এ কে এম শামসুদ্দিন
মানুষ মাত্রই আবেগপ্রবণ। এটি মানুষের এমন একটি মানসিক অবস্থা, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, আবেগ হলো মানুষের অনুভূতির উৎস। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘মানুষের চেতনার যে অংশ অনুভূতি বা সংবেদনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত, তাকে আবেগ বলা যায়।’ আবেগকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আবার কেউ পারেন না। দেখা গেছে, বেশি আবেগপ্রবণ মানুষ জীবনে অনেক ভুল করে বসেন। কারণ এটি এমন একটি উপসর্গ, যা মানুষকে বিব্রত পরিস্থিতিতেও ফেলে দেয়। বেশি আবেগপ্রবণ মানুষ অনেক সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য করতে পারেন না। মানুষ যখন প্রবল আবেগ দ্বারা তাড়িত হন, তখন তাঁদের বিবেক সঠিকভাবে কাজ করে না। এ জন্যই তাঁরা ভুল করেন। বিবেক ও আবেগের মধ্যে পার্থক্যটি হলো, বিবেক ভালো-মন্দ বিবেচনা করতে পারে; কী হবে না হবে—এসব যুক্তি মেনে নিয়েই বিবেক কাজ করে।
অপরদিকে, আবেগের কাজে এ যুক্তি থাকতেও পারে আবার না-ও থাকতে পারে। এতৎসত্ত্বেও বিবেক ও আবেগ রাত ও দিনের মতোই একে অপরের পরিপূরক। তবে আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কখনো নিজের বিবেকের বিচারবুদ্ধিকে বিসর্জন দেওয়া উচিত হবে না।
আবেগ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। দায়িত্ববান মানুষের এই নিয়ন্ত্রণক্ষমতা অবশ্যই থাকতে হয়। বিশেষ করে দেশ বা রাষ্ট্র কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তো বটেই। এ ক্ষেত্রে যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হন, তাহলে তো কথাই নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকাল অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই এই শ্রেণির ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণক্ষমতা লোপ পেতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে তাঁদের বিশেষ আচরণ দেখে মনেই হয় না তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। যেমন শরীয়তপুর জেলার সদর পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার হোসেনের কথা ধরা যাক। তিনি ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মতোইস্লোগান দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর এই কর্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তিনি নিজের সেই অনভিপ্রেত কর্মকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে বেশ আস্থার সঙ্গেই বলেছেন, ‘আমি ছাত্রলীগ করতাম। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধে ও আবেগের কারণে স্লোগান দিয়েছি। এতে কোনো বিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করছি না।’ অথচ একই জেলায় কর্মরত তাঁরই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এমন কর্মকাণ্ড করতে পারেন না। কাজটি করে থানার ওসি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, থানার ওসি এখানে মিথ্যাচার করেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে পালং থানার ওসি আক্তার হোসেন সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ সম্পর্কে অবগত নন, তা বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের করণীয় এবং সেই করণীয় পদ্ধতি ও উপায় সুনির্দিষ্টভাবে আইনে উল্লেখ আছে। মৌলিক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নানা সময়ে পুলিশের সব সদস্যকে সে বিষয়ে জানানো হয়। এখানে আক্তার হোসেন জেনেশুনেই এই মিথ্যাচার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে স্লোগান দিয়ে কোনো বিধি ভঙ্গ করেননি বলে যে দাবি করেছেন, তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু তা-ই নয়, তিনি এখানে তাঁর পূর্বতন রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে আরও একটি গর্হিত কাজ করেছেন। তিনি জেনেশুনেই কাজটি করেছেন। তিনি নিজের ওপর এতটাই আস্থাশীল যে তিনি জানেন, এই অপকর্মের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। বরং কর্মজীবনে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে এটি প্লাস পয়েন্ট হিসেবেই কাজ করবে। শুধু কি তাই! তিনি এ-ও জানেন, এই কর্মের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়েও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আনুগত্যই প্রকাশ পেয়েছে, যা তাঁর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করবে।
পালং থানার ওসি আক্তার হোসেনের এরূপ আচরণে আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার আদৌ বিব্রত কি না, বোঝা না গেলেও একেবারে অখুশি যে হয়নি, তা বোঝা গেছে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে ব্যারিস্টার সুমনকে সাময়িক অব্যাহতির মাধ্যমে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়ে পালং থানার ওসির রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সুমনের ওপর তাঁর দলের দেওয়া এই শাস্তি নেমে আসে। কারণ, তাঁর সংগঠন মনে করে, ‘আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে দলের স্লোগানের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো সুমনের উচিত হয়নি।’
