ড. দেলোয়ার হোসেন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গণহত্যার রাতের দুঃসহ স্মৃতি বাঙালি জাতিকে বারবার রক্তাক্ত ও বিষণ্ণ করে তোলে। আজও মানুষ স্তম্ভিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে ইতিহাসের কলঙ্কিত, জঘন্যতম ও অভিশপ্ত সেই সময়ের কথা ভেবে। সেদিন ভোররাতে ঘাতকের নিষ্ঠুর ও হিংস্রতম আক্রমণে সপরিবারে শাহাদতবরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চরম নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা হয় তাঁর পরিবারের নারী-শিশুদেরও। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা হয়; যদিও পলাতক আছে আরও পাঁচ খুনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা পরিচালিত ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এই বিচারের প্রক্রিয়া চলমান। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও গণহত্যার বিচারের মাধ্যমে সরকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে জাতিকে কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত করতে পেরেছে। শতসহস্র বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম নিষ্ঠুরতা ও অকৃতজ্ঞতা বাঙালি জাতিকে তাড়িয়ে বেড়াবে ও কাঁদাবে। এই কান্না আর ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে তাই বারবার বাঙালির প্রশ্ন থাকবেই যে কেন জাতির পিতাকে শাহাদতবরণ করতে হলো? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নানাবিধ বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ১৫ আগস্ট আসলে যেমন আমাদের সামনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভেতর ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্র ফুটে ওঠে, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি বীভৎস চেহারাও ভেসে ওঠে।
হাজার হাজার বছরের বিশ্ব রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব একটি বিস্ময়কর ঘটনা। বিশ্ব রাজনীতির কাঠামো নগর-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক কিংবা রাজ্য ও সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক কিংবা জাতি-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হোক না কেন শক্তির রাজনীতি ও মানবতার রাজনীতির মধ্যকার বিরোধ চিরন্তন। শক্তির রাজনীতি পৃথিবীকে বারবার সংঘাত, বৈষম্য, যুদ্ধ, শোষণ ও অন্যায়ের পথে ধাবিত করেছে। অন্যদিকে মানবতার রাজনীতি মানবকল্যাণ, মানবমুক্তি ও শান্তির পথে পরিচালিত করেছে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন মানবতার রাজনীতির অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র নেতা, যিনি একটি জাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন অর্থাৎ ১২ বছরের বেশি কারাবন্দী ছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ সময় কারাবরণ করেন, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেকেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ মানব ইতিহাসে অনন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন নেতার ভাষণ আমরা যখন শুনি এবং তাঁদের ভাষণের সঙ্গে যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা করি, তখন আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে ‘জনগণের প্রতি ভালোবাসার’ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অনন্য ও অতুলনীয়। ইউনেসকো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সমগ্র মানবজাতির জন্য অসাধারণ বার্তা বহন করে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি, একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন যে বিশ্ব দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত–শোষিত ও শোষক। আমি শোষিতের পক্ষে। মানবতাকেন্দ্রিক রাজনীতি বঙ্গবন্ধু বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক দর্শনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, যা ১৯৭০ দশকের বিশ্বে ছিল এক সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন থেকেই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা। এই তৎপরতার এক পৃষ্ঠে যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্ছ্বাস, প্রশংসা ও সমর্থন। অন্য পৃষ্ঠে ছিল ষড়যন্ত্র, হিংসা ও শত্রুতা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠ থেকে বীরবেশে মুক্তি পেয়ে যখন বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারিতে স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ব রাজনীতি সমার্থক হয়ে ওঠে। প্রিয় জন্মভূমিতে যাত্রাকালে লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন, হোটেল ক্লারিজে অবস্থান ও দিল্লি বিমানবন্দরে সংবর্ধনা ও বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের কাজে বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতিকে সরাসরি মোকাবিলা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কিছু কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ঠান্ডা লড়াইয়ের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ঠান্ডা লড়াই ছিল ম্যাকিয়াভেলি, হবস ও মরগেন্থুর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যেখানে শক্তি এবং স্বার্থের জন্য বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হয়নি। ফলে ষড়যন্ত্র, হত্যা, আক্রমণ, প্রোপাগান্ডাসহ সব ধরনের কৌশল অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে। ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যকার বিরোধ বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রভাব রেখেছিল। