছে লাখে লাখে। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর ঈশ্বর যখন দেখবেন, তাঁর মৃত্যু-উপত্যকায় বেঁচে থাকা কিছু মানুষ নিয়ে তাঁকে নতুন দুনিয়া গড়তে হবে এবং সেই বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যেও সৎ এবং সাধু লোকের সংখ্যা কম–তখন তিনি কী করবেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের করোনা হয়েছিল, সেরে উঠেছেন। বরিস জনসনের ভয়ানক করোনা হয়েছিল। তিনিও বেঁচে উঠেছেন। চীনের সি চিন পিং, চীনে করোনায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তিনি তা কাউকে জানতে দেননি। উত্তর কোরিয়ার কিম বলেছেন, তাঁর দেশে করোনা ঢোকেনি। ঢুকতে পারেনি। ঈশ্বর কি এদের নেতৃত্বে করোনা-পরবর্তী তাঁর নতুন দুনিয়া গঠন করবেন? সেই দুনিয়াটা কেমন হবে? আজ লিখতে বসে সেই কথাটাই ভাবছিলাম।
করোনা আজ না-হয় কাল যাবে। আজকের বাংলাদেশে যে ভয়াবহ মৃত্যুসংখ্যা, তা-ও একদিন কমবে; একেবারে কমবে না, মৌসুমি রোগ হিসেবে থেকে যাবে।
যক্ষ্মা-কলেরার মতো বছর বছর টিকা নিতে হবে। কথাটা বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা একটি আশার বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, করোনার আক্রমণক্ষমতা কমে আসছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পৃথিবী অনেকটাই এই রোগ থেকে মুক্ত হতে পারবে বলে তাঁরা আশা করছেন। কিন্তু এই করোনার গ্রাস থেকে মুক্ত হলেই ঈশ্বরের নতুন দুনিয়ায় কি শান্তি ফিরে আসবে? কারণ, আগেই বলেছি, করোনা সেভাবে অসাধু লোকদের শাস্তি দেয়নি। বাংলাদেশে তো বেছে বেছে বেশির ভাগ সাধু বুদ্ধিজীবীর প্রাণ হরণ করেছে।
এখন আফগানিস্তানে ‘মানুষ-করোনার’ পুনরাবির্ভাব হচ্ছে। তারা তালেবান। দীর্ঘ ৩০ বছর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে। তাতে নিরীহ নরনারী ও শিশু যত মারা গেছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও তত মানুষ মারা যায়নি। করোনায় মৃত মানুষের তবু একটা প্রাত্যহিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক যুদ্ধে মার্কিন সেনা এবং তালেবানদের হাতে কত লোক রোজ মারা গেছে, তার কোনো হিসাব জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে, পাকিস্তানে বিয়ে করতে এসে বর-কনেসহ ৬০০ লোকের এক পার্টি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আমেরিকা তার তেলের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যকে আবার ‘ওয়ার থিয়েটার’-এ পরিণত করতে চায়। পরিকল্পনাটা করে গিয়েছিলেন আগের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এখন সেটা বাস্তবায়ন করতে চান বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকায় একটা কথা আছে, দেশটিতে প্রেসিডেন্ট বদলায়, বৈদেশিক নীতি বদলায় না। অর্থাৎ ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের একই বৈদেশিক নীতি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি তাই জো বাইডেনও অনুসরণ করছেন। অভ্যন্তরীণ নীতিতে তিনি অবশ্য বড় পরিবর্তন এনেছেন।
ট্রাম্প ছিলেন আমেরিকার হিটলার। তিনি ফিলিস্তিনিদের চিরকালের জন্য ইসরায়েলের দাস করে রাখতে বড় বড় আরব দেশকে ঘুষ দিয়ে বশ্যতা মানিয়েছেন। অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে দেশটিতে তালেবানদের বর্বর শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে গেছেন। আফগানিস্তানে আফগান জনগণের নির্বাচিত নজিবুল্লার গণতান্ত্রিক সরকারকে সেনা হামলা চালিয়ে উৎখাতের পর আমেরিকা দেশটিকে কখনো স্বাধীনতা দেয়নি, গণতন্ত্রও দেয়নি। সেখানে একটার পর একটা তাঁবেদার সরকার বসিয়েছে।
প্রথম তাঁবেদার সরকার বসানোর জন্য পশ্চিমা সৈন্যদের অস্ত্রের পাহারায় আমেরিকা একটি প্রহসনের নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনের সাক্ষী হিসেবে কাবুলে ডেকে নিয়েছিল আমাদের ড. কামাল হোসেন সাহেবকে। সেই তাঁবেদার সরকার টেকেনি। বর্তমানে যে তাঁবেদার সরকার আছে, ট্রাম্পের চুক্তির ফলে, বাইডেনের নির্দেশে মার্কিন অবশিষ্ট সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করায় সেই সরকার বিপাকে। তালেবানরা এগিয়ে এসেছে কাবুলের উপকণ্ঠ পর্যন্ত।