ব্যারিস্টার সুমনের বিরুদ্ধে এই শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত যে আওয়ামী লীগ কর্তৃক অনুমোদিত, তা নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়। কারণ ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর যুবলীগের ২০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি স্বয়ং আওয়ামী লীগের সভাপতি অনুমোদন দিয়েছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়, সভাপতির অনুমোদিত কমিটির যেকোনো সদস্যকে অব্যাহতি দিতে গেলেও তাঁর অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। ব্যারিস্টার সুমনের বিরুদ্ধে যুবলীগের এই পদক্ষেপ একটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে। ব্যারিস্টার সুমনের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে খারাপ বা ভুল কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি কেবল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পালং থানার ওসির আচরণ যে বিধিসম্মত ছিল না, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগে স্লোগান দেওয়ার মানুষ কি এতই কম যে একজন ওসি সাহেবের এই স্লোগান দিতে হবে? আমার কথা হচ্ছে, আপনি যখন সরকারি দায়িত্বে থাকবেন কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আবেগ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি এখনো ওই জায়গায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন।’ ব্যারিস্টার সুমনের এই বক্তব্যে দেশের কোনো আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কি না বা তিনি তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে কোনো বিধি ভঙ্গ করেছেন কি না, বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বিবেচিত হয়েছে বলে মনে হয়নি। অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা লঙ্ঘন করে, এমনকি পূর্বতন রাজনৈতিক পরিচয়ের দোহাই দিয়ে যে বিধি লঙ্ঘন করেছেন, তার জন্য আক্তার হোসেনকে কোনো খেসারত দিতে হয়নি, বরং তিনি তাঁর পদে বহালতবিয়তেই আছেন। সুতরাং পালং থানার ওসির এমন অনভিপ্রেত আচরণে সরকারও যে বিব্রত নয়, তা সহজেই অনুমেয়। কথিত ওসির এহেন আচরণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, আজও আমরা জানতে পারিনি।
বিগত এক যুগে কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণে যে পরিবর্তন এসেছে, তা দেশের গণতন্ত্রচর্চার জন্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর তাঁদের এই আচরণ আরও বেড়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়ে দলীয় সদস্যদের মতো ব্যবহার অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চার স্বাক্ষর বহন করে। সরকারি কর্মকর্তাদের ভেতরে এই চর্চা দিনদিন বেড়ে চলেছে। তাঁদের আচরণ দেখে মনে হয় প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক চাকরিজীবী হয়েও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার চেয়ে কেউ কেউ দলীয় অনুগত সদস্য হিসেবে নিজেদের জাহির করতেই যেন স্বচ্ছন্দবোধ করেন। তবে কিছু কিছু ঘটনায় এসব নিয়ে যখন বিভিন্ন মিডিয়ায় সমালোচনা হয়, তখন পালং থানার ওসির মতো আবেগের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আবেগ ও বিবেকের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে বিপদও হতে পারে। তবে এ কথা ঠিক, সবাই পালং থানার ওসির মতো ভাগ্যবান না-ও হতে পারেন। অতিরিক্ত আবেগ এতই খারাপ যে তা কারও কারও ভাগ্য বিপর্যয়ের (যদি কেউ বিবেচনা করে) কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এমনটি হয় বলেই হয়তো পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাকলায়েনের মতো তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্ত করতে গিয়ে পরীমণিদের প্রেমে পড়ে ধরা খেয়ে যান কিংবা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হয়ে অধীনস্থ নারী কর্মকর্তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোপনে শারীরিক সম্পর্ক করলেও সেটি আর গোপন থাকে না।
আবেগ ও বিবেকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কথা বলেছি। ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলেই বিপদ। মনে রাখা ভালো, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, সামাজিক আচার-আচরণে, কর্মস্থলে কিংবা বৃহত্তর পরিমণ্ডলে সব কাজে কম-বেশি আবেগ থাকবেই। তবে দায়িত্বশীল পজিশনে বসে আবেগের পাশাপাশি বিবেকের দরজাও খোলা রাখতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই আবেগের চেয়ে বিবেককে প্রাধান্য দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে চোরাবালিতে পড়ার আশঙ্কা কম থাকে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের আবেগ থাকবেই। আবেগ থাকা ভালো; তবে এর প্রয়োগে হিসাবি হতে হবে। তা না হলে পা ফসকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