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র পরাশক্তিসমূহের প্রক্সির ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব শক্তি কাঠামোর জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বকীয়তা হারিয়ে তাঁবেদারে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র যেমন সৌদি আরবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্রের বাংলাদেশ-বিরোধিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি বড় কূটনীতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। তৃতীয়ত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীনের বাংলাদেশ-বিরোধিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য আরও একটি কূটনৈতিক ফ্রন্ট তৈরি হয়। চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা ও বিশ্বে বিরাজমান নয়া সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের কারণে বঙ্গবন্ধুকে একটি মতাদর্শিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেন, যা পুঁজিবাদী বিশ্বকে বৈরী করে তোলে। নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর এই সাহসী সিদ্ধান্ত অনেককে অবাক করেছিল। বিশ্ব রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দাবার ঘুঁটি চলতে থাকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহের রাজধানীগুলোতে। সাধারণ মানুষের চোখের মণি ও রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু অসীম সাহস ও দৃঢ়তায় আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৬১-১৯৭৩ পর্যন্ত আফ্রিকাতে ছয়জন মুক্তিকামী ও স্বাধীনতার স্থপতিকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। এই মহান নেতাদের অন্যতম হচ্ছেন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, ঘানার কয়ামে নক্রুমা, মোজাম্বিকের ফ্রেলিমো এবং ক্যামেরুনের ফেলিক্স মুমি। চিলির সালভাদর আলেন্দে, বিপ্লবী চে গুয়েভারা হত্যা থেকে শুরু করে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বে অসংখ্য গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৫০-এর দশক থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের ক্রমাগত সমাপ্তি ঘটলেও ঠান্ডা লড়াই ও নয়া সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব রাজনীতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ, নিষ্ঠুরতম ও ষড়যন্ত্রমূলক। পরাশক্তিসমূহসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির পররাষ্ট্রনীতি কিংবা কূটনীতির ভাষা গণতন্ত্র ও শান্তির হলেও আধিপত্যবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থই মুখ্য বিষয় ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিশ্ব রাজনীতির এই অন্ধকারময় নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ বৈঠকের ভাষণ কিংবা ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলায় প্রদত্ত ভাষণ স্নায়ুযুদ্ধের বিশ্বে আধিপত্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক দলিল এবং রোডম্যাপ। পরাজিত, স্বাধীনতাবিরোধী, আধিপত্যবাদ এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আজ্ঞাবহ এদেশীয় দোসর ও বিশ্ব রাজনীতির গভীর ষড়যন্ত্রের নির্মমতম ছোবলে বাঙালি জাতি হারাল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালি জাতি এবং বিশ্বের অগণিত মানুষ ও মানবজাতির জন্য বঙ্গবন্ধু চিরকাল হয়ে থাকবে আলোর দিশারি ও প্রতিবাদের বজ্র কণ্ঠস্বর।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গণহত্যার রাতের দুঃসহ স্মৃতি বাঙালি জাতিকে বারবার রক্তাক্ত ও বিষণ্ণ করে তোলে। আজও মানুষ স্তম্ভিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে ইতিহাসের কলঙ্কিত, জঘন্যতম ও অভিশপ্ত সেই সময়ের কথা ভেবে। সেদিন ভোররাতে ঘাতকের নিষ্ঠুর ও হিংস্রতম আক্রমণে সপরিবারে শাহাদতবরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চরম নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা হয় তাঁর পরিবারের নারী-শিশুদেরও। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা হয়; যদিও পলাতক আছে আরও পাঁচ খুনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা পরিচালিত ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এই বিচারের প্রক্রিয়া চলমান। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও গণহত্যার বিচারের মাধ্যমে সরকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে জাতিকে কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত করতে পেরেছে। শতসহস্র বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম নিষ্ঠুরতা ও অকৃতজ্ঞতা বাঙালি জাতিকে তাড়িয়ে বেড়াবে ও কাঁদাবে। এই কান্না আর ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে তাই বারবার বাঙালির প্রশ্ন থাকবেই যে কেন জাতির পিতাকে শাহাদতবরণ করতে হলো? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নানাবিধ বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ১৫ আগস্ট আসলে যেমন আমাদের সামনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভেতর ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্র ফুটে ওঠে, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি বীভৎস চেহারাও ভেসে ওঠে।
হাজার হাজার বছরের বিশ্ব রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব একটি বিস্ময়কর ঘটনা। বিশ্ব রাজনীতির কাঠামো নগর-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক কিংবা রাজ্য ও সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক কিংবা জাতি-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হোক না কেন শক্তির রাজনীতি ও মানবতার রাজনীতির মধ্যকার বিরোধ চিরন্তন। শক্তির রাজনীতি পৃথিবীকে বারবার সংঘাত, বৈষম্য, যুদ্ধ, শোষণ ও অন্যায়ের পথে ধাবিত করেছে। অন্যদিকে মানবতার রাজনীতি মানবকল্যাণ, মানবমুক্তি ও শান্তির পথে পরিচালিত করেছে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন মানবতার রাজনীতির অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র নেতা, যিনি একটি জাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন অর্থাৎ ১২ বছরের বেশি কারাবন্দী ছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ সময় কারাবরণ করেন, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেকেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ মানব ইতিহাসে অনন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন নেতার ভাষণ আমরা যখন শুনি এবং তাঁদের ভাষণের সঙ্গে যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা করি, তখন আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে ‘জনগণের প্রতি ভালোবাসার’ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অনন্য ও অতুলনীয়। ইউনেসকো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সমগ্র মানবজাতির জন্য অসাধারণ বার্তা বহন করে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি, একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন যে বিশ্ব দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত–শোষিত ও শোষক। আমি শোষিতের পক্ষে। মানবতাকেন্দ্রিক রাজনীতি বঙ্গবন্ধু বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক দর্শনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, যা ১৯৭০ দশকের বিশ্বে ছিল এক সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন থেকেই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা। এই তৎপরতার এক পৃষ্ঠে যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্ছ্বাস, প্রশংসা ও সমর্থন। অন্য পৃষ্ঠে ছিল ষড়যন্ত্র, হিংসা ও শত্রুতা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠ থেকে বীরবেশে মুক্তি পেয়ে যখন বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারিতে স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ব রাজনীতি সমার্থক হয়ে ওঠে। প্রিয় জন্মভূমিতে যাত্রাকালে লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন, হোটেল ক্লারিজে অবস্থান ও দিল্লি বিমানবন্দরে সংবর্ধনা ও বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের কাজে বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতিকে সরাসরি মোকাবিলা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কিছু কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ঠান্ডা লড়াইয়ের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ঠান্ডা লড়াই ছিল ম্যাকিয়াভেলি, হবস ও মরগেন্থুর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যেখানে শক্তি এবং স্বার্থের জন্য বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হয়নি। ফলে ষড়যন্ত্র, হত্যা, আক্রমণ, প্রোপাগান্ডাসহ সব ধরনের কৌশল অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে। ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যকার বিরোধ বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রভাব রেখেছিল। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র পরাশক্তিসমূহের প্রক্সির ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব শক্তি কাঠামোর জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বকীয়তা হারিয়ে তাঁবেদারে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র যেমন সৌদি আরবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্রের বাংলাদেশ-বিরোধিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি বড় কূটনীতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। তৃতীয়ত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীনের বাংলাদেশ-বিরোধিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য আরও একটি কূটনৈতিক ফ্রন্ট তৈরি হয়। চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা ও বিশ্বে বিরাজমান নয়া সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের কারণে বঙ্গবন্ধুকে একটি মতাদর্শিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেন, যা পুঁজিবাদী বিশ্বকে বৈরী করে তোলে। নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর এই সাহসী সিদ্ধান্ত অনেককে অবাক করেছিল। বিশ্ব রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দাবার ঘুঁটি চলতে থাকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহের রাজধানীগুলোতে। সাধারণ মানুষের চোখের মণি ও রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু অসীম সাহস ও দৃঢ়তায় আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৬১-১৯৭৩ পর্যন্ত আফ্রিকাতে ছয়জন মুক্তিকামী ও স্বাধীনতার স্থপতিকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। এই মহান নেতাদের অন্যতম হচ্ছেন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, ঘানার কয়ামে নক্রুমা, মোজাম্বিকের ফ্রেলিমো এবং ক্যামেরুনের ফেলিক্স মুমি। চিলির সালভাদর আলেন্দে, বিপ্লবী চে গুয়েভারা হত্যা থেকে শুরু করে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বে অসংখ্য গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৫০-এর দশক থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের ক্রমাগত সমাপ্তি ঘটলেও ঠান্ডা লড়াই ও নয়া সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব রাজনীতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ, নিষ্ঠুরতম ও ষড়যন্ত্রমূলক। পরাশক্তিসমূহসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির পররাষ্ট্রনীতি কিংবা কূটনীতির ভাষা গণতন্ত্র ও শান্তির হলেও আধিপত্যবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থই মুখ্য বিষয় ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিশ্ব রাজনীতির এই অন্ধকারময় নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ বৈঠকের ভাষণ কিংবা ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলায় প্রদত্ত ভাষণ স্নায়ুযুদ্ধের বিশ্বে আধিপত্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক দলিল এবং রোডম্যাপ। পরাজিত, স্বাধীনতাবিরোধী, আধিপত্যবাদ এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আজ্ঞাবহ এদেশীয় দোসর ও বিশ্ব রাজনীতির গভীর ষড়যন্ত্রের নির্মমতম ছোবলে বাঙালি জাতি হারাল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালি জাতি এবং বিশ্বের অগণিত মানুষ ও মানবজাতির জন্য বঙ্গবন্ধু চিরকাল হয়ে থাকবে আলোর দিশারি ও প্রতিবাদের বজ্র কণ্ঠস্বর।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২ ঘণ্টা আগে