যেসব জায়গা তারা দখল করছে, সেখানে শুরু করেছে বর্বর অত্যাচার। শিক্ষিত নারীদেরও ঘরে বন্দী করা হয়েছে। অভিভাবক ছাড়া মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লম্বা দাড়ি রাখাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তালেবানদের জন্য মার্কিন সরকার আর্থিক সাহায্য মঞ্জুর করায় এটা স্পষ্ট–বাইডেন সরকারও চায় আফগানিস্তানে এই জংলি, জঙ্গিরাজত্ব স্থাপিত হোক।
তা যদি হয়, তাহলে করোনার মতো এক জঙ্গি-ভাইরাস সারা বিশ্বে আবার ছড়িয়ে পড়বে। আফগানিস্তানে অতীতে তালেবান রাজত্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশসহ সারা উপমহাদেশের মানুষের জানা। আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা শুধু পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেনি, পাকিস্তানের মদদে বাংলাদেশে ঢুকেছে এবং বাংলাদেশে জিহাদি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এই জিহাদিস্টরা ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। মুক্তবুদ্ধির বহু তরুণ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তাদের বর্বরতায় তরুণ বুদ্ধিজীবীরা দেশত্যাগ শুরু করেছিল। বাংলাদেশে এই বুদ্ধিজীবীদের প্রথম হত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। তারপর স্বাধীনতা-উত্তরকালে শুরু করে জিহাদিস্টরা। শেখ হাসিনা সরকার জিহাদিদের দমন করার পর বাকি বুদ্ধিজীবী হত্যার কাজটি করছে করোনা। চতুর্থ দফায় আবার যদি আফগানিস্তান থেকে জিহাদি বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয়, তাহলে আবার শুরু হতে পারে ভয়াবহ সন্ত্রাস। নতুন মহামারি। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার অর্থ, সারা উপমহাদেশে অশান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করা। পাকিস্তানে নম নম করে যেটুকু গণতন্ত্র আছে, তা বিলুপ্ত হবে।
এমনিতেই পেশোয়ার পর্যন্ত তালেবান-রাজত্ব প্রসারিত হয়ে আছে, কাশ্মীরে আবার আগুন জ্বলবে। তালেবানরা চীনকে এখন বলছে বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলমানদের তারা সাহায্য দেবে না। সে প্রতিশ্রুতি তারা রাখবে না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন রূপ নেবে। বাংলাদেশ থেকে কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা ছিনিয়ে নিয়ে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যজুড়ে ‘ইসলামি স্টেট’ প্রতিষ্ঠার যে পুরোনো জামায়াতি পরিকল্পনা, তা আবার বাস্তবায়নের নতুন প্রয়াস শুরু হবে।
আমেরিকা জেনেশুনেই এই নিবু নিবু অগ্নিশলাকা আফগানিস্তানের বারুদে নিক্ষেপ করেছে। এই আগুন শুধু উপমহাদেশকে অশান্ত করবে না, ইউরোপকেও করবে। ইতিপূর্বে তালেবানদের মদদপুষ্ট জিহাদিরা ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ায় ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। আফগানিস্তানে তালেবান-রাজত্ব তৈরি হলে যে বিশাল মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র তালেবানদের হস্তগত হয়েছে, তা দিয়ে তারা বিশ্বময় ‘জিহাদ’ প্রমোট করার চেষ্টা চালাবে। এটা আমার অনুমান নয়, বর্তমান তালেবান নেতাদের কথাবার্তা থেকেই জানা যাচ্ছে। তালেবানদের প্রচারপত্র থেকেও এই আসন্ন বিপদবার্তা জানা যায়। ২৮ জুলাইয়েও বাংলাদেশে করোনায় যে মৃত্যুর খবর জেনেছি, তা আতঙ্কজনক। এই আতঙ্কের মধ্যে ভবিষ্যতের তালেবান-আতঙ্কের কথা তুলে আর পাঠকদের মন ভারাক্রান্ত করতে চাই না।
কিন্তু ভয় হয়, বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার শক্তি সম্প্রতি যেভাবে বেড়েছে, তা যদি তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা সরকার না করে এবং ভারতেও সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে উপমহাদেশ ভবিষ্যতে কোনো এক সময় করোনামুক্ত হলেও ঈশ্বর তাঁর নতুন বিশ্ব কীভাবে, কী ধরনের তৈরি করবেন–তা ভেবে পাই না।
শুধু করোনার শত শত মৃত্যুর আহাজারির মধ্যেও ঈশ্বরের সেই নতুন পৃথিবীর আশায় অপেক্ষায় রয়েছি।
লন্ডন, ২৮ জুলাই, বুধবার, ২০২১
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১ দিন আগে