জাহীদ রেজা নূর
লাভ হয়েছে বেশি, ছাঁটাইও হয়েছে বেশি–আমাদের ব্যাংকগুলো এ রকম একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে এই করোনাকালে। ভয়াবহ করোনাকালে লাভের পরিমাণ বাড়লেও কোনো কোনো ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করে একরকম নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। আজকের পত্রিকায় পর পর চাকরিচ্যুতি প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাসংক্রান্ত খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই বলাই যায়, যাঁরা ব্যাংকার নন বা ব্যাংকে চাকরি করেন না, তাঁরা কেন এ বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাবেন? সব ব্যাংকারকেই-বা এ নিয়ে ভাবতে হবে কেন? নিজে বাঁচলে বাপের নাম! তাই ভাববেন শুধু তাঁরাই, যাঁরা করোনার এই ভয়াল সময়টাতে ব্যাংক থেকে চাকরি হারিয়েছেন!
দুই. কেবল ব্যাংকপাড়ায়ই এই অনাচার হয় বা হয়েছে, তা তো নয়। আমাদের দ্রুত উন্নয়নের দিকে ধাবমান অর্থনীতির বিভিন্ন ফাঁকফোকরে বহু ধরনের অনাচার হচ্ছে, তার হিসাব রাখছে কে? দক্ষতা ও অদক্ষতার বিচার যদি স্বাভাবিক নিয়মে হতো, তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। প্রশ্ন ওঠে তখনই, যখন চাকরিজগতে একজন ক্ষমতাবানের চারপাশে জুটে যায় একদল মোসাহেব, হীরক রাজার পারিষদদের মতোই যারা সেই ক্ষমতাবানের সব কথার জবাবে বলতে থাকে, ‘ঠিক, ঠিক।’ ক্ষমতাবানকে যা কিছু করার সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় তারা বিনা শর্তে। এবং তখন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে জায়গা করে নিতে থাকে নানামুখী অব্যবস্থাপনা এবং অরাজকতা।
এ রকম দুঃসময়ে ব্যাংকারদের চাকরি যাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি চক্রের হাত থাকতেই পারে। যাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের মধ্যে পেশাজীবী আচরণের জায়গায় অমানবিকতা এসে ভর করতে পারে এবং তাঁরা বুঝতেও পারেন না, এই অমানবিকতার নাম পেশাজীবী আচরণ নয়।
তিন. একজন ব্যাংকার চাকরিচ্যুত হন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো যুক্ত থাকে একটি পরিবার। তিনি যদি সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে সেই পরিবারের দশা কী হয়, তা কি একবারও ভেবে দেখা হয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা একটা আলোর দিশা দেখতেই পারেন, কিন্তু এই নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরে চাকরিসংক্রান্ত জটিলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে কিংবা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, এ রকম গ্যারান্টি নেই।
চার. এবার একটু তাসের উল্টোপিঠের দিকে তাকাই। আমার ব্যাংকার বন্ধুদের কাছ থেকে নানা সময় যা জেনেছি, তার ওপর দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলা বোধ হয় ভুল হবে না।
ব্যাংকে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীই যে দক্ষতার সঙ্গে তাদের কাজ করে থাকেন, তা সত্য নয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই ভালো, মাঝারি আর খারাপ মানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যাংকেও আছেন। খারাপ মানের কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্য কোনো পেশার মতোই ব্যাংকিং পেশায়ও গোদের ওপর বিষফোড়া। বছরের পর বছর তাঁদের কাজের কোনো উন্নতি হয় না। এ অবস্থায় তাঁর জায়গায় যোগ্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করা হতেই পারে।
কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হয়। যখন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখন কি যাচাই-বাছাই করে লোক নেওয়া হয়নি? যদি যাচাই-বাছাই করেই লোক নেওয়া হয়, তাহলে হঠাৎ করে তিনি অদক্ষ হয়ে পড়েন কেন?
নিয়োগব্যবস্থায় কি এমন কিছু ঘটে, যাতে অদক্ষ মানুষেরা অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারেন চাকরিতে? এর উত্তর হয়তো এ রকম: যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই ব্যাংকেও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লোক নিয়োগ হয়। কিন্তু তার পাশাপাশি ‘রেফারেন্স’ নামক এক ঘটনাও চাকরিপ্রাপ্তির একটি বড় নির্ণায়ক হয়ে থাকে। বড় কোনো কর্মকর্তার রেফারেন্স কিংবা রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী কারও ‘আবদার’ রক্ষা করার জন্যও কিছু নিয়োগ হয়ে থাকে। মূলত প্রভাবশালীদের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরাই অদক্ষ হয়ে থাকেন। স্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারলে কোনো রেফারেন্সের মাধ্যমে তাঁদের চাকরির মাঠে এভাবে আসতে হতো না।এই সমস্যা সমাধানের প্রথম উপায় হলো, পরীক্ষার মাধ্যমেই নিয়োগ হবে, রেফারেন্সের মাধ্যমে নয়। রেফারেন্সের মাধ্যমে নিয়োগ ঠেকাতে পারবেন তাঁরাই, যাঁদের হাতে নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা। তাঁরাই, যাঁরা করোনার মধ্যেও সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করেছেন। তাঁরা কি রেফারেন্সের মাধ্যমে চাকরি দেওয়া বন্ধ করতে পারবেন?
পাঁচ. কিন্তু যিনি চাকরি পেয়ে গেছেন (সেটা যেভাবেই হোক), তাঁকে কি কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য, তাঁর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? তাঁর অযোগ্যতাগুলোকে কি যোগ্য করে তোলার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? তাঁর দক্ষতা বিকাশে কি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো অবদান রেখেছে? যদি কর্মকর্তা-কর্মচারী এরপরও অযোগ্য থেকে যান, তাহলে কি এ কথাও সত্য নয় যে, যাঁরা তাঁকে গড়েপিটে নেবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তাঁরা নিজেরাই ততটা যোগ্য প্রশিক্ষক নন?
দোষটা কি শুধু অযোগ্য চাকরিজীবীর, নাকি অযোগ্য চাকরিদাতারও?
এ প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ওপরের দিকে যাঁরা নীতিনির্ধারক হয়ে বসে আছেন, তাঁদের অদক্ষতার দিকে আঙুল তোলার সুযোগই নেই। তাঁরা অদক্ষ, অমানবিক, অপেশাজীবী হলেও তাঁরাই নীতি তৈরি করতে পারেন, তার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের কারণে দক্ষ কর্মকর্তারাও সুচারু অবদান রাখতে পারেন না।
ছয়. ব্যাংকে চাকরি যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মূলত কাজ করে, তার একটি হলো গ্রুপিং। একটি হলো, ব্যবস্থাপনা পরিষদের সঙ্গে মাখামাখি বা দূরত্ব। একটি হলো, দক্ষতার অভাব। আরও অনেক বিষয় নিশ্চয় আছে; তবে চাকরি ‘খেয়ে’ নেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, কাউকে পছন্দ না হলে তাঁর জন্য এমন একটা টার্গেট ঠিক করে দেওয়া, যা পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা ব্যাংক সেক্টর থেকে একটু সরে গিয়ে এ বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করব। ধরুন, চিড়িয়াখানায় যিনি বাঘের দেখভাল করেন, তাঁকে যদি টার্গেট দেওয়া হয় সুন্দরবন থেকে গোটা পাঁচেক বাঘ ধরে এনে দিতে হবে, তাহলে কি এই লোকের পক্ষে সেই টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে? যাঁদের চাকরি গেছে এই দুঃসময়ে, তাঁদের কী ধরনের টার্গেট দেওয়া হয়েছিল, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।