মানুষ মাত্রই আবেগপ্রবণ। এটি মানুষের এমন একটি মানসিক অবস্থা, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, আবেগ হলো মানুষের অনুভূতির উৎস। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘মানুষের চেতনার যে অংশ অনুভূতি বা সংবেদনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত, তাকে আবেগ বলা যায়।’ আবেগকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আবার কেউ পারেন না। দেখা গেছে, বেশি আবেগপ্রবণ মানুষ জীবনে অনেক ভুল করে বসেন। কারণ এটি এমন একটি উপসর্গ, যা মানুষকে বিব্রত পরিস্থিতিতেও ফেলে দেয়। বেশি আবেগপ্রবণ মানুষ অনেক সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য করতে পারেন না। মানুষ যখন প্রবল আবেগ দ্বারা তাড়িত হন, তখন তাঁদের বিবেক সঠিকভাবে কাজ করে না। এ জন্যই তাঁরা ভুল করেন। বিবেক ও আবেগের মধ্যে পার্থক্যটি হলো, বিবেক ভালো-মন্দ বিবেচনা করতে পারে; কী হবে না হবে—এসব যুক্তি মেনে নিয়েই বিবেক কাজ করে।
অপরদিকে, আবেগের কাজে এ যুক্তি থাকতেও পারে আবার না-ও থাকতে পারে। এতৎসত্ত্বেও বিবেক ও আবেগ রাত ও দিনের মতোই একে অপরের পরিপূরক। তবে আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কখনো নিজের বিবেকের বিচারবুদ্ধিকে বিসর্জন দেওয়া উচিত হবে না।
আবেগ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। দায়িত্ববান মানুষের এই নিয়ন্ত্রণক্ষমতা অবশ্যই থাকতে হয়। বিশেষ করে দেশ বা রাষ্ট্র কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তো বটেই। এ ক্ষেত্রে যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হন, তাহলে তো কথাই নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকাল অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই এই শ্রেণির ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণক্ষমতা লোপ পেতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে তাঁদের বিশেষ আচরণ দেখে মনেই হয় না তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। যেমন শরীয়তপুর জেলার সদর পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার হোসেনের কথা ধরা যাক। তিনি ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মতোইস্লোগান দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর এই কর্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তিনি নিজের সেই অনভিপ্রেত কর্মকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে বেশ আস্থার সঙ্গেই বলেছেন, ‘আমি ছাত্রলীগ করতাম। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধে ও আবেগের কারণে স্লোগান দিয়েছি। এতে কোনো বিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করছি না।’ অথচ একই জেলায় কর্মরত তাঁরই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এমন কর্মকাণ্ড করতে পারেন না। কাজটি করে থানার ওসি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, থানার ওসি এখানে মিথ্যাচার করেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে পালং থানার ওসি আক্তার হোসেন সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ সম্পর্কে অবগত নন, তা বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের করণীয় এবং সেই করণীয় পদ্ধতি ও উপায় সুনির্দিষ্টভাবে আইনে উল্লেখ আছে। মৌলিক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নানা সময়ে পুলিশের সব সদস্যকে সে বিষয়ে জানানো হয়। এখানে আক্তার হোসেন জেনেশুনেই এই মিথ্যাচার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে স্লোগান দিয়ে কোনো বিধি ভঙ্গ করেননি বলে যে দাবি করেছেন, তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু তা-ই নয়, তিনি এখানে তাঁর পূর্বতন রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে আরও একটি গর্হিত কাজ করেছেন। তিনি জেনেশুনেই কাজটি করেছেন। তিনি নিজের ওপর এতটাই আস্থাশীল যে তিনি জানেন, এই অপকর্মের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। বরং কর্মজীবনে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে এটি প্লাস পয়েন্ট হিসেবেই কাজ করবে। শুধু কি তাই! তিনি এ-ও জানেন, এই কর্মের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়েও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আনুগত্যই প্রকাশ পেয়েছে, যা তাঁর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করবে।
পালং থানার ওসি আক্তার হোসেনের এরূপ আচরণে আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার আদৌ বিব্রত কি না, বোঝা না গেলেও একেবারে অখুশি যে হয়নি, তা বোঝা গেছে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে ব্যারিস্টার সুমনকে সাময়িক অব্যাহতির মাধ্যমে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়ে পালং থানার ওসির রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সুমনের ওপর তাঁর দলের দেওয়া এই শাস্তি নেমে আসে। কারণ, তাঁর সংগঠন মনে করে, ‘আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে দলের স্লোগানের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো সুমনের উচিত হয়নি।’
ব্যারিস্টার সুমনের বিরুদ্ধে এই শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত যে আওয়ামী লীগ কর্তৃক অনুমোদিত, তা নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়। কারণ ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর যুবলীগের ২০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি স্বয়ং আওয়ামী লীগের সভাপতি অনুমোদন দিয়েছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়, সভাপতির অনুমোদিত কমিটির যেকোনো সদস্যকে অব্যাহতি দিতে গেলেও তাঁর অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। ব্যারিস্টার সুমনের বিরুদ্ধে যুবলীগের এই পদক্ষেপ একটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে। ব্যারিস্টার সুমনের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে খারাপ বা ভুল কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি কেবল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পালং থানার ওসির আচরণ যে বিধিসম্মত ছিল না, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগে স্লোগান দেওয়ার মানুষ কি এতই কম যে একজন ওসি সাহেবের এই স্লোগান দিতে হবে? আমার কথা হচ্ছে, আপনি যখন সরকারি দায়িত্বে থাকবেন কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আবেগ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি এখনো ওই জায়গায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন।’ ব্যারিস্টার সুমনের এই বক্তব্যে দেশের কোনো আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কি না বা তিনি তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে কোনো বিধি ভঙ্গ করেছেন কি না, বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বিবেচিত হয়েছে বলে মনে হয়নি। অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা লঙ্ঘন করে, এমনকি পূর্বতন রাজনৈতিক পরিচয়ের দোহাই দিয়ে যে বিধি লঙ্ঘন করেছেন, তার জন্য আক্তার হোসেনকে কোনো খেসারত দিতে হয়নি, বরং তিনি তাঁর পদে বহালতবিয়তেই আছেন। সুতরাং পালং থানার ওসির এমন অনভিপ্রেত আচরণে সরকারও যে বিব্রত নয়, তা সহজেই অনুমেয়। কথিত ওসির এহেন আচরণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, আজও আমরা জানতে পারিনি।
বিগত এক যুগে কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণে যে পরিবর্তন এসেছে, তা দেশের গণতন্ত্রচর্চার জন্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর তাঁদের এই আচরণ আরও বেড়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়ে দলীয় সদস্যদের মতো ব্যবহার অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চার স্বাক্ষর বহন করে। সরকারি কর্মকর্তাদের ভেতরে এই চর্চা দিনদিন বেড়ে চলেছে। তাঁদের আচরণ দেখে মনে হয় প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক চাকরিজীবী হয়েও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার চেয়ে কেউ কেউ দলীয় অনুগত সদস্য হিসেবে নিজেদের জাহির করতেই যেন স্বচ্ছন্দবোধ করেন। তবে কিছু কিছু ঘটনায় এসব নিয়ে যখন বিভিন্ন মিডিয়ায় সমালোচনা হয়, তখন পালং থানার ওসির মতো আবেগের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আবেগ ও বিবেকের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে বিপদও হতে পারে। তবে এ কথা ঠিক, সবাই পালং থানার ওসির মতো ভাগ্যবান না-ও হতে পারেন। অতিরিক্ত আবেগ এতই খারাপ যে তা কারও কারও ভাগ্য বিপর্যয়ের (যদি কেউ বিবেচনা করে) কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এমনটি হয় বলেই হয়তো পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাকলায়েনের মতো তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্ত করতে গিয়ে পরীমণিদের প্রেমে পড়ে ধরা খেয়ে যান কিংবা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হয়ে অধীনস্থ নারী কর্মকর্তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোপনে শারীরিক সম্পর্ক করলেও সেটি আর গোপন থাকে না।
আবেগ ও বিবেকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কথা বলেছি। ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলেই বিপদ। মনে রাখা ভালো, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, সামাজিক আচার-আচরণে, কর্মস্থলে কিংবা বৃহত্তর পরিমণ্ডলে সব কাজে কম-বেশি আবেগ থাকবেই। তবে দায়িত্বশীল পজিশনে বসে আবেগের পাশাপাশি বিবেকের দরজাও খোলা রাখতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই আবেগের চেয়ে বিবেককে প্রাধান্য দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে চোরাবালিতে পড়ার আশঙ্কা কম থাকে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের আবেগ থাকবেই। আবেগ থাকা ভালো; তবে এর প্রয়োগে হিসাবি হতে হবে। তা না হলে পা ফসকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১২ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১২ ঘণ্টা আগে