সাত. আমরা যে অমানবিক হয়ে গেছি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে করোনাকালে চাকরিচ্যুত ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘পদত্যাগ’পত্রগুলো দেখলেই। কী এক ‘অলৌকিক কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে তিন হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন। হ্যাঁ, ভুল শোনেননি। তাঁরা স্রেফ ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগ’ করেছেন। তাঁরা নতুন কোনো লোভনীয় চাকরি পেয়ে ব্যাংকে চাকরির ক্যারিয়ার ছেড়ে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন—এ রকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে বলে দেওয়া হয়, ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন, এ কথা লিখে দিতে হবে। নইলে কী হবে? নইলে ব্যাংক থেকে যে পাওনা রয়েছে, তার কিছুই জুটবে না কপালে। এমনিতেই চাকরি থাকবে না, তার ওপর পাওনা টাকাও মার গেলে তো একেবারে অতলান্ত গহ্বরে গিয়ে পড়তে হবে। তাই পরাজিত সৈনিকের মতো ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করছেন বলে জানাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
আট. বাংলাদেশ ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে, তাতে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আশায় বুক বাঁধতে পারেন। আমরাও চাইব, এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের মুখে হাসি ফুটে উঠুক। যাঁরা উঁচু পদে বসে থেকে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেব, এই ব্যাংক কর্মচারীরাই সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে চাঙা রেখেছেন। আর সে কাজ করতে গিয়ে গত মে মাস পর্যন্ত ২৫ হাজার ৩৯৯ জন ব্যাংকার কোভিড-আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৩৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেছেন।
তাঁদের কাজের মূল্যায়নের জন্য নীতিনির্ধারকেরা কিছু ভাবতে পারতেন। মুনাফার ভাগ দেওয়ার কথা ভাবতে পারতেন। প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবতে পারতেন। তা না ভেবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে সহজ ও অমানবিক কাজটাই—চাকরিচ্যুতি!
ঘটনাটা একটু ভালোর দিকে এবার মোড় নিক।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
লাভ হয়েছে বেশি, ছাঁটাইও হয়েছে বেশি–আমাদের ব্যাংকগুলো এ রকম একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে এই করোনাকালে। ভয়াবহ করোনাকালে লাভের পরিমাণ বাড়লেও কোনো কোনো ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করে একরকম নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। আজকের পত্রিকায় পর পর চাকরিচ্যুতি প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাসংক্রান্ত খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই বলাই যায়, যাঁরা ব্যাংকার নন বা ব্যাংকে চাকরি করেন না, তাঁরা কেন এ বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাবেন? সব ব্যাংকারকেই-বা এ নিয়ে ভাবতে হবে কেন? নিজে বাঁচলে বাপের নাম! তাই ভাববেন শুধু তাঁরাই, যাঁরা করোনার এই ভয়াল সময়টাতে ব্যাংক থেকে চাকরি হারিয়েছেন!
দুই. কেবল ব্যাংকপাড়ায়ই এই অনাচার হয় বা হয়েছে, তা তো নয়। আমাদের দ্রুত উন্নয়নের দিকে ধাবমান অর্থনীতির বিভিন্ন ফাঁকফোকরে বহু ধরনের অনাচার হচ্ছে, তার হিসাব রাখছে কে? দক্ষতা ও অদক্ষতার বিচার যদি স্বাভাবিক নিয়মে হতো, তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। প্রশ্ন ওঠে তখনই, যখন চাকরিজগতে একজন ক্ষমতাবানের চারপাশে জুটে যায় একদল মোসাহেব, হীরক রাজার পারিষদদের মতোই যারা সেই ক্ষমতাবানের সব কথার জবাবে বলতে থাকে, ‘ঠিক, ঠিক।’ ক্ষমতাবানকে যা কিছু করার সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় তারা বিনা শর্তে। এবং তখন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে জায়গা করে নিতে থাকে নানামুখী অব্যবস্থাপনা এবং অরাজকতা।
এ রকম দুঃসময়ে ব্যাংকারদের চাকরি যাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি চক্রের হাত থাকতেই পারে। যাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের মধ্যে পেশাজীবী আচরণের জায়গায় অমানবিকতা এসে ভর করতে পারে এবং তাঁরা বুঝতেও পারেন না, এই অমানবিকতার নাম পেশাজীবী আচরণ নয়।
তিন. একজন ব্যাংকার চাকরিচ্যুত হন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো যুক্ত থাকে একটি পরিবার। তিনি যদি সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে সেই পরিবারের দশা কী হয়, তা কি একবারও ভেবে দেখা হয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা একটা আলোর দিশা দেখতেই পারেন, কিন্তু এই নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরে চাকরিসংক্রান্ত জটিলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে কিংবা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, এ রকম গ্যারান্টি নেই।
চার. এবার একটু তাসের উল্টোপিঠের দিকে তাকাই। আমার ব্যাংকার বন্ধুদের কাছ থেকে নানা সময় যা জেনেছি, তার ওপর দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলা বোধ হয় ভুল হবে না।
ব্যাংকে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীই যে দক্ষতার সঙ্গে তাদের কাজ করে থাকেন, তা সত্য নয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই ভালো, মাঝারি আর খারাপ মানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যাংকেও আছেন। খারাপ মানের কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্য কোনো পেশার মতোই ব্যাংকিং পেশায়ও গোদের ওপর বিষফোড়া। বছরের পর বছর তাঁদের কাজের কোনো উন্নতি হয় না। এ অবস্থায় তাঁর জায়গায় যোগ্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করা হতেই পারে।
কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হয়। যখন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখন কি যাচাই-বাছাই করে লোক নেওয়া হয়নি? যদি যাচাই-বাছাই করেই লোক নেওয়া হয়, তাহলে হঠাৎ করে তিনি অদক্ষ হয়ে পড়েন কেন?
নিয়োগব্যবস্থায় কি এমন কিছু ঘটে, যাতে অদক্ষ মানুষেরা অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারেন চাকরিতে? এর উত্তর হয়তো এ রকম: যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই ব্যাংকেও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লোক নিয়োগ হয়। কিন্তু তার পাশাপাশি ‘রেফারেন্স’ নামক এক ঘটনাও চাকরিপ্রাপ্তির একটি বড় নির্ণায়ক হয়ে থাকে। বড় কোনো কর্মকর্তার রেফারেন্স কিংবা রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী কারও ‘আবদার’ রক্ষা করার জন্যও কিছু নিয়োগ হয়ে থাকে। মূলত প্রভাবশালীদের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরাই অদক্ষ হয়ে থাকেন। স্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারলে কোনো রেফারেন্সের মাধ্যমে তাঁদের চাকরির মাঠে এভাবে আসতে হতো না।এই সমস্যা সমাধানের প্রথম উপায় হলো, পরীক্ষার মাধ্যমেই নিয়োগ হবে, রেফারেন্সের মাধ্যমে নয়। রেফারেন্সের মাধ্যমে নিয়োগ ঠেকাতে পারবেন তাঁরাই, যাঁদের হাতে নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা। তাঁরাই, যাঁরা করোনার মধ্যেও সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করেছেন। তাঁরা কি রেফারেন্সের মাধ্যমে চাকরি দেওয়া বন্ধ করতে পারবেন?
পাঁচ. কিন্তু যিনি চাকরি পেয়ে গেছেন (সেটা যেভাবেই হোক), তাঁকে কি কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য, তাঁর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? তাঁর অযোগ্যতাগুলোকে কি যোগ্য করে তোলার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? তাঁর দক্ষতা বিকাশে কি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো অবদান রেখেছে? যদি কর্মকর্তা-কর্মচারী এরপরও অযোগ্য থেকে যান, তাহলে কি এ কথাও সত্য নয় যে, যাঁরা তাঁকে গড়েপিটে নেবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তাঁরা নিজেরাই ততটা যোগ্য প্রশিক্ষক নন?
দোষটা কি শুধু অযোগ্য চাকরিজীবীর, নাকি অযোগ্য চাকরিদাতারও?
এ প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ওপরের দিকে যাঁরা নীতিনির্ধারক হয়ে বসে আছেন, তাঁদের অদক্ষতার দিকে আঙুল তোলার সুযোগই নেই। তাঁরা অদক্ষ, অমানবিক, অপেশাজীবী হলেও তাঁরাই নীতি তৈরি করতে পারেন, তার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের কারণে দক্ষ কর্মকর্তারাও সুচারু অবদান রাখতে পারেন না।
ছয়. ব্যাংকে চাকরি যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মূলত কাজ করে, তার একটি হলো গ্রুপিং। একটি হলো, ব্যবস্থাপনা পরিষদের সঙ্গে মাখামাখি বা দূরত্ব। একটি হলো, দক্ষতার অভাব। আরও অনেক বিষয় নিশ্চয় আছে; তবে চাকরি ‘খেয়ে’ নেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, কাউকে পছন্দ না হলে তাঁর জন্য এমন একটা টার্গেট ঠিক করে দেওয়া, যা পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা ব্যাংক সেক্টর থেকে একটু সরে গিয়ে এ বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করব। ধরুন, চিড়িয়াখানায় যিনি বাঘের দেখভাল করেন, তাঁকে যদি টার্গেট দেওয়া হয় সুন্দরবন থেকে গোটা পাঁচেক বাঘ ধরে এনে দিতে হবে, তাহলে কি এই লোকের পক্ষে সেই টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে? যাঁদের চাকরি গেছে এই দুঃসময়ে, তাঁদের কী ধরনের টার্গেট দেওয়া হয়েছিল, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।
সাত. আমরা যে অমানবিক হয়ে গেছি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে করোনাকালে চাকরিচ্যুত ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘পদত্যাগ’পত্রগুলো দেখলেই। কী এক ‘অলৌকিক কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে তিন হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন। হ্যাঁ, ভুল শোনেননি। তাঁরা স্রেফ ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগ’ করেছেন। তাঁরা নতুন কোনো লোভনীয় চাকরি পেয়ে ব্যাংকে চাকরির ক্যারিয়ার ছেড়ে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন—এ রকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে বলে দেওয়া হয়, ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন, এ কথা লিখে দিতে হবে। নইলে কী হবে? নইলে ব্যাংক থেকে যে পাওনা রয়েছে, তার কিছুই জুটবে না কপালে। এমনিতেই চাকরি থাকবে না, তার ওপর পাওনা টাকাও মার গেলে তো একেবারে অতলান্ত গহ্বরে গিয়ে পড়তে হবে। তাই পরাজিত সৈনিকের মতো ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করছেন বলে জানাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
আট. বাংলাদেশ ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে, তাতে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আশায় বুক বাঁধতে পারেন। আমরাও চাইব, এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের মুখে হাসি ফুটে উঠুক। যাঁরা উঁচু পদে বসে থেকে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেব, এই ব্যাংক কর্মচারীরাই সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে চাঙা রেখেছেন। আর সে কাজ করতে গিয়ে গত মে মাস পর্যন্ত ২৫ হাজার ৩৯৯ জন ব্যাংকার কোভিড-আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৩৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেছেন।
তাঁদের কাজের মূল্যায়নের জন্য নীতিনির্ধারকেরা কিছু ভাবতে পারতেন। মুনাফার ভাগ দেওয়ার কথা ভাবতে পারতেন। প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবতে পারতেন। তা না ভেবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে সহজ ও অমানবিক কাজটাই—চাকরিচ্যুতি!
ঘটনাটা একটু ভালোর দিকে এবার মোড় নিক।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৪ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৪ ঘণ্টা আগে